Alapon

ইন্ডিয়ার রাজত্ব

বাংলাদেশ সিকিম হয়ে যাচ্ছে না তো?

বাংলাদেশের অভ্যন্তরীণ সীমানায় পুরোনো মসজিদ ভেঙ্গে যখন নুতানভাবে তৈরি করা হয়, ঠিক তখনই বিএসএফ বাংলাদেশের অভ্যন্তরে প্রবেশ করে বাধা দেয়। এবং ঘনটা স্থলে তিনটি ট্যাংকার স্থাপন করে।

যাই হোক, আমরা একটু স্বাধীন দেশ সিকিমের ইতিহাস জানি। যেটা নিয়ে ভারতের দীর্ঘমেয়াদী পরিকল্পনা ছিলো।

বর্তমান উত্তর-পূর্ব ভারতের একটি অঞ্চল, ১৬৪২ সালে প্রতিষ্ঠিত একটি রাজ্য হিসাবে শুরু হয়েছিল যখন ভারতে এবং নেপালে তখনও অনেক শাসক সহ অনেক দেশীয় রাজ্য ছিল এবং বর্তমানের একত্রিত হওয়া ভারতের ইউনিয়ন এবং নেপালের দেশ তখনও সৃষ্টি হয় নি। সিকিম তখন ছিল চোগিয়াল (বা ধর্মরাজ) নামে পরিচিত একজন রাজার ছত্রছায়ায় মজবুত রাষ্ট্র হয়ে উঠেছিল এবং ১৯৭৫ সালের ১৬ই মে অবধি রাজা রাজাদের দ্বারা শাসিত একটি স্বাধীন দেশ ছিল। সিকিমের বারোজন রাজা ছিলেন; পালডেন থন্ডুপ নামগিয়াল ছিলেন স্বাধীন সিকিমের শেষ রাজা। প্রাচীন হিন্দু এবং তিব্বতিদের মধ্যে যোগাযোগ ছিল, তারপরে সপ্তদশ শতকে বৌদ্ধ রাজ্য বা চোগিয়াল প্রতিষ্ঠা হয়েছিল। তিব্বত ও ভুটান থেকে আগত আক্রমণগুলির প্রেক্ষাপটে সিকিম নিজস্ব অধিকারে একটি সংগঠিত রাষ্ট্র হিসাবে আবির্ভূত হয়েছিল, এই সময় রাজ্যটি বিভিন্ন স্তরের স্বাধীনতার ভোগ করেছিল। অষ্টাদশ শতকের গোড়ার দিকে, ব্রিটিশ সাম্রাজ্য তিব্বতের সাথে বাণিজ্যপথ স্থাপনের চেষ্টা করেছিল, যার ফলে সিকিম ১৯৪৭ সালে স্বাধীনতা অবধি ব্রিটিশ অভিযানের অধীনে ছিল। প্রথমদিকে, ১৯৭৫ সালের গণভোটের পরে ভারতের সাথে একীভূত হওয়ার আগে অবধি সিকিম একটি স্বাধীন দেশ ছিল। সিকিম ও ভারতের মধ্যে আন্তর্জাতিক চুক্তিগুলির জন্য ভারতীয় সংবিধানের অনেক বিধান পরিবর্তন করতে হয়েছিল।

১৯৪৭ সালে ব্রিটিশরা ভারত ছেড়ে যাওয়ার পূর্বে স্বাধীন রাজতন্ত্র হিসেবে সিকিমের স্বীকৃতি দিয়ে গিয়েছিল। তবে পরপরই ভারতে যোগ দেওয়ার প্রসঙ্গে সিকিমে অনুষ্ঠিত হয় গণভোট। যেখানে ভারতের বিরুদ্ধে ভোট পড়ে সবচেয়ে বেশী। ‘সিকিম স্টেট কংগ্রেস’ নামক একটি দলের বিরোধিতায় চাপে পড়ে ১৯৫০ সালে সিকিমের ১১তম চোগিয়াল থাসি নামগয়াল ভারতের সাথে একটি চুক্তি করতে বাধ্য হন। চুক্তি অনুসারে সিকিম ভারতের আশ্রিত রাজ্য হিসেবে ঘোষিত হয়।

সিকিম দখলের দীর্ঘ পরিকল্পনা ছিলো ভারতের। পঞ্চাশের দশকের শুরুতে যার আঁচ পাওয়া যায়। আশ্চর্যজনক বিষয় হলো পরিকল্পনার পিছনে শুধু ভারত নয়, ছিল পৃথিবীর দুই সাম্রাজ্যবাদী শক্তি আমেরিকা এবং ইংল্যান্ড। শুধুমাত্র চীনকে নাস্তানাবুদ করতে তারা হাত মেলায় ভারতের সাথে। ভারতের গোয়েন্দা সংস্থা ‘র’ আমেরিকার ‘সিআইএ’ এবং ব্রিটিশদের ‘এমআই সিক্স’, তারা সিকিম প্রজেক্ট বাস্তবায়নের জন্য একসাথে দিল্লি, কলকাতা, দার্জিলিং ও শিলিগুড়িতে অফিস খোলে এবং সেখান থেকে যৌথভাবে অপারেশন পরিচালনা করতে থাকে।

এর ফলে ভারতের হাতে সিকিমের নিরাপত্তা, পররাষ্ট্র ও যোগাযোগ সম্পর্কিত বিষয়গুলোর নিয়ন্ত্রণ চলে আসে, তবে অভ্যন্তরীণ বিষয়তে সিকিম ছিল স্বাধীন। ১৯৬২ সালের ভারত-চীন যুদ্ধের পর সিকিমের গুরুত্ব বেড়ে যায়। ১৯৬৪ সালে নেহরু মারা গেলে পরিস্থিতি মোড় নেয় অন্যদিকে। চোগিয়াল হন পানডেল নামগয়াল। এ সময় ভারতের প্রধানমন্ত্রী ইন্দিরা গান্ধী সর্বশক্তি নিয়োগ করেন সিকিমকে দখল করার জন্য। আর তখনই দৃশ্যপটে প্রবেশ ঘটে সিকিম ইতিহাসের খলনায়ক লেন্দুপ দর্জির।

লেন্দুপ দর্জির ও সিকিমের রাজপরিবারের মধ্যে বংশগত শত্রুতা ছিল পুরানো। লেন্দুপ রাজতন্ত্রের বিরোধী ছিলেন। ১৯৪৫ সালে লেন্দুপ ‘সিকিম প্রজামন্ডল’ নামক একটি দল গঠন করেন, যার সভাপতি ছিলেন তিনি। ১৯৫৩-১৯৫৮ সাল পর্যন্ত সিকিম স্টেট কংগ্রেসের সভাপতি হিসেবে দায়িত্ব পালন করেন। ১৯৬২ সালে সিকিমের আরো কয়েকটি দলকে একীভূত করে গঠন করেন ‘সিকিম ন্যাশনাল কংগ্রেস’। যার মূল লক্ষ্য ছিল রাজতন্ত্রের অবসান করে গণতন্ত্রের প্রচলন করা।

ভারতের ভয় ছিল সিকিম হয়তো স্বাধীনতার জন্য জাতিসংঘের কাছে আবেদন করতে পারে বা চীনের সাহায্য চাইতে পারে। এজন্য ইন্দিরা গান্ধী নিজের হাতের মুঠোয় নিয়ে আসেন লেন্দুপ দর্জিকে। ভারতীয় ইন্টেলিজেন্স থেকে সব রকমের সহায়তা দেয়া হতো লেন্দুপকে।

পিঠপিছনে ভারত ষড়যন্ত্রের জাল বিছিয়ে রাখছে তা ঘুণাক্ষরেও টের পাননি তৎকালীন চোগিয়াল পালডেন। যাদেরকে তিনি গুরু মানতেন সেই মহাত্মা গান্ধী ও পন্ডিত নেহেরুর উত্তরসূরীরাই যে তার রাজ্যে হানা দেবে, তা দুঃস্বপ্নেও ভাবতে পারেননি তিনি। অবশ্য ভারত এখানে বড় ধরণের চাল চেলেছিলো। একদিকে তারা পালডেনকে আশ্বস্ত করেছে, অন্যদিকে লেন্দুপ দর্জিকে কাজে লাগিয়েছে। চীন ভারতের বিষয়ে বারবার সতর্ক করেছিলো পালডেনকে। কিন্তু তিনি তা গুরুত্ব দেননি।

সিকিমে ১৯৭৩ সালে অনুষ্ঠিত নির্বাচনের ফলাফলে অসন্তুষ্ট হয়ে ভোট কারচুপির অভিযোগ আনে লেন্দুপের নেতৃত্বাধীন সিকিম ন্যাশনাল কংগ্রেস। দেশব্যাপী তীব্র আন্দোলন শুরু হয়। যা একসময় মোড় নেয় রাজতন্ত্রের পতন আন্দোলনে। পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে চোগিয়াল ভারত সরকারের সাহায্য চায়। ভারত সাহায্য তো করেইনি বরং তারা নতুন সংবিধান প্রণয়ন করে। এ সংবিধান অনুসারে প্রায় সব ক্ষমতাই চলে যায় নির্বাচিত প্রতিনিধিদের কাছে। ১৯৭৪ সালের নির্বাচনে লেন্দুপ দর্জি অস্বাভাবিক ব্যবধানে বিজয় লাভ করে। ৩২টি আসনের মধ্যে ৩১টি আসনেই তার দল জয়ী হয়েছিল। এতে সিকিমের প্রধানমন্ত্রী হন লেন্দুপ দর্জি। আর চোগিয়াল সাংবিধানিক প্রধান হিসেবে রয়ে যান।

১৯৭৫ সালের ২৭ মার্চ লেন্দুপ দর্জি কেবিনেট মিটিংয়ে রাজতন্ত্র বিলোপের প্রশ্নে একটি সাজানো গণভোটের আয়োজন করেন। যার ফলাফলস্বরূপ অবসান ঘটে চোগিয়াল পদের। সেই বছরের ৬ এপ্রিল ভরতীয় সেনাবাহিনী বন্দী করে পানডেলকে। সেই সাথে সিকিমের স্বাধীনতার সূর্য আজীবনের জন্য অস্তমিত হয়। এরপর সবকিছু ঘটে ভারতের ছক কষে। ভারতের নির্দেশ মতো লেন্দুপ দর্জি জাতীয় পার্লামেন্টে সিকিমকে পুরোপুরি ভারতের প্রদেশ করার অনুরোধ করেন। ২৬ এপ্রিল ১৯৭৫ ভারতের ২২তম প্রদেশ হিসেবে স্বীকৃতি পায় সিকিম।বিশ্বাসঘাতকতার ফল সবসময়ই নির্মম হয়। লেন্দুপ দর্জির বেলায়ও ভিন্ন কিছু ছিল না। ভারত তাদের স্বার্থে পুতুলের মতো ব্যবহার করেছিলো লেন্দুপকে। আর যখন প্রয়োজন মিটে গিয়েছিল তখন আস্তাকুঁড়ে ফেলে দিলো লেন্দুপকে। চার বছর লেন্দুপকে মুখ্যমন্ত্রী পদে বসিয়ে রেখে ১৯৭৯ সালে ক্ষমতাচ্যুত করা হয়। পরবর্তী দুই বছর লেন্দুপের কেটেছে দিল্লি প্রশাসনের পেছন ঘুরে। কিন্তু লাভ হয়নি। যার জন্য স্বজাতির সাথে গাদ্দারি করলেন সেই ইন্দিরা গান্ধীর সাক্ষাৎ আর মিলেনি।

অবহেলা-অযত্ন এবং নানা রকম বিড়ম্বনা ভোগ করে ১০২ বছর বয়সে কলকতায় মারা যান তিনি। সিকিমের মাটিতে শেষ আশ্রয়টুকুও আর হয়নি তাঁর৷

হ্যাঁ। ইন্ডিয়া আমাদের প্রতিবেশী। ইন্ডিয়ার সাথে আমাদের ভাল সম্পর্ক থাকবে এটাউ স্বাভাবিক। কিন্ত তা নিজের সার্বভৌমত্ব হাড়িয়ে নয়। সেটা জনগনের বিপক্ষে গিয়ে নয়।

পঠিত : ৪৮২ বার

মন্তব্য: ০