Alapon

|| তারা : বদলে দিয়েছে বদলে গিয়েছে-০৩ ||




কোনো ক্রমেই আল্লাহর নবি ( স্বল্লালাহু আলাহি ওয়াসাল্লাম) তার কোনো খোঁজ খবর পাচ্ছেন না।
চতুর্দিকে হন্য হয়ে খুঁজেই যাচ্ছেন। খুঁজেই যাচ্ছেন। সাহাবায়ে আজমাইনও এদিক-ওদিক খুঁজে খুঁজে হয়রান। নাহ, কোথাও আর তার দেখা পাওয়া যাচ্ছে না।

একসময় খুঁজতে খুঁজতে সাহাবায়ে আজমাইন চলেন গেলেন মক্কা-মদীনার সীমান্তবর্তী এলাকায়। সেখানে সাহাবায়ে আজমাইন কিছু বেদুইনের সাথে দেখা হয়। তাদেরকে আসহাবে রাসুলগণ নাম পরিচয়সহ জিজ্ঞেস করেছেন তার কথা। তারা জানালো উক্ত নামে কাউকেই তারা চিনে না, জানে না। কিন্তু একটা বালককে অনেকদিন যাবত ওই পাহাড়ে দেখা যাচ্ছে। বালকটি সারাদিন শুধু কাঁদতে থাকে। কাঁদতেই থাকে। তারা বললো, আমরা তাকে প্রতিদিন খাবারের জন্য একবাটি দুধ দিই, বালকটি সেই যে দুধের বাটি, সেই দুধের বাটিতে চুমুক দেয় আর কান্না করে। ভীষণ কান্না। প্রতিটা চুমুকের সময় তার চোখের পানি টুপটুপ করে পড়ে সাদা দুধের সাথে মিশে যায়, তবুও সেদিকে তার খেয়াল থাকে না। চল্লিশ দিন যাবৎ বেহুঁশের মতো ছেলেটা এখানে বসে বসে কাঁদছে। অবশেষে সাহাবায়ে আজমাইন পাহাড়ের কাছে গিয়ে দেখতে পেলেন তাকে। এবং চিনতেও পারলেন।
সাহাবায়ে কেরাম তাকে একপ্রকার জোর করেই মদিনাতুল মুনাওয়ারায় ফিরিয়ে আনলেন । একদম দুর্বল হয়ে পড়েছে সে। মদিনায় ফিরে তিনি মহানবী স্বল্লালাহু আলাহি ওয়াসাল্লামের কাছে প্রশ্ন করে, ‘আল্লাহ রাব্বুল আলামীন কি এমন কোনো আয়াত নাযিল করেছেন যেখানে বলা হয়েছে আমি মুনাফিক্ব?’

নবিজী (স্বল্লালাহু আলাহি ওয়াসাল্লাম) তার দুর্বল মাথাটা নিজ কোলের ওপর রাখলেন, আর বললেন - না। সেই ছোট্ট কিশোর সাহাবী কাঁদতে কাঁদতে বললেন, ‘হে রাসুল (স্বল্লালাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম), আমি গুনাহগার। আমার মতো গুনাহগারের মাথা আপনার কোল থেকে সরিয়ে দিন। প্রিয় নবিজী স্বল্লালাহু আলাহি ওয়াসাল্লাম তাকে বললেন ; আল্লাহর রহমত ও দয়ার উপর ভরসা করো।

কিছু সময় অতিক্রান্ত হোলো এভাবেই। তিনি তখনও ক্রন্দন করে যাচ্ছেন। সেই অবস্থায়ই বলে ওঠলেন, ‘হে প্রিয় রাসুল ( সল্লাল্লাহু অা'লাইহি ওয়াসাল্লাম )। আমার মনে হচ্ছে যেনো আমার হাড় আর মাংসের মাঝখান দিয়ে পিঁপড়া হেঁটে যাচ্ছে।’ রাসুলুল্লাহ সল্লাল্লাহু অা'লাইহি ওয়াসাল্লাম যা বুঝার বুঝে ফেললেন। আর তাকেও বললেন, ‘ওটা হল মৃত্যুর ফেরেশতা। তোমার সময় ফুরিয়ে এসেছে। তুমি শাহাদাহ পাঠ করো। তিনিও পাঠ করতে থাকলেন। এভাবে শাহাদাহ পাঠরত অবস্থায় তার দুর্বল-পরিশ্রান্ত দেহে থেকে প্রাণবায়ুটি বের হয়ে গেলো। ঢলে পড়লেন তিনি মৃত্যু-কোলে।

হ্যাঁ, ইনিই হলেন সেই কিশোর সাহাবী থালাবা রাদ্বিয়াল্লাহু আনহু। সবে ষোলো বছর বয়স তার। এই ছোট্ট বয়সেও তিনি আল্লাহর হাবিবের বাণী সমূহ মানুষের ধারে ধারে পৌঁছে দিতে লাগলেন। সেদিনও উদাস-আনমনা হয়ে মদিনার রাজপথ ধরে হাটছিলেন। ছুটন্ত-চঞ্চল এখনো তিনি। হবেই না বস কেনো! মাত্র তো ১৬ বছর বয়স তার। সেই চঞ্চলতা নিয়ে মদিনার রাস্তা ধরে হাটা অবস্থায় তার দৃষ্টি চলে গেলো একটি গোসলখানায়। একজন মহিলা গোসলরত। থা’লাবার চোখ গিয়ে পড়লো সেখানে -গোসলরত মহিলাটির দিকে। দৃষ্টিটা তিনি সাথে সাথেই নামিয়ে নিলেন। কিন্তু তার মন ছেয়ে গেলো ভীষণ বিষণ্ণতায়। গভীর অপরাধবোধে ভরে গেলো হৃদয় তার। মনে মনে ভাবলেন, ‘ আল্লাহর রাসুলের সাহাবা হয়ে কীভাবে আমি এতোটা অপ্রীতিকর কাজ করলাম? এই ঘটনার পর ভীষণ লজ্জা ও বিষণ্ণ বিষাদ ওনাকে এতোটাই গ্রাস করলো যে, তিনি হারিয়ে গেলেন লোক চক্ষুর আড়ালে। আল্লাহর রাসুল স্বল্লালাহু আলাহি ওয়াসাল্লামের সমুখে যাবার শক্তি তিনি হারিয়ে ফেলেছেন। এরপরের কাহিনি তো শুরুতেই বলা হোলো।

এখন দেখুন, যে সমাযে যে-ই সে-ই স্থানে, যার তার সাথে সেক্স ছিলো খুবই স্বাভাবিক একটা বিষয়। এক কথায় অবাধ যৌনতার কোলাহল ছিলো যে সমাজে, নারী স্রেফ একটুকরো ভোগ্য মাংসপিণ্ড ছাড়া আর কিছুই ছিলো না যাদের নিকট। সেই সময় সেই সমাজেও শুধু একটিবার অসচেতনভাবে গোসলরত একজন নারীর দেহ তার চক্ষু অবলোকন হওয়ায় তার সে-কি অনুসূচনা, সে-কি আফসোস! শুধু একটি যে আফসোসের অনলে পুড়ে পুড়ে অবশেষে আশ্রয় নিলো মৃত্যু কোলে। কী বিষ্ময়করভাবে তারা বদলে গেলো। কী বিষ্ময়করভাবেই না ইসলামের পরশে, আল্লাহর রাসুলের দারসে সেই সমাজ এবং সমাজের মানুষগুলো বদলে গেলো! তাই না? এতো এতো কঠিন করেই বদলে গিয়েছে যে, শুধু একটি অসেচতন দৃষ্টির কারণে যে পরিমাণ চখের জল ঝরিয়েছে যে, তা দিয়ে তো হয়তো ছোটো খাটো একটা নদীও হয়ে যেতো!


তার সেই চোখের জল, তার সেই আফসোস, তার এই অনুপম অনুসূচনা আল্লাহর কাছে এতোটাই গ্রহণযোগ্য হয়েছে যে, আরশের মালিক তার জানাযায় পাঠালেন অগণিত ফেরেশতার দল। যে কারণে মহানবী স্বল্লালাহু আলাহি ওয়াসাল্লামকে গোসল করিয়ে জানাজার পর কবর দিতে পা টিপে টিপে অনেক সাবধানে এগিয়ে যেতে হয়েছিলো। ঠিকমত হাঁটতেও পারছিলেন না তিনি।

আল্লাহর রাসুলকে তো উমার ইবনুল খত্তাব রাদ্বিয়াল্লাহু আনহু অবাক হয়ে জিজ্ঞেসও করে ফেলেছেন যে, হে আল্লাহর রাসুল! আপনি এমন করে হাঁটছেন কেনো? রাস্তায় তো জায়গা কম নেই। কতো রাস্তা খালি পড়ে রয়েছে। আপনি আরাম করে চলেন; জবাবে আল্লাহর রাসুল স্বল্লালাহু আলাহি ওয়াসাল্লাম বললেন, ‘হে উমর, আমাকে অনেক বেশি সাবধানে ক্বদম ফেলতে হচ্ছে। সারাটা রাস্তাজুড়ে শুধু ফেরেশতা আর ফেরেশতা। তাদের দ্বারা ভরে গেছে পুরো রোড। তিনি কসম করে বললেন, এই থা’লাবার জন্য এতো এতো এতো বেশি ফেরেশতা নেমে এসেছে যে আমি ঠিকমত হাঁটার মতো জায়গাটুকুনও পাচ্ছি না’।

আজ আমরা অবারিত অন্যায়ের আঙ্গিনায় হেটে হেটে জীবন-যৌবন নিঃশেষ করে দিই, কিন্তু তবুও আমি এবং আমরা থাকি নির্বিকার। হাঁটা-চলায় তো ইচ্ছেয় হোক কিংবা অনিচ্ছায়; আমরা নানান বাজে দৃশ্যের মুখোমুখি হই। আর যারা এককাঠি বেশি সরেশ তারা তো ইচ্ছেকৃতই দেখে। তাদের বাজে দৃষ্টির বিষাক্ত তীর থেকে তো কোনো নারীই রেহাই পায় না, রাস্তা-ঘাটে, হাটে-মাঠে, পাড়া-মহল্লায় চোখ বাকিয়ে, দৃষ্টি পাকিয়ে হিংস্র দৃষ্টিতে খুঁজে ফেরে নারীর বুক, পেটের ভাজ ইত্যাদি ইত্যাদি। আর যারা নিপাট ভদ্দরলোক, তারা এতোটা সাহসের অধিকারী না হলেও কিন্তু অন্ধকারে একলা রুমে, কম্বলের নিচে খাটের ওপরে হারিয়ে যায় নিষিদ্ধ নীল জগতে। নীল জগতের নষ্টা নারীদেহের ভাজে ভাজে হারিয়ে ফেলা হয় আল্লাহর দেওয়া মহান নিয়ামত চক্ষু দুটোকে।

|| তারা : বদলে দিয়েছে বদলে গিয়েছে-০৩ ||
~রেদওয়ান রাওয়াহা

পঠিত : ৬৬৭ বার

মন্তব্য: ০