Alapon

❝হজ্জ্বের মহিমায় উদ্ভাসিত হোক জীবন❞

আলহামদুলিল্লাহ! এখন আমরা হজ্জের সমস্ত আনুষ্ঠানিকতা সরাসরি সম্প্রচারের মাধ্যমে দেখতে পারি। হজ্জের এ আনুষ্ঠানিকতাগুলো আমাদেরকে ইব্রাহীম আলায়হি ওয়াসাল্লাম এবং তার স্ত্রী বিবি হাজেরা আলায়হি ওয়াসাল্লামের জীবনের নানাবিধ ত্যাগ থেকে শিক্ষা গ্রহণের কথা স্মরণ করিয়ে দেয়। হজ্জ এর প্রসংগ আসলেই আমাদের মানসপটে ভেসে ওঠে ইব্রাহিম আলায়হি ওয়াস সাল্লামের ত্যাগের কথা, তাঁর একত্ববাদী বিশ্বাসের কথা। বিজন মরুপ্রান্তরে বিবি হাজেরা আলায়হি ওয়াসাল্লামের ক্ষুৎপিপাসায় কাতর অবস্থায় কেবল আল্লাহর উপর ভরসা করে অবিচল থাকার কথা যেনো আমাদের স্মৃতিতে জ্বলজ্বল করে। হজ্জের এই চমৎকার রীতিনীতিগুলো আমাদের ইসমাইল আলায়হি ওইয়াসাল্লামের স্মৃতি সহ আরো অনেক কিছুই মনে করিয়ে দেয়।

আপনারা প্রত্যেকে নিশ্চয়ই অবগত আছেন যে, হজ্জ ইসলামের পঞ্চম স্তম্ভ। এর ব্যাপক তাৎপর্য রয়েছে। এই মহান ইবাদাত সমাধা করার পেছনে উদ্দেশ্য যেমন রয়েছে, তেমনি ভাবে বান্দার কল্যাণ ও নিহিত রয়েছে। আল্লাহর সন্তুষ্টি অর্জন হচ্ছে হজ্জ পালনের উদ্দেশ্য। যেমনটা আমরা সবাই ই জানি, যে জীবনে অন্তত একবার হজ্জ পালন করা সব মুসলিমের জন্য ফরয (অত্যাবশ্যক)। সুবহানাল্লাহ! আমরা যদি হজ্জ নিয়ে গভীরভাবে চিন্তাভাবনা করি, তাহলে বৃহৎ পরিসরে চিন্তার খোরাক খুঁজে পাবো। সমস্ত আনুষ্ঠানিকতার দিকে দৃষ্টিপাত করলে হজ্জের মাহাত্ম্য, নিগুঢ় অর্থ সম্বন্ধে ধারণা পাওয়া যাবে।

হজ্জের মাধ্যমে দু'টি বিষয়ের প্রতিফলন ঘটে। এক. আল্লাহর মাহাত্ম্যের প্রতিফলন। তার শ্রেষ্ঠত্ব, মহিমা প্রতিষ্ঠা। দুই. নিজস্ব জীবনে এর প্রভাব।
আল্লাহ সুবহানাহু ওয়াতাআ'লা আমাদের জন্য হজ্জের সম্পূর্ণ যেই রীতিনীতি দিয়েছেন- তার মাঝে স্পষ্টভাবে আল্লাহর সার্বভৌমত্ব, তাঁর সর্বশক্তিমান সত্তার পরিচয় পাওয়া যায়। বিশ্বের আনাচে কানাচে ছড়িয়ে থাকা সকল মুসলমানেরা একত্রিত হয় কেবল একটি উদ্দেশ্যে, বুকে একটি আকাঙ্খা লালন করে। এখানে মহান আল্লাহ রব্বুল 'আলামীনের মানুষকে সৃষ্টি করার একটি চমৎকার উদ্দ্যেশ্যের বাস্তবায়ন ঘটে। এবিষয়ে আল্লাহ কোরআনে বলেন,
“ হে মানব! আমি তোমাদেরকে এক পুরুষ ও এক নারী থেকে সৃষ্টি করেছি এবং তোমাদেরকে বিভিন্ন জাতি ও গোত্রে বিভক্ত করেছি, যাতে তোমরা পরস্পর পরিচিত হও।”
[ সূরা আল হুজরাত-আয়াত-১৩ ]

আমরা প্রত্যেকেই সমান! আমাদের আদি পিতা, আদি মাতা একই! যদি আপনি হজ্জের দিকে খেয়াল করেন, তাহলে দেখতে পাবেন, মানুষে মানুষে সম্প্রীতির বন্ধনের এত বিশাল সম্মিলন আর কোথাও খুঁজে পাওয়া যাবে না। বিশ্বের নানা দিক হতে আসা অসংখ্য গোত্র, জাতি একত্রিত হয়। এর মাধ্যমে আল্লাহ আমাদেরকে সৃষ্টি করার একটি অন্যতম উদ্দেশ্যের কথা স্মরণ করিয়ে দেন। তা হচ্ছে- আমরা যেনো একে অপরের সাথে পরিচিত হতে পারি। তিনি আমাদের এজন্য সৃষ্টি করেন নি যাতে আমরা পরস্পর পরস্পরকে ঘৃণা করি! নিজেদের মাঝে জাতিগত বিদ্বেষ তৈরি করে লড়াইয়ে মেতে ওঠার জন্য আমাদের সৃষ্টি করা হয়নি। বরং নিজেদের মাঝে ভ্রাতৃত্বের বন্ধন সৃষ্টি করে সৌহার্দ্যের সাথে জীবন যাপন করতে বলা হয়েছে! আল্লাহ সুবহানাহু ওয়াতাআ'লা আমাদের মাঝে সবচেয়ে উত্তম ব্যক্তি হিসেবে অভিহিত করেছেন উত্তম চরিত্রের অধিকারীকে! আল্লাহ কিন্তু এই ঘোষণায় কোন দেশ কিংবা জাতির নামোল্লেখ করেন নি। অর্থাৎ,আল্লাহর দৃষ্টিতে সর্বোত্তম হতে হলে দেশ, জাতীয়তা, বর্ণ, সম্পদ নির্বিশেষে আপনাকে বিচার করা হবে। আল্লাহ কেবল আপনার উত্তম চরিত্র দ্বারা ই আপনাকে বিবেচনা করবেন।

যখন আমরা দেখি বিশ্বের বিভিন্ন দিক থেকে ভিন্ন ভিন্ন জাতীয়তার, ভিন্ন গোষ্ঠীর সকল মানুষ একত্রিত হচ্ছে মহান রবের সন্তুষ্টির জন্য- তখন হজ্জ আমাদেরকে মহান আল্লাহ রব্বুল 'আলামীনের শ্রেষ্ঠত্বের পরিচয় দেয়।
হজ্জ আমাদের সবাইকে এক কাতারে দাঁড় করিয়ে দেয়। যখন আপনি ইহরাম পরিধান করে তাওয়াফ করছেন, মিনায় অবস্থান করছেন- প্রত্যেকে সমান! আপনি কোন প্যাকেজে হজ্জ করতে গিয়েছেন, তা কিন্তু বিবেচ্য বিষয় নয়। আপনি টেন স্টার প্যাকেজে হজ্জ করুন, অথবা ওয়ান স্টার প্যাকেজে হজ্জ করুন- মিনা, আরাফা, মুযদালিফায় আপনি কেবল সাম্যের দেখা পাবেন৷ সামাজিক মর্যাদা অনুযায়ী সেখানে আপনাকে বিচার করা হবে না। আল্লাহর ঘরে তাওয়াফ করতে যাওয়া প্রতিটি মানুষের কেবল একটি ই পরিচয়। তারা আল্লাহর বান্দা। এই বিশাল সম্মেলন থেকে আপনি কখনোই একজন যুবরাজ, একজন রাষ্ট্রদূতকে আলাদা করতে পারবেন না। কেননা যখন ই আপনি ইহরাম পরিধান করবেন, আপনারা সকলেই সমান! ইহরাম আমাদের জন্য একটি গুরুত্বপূর্ণ রিমাইন্ডার। এটি আমাদের স্মরণ করিয়ে দেয়, এ দুনিয়ায় আমরা সকলেই সমান। যদিও মহিলারা পর্দার বিধান মেনে চলার জন্য ইহরাম হিসেবে নিত্য অভ্যাসের কাপড় পরিধান করে থাকেন। তদুপরি, তারা অনাড়ম্বর পোশাক পরিধান করেন।

কেবল পোশাকে ই সীমাবদ্ধ নয়। বরং হজ্জ আমাদের কন্ঠের একাত্মতা ও নিশ্চিত করে। প্রত্যেকে একই তালবিয়া পাঠ করে প্রভুর কাছে নিজের উপস্থিতির কথা জানান দেয়।
“ লাব্বাইক আল্ল-হুম্মা লাব্বাইক। লাব্বাইকা লা-শারীকা লাকা লাব্বাইক। ইন্নাল হামদা ওয়ান নি'মাতা লাকা ওয়াল মূলক, লা-শারীকা লাক।”
অর্থঃ 'আমি হাজির, হে আল্লাহ! আমি হাজির! তোমার কোন শরীক নেই, আমি উপস্থিত! নিশ্চয়ই যাবতীয় নিয়ামত ও প্রশংসা তোমার এবং রাজত্ব ও, তোমার কোন শরীক নেই'।
হজ্জে উপস্থিত সব মানুষের শুধুমাত্র একটি উদ্দেশ্য থাকে। তা হলো- আল্লাহর ইবাদাতের মাধ্যমে তার সন্তুষ্টি অর্জন। সুবহানাল্লাহ! আল্লাহর কাছে তাঁর বান্দার মর্যাদা কখনোই প্রতিপত্তি, সামাজিক অবস্থান দিয়ে প্রভাবিত নয়। আত্মসমর্পণকারী বান্দা ই মর্যাদাবান। কার ইবাদাত আল্লাহ কবুল করবেন তা আমরা কেউ ই জানি না।

কা'বা ঘর তৈরি করার পর আল্লাহ ইবরাহীম আলায়হি ওয়াস সালামকে মানুষের কাছে কা'বার তাওয়াফ করার আহবান জানাতে নির্দেশ জানালেন। ইবরাহীম আলায়হি ওয়াস সালাম উত্তরে বলেছিলেন, তিনি একা কীভাবে মানুষকে এই আহবান করবেন! আল্লাহ তখন আয়াত নাজিল করেন,

“ আর মানুষের নিকট হজ্জের ঘোষণা দাও, তারা তোমার কাছে আসবে পায়ে হেঁটে এবং কৃশকায় উটে চড়ে দূরের পথ পাড়ি দিয়ে।”
[ সূরা হজ্জ, আয়াত-২৭ ]

বাস্তবেও তাই হয়েছে, যার ধারা আমরা এখনো দেখতে পাই। পৃথিবীর নানা প্রান্ত হতে, ভিন্ন ভিন্ন যানবাহনে করে সকল আল্লাহর বান্দারা একত্রিত হন! সুবহানাল্লাহ! হজ্জ আমাদের স্পষ্ট রূপে মহান আল্লাহর মহিমা উপলব্ধি করায়।

হজ্জ আমাদের নিজস্ব জীবনেও শিক্ষণীয় প্রভাব ফেলে। হজ্জ আদায়ের জন্য আমাদের স্বীয় সম্পদ, সময় ত্যাগ করতে হয়। হজ্জ আমাদের ধৈর্যশীল হবার শিক্ষা দেয়। প্রতিটি রীতিনীতি, আনুষ্ঠানিকতা নিষ্ঠার সাথে পালন করা আমাদের ধৈর্য বৃদ্ধি করে। এই শিক্ষাগুলো আমাদের আচরণে পরিবর্তন আনতে ভূমিকা রাখে। আল্লাহর বিধান পালনে নিজের কোনকিছু ত্যাগ করার গুরুত্ব, ঈমানের স্বরূপ কেমন হয়, আল্লাহর নিকটবর্তী বান্দা কিভাবে হওয়া যায়- তা আমরা হজ্জের মাধ্যমে উপলব্ধি করতে পারি।

আমরা যারা হজ্জে অংশ নিয়েছি অথবা ভবিষ্যতে নিবো, তাদের জন্য এই শিক্ষাগুলো স্মরণ করিয়ে দেয়, আমাদের মানসিকতা কিরূপ হওয়া উচিত। কারণ যন্ত্রচালিত মেশিনের মতো হজ্জ আদায় করলে তা প্রকৃত হজ্জ নয়। আপনি হজ্জ করলেন, কিন্তু তা আপনার হজ্জ পরবর্তী জীবনে কোন প্রভাব ই ফেললো না। আল্লাহর সাথে মজবুত সম্পর্ক গঠনে সহায়ক হলো না! তাহলে এ কেমন হজ্জ?!
আপনাকে হজ্জের প্রতিটি রীতির গুরুত্ব অনুধাবন করতে হবে। তখন ই কেবল এই হজ্জ থেকে ব্যক্তিগত ভাবে আপনি লাভবান হতে পারবেন।

আমাদের জন্য ২য় যে শিক্ষাটি গুরুত্বপূর্ণ, তা হচ্ছে একতা, সম্প্রীতি। আগেও আলোচনা করেছি যে, হজ্জ জাতীয়তা, বর্ণ, গোষ্ঠী নির্বিশেষে আমাদের এক সারিতে দাঁড় করিয়ে দেয়। আমরা এমনকি আমাদের উম্মাহর মাঝেও দেখতে পাই, বিভিন্ন মতের মানুষ বিদ্যমান। ভিন্ন ভিন্ন মানহাজ রয়েছে। কিন্তু যখন তারা কাবার চারিপাশে তাওয়াফ করে, প্রত্যেকের একটি ই গন্তব্য! কেউ ভিন্ন পথ অবলম্বন করেনা। আরাফাহর দিনে আপনি কোন হাজী কে আরাফাহর ময়দান ব্যতীত অন্য কোথাও পাবেন না। মুজদালিফায় সবাই একত্রে ই অবস্থান করবে। কোন ভেদাভেদ থাকে না তাদের মাঝে৷ নিশ্চয়ই বুদ্ধিমান ব্যক্তির জন্য হজ্জের মাঝেই রয়েছে উত্তম নিদর্শন।

প্রকৃতপক্ষে আমাদের মাঝে মতের ভিন্নতা বা অনৈক্য হবার যে দিকগুলো রয়েছে, তার থেকেও অনেক বেশি দিক রয়েছে- যা আমাদের ঐক্যের নিদর্শন স্বরূপ! আমাদের উচিত সেই বিষয় গুলোতে বেশি ফোকাস করে পুরো উম্মাহকে কেবল ইসলামের পতাকাতলে ই নিয়ে আসা! কারণ আমরা যতো বেশি এই মতের ভিন্নতার দিকে নজর দিবো, আমাদের মাঝে ততো বেশি বিভক্তি সৃষ্টি হবে। আমরা পরস্পর থেকে দূরে সরে যাবো।

আল্লাহ চান আমরা যেনো একে অপরের সাথে পরিচিত হই। তা করতে হলে আমাদের পারস্পরিক সম্পর্ক মজবুত করতে হবে৷ যা কিছু ভিন্নতা রয়েছে, তার সমাধান করতে হবে কাছাকাছি অবস্থানের মাধ্যমে। রুক্ষতা দিয়ে নয়, বরং কোমলতা ও উত্তম নসীহতের মাধ্যমে।

সর্বশেষ রিমাইন্ডার! ইহরামের দুই টুকরো সাদা কাপড় আমাদের স্মরণ করিয়ে দেয় মৃত্যুর কথা। আমাদের সকলকে একদিন এই দু'টুকরো সাদা কাফন গায়ে জড়িয়ে ই কবরে শায়িত হতে হবে।
আমাদের সবসময় স্মরণে রাখতে হবে যে, আমরা আল্লাহর পক্ষ থেকেই এসেছি এবং একদিন তারই কাছে আমাদের ফিরে যেতে হবে। আল্লাহর কাছে আমরা চুক্তিবদ্ধ হয়ে সাক্ষ্য দিয়েছিলাম। তাকে নিজেদের একমাত্র রব হিসেবে মেনে নিয়েছিলাম। আবার একদিন এই আরাফাহর ময়দানেই শেষ বিচারের দিন মানবজাতি একত্রিত হবে, সাদা কাফন গায়ে!

আমাদের দুনিয়ার এই জীবন কতোই না সংক্ষিপ্ত! এই স্বল্প সময়ের মাঝেই আল্লাহতায়ালাকে সন্তুষ্ট করে নিজেদের আখিরাতের পাথেয় সংগ্রহ করার জন্য আমাদের সচেষ্ট হতে হবে।

আপনাদের প্রতি আমার অনুরোধ থাকবে- হজ্জ আমাদের যেসব শিক্ষা প্রদান করে, তা অনুধাবন করে নিজ জীবনে অনুশীলন করবেন।
যারা এখনো হজ্জ আদায় করতে পারেন নি, আল্লাহ তাদের হজ্জ পালনের তাওফিক দান করুন। যারা ইতোমধ্যে হজ্জ পালন করেছেন, তাদের হজ্জ আল্লাহ কবুল করে নিন।
আল্লাহ আমাদেরকে ইবরাহীম আলায়হি ওয়াসাল্লামের জীবনী থেকে শিক্ষা অর্জন করে বাস্তব জীবনে তা প্রতিফলনের তাওফিক দান করুন!
জাযাকুমুল্লাহু খাইরান।

।হজ্জ্বের মহিমায় উদ্ভাসিত হোক জীবন।
মূলঃ উস্তাদ আবু মুহাম্মদ
ভাবানুবাদঃ সাবিহা সাবা

পঠিত : ৬১৬ বার

মন্তব্য: ০