Alapon

কবি আল মাহমুদ-এর সাক্ষাৎকার...



কবি আল মাহমুদ-এর সাক্ষাৎকার...
(একটু দীর্ঘ। তবে সুখপাঠ্য। জানা যাবে অনেক কিছু)

আমি বিধাতাক্রান্ত মানুষ, ধর্মাক্রান্ত নই —আল মাহমুদ

বাংলা কবিতার রাজপুত্র আল মাহমুদ পাড়ি জমিয়েছেন অন্যলোকে। তিনি চলে গেছেন, কিন্তু রেখে গেছেন অসংখ্য সব স্মৃতি এবং কর্ম। তাঁর জীবদ্দশায় শাহীন রেজা বিভিন্ন সময়ে টুকরো টুকরো ভাবে তাঁর যে সাক্ষাত্কার গ্রহণ করেছেন, প্রিয় কবির মৃত্যুর পর সেই সাক্ষাত্কারটি একত্রিত করে পাঠকের উদ্দেশ্যে পেশ করা হলো। অপ্রকাশিত এ সাক্ষাত্কারে কবির চিন্তা এবং চেতনার প্রতিফলন ঘটেছে প্রচ্ছন্নভাবে। উঠে এসেছে তাঁর বোধ ও বিশ্বাসের ক্ষেত্রভূমি। তিনি বর্ণনা করেছেন তাঁর উপলব্ধি এবং আকাঙ্ক্ষার কথা—

শাহীন রেজা :যদি কবিতা দিয়ে শুরু করি...

আল মাহমুদ :যখন কবির কাছে এসেছ তখন তো তা করতেই পারো, করো।

শাহীন :কবিতা নিয়ে আপনার ভাবনা কী?

মাহমুদ :কবিতা আমাদের আত্মার খোরাক। আমরা প্রত্যহ তা থেকে আহার গ্রহণ করি এবং ক্রমশ সমৃদ্ধ হই।

শাহীন :কবিতাকে আপনি একসময় কষ্টের কলা হিসেবে আখ্যায়িত করেছিলেন...

মাহমুদ :করেছিলাম। এখনো করি। কবিতা তো কষ্টেরই কলা। কষ্টসমুদ্রে ডুব দিয়ে একজন কবিকে কবিতার রসদ সংগ্রহ করতে হয়। দুঃখ না থাকলে যেমন সুখের অনুভব আসে না, ঠিক তেমনি হূদয়ে কষ্টের স্পর্শ না পেলে অনুভূতি এবং ‘শব্দ’ অর্থাত্ ‘কবিতা’ জাগ্রত হয় না।

শাহীন :তাহলে কি আমরা ধরে নেব, কবি হতে গেলে প্রথমেই কষ্টসমুদ্রে সাঁতার কাটতে হবে?

মাহমুদ :‘কষ্ট’ দু ধরনের। একটা হচ্ছে না পাওয়ার বেদনা আরেকটা ক্রমাগত চর্চা ও অনুশীলনের। তোমাকে দুটোতেই সাঁতার কাটতে হবে। কবি হতে গেলে প্রয়োজন প্রচুর পাঠ ও পঠনের। তোমার ভেতরে একটি তৃতীয় সত্তা নির্মাণ করতে হবে। মনে রাখতে হবে, অন্যের দৃষ্টিপথ যেখানে রুদ্ধ কবির যাত্রাপথ সেখান থেকে শুরু।

শাহীন :অনেকে মনে করেন, কবিতা শুধুই চর্চার বিষয়...

মাহমুদ :নাহ্, আমি সেটা মনে করি না। কবিতায় চর্চার প্রয়োজন আছে বটে তবে যিনি কবিতা লিখবেন তাঁর মধ্যে কবিতার নির্যাস থাকতে হবে। তোমার মধ্যে যদি কবিতাভ্রমর লুকিয়ে না থাকে তাহলে যতই চর্চা করো, তুমি কবি হতে পারবে না।

শাহীন :আপনি তো টিনের বাক্স হাতে নিয়ে এই মহানগরীতে পা রেখেছিলেন, সেই বাক্সটির ভেতরে কী ছিল, সেটি এখন কোথায়?

মাহমুদ :সেটির ভেতরে ছিল আমার শৈশব-কৈশোর, আমার স্বপ্ন। আমার প্রেম। আমার দেখা প্রকৃতি, তিতাস নদী আর আমার কবিতা। আজ সারা বাংলাদেশ জুড়ে এই যে কবিতার মাতম, এই যে আল মাহমুদ ধ্বনি, সেই টিনের বাক্সটিকে যদি খুঁজতে চাও তাহলে এর-ই মধ্যে খুঁজে পাবে।­

শাহীন :আপনার কবিতার শুরুটা যদি জানতে চাই...

মাহমুদ :এ কথাটা আমি বহুবার বলেছি। আজ তার সাথে নতুন কিছু যুক্ত করতে চাই। মনে করো, এই আল মাহমুদ জন্মেছেই কবি হতে, জন্মের পর চোখ খুলে সে দেখেছে তার মায়ের মুখ, সেই প্রথম দৃষ্টিতেই সে মাতৃমুখে আবিষ্কার করেছে কবিতাসূত্রকে আর যেদিন তার মাকে ‘আম্মা’ বলে ডাক দিয়েছে সেদিনই লিপিবদ্ধ হয়েছে তার প্রথম কবিতা।

শাহীন :বাংলাদেশে পরিচিতি লাভের আগেই কলকাতায় ছড়িয়ে পড়েছিল আপনার সুনাম...

মাহমুদ :এটাকে সুনাম বলব না, ওরা আমার কবিতাকে গ্রহণ করেছিল। হয়তো ওরা আমার মধ্যে কবিত্বের সেই শক্তিকে আবিষ্কারে সক্ষম হয়েছিল। আমি বলছি না, আমাদের দেশের লোকজন তা সেকালে বুঝতে সক্ষম হয়নি তবে একজন স্পঞ্জের স্যান্ডেল পায়ে ঘোরাঘুরি করা গ্রামের যুবককে স্বীকৃতি দিতে তাদের কিছুটা তো কুণ্ঠা থাকতেই পারে।

শাহীন :আজ এই যে আপনার সফলতা এটাকে আপনি মূল্যায়ন করতে চান কিভাবে?

মাহমুদ :দেখ একজনমের স্বীকৃতি একজন কবির জন্য যথেষ্ট নয়। রবীন্দ্রনাথ শতবর্ষ পরের দিনটিকে স্পর্শ করতে চেয়েছিলেন বলেই তিনি শতবর্ষ নয়, তারচেয়েও বেশি বেঁচে আছেন এবং বেঁচে থাকবেন। একজন আল মাহমুদ কবিতার মধ্য দিয়ে যদি হাজার বছর বেঁচে থাকেন তাহলেই আমি তাকে সার্থক মনে করব, তার আগে নয়। অবশ্য সেটা দেখার জন্য সেদিন আমি বেঁচে থাকব না। মহাকালে যদি কবির স্বীকৃতি লিপিবদ্ধ না হয় তাহলে তার সাফল্য কোথায়?

শাহীন :আপনি কি মনে করেন—আপনার যে কর্ম তা আপনাকে সেই সাফল্য এনে দিতে সক্ষম?

মাহমুদ :প্রত্যেকেই নিজ নিজ কর্ম নিয়ে আশাবাদী থাকে। আমিও আশাবাদী। তবে আমার আশা-নিরাশায়

কিছু যায় আসে না। পাঠক, বিশ্লেষক এবং সময় যদি আমাকে ধারণ করে নেয় তবে সে রকম কোনোকিছু

ঘটাকে আমি অসম্ভব মনে করি না।

শাহীন :‘কবিতা এমন’ কবিতায় আপনি কবিতাকে বিভিন্ন জন এবং বিষয়ের সাথে তুলনা করেছেন...

মাহমুদ :কবিতার উপকরণ তো ছড়িয়ে আছে আমাদের চারপাশেই। যে বিষয় কিংবা যে মানুষটি তোমার

ভেতরে স্পন্দন তুলতে সক্ষম হবে এবং উঠে আসবে বর্ণনার ছটা হয়ে তোমারই কবিতায়, প্রকারান্তরে

সেই-ই তো কবিতা। নিমডালে বসে থাকা হলুদ পাখিটি, আব্বার ফিরে আসা, সাইকেলের সেই ঘণ্টাধ্বনির

সাথে উচ্চারিত আমার মায়ের নাম ‘রাবেয়া-রাবেয়া’ এ সবকিছুই তো আমার কবিতার ধ্বনি, আমার

উচ্চারণ। আমি এসবকে কবিতা বলব না তো কাকে বলব?

শাহীন :মক্তবের মেয়ে সেই চুল খোলা আয়েশা আক্তার...


মাহমুদ :ছিলেন একজন এ নামেই হয়তো, আমার কবিতার সাক্ষী হয়ে। তিনি তো অতি প্রাচীন। তিনি বেঁচে থাকুন আমার কবিতায়। চরের পানি, কুড়ানো হাঁসের ডিম কিংবা গন্ধভরা ঘাসের মতো তিনিও ছড়াতে থাকুন আপন সুবাস।

শাহীন :ছেচল্লিশে বেড়ে ওঠা সেই অসুখী কিশোরের কথা কি মনে পড়ে?

মাহমুদ :অতটা মনে করতে পরব না। তবে সেই দেশভাগ, আন্দোলন-সংগ্রাম কুয়াশার মতো মাঝেমধ্যে স্মৃতির দীপ জ্বালিয়ে যায়। সাতচল্লিশেই তো পাকিস্তান এল। কিন্তু শান্তি এল কই?

শাহীন :ট্রাক নিয়ে আপনার সেই বিখ্যাত ছড়াটার কথা যদি বলতেন...

মাহমুদ :গণঅভ্যুত্থানে নিহত আসাদ আমার বুকে একটা শোকের শেল হয়ে বিঁধেছিল। ঊনসত্তুরের ছড়া-১ এবং ২ তে আমি সে শোককে শক্তিতে পরিণত করার চেষ্টা চালিয়েছি। ঘাতক ট্রাকের মুখে আগুন দিতে ডাক পাঠিয়েছি মতিয়ুরকে।

শাহীন :এবার ‘সোনালী কাবিন’-এ আসি। অনেকেই মনে করেন এ কাব্যগ্রন্থটি নোবেল পাওয়ার যোগ্য...

মাহমুদ :কেউ মনে করলে আমি তো তার মনকে থামিয়ে দিতে পারি না, আমার তো সেই শক্তি নেই, এটাকে আমি আমার এবং আমার কবিতার প্রতি তার আস্থা ও ভালোবাসার প্রকাশ বলেই মনে করছি। এ প্রসঙ্গে আমি বলতে চাই, শুধু ‘সোনালী কাবিন’ নয় আমাদের দেশেও এমন কিছু কাব্যগ্রন্থ রচিত হয়েছে যা নোবেল পুরস্কারের জন্য বিবেচনায় উঠে আসতে পারে। নোবেলের জন্য আমার কোনো আক্ষেপ নেই। এই যে তোমরা মনে করছ—‘সোনালী কাবিন’ নোবেল পাওয়ার যোগ্য, এটাই আমার বড় ‘নোবেল’ বলে আমি মনে করি।

শাহীন :কবিতা কিংবা সাহিত্যের ক্ষেত্রে পুরস্কার বা পদক কি আসলেই জরুরি কিছু?

মাহমুদ :না। অন্তত আমি জরুরি ভাবি না। কবির স্বীকৃতি পাঠকের ভালোবাসায়। পাঠক যদি গ্রহণ না করে তাহলে লক্ষ পুরস্কারও একজন কবিকে বাঁচিয়ে রাখতে পারে না। তবে অনুপ্রেরণা যদি বলো, তা পুরস্কার বা পদকের মধ্য দিয়ে আসে, তবে সেটা দীর্ঘস্থায়ী নয়।

শাহীন :দুই বাংলাতেই আল মাহমুদ এখন সমান জনপ্রিয়, বিষয়টি নিশ্চয়ই আপনার জন্য উপভোগের।

মাহমুদ :উপভোগ বলতে যা বোঝায় সেটা হয়তো আমি করি না তবে ভালো লাগে। এটা যে লক্ষ প্রাণের ভালোবাসা তা আমাকে ভাসিয়ে নিয়ে যায়। মনে হয় এর জন্যই হয়তো আমার পৃথিবীতে আসা।

শাহীন :এখন তো আপনিই এক নম্বর...

মাহমুদ :যখন প্রথম ঢাকাতে আসি তখন আমার নাম ৩৬ বা তারও পরে লেখা হতো, আজ তোমরা এক নম্বরে নিয়ে এসেছ। আমি মনে করি এটা কবিতার প্রতি আমার একান্ত নিষ্ঠা ও একাগ্রতার ফসল। একটা কথা জেনে রাখো, আমি কখনোই এক নম্বর হওয়ার জন্য কবিতা লিখিনি। প্রধান কবি নয়, প্রকৃত কবি হওয়াই ছিল আমার একমাত্র উদ্দেশ্য। আজ সকলের উচ্চারণ শুনে মনে হয় এক্ষেত্রে আমি সফল হয়েছি। আমার চোখ ভিজে যায়। অন্ধ মানুষ। যা কিছু দেখি তা ঝাপসা। বিধাতার কাছে কৃতজ্ঞতায় মাথাটা নুয়ে আসে। একজন অতি সাধারণ মানুষকে তিনি যা দান করেছেন তার জন্য আমার প্রতিটি সিজদায় তাঁর প্রতি অপার শ্রদ্ধা ও ভালোবাসা ঝরে পড়ে।

শাহীন :বিধাতার প্রসঙ্গ যখন এল, তখন একটা বিষয় না জানতে চেয়ে পারছি না, প্রথম জীবনে আপনি তো সমাজতন্ত্রে বিশ্বাসী ছিলেন, হঠাত্ করেই বিধাতাক্রান্ত হলেন কিভাবে?

মাহমুদ :সমাজতন্ত্রে বিশ্বাসী ঠিক নয়, আমি চিরকাল সাম্যে বিশ্বাসী ছিলাম। যৌবনে আমি সেই সাম্যের স্বপ্নটা সমাজতন্ত্রের মধ্যে দেখতে পেয়েছি, কিন্তু পরবর্তী সময়ে পরিণত বয়সে এসে দেখলাম, ইসলামেই পরিপূর্ণ সাম্য বিরাজমান, তখন বিধাতা এবং ধর্মের প্রতি গভীরভাবে অনুরক্ত হয়ে পড়লাম। এটাকে কেউ কেউ ভিন্ন ব্যাখ্যা করে। আমি সারাটি জীবন সাম্য অর্থাত্ মানুষের সমান অধিকারের পক্ষে ছিলাম, বাম কিংবা ডানের বিভাজনে আমার এ বিশ্বাসকে ব্যবচ্ছেদের অপচেষ্টা হয়েছে বারবার, তবে সত্য চিরকালই সত্য। আমার কবিতা যেমন টিকে থাকবে তেমন টিকে থাকবে আমার বিশ্বাস এবং কর্ম।

শাহীন :আপনাকে কি তাহলে ধর্মাক্রান্ত মানুষ হিসেবে আখ্যায়িত করা যায়?

মাহমুদ :আমি ধর্মভীরু, তবে কিছুতেই ধর্মান্ধ নই। আর আক্রান্ত যদি বলো তাহলে আমি পরিপূর্ণভাবে একজন বিধাতাক্রান্ত মানুষ, ধর্মাক্রান্ত নই। আমি মহান প্রভু আল্লাহ-তে বিশ্বাস স্থাপন করে অগ্রসর হয়েছি এবং আমৃত্যু আমার এই পথচলা অব্যাহত থাকবে ইন্শাআল্লাহ।

শাহীন :মৃত্যু নিয়ে আপনার ভাবনা কী?

মাহমুদ :জন্ম যেমন সত্য, মৃত্যুও তেমনি। আমি ডামাডোলের মধ্য দিয়ে নয়, নীরবে নিভৃতে প্রস্থান করতে চাই। আমার মৃত্যুর পর যদি মহাকাশ থেকে এক বিন্দু শিশির পতিত হয় তবে তাকেই আমি প্রকৃতির অশ্রু মেনে নিয়ে চলে যাব একাকী আপন পথে।

শাহীন :একটি কবিতায় আপনি পবিত্র জুমআ’র দিন অর্থাত্ শুক্রবার পৃথিবী থেকে বিদায় নেওয়ার কথা উল্লেখ করেছিলেন...

মাহমুদ :হ্যাঁ করেছিলাম। আমার একান্ত ইচ্ছা এই পবিত্র দিনেই আমার মহাপ্রস্থান ধ্বনিত হোক।

শাহীন :কবিতাটি কি আপনার মনে আছে?

মাহমুদ :কয়েকটা লাইন বলতে পারব—

‘কোনো এক ভোরবেলা, রাত্রি শেষে শুভ শুক্রবারে

মৃত্যুর ফেরেশতা এসে যদি দেয় যাওয়ার তাকিদ

অপ্রস্তুত এলোমেলো এ গৃহের আলো অন্ধকারে

ভালোমন্দ যা ঘটুক মেনে নেবো এ আমার ঈদ’

শাহীন :মুক্তিযুদ্ধ প্রসঙ্গে আসি। কেউ কেউ আপনাকে স্বাধীনতার বিপক্ষ শক্তি হিসেবে চিহ্নিত করতে চায়...

মাহমুদ :করুক না, তাতে কী এসে যায়। আমার গর্ব আমি স্বাধীন বাংলা বেতারকেন্দ্রে কাজ করেছি। আমার ছড়া কিংবা কবিতায় ৫২, ৬৯ কিংবা ৭১ যেভাবে উপস্থাপিত হয়েছে তারা দেখাক না অন্য কবির কবিতায় এর কিয়দংশও আছে কি না। কাউকে দোষারোপ করতে হলে প্রমাণ লাগে। প্রমাণ ছাড়া কোনো কিছু হয় না।

শাহীন :মুক্তিযুদ্ধের শব্দ সৈনিক হয়েও আপনি একসময় স্বাধীনতা বিরোধীদের কাগজে কাজ করেছেন...

মাহমুদ :তাদের কাগজে কাজ করেছি পেটের দায়ে। আমি তো ইত্তেফাক, গণকণ্ঠেও কাজ করেছি। বঙ্গবন্ধু নিজে আমাকে শিল্পকলা একাডেমিতে চাকরি দিয়েছেন। একজন পেশাজীবী হিসেবে যে কোনো কাগজে বা প্রতিষ্ঠানে যে কেউ কাজ করতে পারেন। দেখতে হবে তিনি ঐ কাগজ বা প্রতিষ্ঠানের আদর্শে পরিচালিত হয়েছেন কি না। আমি শুধু সাংবাদিক হিসেবে ওই কাগজটিতে চাকরি করেছি মাত্র। এটা অনেকেই করেন। জনকণ্ঠে কিংবা ভোরের কাগজে যাঁরা কাজ করেন তাঁরা সবাই কি আওয়ামী লীগ করেন?

শাহীন :আপনি পাঁচ ওয়াক্ত নামাজ পড়েন, রোজা রাখেন...

মাহমুদ :তো কী হয়েছে? এতে করে কি আমি মৌলবাদী হয়ে গেছি, রাজাকার হয়ে গেছি? নামাজ তো ইসলামের অঙ্গ। আমি মুসলমান। সাচ্চা মুসলমান নামাজ পড়বেই। রোজা রাখবেই। দাড়ি, টুপি কিংবা নামাজ-রোজার জন্য কারো দিকে আঙুল তোলা ঠিক নয়।

শাহীন :এবার আপনার বন্ধুদের প্রসঙ্গ...

মাহমুদ :বন্ধু যদি বলো তাহলে প্রথমেই যাঁর নাম বলতে হয় তিনি শামসুর রাহমান। তাঁর সাথে আমার সম্পর্কটি ছিল অত্যন্ত সুখকর। আমি তাঁকে শ্রদ্ধা করতাম। তিনি বয়সে একটু বড় ছিলেন। অত্যন্ত ব্যক্তিত্বসম্পন্ন মানুষ। কবিতায় এমন নিবেদিতপ্রাণ আমি আর দেখিনি। কত আড্ডা দিয়েছি তাঁর সাথে, কত স্মৃতি। অনেকেই আমাদের বন্ধুত্ব বিনষ্টের চেষ্টা চালিয়েছেন কিন্তু কামিয়াব হয়নি। তাঁর মৃত্যু পর্যন্ত আমাদের সম্পর্ক অটুট ছিল।

শাহীন :শহীদ কাদরী, সৈয়দ শামসুল হক কিংবা ফজল শাহাবুদ্দীন...

মাহমুদ :শহীদ আর ফজলের সাথে আমার মাখামাখি একটু বেশিই ছিল। ফজলের কর্মক্ষেত্র পোস্ট অফিস আর হারুন এন্টারপ্রাইজে আমি সর্বাধিক আড্ডা দিয়েছি। দৈনিক বাংলাতে তো আড্ডা জমত সবারই। সৈয়দ হক মেজাজি তবে বড় ভালো মানুষ। তাঁর নাট্য আর কাব্যশক্তি দুটোই সমান সমান।

শাহীন :অন্য যাঁরা ছিলেন...

মাহমুদ :ঐ সময়ে আসলে আমাদের এত কাজ ছিল না। ছিল না এমন অর্থের জন্য লড়াই-সংগ্রামও। প্রত্যেকের হাতে সময় ছিল অফুরান। আমরা মিলিত হতাম, আড্ডা মারতাম। আড্ডার প্রধান বিষয় ছিল কবিতা। কত জনের নাম বলব—এঁদের প্রায় সকলেই কবিতা লিখতেন। কেউ কেউ ছিলেন সাংবাদিকতার সাথে যুক্ত, কেউ কেউ অন্য পেশায়। বয়সটা বিবেচ্য ছিল না, মনের উষ্ণতায় যাঁদের কাছাকাছি হয়েছি তাঁদেরকেই বন্ধু বলে ভেবেছি। এ অভ্যাসটা এখনো আছে।

শাহীন :কার কার লেখা আপনার ভালো লাগে?

মাহমুদ :কবিতার কথা যদি বলো তাহলে ব্যাপকভাবে বলতে হয়। এত ব্যাপকভাবে বলতে চাই না। আমি রবীন্দ্রভক্ত। তা বলে নজরুল কিংবা জীবনানন্দকে অস্বীকার করব—এমন সাহস আমার নেই। তবে একটা কথা জেনে রাখো—জসীম উদ্দীন কিংবা ফররুখ অত্যন্ত শক্তিশালী কবি ছিলেন আর মাইকেল তো চিরকালের।

শাহীন :একসময়ের প্রবল কবি ফররুখ কিংবা জসীম উদ্দীন এখন অনেকটাই আড়ালে—

মাহমুদ :জসীম উদ্দীন সম্পর্কে বলার আগে আমি তাঁর একটি কবিতার লাইন উল্লেখ করতে চাই—‘কাল সে আসিবে মুখখানি যার নতুন চরের মত’—এই চরণটি বাংলা কবিতায় একটি বিপ্লবের সূচনা করেছিল। এর আগে সবাই চাঁদের সাথে প্রিয়তম নারীর মুখের তুলনা দিয়েছেন, জসীম উদ্দীনই ব্যতিক্রম যিনি চাঁদের স্থলে চরের উপমা টেনে এনেছেন। একটা কথা জেনে রাখো, কোনো সৃজনশীল কবিই কখনো আড়ালে যান না। হয়তো নতুনত্বের জোয়ারে তাঁরা একটু পাশে সরে থাকেন। জসীম উদ্দীন এবং ফররুখের ক্ষেত্রে এটিই ঘটেছে। বাংলা কবিতা থেকে ‘কবর’ এবং ‘ডাহুক’-এর বিদায় কি এতই সহজ?

শাহীন :এ প্রজন্মের কারো লেখা কি আপনাকে স্পর্শ করে?

মাহমুদ :আমি অন্ধ মানুষ। আমাকে তো অন্যের সাহায্য নিয়ে পড়াশোনা করতে হয়। আবিদ আজাদকে আমি অনেক সম্ভাবনাময় কবি হিসেবে একসময় চিহ্নিত করেছিলাম, কিন্তু সে তো আর নেই। তবে পরবর্তীকালে কারো কারো কবিতা হঠাত্ হঠাত্ ভালো লেগে গেছে।

শাহীন :ইদানীং আপনি অসুস্থ তবুও লেখা চালিয়ে যাচ্ছেন, এটা সম্ভব হচ্ছে কিভাবে?

মাহমুদ :আমার কিছু তরুণ বন্ধু আছে, আমি বলি আর ওরা তা লিখে নেয়। আবিদ নামের একটি ছেলে আমাকে বেশ সাহায্য করে। আমি ওদের কাছে ঋণী।

শাহীন :আপনি অসুস্থ হবার পর নিয়মিত খোঁজখবর রাখছেন এমন কেউ...

মাহমুদ :আসাদ চৌধুরী প্রয়াশই খোঁজখবর নেন। জাকিরসহ তরুণ কবিরাও আসে। তারা এলে বেশ ভালো লাগে, আহ্লাদিত হই।

শাহীন :জীবনানন্দ বলেছেন, সকলেই কবি নয় কেউ কেউ কবি, আপনি কী বলেন?


মাহমুদ :‘কবি’ অনেক বড় একটা বিষয়। কবিত্ব হয়তো ভেতরে লুকিয়ে আছে, কিন্তু চর্চার অভাবে এর প্রকাশ ঘটছে না—এমন কিছু বিষয় অবশ্য আছে। তবে কাউকে ‘কবি’ বলার আগে দু দণ্ড থেমে তার সম্পর্কে জেনে নেওয়া উচিত। একজন কবিকে প্রতিষ্ঠিত করে তার কবিতা অন্য কিছু নয়। তুমি কাউকে ‘কবি’ বললে আর অমনি তিনি কবি হয়ে গেলেন এটা অসম্ভব। কাক আর কবি এক নয়। কা কা করলে কাক হয় কবি হয় না। কবিতা লেখার জন্য প্রয়োজন ‘কবি’ হওয়া। আমি সবসময় একটা কথা বলে এসেছি, কবি হতে হলে প্রথমে তোমাকে মানুষ হতে হবে, যতই জ্ঞান ধারণ করুক, কোনো অমানুষ কখনো কবি হতে পারে না।

শাহীন :আপনার কবিতার অনুপ্রেরণা কে?

মাহমুদ :আমার দেশ, আমার প্রকৃতি। আমি মাটির ঘ্রাণ নিয়ে বেড়ে ওঠা একজন কবি। আমার শরীরে তিতাসের জলগন্ধ্যা বাতাস আর চিরায়ত বাংলার সবুজের স্পর্শ। তবে একটি কথা না বললেই নয়, আমার সহধর্মিণী নাদিরা বেগম আমার জীবনে না এলে আমার পূর্ণাঙ্গ বিকাশ হয়তো সম্ভব হতো না। তিনি সংসার সামলেছেন, অভাব অনটনের মধ্যেও ধৈর্য ধারণ করে নীরবে আমার পাশে থেকেছেন, কখনো অসহিষ্ণুতা প্রকাশ করেননি। তাই কবি আল মাহমুদ তার কাছে কৃতজ্ঞ। নাদিরাকে শুধু একজন স্ত্রী হিসেবে আমি চিহ্নিত করতে চাই না। তিনি একজন মহান মানবী, যার ছোঁয়ায় আমার প্রাণ পূর্ণতা পেয়েছে, কবিতার পাখি ডানা মেলেছে উজানে।

শাহীন :আপনি সবসময় বলে থাকেন—ছন্দ-মাত্রা ছাড়া কবিতা অর্থহীন, যদি তা-ই হয় তাহলে গদ্য কবিতাকে আপনি মূল্যায়ন করবেন কিভাবে?

মাহমুদ :দেখ ভাই, সত্য কথা হচ্ছে আমি লিরিক্যাল অর্থাত্ গীতপ্রবণ কবি। অন্ত্যমিল ভালোবাসি, ছন্দের গীত পছন্দ করি। তুমি আমাকে একজন গীতপ্রবণ কবি ভেবে নিতে পারো। গদ্য কবিতাও কবিতা, আমি তার বিরোধী নই তবে আমার পছন্দ গীত, ছন্দ।

শাহীন :গদ্য কবিতায় অভ্যস্তরা ইদানীং ছন্দের বিরুদ্ধে কথা বলছেন...

মাহমুদ :ওরা বোধহয় মনে করে ছন্দের অনুশাসনে ব্যাপক চিত্রকল্প নির্মাণ অসম্ভব। ছন্দ কবিতায় একটা সুর আছে, বিশেষ ধরনের ধ্বনি আছে, অন্ত্যমিল এবং মাত্রার সীমাবদ্ধতা আছে। টানা গদ্যে লেখা কবিতায় সেই পরিশ্রমের প্রয়োজন হয় না। মোটামুটি কিছু উপমা, উেপ্রক্ষা নিয়ে একটা চিত্রকল্প নির্মাণ করতে পারলেই সহজে উতরে যাওয়া যায়। তবে সবাই যে তা করে সেটা নয়। গদ্যেও অনেক উত্কৃষ্ট ও শ্রুতিমধুর কবিতা রচিত হয়েছে এবং এখনো হচ্ছে, যেগুলো নিঃসন্দেহে চিন্তার খোরাক জোগায়। একটা কথা আমি সুস্পষ্টভাবে বলে দিতে চাই, কবিতার একটা ব্যাকরণ আছে। তার অনুশীলন না করেই যাঁরা কাব্য রচনায় হাত দিয়েছেন তাঁরা ভুল করেছেন। জেনে শুনে শিখে নিয়ম মেনে কবিতা লিখতে হয়। মনে আসা আবেগকে যেনতেন ভাবে প্রকাশ করার নাম কবিতা নয়।

শাহীন :কিন্তু কবিতা তো আবেগেরই ফসল...

মাহমুদ :তা সত্য। তবে সেটাকে সঠিকভাবে কাব্যিক রূপে উপস্থাপন করতে হবে। মোদ্দা কথা হচ্ছে, তোমাকে ব্যাকরণ মেনে এগুতে হবে। যা ইচ্ছে তা লেখার অধিকার তোমার আছে, কিন্তু সেটা কবিতা হলো কি না তা বিচারের ভার পাঠক এবং বিশ্লেষকের। সেখানে তুমি উওীর্ণ হতে না পারলে তোমার পারিশ্রমই বৃথা।

শাহীন :এ প্রজন্মের কবিদের সম্পর্কে আপনার ধারণা কেমন?

মাহমুদ :তারা খারাপ করছে এমন বলব না, তবে আমাদের মতো চর্চা অভিনিবেশ তাদের মধ্যে খুব কমই পরিলক্ষিত হচ্ছে। যদিও এখন আমার জানার পথ খুবই সীমিত, তবুও যেটুকু জ্ঞান অর্জন করেছি তাতে বলতে পারি, মনোযোগী হলে তাদের মধ্যেও আগামী দিনের কবিসূর্য উদিত হতে পারে।

শাহীন :আপনাদের সময়ে কবিদের মধ্যে একটা প্রীতির সম্পর্ক ছিল, এখন সেটা নেই—এতে করে কবিতা কি ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে?

মাহমুদ :কবিদের মধ্যে দ্বন্দ্ব-বিভাজন সবকালেই ছিল। নানা গোষ্ঠীতে বিভক্ত হয়েছিল তাঁদের কোলাহল। তবে আমাদের সময়ে এতটা নোংরামি ছিল না। আমরা একটা প্রতিযোগিতার মধ্য দিয়ে এগিয়েছি। আমাদের লড়াইটা ছিল কলমের। কে কত ভালো লিখতে পারবে—তার একটা প্রতিযোগিতা ছিল আমাদের মধ্যে। ঠিক পরীক্ষার মতো। আমরা ব্যক্তিগত পর্যায়ে কাউকে আক্রমণ করিনি। গোষ্ঠীচর্চা থাকলেও আমাদের মধ্যে বিভেদটা প্রকট ছিল না। একটা সৌহার্দ্য বজায় ছিল, এখন বোধহয় সেটা নেই। তার কারণ অনেক। সামাজিক রাজনৈতিক অস্থিরতা ও বিভাজন তো বটেই, শর্টকাট রাস্তায় এগিয়ে যাওয়ার নোংরা প্রবণতাকেও আমি এর জন্য বিশেষভাবে দায়ী করব।

শাহীন : বৈশ্বিক প্রেক্ষাপটে যদি বাংলা কবিতার অবস্থানকে বর্ণনা করতে বলি...

মাহমুদ :দেখ, আমাদের রাষ্ট্রভাষা আন্দোলন কিন্তু এখন আন্তর্জাতিকভাবে স্বীকৃত, কিন্তু সে তুলনায় সাহিত্যবিশ্বে বাংলাকে ভাষা হিসেবে আমরা তেমন একটা পরিচিত করে তুলতে পারিনি। আমাদের কবিরাও জোরেসোরে এ নিয়ে কথা বলেনি। আর যে মাধ্যমে এগিয়ে যাওয়া সম্ভব ছিল, সেই অনুবাদের দিকে আমরা এগিয়ে যাইনি এমনকি মৌলিক ইংরেজিতেও আমাদের সীমাবদ্ধতা রয়েছে। ভাষাকে একচেঞ্জ অর্থাত্ বিনিময় করতে হয়। আমরা সেটা পারিনি। যে কারণে আমরা বিশ্ব সাহিত্যসভায় এখনো অপরিচিত এবং অনুল্লেখযোগ্য।

শাহীন :কিন্তু আমাদের রবীন্দ্রনাথ তো নোবেল পেয়েছিলেন...


মাহমুদ :ঐ একটাই আর এটাও সত্য যে তিনি নোবেল পেয়েছিলেন ইংরেজি ভাষায় রচিত গীতাঞ্জলির জন্য। বাংলায় লেখা গীতাঞ্জলির জন্য নয়। রবীন্দ্রনাথে ভর করে বিশ্ব সাহিত্যাঙ্গনে আমাদের যেটুকু পরিচিতি, এ থেকে এখন পর্যন্ত আর কোনো উত্তরণ সম্ভব হয়নি।

শাহীন :আপনি তো ঢাকাকে বাংলা কবিতার রাজধানী বানাতে চেয়েছিলেন—

মাহমুদ :বানাতে চাইনি। ঢাকা তার নিজ যোগ্যতাতেই বাংলা কবিতার রাজধানী হিসেবে শনাক্ত হয়েছে, আমি স্পষ্ট ভাষায় সেটা উচ্চারণ করেছি মাত্র।

শাহীন :আপনার স্বপ্নের সীমানা কতটুকু?

মাহমুদ :অসীম। আমি চর্যাপদের রচয়িতার মতো কাল থেকে কালে বিচরণ করতে চাই। সময় বিলীন হবে, কিন্তু আমার বিশ্বাস আল মাহমুদের কোনো বিলয় নেই। বাংলা ভাষা যতদিন বেঁচে আছে, আল মাহমুদও ততদিন তার অংশ হয়ে বেঁচে থাকবে এবং ঘ্রাণ ছড়াবে।

শাহীন :এটাকে কি আপনার অহংকার বলে চিহ্নিত করা যায়?

মাহমুদ :না অহংকার নয়। এটা আমার বিশ্বাস। মানুষ গত হয় কিন্তু তার বিশ্বাস বেঁচে থাকে। আমার কবিতার মধ্যদিয়ে আমি যে বিশ্বাসের বীজ রোপন করে যাচ্ছি, কালের পরিক্রমায় তা আরো উজ্জ্বল হবে, জ্যোতির্ময় হবে।

শাহীন :একজন কবির জন্য শিক্ষাগত যোগ্যতার আবশ্যকীয়তা কতটুকু?

মাহমুদ :যতটুকু না হলে নয়। উচ্চতর প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষায় শিক্ষিত হলেই যে তিনি বিশাল কবি হয়ে উঠবেন এমনটি নয়। বোধ, বিশ্বাস এবং আবেগ এই তিনের সমন্বয়ে এগিয়ে যেতে হয় একজন কবিকে। তিনি প্রকৃতির পাঠশালার ছাত্র। জীবন থেকে নেওয়া উপলব্ধিগুলোকে তিনি ভাব ও ভাষায় সাজিয়ে তোলেন। উচ্চতর প্রাতিষ্ঠানিক সার্টিফিকেট নয়, একজন কবিকে প্রকৃত জ্ঞানের সার্টিফিকেট অর্জন করতে হয়। আর এর জন্য প্রয়োজন প্রচুর পড়াশোনা।

শাহীন :কবি না হলে কী হতেন?

মাহমুদ :কবি না হলে হয়তো সংগীতজ্ঞ হতাম। তোমরা জানো কি না জানি না, যে শহরে আমার জন্ম হয়েছিল, সে শহরটিকে একসময় সংগীতের শহর বলা হতো। কারণ এ শহরেই তৈরি হতো নানান ধরনের বাদ্যযন্ত্র। শহরের কারিগররা বাদ্যযন্ত্রের খোল-নলচে তৈরি করতেন। শিরিষ কাগজ দিয়ে ঘষে ঘষে আঠা লাগাতেন। আমি তাঁদের ঘরের দরজায় দাঁড়িয়ে মনোযোগ সহকারে তাঁদের কাজ দেখতাম। এই সমস্ত বাদ্যযন্ত্র কিনতে বড় বড় ওস্তাদেরা এসে হাজির হতেন এই শহরে। সে সময়ে সংগীতের প্রতি একধরনের তাড়না অনুভব করেছি হূদয়ে। যদি কবি না হতাম তাহলে মনে হয় সংগীতজ্ঞই হতাম।

শাহীন :সুরের প্রতি হূদয়ে এই তাড়না অনুভবের পরেও আপনি সংগীত রচনায় হাত দেননি...

মাহমুদ :দেখ, আমার কবিতার মূল সুর কিন্তু গীতলতা যার সাথে সংগীতের কোনো বিভাজন নেই। এটা সাহিত্যের একটি স্বভাব যা আমরা অর্জন করেছিলাম। এর মধ্যদিয়ে আধুনিকতার যে পর্যায়কে আমরা অতিক্রম করেছি তা হচ্ছে, আমরা কাব্যের যে ছন্দ এবং মিল সেখানে সংগীতকে প্রবেশ করিয়ে দিয়েছিলাম। আমরা যন্ত্রের দোলায় ছন্দের শিক্ষা গ্রহণের সময় পাইনি আর তার জন্য অপেক্ষাও করিনি এবং কাজটি যে খুব সহজ ছিল তা-ও নয়। আমরা যেটা করেছি তা আজও করছি।

শাহীন :কিন্তু কেউ কেউ যে মনে করেন, অধিকতর টিকে থাকার জন্য কবিতার পাশাপাশি সংগীত রচনাও জরুরি—

মাহমুদ :আমি মনে করি না। যদি তা-ই হতো তাহলে রবীন্দ্রনাথ এবং নজরুলকে কেউ কবি বলত না, বলত গীতিকার। সেটা যখন হয়নি তখন এ প্রসঙ্গ অবান্তর।

শাহীন :একজন কবির জীবনে প্রেমের ভূমিকা কতটুকু?

মাহমুদ :দেখ, প্রেম ছাড়া পৃথিবী অর্থহীন। আমরা যে জীবন অতিবাহিত করছি সেটা এতটা আন্তরিক এতটা সুন্দর শুধুমাত্র প্রেমের কারণে। প্রেম আছে বলেই পৃথিবীতে স্বপ্ন আছে, বেঁচে থাকার অর্থ আছে। কবি তো এই ভূমণ্ডলেরই বাসিন্দা, তাঁর সৃজনে প্রেম থাকবে এটাই তো স্বাভাবিক।

শাহীন :আপনার প্রেম...

মাহমুদ :আছে অবশ্যই আছে। একজন নারী আছে আত্মার ভেতরে আর আছে কবিতার ঘ্রাণ।

শাহীন :আপনার পূর্বসূরিদের প্রসঙ্গে জানতে চাই—

মাহমুদ :যদি প্রিয়কবি সম্পর্কে জানতে চাও তাহলে আমি প্রথমেই উচ্চারণ করব রবীন্দ্রনাথের নাম।

শাহীন :কিন্তু এ প্রজন্ম তো তাঁকে গ্রহণ করতে আগ্রহী নয়।

মাহমুদ :এটা তাদের ঔদ্ধত্য। আধুনিকতার নামে রবীন্দ্রবর্জন ফ্যাশনের অংশ হতে পারে, কিন্তু বাস্তবতা ভিন্ন। রবীন্দ্রনাথ আমাদের কবিতায় চিরকালের আধুনিক একজন। যিনি রবীন্দ্রনাথ পাঠ করেছেন, তিনি চিরকালের জন্য শিক্ষিত হয়ে গেছেন ।

শাহীন :তাহলে জীবনানন্দ দাশকে আমরা কিভাবে মূল্যায়ন করব?

মাহমুদ :সন্দেহ নেই যে জীবনানন্দ দাশ একজন আধুনিক কবি। তিনি কবিতায় একটি নতুন ধারা রচনা করে গেছেন। কিন্তু বাংলা কাব্যে প্রকৃত আধুনিকতার প্রবর্তক রবীন্দ্রনাথ, অন্য কেউ নয়। জীবনানন্দ দাশ তো তাঁকে অস্বীকার করেননি, তাহলে আমরা কেন?

শাহীন :আপনার প্রিয় কবিতা কোনটি?

মাহমুদ :আমার না অন্য কারো?

শাহীন : আপনার।

মাহমুদ :অনেক প্রিয়’র ভিড় থেকে আলাদা করে প্রিয় খোঁজা মুশকিল। নিজের সৃষ্টি সবগুলোই আমার প্রিয়। তারপরও যদি বলো, আমি সেই কিশোর কবিতাটির কথাই বলব যার নাম ‘নোলক’। এটি শুধু আমারই নয় সকল শিশু-কিশোর এমনকি আমার নাতি-নাতনিদেরও প্রিয়।

শাহীন :একাত্তরের কোন স্মৃতিটা আপনার মনে আজও ভাস্বর?

মাহমুদ :কলকাতায় ট্রামের জন্য দাঁড়িয়ে আছি, আমাকে দেখে এক বৃদ্ধা মহিলা এগিয়ে এলেন। জানতে চাইলেন, আমার দেশ কোথায়। তাঁকে পূর্ববাংলার কথা বলতেই হেসে বললেন, দেখেই বুঝতে পেরেছি। তারপর মলিন ব্যাগ খুলে আমার হাতে ক টা নোট দিয়ে বললেন, এটি তোমার দেশের শরণার্থীদের জন্য নিয়ে যাও। তাঁর আবেগ দেখে আমিও আবেগি হয়ে পড়লাম। তাঁর দু হাত ধরে বললাম, বুুড়িমা, এ টাকাটা তোমার কাছে থাক। তোমার ভালোবাসাই আমাদের জন্য যথেষ্ট। আজও মনে পড়ে সেই স্মৃতি। এরকম অজস্র ভালোবাসার ফুল ফুটেছিল বলেই আমরা সেদিন বিজয় ছিনিয়ে আনতে পেরেছি।

শাহীন :কবির ধর্ম কী?

মাহমুদ :বয়ে চলা। একজন কবি নদীর মতো বয়ে যাবেন। বাঁকে বাঁকে অভিজ্ঞতা সঞ্চয় করবেন এবং তা কবিতার মধ্যদিয়ে পাঠকের দরবারে উপস্থাপন করবেন।

শাহীন :জীবনসায়াহ্নে এসে অতীতের কোন স্মৃতিটা আপনাকে তাড়িত করে?

মাহমুদ :আমার জান্নাতবাসিনী মায়ের স্মৃতি। আহ্ তিনি আমাকে গর্ভে ধারণ করেছেন। কত কষ্ট পেয়ে আমাকে প্রসব করেছেন। তাঁর স্নেহের আঁচলের স্পর্শেই কবিতার পাঠশালায় আমার হাতেখড়ি। তিনি উপলক্ষ না হলে আমার তো এ পৃথিবীতে আসাই হতো না। আমার কবিতার প্রথম উপলব্ধি আমার মা। আজও হূদয়ে ডুব দিয়ে আমি তাঁকে আবিষ্কার করার চেষ্টা করি। তাই সেই মুখ সেই হাসি আজও আমার সংগ্রামী দিনের প্রেরণা।

শাহীন :যদি নতুন কোনো জন্মের সুযোগ থাকে তবে কোন পরিচয়ে আপনি জন্ম লাভ করতে চান?

মাহমুদ :সে সুযোগ যদিও নেই তবুও বলছি, হাজার হাজার জন্ম থাকলেও প্রতিবারই আমি কবি হয়েই জন্ম নিতে চাই।

সূত্রঃ দৈনিক ইত্তেফাক, ৩ জুন, ২০১৯

পঠিত : ৫৯৩ বার

মন্তব্য: ০