Alapon

স্বাধীনতার আর্তি

১. 
মোটর সাইকেলের উপর উল্টো হয়ে বসেছে,দেখতেই গুণ্ডার মতন লাগছে; ব্রেকটা পিছন দিকে রেখে সিগারেটের কালো ধোঁয়া বের করে অট্টহাসি দিচ্ছে সবাই। একসাথে চার পাঁচটি মোটরসাইকেলে সংখ্যায় দশ - বারোজন তরুণ। সবার মাথায় উসকো খুশকো চুল। কতদিন যে চিরুনি লাগেনি ধারণা করাও মুশকিল। আজকালকার ছেলেরা কেমন যে হয়ে গেছে ভাবতেও ভয় হয়। 
 
শমশের চাচার দোকানটা মসজিদের পাশেই। মসজিদের ঠিক বিপরীত দিকে গ্রামের প্রাথমিক বিদ্যালয়। শমশের চাচা মুসল্লিদের নামাজের পরে বসে গল্পগুজব আর দিনের বেলা স্কুলের ছাত্রদের কাছে সামান্য নাস্তাপানি বিক্রি করে যা টাকা পান তা দিয়ে সংসার পরিচালনা করতে না পারলেও অভাবী জীবনে সন্তানদের বোঝা হওয়া লাগছে না। দোকানের সামনে মুরব্বিদের বসার একটা ছোটখাটো বৈঠকখানাও করা হয়েছে। বিশেষ করে আছরের নামাজের পর বেশ জমজমাট থাকে দোকানের সামনা। নানানজন ভিন্ন ভিন্ন বিষয়ে গল্পে মেতে থাকেন। শমসের চাচাও লাল চায়ের কাপে চিনি দিয়ে টুংটাং শব্দে একের পর এক চা ক্রেতার হাতে তুলে দেন আর সুযোগ মতো জীবনের দীর্ঘ অভিজ্ঞতার আলোকে নিজেও গল্পে শরিক হন। স্কুল চলাকালে  ছোট ছোট বাচ্চাদের সাথেও বেশ জমে ওঠে শমসের চাচার৷ কেউ দাদা, কেউ চাচা বলে এটা-ওটা চায় আর তিনি বার্ধক্যের ছাপ নিয়ে একবার বসে আরেক বার কোমর সোজা করে ছাত্র-ছাত্রীদের হাতে চকলেট, চিপস, চানাচুর-মটরশুঁটির প্যাকেট উঠিয়ে দেন। এভাবেই পূর্ণ কোলাহলে সারাদিন কেটে যায়৷ জীবনের বাস্তবতা, দুঃখবোধ খুব একটা স্মরণেই আসে না শমসের আলীর৷  

আজকে সরকারি ছুটি চলছে৷ স্কুল বন্ধ। মধ্যদুপুর হওয়াতে জোহরের মুসল্লি ছাড়া এদিকে খুব একটা মানুষের আনাগোনা নাই। মুসল্লিগণ নামাজ আদায় করে বের হয়ে দেখেন কতগুলো ছেলে শমসের আলীর দোকানের সামনে আড্ডা দিচ্ছে। আদব-লেহাজ নাই। লোকজন তাদেরকে দেখে খুব বিব্রতবোধ করছেন। কেউ আবার সামনাসামনি কিছু না বলে একটু দূরে গিয়ে তাচ্ছিল্য নিয়ে গোষ্ঠী উদ্ধার করছেন। কেউ চুপচাপ না দেখার ভান করে মাথানিচু করে দ্রুত পায়ে হেঁটে চলে যাচ্ছেন। আবার অনেকেই আঁড়চোখে তাকিয়ে তাকিয়ে ছেলেদেরকে চিনবার চেষ্টা করছেন। একটা সময় ছিল যখন গ্রামের ছেলেদের ভালমন্দ কাজে যেকোনো মুরব্বি শাসন বরন করতেন। খারাপ কাজে দেখলে ধমক দিতেন। কিন্তু এ যুগে কেউ কাউকে কিছু বলে না। কিভাবে বলবে শাসন করতে গেলে নিজেকেই বিপদে পড়তে হয়। 

রহিম সাহেবও নামাজ শেষ করে করে মসজিদ থেকে বের হয়েছেন। হঠাৎ কি মনে করে আবার মসজিদের ভেতরে প্রবেশ করলেন। ভেতরে ঢুকে এদিক-ওদিক তাকিয়ে কাকে যেন খুঁজছেন। দেখেন মসজিদের দক্ষিণ দিকের বারান্দায় সিজদায় মশগুল শমসের আলী। বড় ধীর গতিতে সুন্নাত নামাজ আদায় করছেন শমসের। রহিম আলীও দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে তার নামাজ আদায়ের দৃশ্য দেখছিলেন। ইমাম সাহেব ভিতরের দরজা বন্ধ করে বের হয়ে রহিম সাহেবকে দেখে সালাম দিয়ে বিদায় নিলেন। রহিম সাহেবও মুচকি হাসি দিয়ে সম্মানের সহিত ইমাম সাহেবকে সামান্য এগিয়ে দিয়ে শমসের চাচার দিকে অগ্রসর হলেন। 

পিছন দিক থেকে কাঁধে হাত দিতেই চমকে ফিরে তাকালেন শমসের আলী। বিচলিতভাবটা সামলে নিয়ে মুচকি একটা হাসি দিয়ে বলে-
-অহো,রহিম ভাই, আপনি!

হ্যাঁ, শমসের ভাই, আমি। চলে যাচ্ছিলাম। হঠাৎ মনে পড়লো তোমার দোকান নিয়ে সেদিন একটা সমস্যার কথা বলেছিলে সেই ব্যাপারে একটু বিস্তারিত জানা দরকার, এই আবার চলে আইলাম। এসে দেখি নামাজ আদায় করছ, তাই একটু অপেক্ষা করছিলাম।

ভাই আর বলিয়েন না! ঐ মাইঞ্জা মড়ল আছে না? তার বড় ছেলে। নামটা কি যেনো, ওহ! হ্যাঁ, মনে পড়েছে রানা। সে নাকি নতুন করে জেলা কমিটির সহ উপসম্পাদক হয়েছে। এখন তার গ্রুপের লোকজন আমার দোকান থেকে বিনা টাকায় নাস্তা করবে, সিগারেট খাবে; স্কুল চলাকালে দোকানের সামনে আড্ডা দিবে কিন্তু আমার কিছু বলা যাবে না! 

আচ্ছা, রহিম ভাই, আপনিই বলেন- আমরা সাধারণ মানুষ, অল্প পুঁজি নিয়ে দোকান করি, আর আমার দোকান কী লাভ করার জন্য? জীবনের এই পড়ন্ত বেলায় কিছু না পেয়ে একটা দোকানে সময় কাটাচ্ছি, আমরা কিভাবে টাকা দিবো, বিনা পয়সায় খাওয়াবো? 

শমসের আলীর কথাশোনে রক্তিম বর্ণধারণ করে রহিম আলীর চেহারা। অনেকটা উত্তেজিত হয়ে বলে উঠেন- না না। কিসের চাঁদা! কোনো চাঁদা দেওয়া যাবে না। আমি নিজে মাইঞ্জা মন্ডলের সাথে কথা বলব, একটা সামান্য চকলেটও বিনা পয়সায় দিবা না।

দেশ স্বাধীন হবার এতো বছর পরও এদেশের খেটেখাওয়া মানুষের মাথার ঘামে অর্জিত সম্পদের মাঝে অন্যায় ভাগ বসানোর মতো অসৎ লোককে দেখে প্রচুর ঘৃণা হয়। আমি তোমাকে বলছি, যতদিন বেঁচে আছি আমাদের এই আটগ্রামে তা হতে দেয়া যাবে না। শোন আজকের পর থেকে কেউ এমন করলে ছাফ বলে দিবা এই দোকান থেকে কাউকে চাঁদা দেওয়া হবে না। 

রহিম ভাই, চাঁদা দেইনি, এখনও দিবো না; তবে আপনার কথা শুনে সাহস আরেকটু বেড়ে গেলো।

ঠিক আছে তাহলে আজকে যাচ্ছি। বলে শমসের আলীর কাছ থেকে বিদায় নিয়ে মসজিদের দক্ষিণ পাশে গ্রামের ভিতরের রাস্তা দিয়ে বাড়ির পথ ধরলেন রহিম আলী। 

শমসের আলী আরও দু'রাকাত নামাজ পড়ার জন্য সময় নিয়ে মসজিদেই বসে রইলেন। 

২.
রহিম আলী। জীবনের ফেলে আসা দিনগুলোকে নিয়ে ভাবতে ভাবতে এক পা দু' পা করে হাঁটছেন। তার এতো বিনয়ী হাঁটা দেখে মাটিও হয়ত বলে আরেকটু হাঁটুন।

উনপঞ্চাশটি বছর চলে গেছে। পঁচিশের কালোরাত পরে গ্রামের সকল মানুষ যখন দিগ্বিদিক ছুটোছুটি করছিল, একটু আশ্রয়ের জন্য এ বাড়ি-ওবাড়ি যাচ্ছিল, একজন দিক-নির্দেশকের জন্য আসমানের দিকে তাকিয়ে ফরিয়াদ করছিল ঠিক এমন সময় উনার মা দাঁড়িয়ে গিয়েছিলেন পথহারা যাত্রীদের নাবিক হিসেবে।

তিন ভাই সাবের আলী ,মঞ্জুর আলী আর সবার ছোট রহিম আলীকে মানুষের আশ্রয়ের জন্য থাকার ঘর ছেড়ে দিতে হয়েছিল। তদের বাবার খুব প্রিয় বাংলোটাও গ্রামের মানুষের জন্য ছেড়ে দিয়েছিলেন মা। পাক-বাহিনীর নানান চাপেও সামান্য ভেংগে পড়তেন না তিনি। সাবের আর মঞ্জুরকে মুক্তিবাহিনীর সাথে পাঠিয়ে দিয়ে ছোট্ট রহিমকে মানুষের সমস্যাগুলো সমাধানের জন্য রেখে দেন তার কাছেই।

একদিন গভীর রাতে মঞ্জুর খুব বিষন্ন মন নিয়ে বাড়িতে এসে হাজির। তার মা যেন আগ থেকেই জানতেন ঐরাতে সে আসবে। দরজায় ঠকঠক শব্দ হতেই তিনি বিছানা থেকে উঠে গেলেন রহিম সাহেবকে তাড়া দিয়ে জাগিয়ে বললেন মন বলছে তোর ভাইয়েরা এসেছে।

দরজা খুলে দেখেন কাঁধে বন্দুক সহ মঞ্জু দাঁড়িয়ে আছে। ঝটকা টানে ঘরের ভেতর ঢুকিয়ে জড়িয়ে ধরে কাঁদোকাঁদো সুরে জিজ্ঞেস করেছিলেন 'সাবের আসেনি?' মঞ্জুর চুপ করে চোখের অশ্রু মুছেছিল শুধু। মা তখন শান্তনা দিয়ে বলেছিলেন- 

"দেশ বাঁচানোর জন্য,মাটি বাঁচানোর এ যুদ্ধে আমরা সবাই জীবন দিয়ে দিব, তোমরা ভেঙ্গে পড় না। আমার সাবের জয়ী হয়েছে। রক্ত কথা বলবেই। তুমি ব্যারাকে চলে যাও। ওহ, একটু দাঁড়াও, এই বস্তাটা সাথে নিয়ে যাও।' 
সেদিন রহিম সাহেবও বুঝেছিলেলেন সাবের আলী আর নেই। মঞ্জুর আলী আবার ঐরাতেই ব্যারাকে ফিরে যান কিন্তু তিনিও আর ফিরে আসেননি।

মা তাকে প্রায়ই বলতেন দেখবা সাবের-মঞ্জু'রা আমাদের জন্য স্বাধীনভাবে বাঁচার অধিকার নিয়ে আসবে,লাল সবুজের পতাকা, সাম্য-ভ্রাতৃত্ব, নাগরিক এবং মানবিক অধিকারসহ একটা বাংলাদেশ নিয়া আসবে।"

সব হয়েছে। দেশও স্বাধীন হয়েছে কিন্তু আজ তার মা নেই, দুই ভাই আর ফেরেনি। সেই গ্রাম আছে। রহিম আলীও আছেন। কিন্তু কি একটা যেনো এখনো নাই। প্রতিদিনকার দৈনিক পত্রিকা দেখলে এই শূন্যতা আরও বেড়ে যায়। অস্থির মন নিয়ে দিনাতিপাত করতে হয়। ক্ষমতারদ্বন্দ্বে জর্জরিত নেতাদের প্রতি ঘৃণাই বাড়ে। 

স্বাধীনতা পরবর্তী কতো কিছুই ঘটে গেলো। ক্ষমতার পালাবদলে সবাই নিজেদের পরিবর্তনেই ব্যস্ত। শমসের আলী কিবা এদেশের দুর্বল মানুষের কোন পরিবর্তন দেখেন না রহিম সাহেব। এই গ্রামটিকে সাজাতে, গরিব ও দুর্বল মানুষদের তৈরী করতে কত শ্রম দিতে হয়েছে তাদের। দুইশত বছরের জমিদারি ছিল, চাইলে তারাও এখনকার ক্ষমতাবানদের মতো হতে পারতেন। শিক্ষাদীক্ষায়ও তাদের সুনাম ছিল মহকুমা ছড়িয়ে আজও পুরো জেলায় এক নামে পরিচিত তারা৷

শমসের আলীর সাথে কথা বলে মা আর ভাইদের কথা ভাবছেন আর মিলিয়ে নিচ্ছেন দেশের বর্তমান অবস্থার সাথে - 
'লাল-সবুজের পতাকা এসেছে, স্বাধীন ভূমি পেয়েছেন কিন্তু কথা বলার অধিকার, নাগরিক ও মানবিক অধিকার কিংবা আদর্শবান নেতৃত্ব পাননি।
কতগুলো চাটুকার আর বংশীবাদক পেয়েছেন যারা লুটেপুটে খাচ্ছে সব। সেক্যুলারিজমের নাম করে পুঁজিবাদ আর সমাজতন্ত্রের যাঁতাকলে ফেলে পিষ্ট করে দেয়া হচ্ছে জাতির নীতি-নৈতিকতাকে। যুব সমাজ পথহারা, দিকহারা হয়ে বেকারত্বের তাঁবেদারি করছে, জড়িয়ে যাচ্ছে অপরাধ প্রবণতায়।

এতো কিছু ভাবতে ভাবতে কখন যে বাড়ির আজ্ঞিনায় চলে আসেন রহিম সাহেব খিয়ালই করেন নি। ছোট্ট নাতিটি ততক্ষণে দৌড়ে এসে 'দাদু,দাদু' বলে জড়িয়ে ধরেছে। দাদু ভাই বলে নাতিকে কুলে নিতে যাবেন এমন সময় মসজিদের দিক থেকে অনেক লোকের চিৎকার চেঁচামেচি শুনে ঘুরে দাঁড়ান। 

দূর থেকে কারও আওয়াজ ভেসে আসে 'শমসেরের দোকান জ্বালাই দিছেরে। শমসেরের দো কা ন....

 

পঠিত : ৪৮৭ বার

মন্তব্য: ০