Alapon

❝কোরআন নিয়ে ভাবনা❞

যথারীতি প্রাত্যহিক অভ্যাস অনুযায়ী ফযরের স্বলাত আদায়ের পর কোরআন পাঠে মগ্ন ছিলাম।
পড়তে পড়তে সূরা আন-নহল এর ৯০ নং আয়াতে চোখ আটকে গেলো। আল্লাহ রাব্বুল আলামীন বলেছেন,
" আল্লাহ ন্যায়পরায়ণতা, ইহসান ও আত্মীয় -স্বজনদেরকে দান করার হুকুম দেন"

দেখুন, কত সুন্দরভাবে প্রকাশ করেছেন আল্লাহ!
পরিপূর্ণ দিকনির্দেশনা সম্বলিত একটি আয়াত। আমাদেরকে তিনি হুকুম দিয়ে দিয়েছেন, যেনো আমরা এই আদেশ কোনভাবেই লংঘন করার দুঃসাহস না দেখাই।

সূরা নহলের এই আয়াতটি প্রতিষ্ঠা করা গেলে সমগ্র মানব সমাজের সঠিক অবকাঠামোতে ও চরিত্রে প্রতিষ্ঠিত হওয়া নিশ্চিত করা যায়।

এই আয়াতের তাফসীর অনেক বিস্তৃত অর্থ বহন করে।

শা'বি (রহঃ), শাতিয়ির ইব্ন শাকী (রহঃ) থেকে বর্ণনা করেন, তিনি বলেনঃ "আমি আবদুল্লাহ ইবনে মাসউদ (রাঃ) কে বলতে শুনেছি যে, সমগ্র কোরআনের ব্যাপক অর্থবোধক আয়াত হচ্ছে সূরা নহলের ৯০ নং আয়াতটি" ! ( ) (১)


এই আয়াতে আল্লাহ সুবহানাহু ওয়াতাআ'লা মানব সমাজের গঠনের জন্য তিনটি দিকনির্দেশনামূলক আদেশ দিয়েছেন।

(১). আদল বা ন্যায়পরায়ণতাঃ

আমাদের প্রচলিত ভাব ধারণায় ন্যায় বলতে আমরা ইনসাফকে বুঝি। ইনসাফ এর মূল শব্দ নিসফ যার অর্থ আধাআধি বা মধ্যবর্তী। তাই এই ভিত্তিতে অধিকাংশের নিকট ন্যায় বলতে দু'জনের মাঝে অধিকারের সাম্য বজায় রাখার বিষয়ে ভাবা হয়। কিন্তু সাম্য বা সমতা সর্বত্র কাম্য নয়! এটি প্রকৃতি বিরোধী। প্রকৃতপক্ষে আদল সমতা বা সাম্য নয়, বরং ভারসাম্য দাবী করে। আদল বা ন্যায়পরায়ণতার ২ টি দিক রয়েছে।
এক. লোকেদের মাঝে অধিকার আদায় বা অধিকার বন্টনের ক্ষেত্রে ভারসাম্য বজায় রাখতে হবে।
দুই. প্রত্যেককে তার অধিকার নির্দ্বিধায় দিয়ে দিতে হবে।

সমাজের ব্যক্তিবর্গের মাঝে 'আদল' কিছু কিছু সময় অবশ্যই সাম্য চায়। যেমনঃ নাগরিক অধিকারের ক্ষেত্রে। আবার কোন দিক দিয়ে সাম্য সম্পূর্ণ আদল বিরোধী। যেমন কোন প্রতিষ্ঠানের উচ্চ পর্যায়ের ও নিম্ন পর্যায়ের কর্মচারীদের মাঝে বেতনের সাম্য । কাজেই আল্লাহ আমাকে, আপনাকে যেই হুকুম দিয়েছেন তা অধিকারের মাঝে সাম্য প্রতিষ্ঠা নয় বরং ভারসাম্য ও সমন্বয় সাধন।

(২). ইহসানঃ

ইহসান বা সদাচরণ হচ্ছে আদলের অতিরিক্ত একটি জিনিস যা আদল বা ন্যায়পরায়ণতার সৌন্দর্য আরো বৃদ্ধি করে। ইহসানের গুরুত্ব সমাজ জীবনে অনেক বেশি। আদল সমাজের ভিত্তি হলে ইহসান হবে তার সৌন্দর্য ও পূর্ণতা দানকারী। আদল সমাজকে তিক্ততা থেকে বাঁচানোর কাজ করে থাকলে ইহসান তাতে মিষ্টতার সংযোজন ঘটায়।

সদাচরণ বলতে অন্যের মর্যাদা রক্ষা করা, নিজের অধিকার আদায়ের বেলায় কিছু কমে রাজি হয়ে অন্যকে তার প্রাপ্যের চাইতে বেশি দেওয়া, সর্বাবস্থায় সহানুভূতিশীল হওয়া, ক্ষমাশীলতা প্রদর্শন, পারস্পরিক সুযোগ সুবিধা দান প্রভৃতি আচরণ গুলোকে বোঝায়।

কোন ব্যক্তি কড়ায় গন্ডায় নিজের অধিকার আদায় করছেন এবং অন্যকে শুধুমাত্র তার প্রাপ্য অধিকার ই বুঝিয়ে দিচ্ছেন, এমন হলে সমাজের মানুষের মাঝে ভালোবাসা, স্নেহ- প্রীতির বন্ধন বজায় থাকে না এবং সংঘাত না হলেও তাদের সম্পর্কের মাঝে শীতলতা থাকে। যার ফলে মানবীয় মহৎ গুণ যেমন মহানুভবতা, কৃতজ্ঞতা, ত্যাগ, আন্তরিকতা এসবের দেখা মেলেনা! কিন্তু এসকল মানবীয় গুণের বিকাশের মাধ্যমেই সামষ্টিক জীবনে সুন্দর, মাধুর্যপূর্ণ আবহ সৃষ্টি হয়।


(৩). আত্মীয় স্বজনদেরকে দান ও তাদের সাথে সদাচরণঃ

এই হুকুমের অর্থ শুধু এই নয় যে প্রত্যেকে তার আত্মীয়-স্বজনের সাথে তাদের সুখে দুঃখে ভাগীদার হবে, সদাচরণ করে বৈধ সীমানায় তাদের সাহায্য করবে। বরং এর মানে হচ্ছে এই যে, নিজের ধন- সম্পদের প্রতি শুধু তার ও তার নিজের সন্তান- সন্ততির অধিকার আছে এমনটা মনে না করে সম্পদের উপর তার আত্মীয় স্বজনদের অধিকার স্বীকার করে নেওয়া!

এখন আমাদের সমাজের আলোকে আমরা দেখে থাকি অনেক সম্পদশালী ব্যক্তি প্রচুর দান-সদকা করে থাকেন। কিন্তু তারই কোন একজন আত্মীয় অভাবের মাঝে দিন যাপন করছেন। তিনি তার কোন খোঁজ ও নেন না। ইসলাম এটি কখনোই সমর্থন করে না। বরং এদের জন্য কঠোর হুশিয়ারী রয়েছে।

আবু হুরায়রা(রাঃ) থেকে বর্ণিত। রাসূল (সাঃ) বলেনঃ " হে মুহাম্মাদের উম্মত, যিনি আমাকে সত্য বিধান দিয়ে পাঠিয়েছেন, তার শপথ করে বলছিঃ আল্লাহ তায়ালা সেই ব্যক্তির সদকা গ্রহণ করেন না, যার আত্মীয়স্বজন তার সদকার মুখাপেক্ষী, অথচ সে তাদেরকে বঞ্চিত করে অন্যদেরকে দান করে। মহান আল্লাহর শপথ করে বলছি, কিয়ামতের দিন আল্লাহ তায়ালা এ ধরণের মানুষের প্রতি দৃষ্টি দিবেন না" ।
(তাবরানী) (২)

আপনিই ভেবে দেখুন, একটি সমাজে এ বিষয় কখনোই কাম্য নয় যে কোন একজন ব্যক্তি প্রাচুর্যের মাঝে অবস্থান করে বিলাসিতা করবে এবং তারই কোন আত্মীয় মৌলিক অধিকারটুকুর অভাবে মানবেতর জীবন যাপন করবে! যদি এমনটা হয়, তবে সমাজে স্বাভাবিক জীবন যাত্রা অব্যাহত থাকে না। এবং আল্লাহতায়ালা আপনাকে এই সমস্যার এক সুন্দর সমাধান দিয়েছেন। ইসলাম আপনাকে জানিয়েছে, প্রত্যেক পরিবারের গরীব ব্যক্তিবর্গের প্রথম অধিকার থাকে সেই পরিবারের সচ্ছল ব্যক্তিবর্গের উপর। এভাবে প্রতিটি পরিবার এবং ব্যক্তি যদি সমাজের প্রতিনিধি হিসেবে নিজ নিজ পরিবারের গরীব ব্যক্তিবর্গের দায়িত্ব নিজেরাই নিয়ে নেয় তবে সেখানে কতখানি অর্থনৈতিক সচ্ছলতা বুরাজ তা করবে তা কেবল কল্পনা করে দেখুন।

আপনার, আমার নিজ গরীব আত্মীয়স্বজনকে দান করার পর এ কথা ভাবার কোন অবকাশ নেই যে, আমরা তাদের দয়া করছি। বরং এটি হচ্ছে তার অধিকার, যা সঠিকভাবে আদায় না করলে আপনাকে শাস্তির সম্মুখীন হতে হবে!
আপনার এত এত দান সদকা হয়তো কোন কাজেও আসবে না, যদি আপনার আত্মীয়স্বজনের অভাব দেখেও তাদের সাহায্য করা থেকে আপনি গাফেল থাকেন!

আবার অনেক ক্ষেত্রে দেখা যায়, আত্মীয়দের মাঝে যার সাথে মনোমালিন্য তাকে আমরা সাহায্য করা থেকে বিরত থাকি। কিন্তু হাদীসে এসেছে,

হযরত হাকীম ইবনে হিযাম বর্ণনা করেন যে, এক ব্যক্তি রাসূল (সা) কে জিজ্ঞেস করলো, কোন সদকা উত্তম? তিনি বললেন, মনে মনে শত্রুতা পোষণ করে এমন রক্ত সম্পর্কীয় আত্মীয়কে যে সদকা দেয়া হয়।
(আহমদ, তাবরানী) (৩)

কত সহজেই উত্তম সদকা করে ফেলতে পারেন। এর মাধ্যমে সদকা ও করা হলো, আত্মীয় স্বজনের প্রতি দায়িত্ব পালন ও করা হলো।

আমাদের সমাজে বিদ্যমান অসংগতি, অনাচারের কারণে সমাজের শৃঙ্খলা, ভারসাম্য আজ হুমকির মুখে। আল্লাহতায়ালা এই আয়াতের মাধ্যমে সমাজে ভারসাম্য বজায় রেখে সুন্দর সমাজ গঠনের তিনটি মূলনীতি দিয়ে দিয়েছেন আমাদের।

আল্লাহ আমাদের প্রত্যেককে এই আয়াতের শিক্ষার উপর আমল করার তাওফিক দান করুন।
ওয়ামা তাওফিকি ইল্লা বিল্লাহ।
আমীন।


তথ্যসূত্রঃ
(১) তাবারী (১৭/২৮০)
(২) আত তারগীব ওয়াত তারহীব ( খন্ড-১)
(৩) আত তারগীব ওয়াত তারহীব (খন্ড-১)

গ্রন্থ সহায়তাঃ
তাফসীর ইবনে কাসীর এবং তাফহীমুল
কুরআন।

।। কোরআন নিয়ে ভাবনা।।

~ সাবিহা সাবা

পঠিত : ৬২১ বার

মন্তব্য: ০