Alapon

আল্লাহর রাসূল সা. যেভাবে তাবলীগের কাজ করেছেন



সূরা মুদ্দাসসিরের মাধ্যমে আল্লাহর রাসূল সা.-এর প্রতি তাবলীগের নির্দেশ আসলেও প্রাথমিকভাবে সেটি ছিল গোপন তাবলীগের নির্দেশ। আল্লাহ রাসুল সা. যাদেরকে আপন মনে করতেন তাদেরকে গোপনে ডেকে রিসালাতের কথা জানাতেন। আল্লাহর একত্ববাদের কথা জানিয়েছেন। এভাবে তিন বছর দাওয়াতী কাজ করেছেন। এর মধ্যে রাসূলের চাচা আবু তালিব রাসুল সা. কে বিশ্বাস করেছেন। সহায়তা করার প্রতিশ্রুতি দিয়েছেন। কিন্তু নিজে ইসলামে দাখিল হন নি বা দাওয়াত কবুল করেননি। আর বাদবাকী প্রায় সবাই মুহাম্মদ সা.-কে রাসূল মেনে নিয়ে ইসলামে দাখিল হয়েছেন। যারা ইসলামে দাখিল হয়েছেন তারাও ব্যক্তিগতভাবে আপনজনদের ইসলামে নিয়ে এসেছেন। এভাবে তিন বছরে প্রায় ৪০ জন ইসলাম গ্রহণ করেছিলেন।

এরপর আল্লাহ তায়ালা এবার প্রকাশ্য দাওয়াতের নির্দেশ দিয়েছেন। এ প্রসঙ্গে আল্লাহ তায়ালা সূরা শুয়ারার ২১৩-২১৫ নং আয়াতে বলেন,

//অতএব, আপনি আল্লাহর সাথে অন্য উপাস্যকে আহবান করবেন না। করলে শাস্তিতে পতিত হবেন। আর আপনি নিকটতম আত্মীয়দেরকে সতর্ক করে দিন। এবং আপনার অনুসারী মুমিনদের প্রতি সদয় হোন। যদি তারা আপনার অবাধ্য হয়, তবে বলে দিন, তোমরা যা কর, তা থেকে আমি মুক্ত।//

সূরা শুয়ারায় সর্বপ্রথম হযরত মুসা আ.-এর ঘটনা ব্যক্ত করা হয়। অর্থাৎ বলা হয়, কিভাবে হযরত মুসা আ. নবুয়্যত পেয়েছিলেন এবং বনি ইসরাইলসহ হিজরত করে ফেরাউন এবং ফেরাউনের জাতি এবং তার সঙ্গী সাথীদের নীল নদে ডুবিয়ে মারা হয়েছিল। অন্য কথায় এ সূরায় হযরত মুসা আলাইহিস সালাম, ফেরাউন এবং বনি ইসরাইলীদের নিকট যেভাবে দাওয়াত দিয়েছিলেন সেই দাওয়াতের বিভিন্ন পর্যায় তুলে ধরা হয়েছে। একইসাথে নূহ আ. সালেহ আ. সহ অন্যান্য নবীদের দাওয়াত ও তাদের প্রতিক্রিয়া উল্লেখ করা হয়েছে।

মুহাম্মদ সা.-কে তাঁর জাতির মধ্যে প্রকাশ্য তাবলীগের নির্দেশ দেওয়ার সাথে অন্যান্য নবীদের ঘটনা এ কারণেই বলা হয়েছে যাতে উদাহরণগুলো তাঁর সামনে থাকে। সফিউর রহমান তাঁর আর রাহিকুল মাখতুম গ্রন্থে বলেন, সম্ভবত এর উদ্দেশ্য ছিল এই যে, যেসব লোক আল্লাহর রসূলকে মিথ্যাবাদী বলবে তারা যেন বুঝতে পারে যে, এ ধরনের আচরণের ওপর অবিচল থাকলে তাদের পরিণাম কীরূপ হবে। তারা আল্লাহর কীরূপ পাকড়াও এর সম্মুখীন হবে। এছাড়া ইমানদাররাও বুঝতে পারবে যে, উত্তম পরিণাম তাদেরই জন্য রয়েছে। পক্ষান্তরে যারা নবীকে মিথ্যাবাদী বলে তাদের পরিণাম ভালো হবে না।

এ আয়াত নাজিল হওয়ার পর নবী সা. প্রথম পদক্ষেপ হিসাবে বনু হাশেমদের সমবেত করলেন। তাদের সাথে বনু মুত্তালেব ইবনে আবদে মান্নাফের একটি দলও ছিল। তারা ছিল মোট পঁয়তাল্লিশ জন। দাওয়াত শুনে ক্ষেপে গেলো আবু লাহাব। সে বললো, দেখো এরা তোমার চাচা এবং চাচাতো ভাই। কথা বলো তবে মূর্খতার পরিচয় দিয়োনা এবং মনে রেখো তোমার খান্দান সমগ্র আরবের সাথে মোকাবিলা করতে পারবে না। যদি তুমি তোমার কথার ওপর অটল থাকো তাহলে কোরাইশদের সমগ্র গোত্র তোমার বিরুদ্ধে ঝাঁপিয়ে পড়বে। আরবের অন্যান্য গোত্ররাও তাদের সাহায্যে এগিয়ে আসবে। এরপর কি হবে? বংশের মধ্যে তুমিই হবে সবচেয়ে বেশী ধ্বংসাত্মক কাজের মানুষ। নবী সা. চুপ করে রইলেন।

নবী করিম সা. পুনরায় তাঁর আত্মীয়দের সমবেত করলেন এবং বললেন, আল্লাহ পাকের জন্য সকল প্রশংসা। আমি তাঁর প্রশংসা করছি এবং তাঁর কাছেই সাহায্য চাচ্ছি। তাঁর প্রতি বিশ্বাস স্থাপন করছি। তাঁর ওপর ভরসা করছি। আমি এ সাক্ষ্য দিচ্ছি যে, আল্লাহ ব্যতীত এবাদতের উপযুক্ত কেউ নেই। তিনি এক ও অদ্বিতীয় তাঁর কোন শরিক নেই। এরপর আল্লাহর রাসুল সা. বললেন, পথ প্রদর্শক তার পরিবারের লোকদের নিকট মিথ্যা কথা বলতে পারেনা।

সেই আল্লাহর শপথ যিনি ছাড়া কোন উপাস্য নেই, আমি তোমাদের প্রতি বিশেষভাবে এবং অন্য সব মানুষের প্রতি সাধারণভাবে আল্লাহর রসূল। আল্লাহর শপথ, তোমরা যেভাবে ঘুমিয়ে থাকো সেভাবে একদিন মৃত্যুমুখে পতিত হবে। ঘুম থেকে যেভাবে তোমরা জাগ্রত হও, সেভাবে একদিন তোমাদের উঠানো হবে। এরপর তোমাদের থেকে তোমাদের কৃতকর্মের হিসাব নেওয়া হবে। এরপর রয়েছে চিরকালের জন্য হয়তো জান্নাত অথবা জাহান্নাম।

একথা শুনে আবু তালিব বললেন, তোমাকে সহায়তা করা আমার কতো যে পছন্দ সেটা বলার অপেক্ষা রাখে না। তোমার উপদেশ গ্রহণযোগ্য। তোমার কথা আমি সত্য বলে বিশ্বাস করি। এখানে তোমার পিতৃকুলের সকলে উপস্থিত রয়েছে আমিও তাদের একজন। কাজেই তুমি যে নির্দেশ পেয়েছো তা অব্যাহত রাখো। আমি হিফাযত ও সহায়তা করবো। তবে আমার মন আবদুল মোত্তালেবের দ্বীন ছাড়ার পক্ষপাতী নয়।

আবু লাহাব বললো, আল্লাহর শপথ এটা মন্দ কাজ। অন্যদের আগে তুমি তার হাত ধরেছ? আবু তালেব বললেন, আল্লাহর শপথ, যতদিন বেঁচে থাকি ততদিন আমি তার হেফাজত করতে থাকবো।

মুহাম্মদ সা. যখন নিশ্চিতভাবে বুঝতে পারলেন যে, আল্লাহর দ্বীনের তাবলীগের ক্ষেত্রে চাচা আবু তালিব তাঁকে সহায়তা করবেন তখন তিনি একদিন সাফা পাহাড়ের ওপর উঠে আওয়ায দিলেন যে, ইয়া সাবাহাহ অর্থাৎ হায় সকাল। তখনকার দিনে কোন ভয়াবহ সংবাদ দেয়ার দরকার হলে মানুষরা পাহাড়ের চূড়ায় উঠে ইয়া সাবাহাহ ইয়া সাবাহাহ বলে চিৎকার করতে থাকতো।

এই আওয়াজ শুনে কোরাইশ গোত্রসমূহ তাঁর কাছে সমবেত হলো। তিনি তাদেরকে আল্লাহ পাকের তাওহীদ, তাঁর রেসালাত এবং রোজ কেয়ামতের ওপর বিশ্বাস স্থাপনের দাওয়াত দিলেন। এই প্রসঙ্গে আব্দুল্লাহ ইবনে আব্বাস রা. বলেন,

নবী সা. সাফা পাহাড়ের ওপর আরোহণ করে আওয়াজ দিলেন, হে বনি ফিহর, হে বনি আদী, এই আওয়ায শুনে কুরাইশদের সকল নেতৃস্থানীয় লোক একত্রিত হলো। যিনি যেতে পারেননি তিনি একজন প্রতিনিধি পাঠিয়েছেন কি ব্যাপার সেটা জানার জন্য।কুরাইশরা এসে হাজির হল, আবু লাহাবও তাদের সাথে ছিলেন।

মুহাম্মদ সা. বললেন, যদি আমি তোমাদের বলি যে, পাহাড়ের ওদিকের প্রান্তরে একদল ঘোড় সওয়ার আত্মগোপন করে আছে, ওরা তোমাদের ওপর হামলা করতে চায়, তোমরা কি সে কথা বিশ্বাস করবে?

সবাই বলল, হ্যাঁ বিশ্বাস করব, কারণ আপনাকে আমরা কখনো মিথ্যা বলতে শুনিনি।
নবী সা. বললেন, তাহলে শোনো আমি তোমাদেরকে এক ভয়াবহ আযাবের ব্যাপারে সাবধান করার জন্য প্রেরিত হয়েছি।

সাথে সাথে আবু লাহাব বললো, তুমি ধ্বংস হও। তুমি আমাদেরকে একথা বলার জন্য এখানে ডেকেছ?

রাসূল সা. বললেন, হে কুরাইশগণ, তোমরা নিজেদের জাহান্নাম থেকে রক্ষা করো। হে বিন কাব, নিজেদের জাহান্নাম থেকে রক্ষা কর। হে মোহাম্মদের মেয়ে ফাতেমা, নিজেকে জাহান্নাম থেকে রক্ষা করো। আমি তোমাদেরকে আল্লাহর পাকড়াও থেকে রক্ষার ব্যাপারে আদিষ্ট হয়েছি। যেহেতু তোমাদের সাথে আমার আত্মীয়তা রয়েছে, কাজেই এ সম্পর্কে আমি তোমাদেরকে যথাসম্ভব সজাগ করবো।

এরপর আল্লাহ তায়ালা নাজিল করলেন প্রকাশ্য তাবলীগের নির্দেশ। এই প্রসঙ্গে তিনি সূরা হিজরের ৯৪ নং আয়াতে বলেন, অতএব আপনি প্রকাশ্যে শুনিয়ে দিন যা আপনাকে আদেশ করা হয় এবং মুশরিকদের পরওয়া করবেন না।

এই আদেশের পর রাসুল সা. মুশরিকদের নোংরামি, অকল্যাণসমূহ ও মিথ্যাবাদীতা প্রকাশ্যে তুলে ধরেন। তিনি মূর্তিসমূহের অন্তঃসারশূন্যতা, মূল্যহীনতা তুলে ধরেন এবং তাদের স্বরূপ উদঘাটন করেন। ইবরাহীমের ধর্মের বিকৃতি কীভাবে মুশরিকরা করেছে তাও বললেন। তিনি উদাহরণ দিয়ে দিয়ে বোঝাতে থাকেন যে, মূর্তিসমূহ নিরর্থক এবং শক্তিহীন। তিনি আরো জানান যে, যারা এসব মূর্তিপূজা করে এবং নিজের ও আল্লাহর মধ্যে এদেরকে মাধ্যম হিসাবে স্থির করে তারা সুস্পষ্ট পথভ্রষ্টতার মধ্যে রয়েছে।

মূর্তির উপাসকদের পথভ্রষ্ট বলা হয়েছে একথা শোনার পর মক্কার অধিবাসীরা ক্রোধে দিশেহারা হয়ে পড়লো। কুরাইশরা নেতারা মুহাম্মদ সা.-এর কঠোর বিরোধীতা করতে শুরু করলো। কারণ তারা জানতো যে, আল্লাহ ছাড়া অন্য কাউকে মাবুদ হিসাবে অস্বীকার করা এবং রিসালাত ও আখিরাতের ওপর বিশ্বাস স্থাপনের অর্থ হচ্ছে নিজেকে পরিপূর্ণভাবে মুহাম্মদের হাতে ন্যস্ত করা এবং তাঁর কাছে নিঃশর্ত-ভাবে আত্মসমর্পণ করা। তারা সঠিকভাবে বুঝতে পেরেছে মুহাম্মদ যে দ্বীন বা ধর্ম প্রতিষ্ঠা করতে চাইছে তাতে নিজের জানমাল উপরেও নিজের কোনো স্বাধীন অধিকার থাকেনা।

তারা সঠিকভাবে ভেবেছে মুহাম্মদ সা.-এর দ্বীনের অর্থ হচ্ছে যে, আরবের লোকদের ওপর মক্কার লোকদের ধর্মীয় ক্ষেত্রে যে শ্রেষ্ঠত্ব ও কর্তৃত্ব ছিল সেটা নিশ্চিহ্ন হয়ে যাবে। এর ফলে আল্লাহ এবং তাঁর রাসূলের ইচ্ছা ও মর্জিই হবে চূড়ান্ত। নিজেদের ইচ্ছা মতো তারা কিছুই করতে পারবেনা। নিচু ও দাস শ্রেণীর লোকদের ওপর তারা যে অত্যাচার নির্যাতন চালিয়ে আসছিল, সকাল সন্ধ্যা তারা যেসব ঘৃণ্য কাজে লিপ্ত ছিল সেসব থেকে তাদের দুরে থাকতে হবে।

কুরাইশরা মুহাম্মদ সা.-এর দ্বীনের ব্যাপারটা সঠিকভাবে অনুধাবন করতে সক্ষম হয়েছে। তাই তারা তাদের কর্তৃত্ব ও অন্যায় কাজ চালিয়ে রাখতে মুহাম্মদ সা.-এর বিরোধীতা করেছিল। তাদের মধ্যে অনেকেই মনে মনে বিশ্বাস করতো মুহাম্মদ যা বলে তা সঠিক। কিন্তু নেতৃত্ব ও কর্তৃত্ব হারানোর ভয়ে ইসলামের প্রতি তারা অনুগত হয়নি।

কুরাইশদের বড় সমস্যা ছিল, তাদের সামনে এমন এক ব্যক্তি ছিলেন যিনি ছিলেন সত্যবাদী এবং বিশ্বাসী। তিনি ছিলেন আদর্শের উত্তম দৃষ্টান্ত। দীর্ঘকাল যাবত মক্কার অধিবাসীরা পূর্ব পুরুষদের মধ্যে এ ধরনের দৃষ্টান্ত দেখেনি, শোনেওনি। এমন এক ব্যক্তিত্বের সাথে তারা কিভাবে মোকাবেলা করবে সেটাও ভেবে ঠিক করতে পারছিলনা।

আমরা কালেমা পড়ি ঠিকই কিন্তু কালেমা আমাদের কী নির্দেশ করে তা আমরা বুঝতে সক্ষম হই না। লা ইলাহা ইল্লাল্লাহ'র মাধ্যমে মানুষের ওপর মানুষের নিরংকুশ কর্তৃত্ব নস্যাৎ হয়ে যায়। সার্বভৌমত্ব প্রতিষ্ঠা হয় আল্লাহর। আল্লাহর নির্দেশ ও আইনের বাইরে কোনো কিছু কোনো মুসলিম মেনে নিতে পারে না। আল্লাহ ছাড়া কাউকে ভয় পেতে পারে না, আনুগত্য তো দূরের কথা। মুহাম্মাদুর রাসূলুল্লাহ দ্বারা একমাত্র অনুসরনীয় নেতা হিসেবে মুহাম্মদকে মানতে বাধ্য সকল মুসলিম। ইসলামের ব্যাখ্যা ও রীতিনীতি আল্লাহর মনোনীত প্রতিনিধি মুহাম্মদ সা. যেভাবে বলবেন সেভাবেই হবে। এর কোনো অন্যথা হবে না। যে বিষয়ে আল্লাহ তায়ালা ও মুহাম্মদ সা. অভিমত দিবেন সেই বিষয়ে অন্য কারো মতামত বা অভিমত নেওয়া যাবে না। অন্য কারো ফতওয়া খুঁজা কুফুরি।

এসব কথা ব্যক্তিজীবন ও পরিবারের জন্য যেমন সত্য তেমনি সত্য রাষ্ট্রের জন্য, সমাজের জন্য। নেতা কীভাবে নির্বাচিত হবে এই ব্যাপারে রাসূল যেভাবে ফতওয়া দিয়েছেন সে ফতওয়া ছাড়া অন্য কোনো বুজুর্গের ফতওয়া নেওয়া যাবে না। এটাই আকিদা। আকিদাকে জটিল করার কোনো সুযোগ নেই। আল্লাহর সার্বভৌমত্ব ও রাসূলের নিরঙ্কুশ অনুসরণই মুসলিমদের আকিদা। আমাদের সব কাজ এই ফিল্টারের মধ্যে দিয়ে যাচাই করে নিতে হবে।

যাই হোক, কুরাইশ নেতারা অনেক চিন্তা ভাবনার পর এ সিদ্ধান্ত গ্রহণ করলো যে, তারা রাসূল সা.-এর চাচা আবু তালেবের কাছে যাবে এবং তাকে অনুরোধ করবে, তিনি যেন নিজের ভ্রাতুষ্পুত্রকে তাঁর কাজ থেকে বিরত রাখেন। নিজেদের দাবীকে যুক্তিগ্রাহ্য ও বিশ্বাসযোগ্য করার জন্য তারা এ দলিল তৈরি করলো যে, তাদের উপাস্যদের পরিত্যাগ করার দাওয়াত দেওয়া এবং তারা যে ভালো মন্দ কোন কিছুই করার শক্তি রাখেনা এ কথা বলা প্রকৃতপক্ষে তাদের উপাস্যদের প্রতি অবমাননা এবং মারাত্মক গালি।

তাছাড়া এটা হচ্ছে আমাদের পিতা ও পিতামহ অর্থাৎ আমাদের পূর্ব পুরুষদের নির্বোধ এবং পথভ্রষ্ট আখ্যায়িত করার শামিল। কেননা বর্তমানে আমরা যে ধর্ম বিশ্বাসের ওপর রয়েছি তারাও এই ধর্ম বিশ্বাসের ওপর জীবন যাপন করেছিলেন। সাধারণ কুরাইশদের এসব কথা বোঝানোর পর তারা সহজে বুঝাতে পারছিলো এবং দ্রুত এতে সাড়া দিল।

অবশেষে কুরাইশদের মধ্যে নেতৃস্থানীয় কয়েকজন লোক আবু তালেবের নিকট গেল এবং বলল যে আবু তালেব, আপনার ভ্রাতুষ্পুত্র আমাদের উপাস্যদের গালাগাল করছে, আমাদের দ্বীনকে পথভ্রষ্টতা বলছে এবং আমাদের বিবেককে নির্বুদ্ধিতা বলে অভিহিত করছে। আমাদের পিতা ও পিতামহদের পথভ্রষ্ট বলে আখ্যায়িত করছে। কাজই হয় আপনি তাকে বাধা দিন, অথবা তার এবং আমাদের মাঝখান থেকে আপনি সরে দাঁড়ান। কেননা আপনিও আমাদের মতোই একই ধর্মে বিশ্বাসী। তার সাথে বোঝাপড়ার জন্য আমরা নিজেদের যথেষ্ট মনে করি।

এর জবাবে আবু তালিব বললেন, তিনি তার ভাতিজাকে বলবেন এবং মধ্যস্থতার ভূমিকা পালন করবেন। ফলে তারা ফিরে গেল। আল্লাহর রসূল এই বিষয়ে কর্ণপাত করেননি এবং একই নিয়মে অব্যাহতভাবে দ্বীনের তাবলীগ করতে লাগলেন এবং দ্বীনের প্রচার ও প্রসারে মনোনিবেশ করলেন।

এর মধ্যে হজ্জের সময় এসে গেল। এটা কুরাইশদের জন্য সমস্যা হিসেবে দেখা দিল। কুরাইশরা জানতো যে, আরবের বিভিন্ন এলাকা থেকে প্রতিনিধিদল এ সময় মক্কায় আসবে। এ কারণে তারা দরকার মনে করলো যে, মুহাম্মদ সা. সম্পর্কে এমন কথা বলবে যাতে আরবের লোকদের মনে মুহাম্মদ সা.-এর তাবলীগের কোনো প্রভাব না পড়ে। এ বিষয়ে আলোচনার জন্য তারা ওলীদ ইবনে মুগীরার কাছে গিয়ে একত্রিত হলো।

ওলীদ বললো তোমরা তার সম্পর্কে হাজিদের একথা বলতে পারো যে, তিনি একজন যাদুকর। তিনি যে সব কথা পেশ করেছে সেসব কথা স্রেফ যাদু। তাঁর কথা শোনার পর পিতা পুত্রের মধ্যে, ভাই ভাইয়ের মধ্যে, স্বামী স্ত্রীর মধ্যে, বিভিন্ন গোত্রের মধ্যে মতপার্থক্য দেখা দেয়। একে অপরে শত্রু হয়ে পড়ে।

উল্লিখিত ঘটনার প্রেক্ষিতে ওলীদ সম্পর্কে আল্লাহ পাক সূরা মুদ্দাসসসিরের ১৮ নং থেকে ২৬ নং পর্যন্ত আয়াত নাজিল করেন। আল্লাহ তায়ালা বলেন,

//সে চিন্তা করলো এবং সিদ্ধান্ত করলো। অভিশপ্ত হোক সে, কেমন করে সে এ সিদ্ধান্ত করলো? আরো অভিশপ্ত হোক, সে কেমন করে সে এ সিদ্ধান্তে উপনীত হলো? সে আগে চেয়ে দেখলো। অতঃপর সে ভ্রু-কুঞ্চিত করলো এবং মুখ বিকৃত করলো। অতঃপর সে পেছন ফিরলো এবং দম্ভ প্রকাশ করলো এবং ঘোষণা করলো, এটাতো লোক পরম্পরায় প্রাপ্ত যাদু ভিন্ন আর কিছু নয়, এটাতো মানুষেরই কথা। আমি তাকে প্রবেশ করাবো আগুনে।//

উল্লিখিত সিদ্ধান্ত গৃহীত হওয়ার পর এ সিদ্ধান্ত বাস্তবায়নের উদ্যোগ গ্রহণ করা হয়। কয়েকজন পৌত্তলিক হ্জ্জ যাত্রীদের আসার বিভিন্ন পথে অবস্থান নেয় এবং মুহাম্মদ সা. সম্পর্কে তাদের সতর্ক করে এ কাজে সবার প্রথম ছিল আবু লাহাব। হজ্জের সময়ে সে হজ্জ-যাত্রীদের ডেরায়, ওকায, মাজনা এবং জুল মায়াজের বাজারে রাসূল সা.-এর পেছনে লেগে থাকে। নবী সা. আল্লাহর দ্বীনের তাবলীগ করছিলেন, আর আবু লাহাব পেছনে থেকে বলছিল, তোমরা ওর কথা শুনবে না, সে হচ্ছে মিথ্যাবাদী, বিদ্যাতী এবং বেদ্বীন।

এ ধরনের হুড়োহুড়ির ফলে আল্লাহর রাসূলের তাবলীগের প্রসার হয়েছে বেশি। সকল হজ্জযাত্রী জানতে পারলো মক্কায় নতুন নবীর আবির্ভাব হয়েছে।

পঠিত : ৯৩৪ বার

মন্তব্য: ০