Alapon

অপপ্রচার থেকে প্রসার



নতুন করে একটি সমস্যা দেখা দিল মক্কাবাসীদের সামনে। মুহাম্মদ সা. প্রকাশ্যে ইসলাম প্রচারের কয়েক মাস অতিবাহিত হওয়ার পর এসে পড়লো হজ্জের সময়। এটা তো জানা কথা যে, আরবের বিভিন্ন এলাকা থেকে প্রতিনিধিদল এ সময় মক্কায় আসবে। এ কারণে তারা খুব বিচলিত হয়ে পড়লো। মুহাম্মদ যদি এখন সবার কাছে তার কথাগুলো পেশ করে তবে তো সবাই নতুন ধর্মে দীক্ষিত হয়ে যাবে।

তখন তারা পরিকল্পনা করলো হাজিরা মক্কায় প্রবেশ করলে তাদেরকে মুহাম্মদ সা. সম্পর্কে এমন কিছু বলবে যাতে তারা মুহাম্মদ সা. সম্পর্কে সতর্ক থাকে। মুহাম্মদ সা.-এর তাবলীগ তাদের ওপর প্রভাব তৈরি না করে। তারা অনেক চিন্তা করলো কিন্তু সমাধানে আসতে পারলো না। অতএব তারা সেসময়ের একজন পণ্ডিত ব্যক্তি ওয়ালিদ ইবনে মুগিরার কাছে গেল।

ওয়ালিদ বললো, প্রথমে তোমরা সবাই এই বিষয়ে একমত হবে। নিজেদের মধ্যে মতপার্থক্য করবে না। একজনের কথা অন্যজন মিথ্যা বলে উড়িয়ে দেবে, এমন যেন না হয়। এজন্য আগে ঠিক করা হবে আমরা হাজিদের কী বলবো। তারপর আমরা সবাই তা প্রচার করবো। একেকজন একেকভাবে প্রচার করলে হাজিরা আমাদের কথা বিশ্বাস করবে না। অতএব আমরা কী বলবো তা নির্ধারণ করবো।

তখন সবাই বললো, আপনি ঠিক করে দিন, আমরা কী বলবো?
ওয়ালিদ বলবো, প্রথমে তোমরা বলো, আমি শুনি। পরে সেখান থেকে একটা সিদ্ধান্তে আসা যাবে।

এরপর কয়েকজন বললো, আমরা বলব যে, তিনি একজন জ্যোতিষী।

ওয়ালিদ বললো, না তিনি জ্যোতিষী নন, আমি জ্যোতিষীদের দেখেছি, তার মধ্যে জ্যোতিষীদের মতো বৈশিষ্ট্য নেই, জ্যোতিষীরা যেভাবে অন্তঃসারশূন্য কথা বলে থাকে তিনি সেভাবে বলেন না।

এরপর আরেকজন বললো, তাহলে আমরা বলব যে, তিনি একজন পাগল।

ওয়ালিদ বললো, না তিনি পাগলও নন। আমি পাগলও দেখেছি, পাগলের প্রকৃতিও দেখেছি। তিনি পাগলের মতো আচরণও করেন না পাগলের মতো উল্টাপাল্টা কথাও বলেন না।

লোকেরা বললো, তাহলে আমরা বলব যে, তিনি একজন কবি।

ওয়ালিদ বললো, তিনি কবিও নন। কবিত্বের বিভিন্ন রকম আমার জানা আছে। তার কথা কবিতা নয়।

কেউ কেউ বললো, তাহলে আমরা বলব যে, তিনি একজন যাদুকর।

ওয়ালিদ বললো, না তিনি যাদুকরও নন। আমি যাদুকর এবং তাদের যাদু দেখেছি। তিনি ঝাড়ফুঁক করেননা এবং যাদু-টোনাও করেননা।

এরপর সকলে মিলে বললো, তাহলে আমরা কী বলবো হাজিদেরকে?

ওয়ালিদ বললো, আল্লাহর শপথ তার কথা বড় মিষ্টি। তার কথার তাৎপর্য অনেক গভীরতাপূর্ন। তোমরা উপরোক্ত যে কথাই বলবে শ্রোতাদেরকে, তারা যখন মুহাম্মদের কথা শুনবে তখন সবাই তোমাদের মিথ্যা মনে করবে।

তবে তার সম্পর্কে শুধু একথাই বলতে পারো যে, মুহাম্মদ একজন যাদুকর। সে যেসব কথা তা শুনতে খুবই ভালো শোনায়, সবাই মুগ্ধ হয়। তবে তার কথা শোনার পর পিতা পুত্রের মধ্যে, ভাই ভাইয়ের মধ্যে, স্বামী স্ত্রীর মধ্যে এবং বিভিন্ন গোত্রের মধ্যে ফাসাদ তৈরি হয়। একে অপরের শত্রু হয়ে যায়। মুহাম্মদ যা বলে এগুলো মোটেই আল্লাহর পাঠানো কথা নয়। এগুলো মানুষের বানানো কথা।

ওয়ালিদ ইবনে মুগিরার কথা সবার পছন্দ হলো। সবাই সিদ্ধান্ত নিল হাজিরা মুহাম্মদের দেখা পাওয়ার আগেই তাদেরকে মুহাম্মদের ব্যাপারে সতর্ক করে দেওয়া হবে।

কোনো কোনো বর্ণনায় একথাও উল্লেখ রয়েছে যে, ওয়ালিদ যখন লোকদের সব কথা প্রত্যাখ্যান করলো তখন তারা বললো, তাহলে আপনি সুচিন্তিত মতামত পেশ করুন। এ কথা শুনে ওয়ালিদ বললো, আমাকে একটুখানি চিন্তা করার সময় দাও। কিছুক্ষণ চিন্তা করার পর ওয়ালিদ উপরোক্ত মন্তব্য করেছিল।

যাই হোক, মুশরিকদের এই সিদ্ধান্তে মুহাম্মদ সা. ভেবে পাচ্ছিলেন না কী পদক্ষেপ গ্রহণ করবেন! মুসলিমরা অত্যন্ত কষ্ট পেল কুরাইশদের এই আচরণে। এই ঘটনা আল্লাহ তায়ালা সূরা মুদ্দাসসিরে উল্লেখ করেছেন ১৮ থেকে ২৬ নং আয়াতে। আল্লাহ তায়ালা ওয়ালিদ সম্পর্কে বলেন,

//সে চিন্তা ভাবনা করল এবং সিদ্ধান্ত গ্রহণ করল। অতঃপর সে ধ্বংস হোক! কীভাবে সে সিদ্ধান্ত গ্রহণ করল? তারপর সে ধ্বংস হোক! কীভাবে সে সিদ্ধান্ত গ্রহণ করল? তারপর সে তাকাল। তারপর সে ভ্রূকুঞ্চিত করল এবং মুখ বিকৃত করল। তারপর সে পিছনে ফিরল এবং অহংকার করল। অতঃপর সে বলল, ‘এ তো লোক পরম্পরায়প্রাপ্ত যাদু ছাড়া আর কিছুই নয়’। ‘এটা তো মানুষের কথামাত্র’। অচিরেই আমি তাকে জাহান্নামের আগুনে প্রবেশ করাব।//

মক্কার মুশরিকরা সিদ্ধান্ত নেওয়ার পর এ সিদ্ধান্ত বাস্তবায়নের উদ্যোগ গ্রহণ করলো। মুশরিকরা দলবদ্ধ হয়ে হ্জ্জ যাত্রীদের আসার বিভিন্ন পথে অবস্থান নেয় এবং নবী মুহাম্মদ সা. সম্পর্কে হাজিদের সতর্ক করে।

এ কাজে সবার প্রথম ছিল আবু লাহাব। হজ্জের সময়ে সে হজ্জ-যাত্রীদের ডেরায়, ওকায, মাজনা এবং যুল মায়াযের বাজারে প্রচারণা চালায়। এছাড়া সে মুহাম্মদ সা.-এর পেছনে লেগে থাকে। নবী সা. আল্লাহর দ্বীনের তাবলীগ করেন আর আবু লাহাব পেছনে থেকে বলে, তোমরা ওর কথা শুনবে না, সে হচ্ছে মিথ্যাবাদী, বিদয়াতী এবং বেদ্বীন।

মুশরিকরা তাদের ষড়যন্ত্র করে। ইসলামের ক্ষতি করাই হয় তাদের পরিকল্পনার বেসিক উদ্দেশ্য। কিন্তু আল্লাহর পরিকল্পনা থাকে অন্যরকম। হজ্বের আগে মুহাম্মদ সা.-এর চিন্তা করছিলেন কীভাবে এতো মানুষের কাছে তিনি পৌঁছবেন! কেউ তার কথার গুরুত্ব দিবে কিনা এই নিয়েও তিনি সন্দিহান ছিলেন। এতো মানুষের কাছে একা পৌঁছানো প্রায় দুঃসাধ্য ছিল।

অথচ মুশরিকরা তাঁর এই কাজকে সহজ করে দিয়েছিল। তাদের ছুটোছুটি, তোড়জোড় ও সতর্ক করার ফলে হাজিরা মুহাম্মদ সা.-কে খুবই গুরুত্বপূর্ণ মনে করলেন। অনেকেই মুহাম্মদ সা.-কে দেখতে এলেন। কেউ কেউ কথা বললেন ও শুনলেন। মোটকথা হজ্জ যাত্রীরা সবাই জানতে পারলো যে, মক্কায় মুহাম্মদ নামে এক ব্যক্তি নবুয়্যতের দাবি করেছে। তার কথা খুবই হৃদয়গ্রাহী ও আকর্ষণীয়।

প্রকাশ্য দাওয়াতের ১ম বছরেই সারা আরবে ও আরবের বাইরেও কিছু কিছু এলাকায় খবর পৌঁছে গেল শেষ নবী মুহাম্মদ সা.-এর আগমন হয়েছে।

পঠিত : ৬৮২ বার

মন্তব্য: ০