Alapon

দুখের মাঝে সুখের পরশ...



যুক্তরাষ্ট্রের হার্ভার্ড বিজনেস স্কুলকে ধরা হয় পৃথিবীর সবচেয়ে লোভনীয় শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানগুলোর একটি হিসেবে। সেখানে পড়তে পারাটা যে কোনো ছাত্রের জন্যই গর্বের ব্যাপার। কিন্তু সেখানে চান্স পাওয়া মোটেই সহজ কোনো কর্ম নয়। প্রতি বছর ১০ হাজার শিক্ষার্থী বিজনেস গ্রাজুয়েট হবার জন্য আবেদন করলেও চান্স পায় মাত্র ১ শতাংশ শিক্ষার্থী। সেখানকার এমবিএ শিক্ষার্থীদের জন্য প্রতি পাঁচ বছর পর পর পুনর্মিলনীর আয়োজন করা হয়। গ্রাজুয়েট হয়ে বের হবার পাঁচ বছর পর এক পুনর্মিলনী অনুষ্ঠানে সবাই একত্রিত হলো। সবার মধ্যেই অন্তহীন উচ্ছ্বাস। প্রত্যেকেই বড় প্রতিষ্ঠানের বড় বড় পদবিতে নিয়োগ পেয়েছে। অঢেল উপার্জন, দামি গাড়ি, বাড়ি আর সঙ্গে সিনেমার নায়ক বা নায়িকাদের মতো দেখতে সুদর্শন বা সুদর্শনা জীবনসঙ্গী।

সবার সুখময় জীবন—যেমনটি হওয়ার কথা ছিলো। কিন্তু পরবর্তী ১০, ১৫, ২০ এবং ২৫তম পুনর্মিলনীতে ব্যাপারটা অন্য রকম হয়ে গেলো। জরিপ চালিয়ে দেখা গেলো, তাদের প্রত্যেকেই কোনো না কোনো দিক থেকে জীবনে ভীষণরকম অসুখী। অনেকেরই বিবাহবিচ্ছেদ হয়েছে। কেউ কেউ আবার বিয়ে করেছে। শারীরিক দূরত্বের কারণে সন্তানদের সঙ্গে বছরে একবারের বেশি দেখা হয় না। কোনো কোনো বন্ধু আবার দুর্নীতির মামলায় জেল খাটছে। কিন্তু হার্ভার্ডে থাকাকালীন তাঁরা প্রত্যেকেই ছিলো অসম্ভব মেধাবী, নৈতিক ও সুহৃদ।

সুশান্ত সিং রাজপুত। এমনিতেই সুশান্ত শব্দটি শ্রুতিমধুর, সাথে ধর্মীয় ও রাজকীয় উপাধি মিলে এক কথায় বর্ণাঢ্য। মাত্র ৩৪ বছরের সংক্ষিপ্ত জীবনে সে ১২টি ছবি এবং ৪টি টিভি-সিরিয়াল করে প্রায় ৬০ কোটি রুপি আয় করে। তার দৃশ্যমান পাঁচজন গার্লফ্রেন্ড ছিলো। ছিলো চাঁদে কেনা এক টুকরো জমিও। কিন্তু ছিলো না ছোট্ট একটি শব্দ- ‘শান্তি’। জনপ্রিয় এ বলিউড অভিনেতার মৃত্যু নিয়ে মুম্বাই পুলিশকে দেয়া ভাষ্যে তারই দুই চিকিৎসক জানিয়েছেন, সুশান্ত বাইপোলার ডিজ-অর্ডারে ভুগছিলো। সাথে ছিলো অসম্ভব দুশ্চিন্তা-অনিদ্রাসহ একগুচ্ছ মানসিক অসুখ। সে ঔষুধ নেয়া বন্ধ করে দিয়েছিলো এবং বলতো যে, তার সমস্যার সমাধান কোনো দিনই হবে না। ‘বেঁচে থাকার ইচ্ছা নেই’ চিকিৎসকদের এটিও জানিয়েছিলো সুশান্ত।

শুধু সুশান্ত নয়, গত ১০ বছরে ১২ জন বলিউড ফিল্মস্টার আত্মহত্যা করেন। ঢালিউডে কিছুটা কম হলেও হলিউডে নিজকে হত্যার হার আরো ভয়াবহ। এরও আগে পপ বিশ্বের রাজপুত্র খ্যাত মাইকেল জ্যাকসন মাত্র হাফ সেঞ্চুরিতে এবং তার শ্বশুর এলভিস প্রিসলী নিজেদের মৃত্যুর সীমান্তে নিয়ে যান প্রচুর ব্যথানাশক ঔষধ খেয়ে। খ্যাতির মোহে জ্যাকসন প্রায় শতবার নিজের চেহারায় প্লাস্টিক সার্জারি করেন। এলভিস প্রিসলি ২০ মাসে প্রায় ১২ হাজার ব্যথানাশক পিল সেবন করেন। দূরবর্তী কোথাও গেলে ঔষধের একটি সুটকেস তার সাথে থাকতোই।

বিশ্ববিখ্যাত মার্কিন লেখক আর্নেস্ট হেমিংওয়ে (১৮৯৯-১৯৬১) সাগরের সাথে এক সংগ্রামী বৃদ্ধের বিজয়ের কাহিনী নিয়ে তাঁর বিখ্যাত বই ‘দ্য ওল্ড ম্যান অ্যান্ড দ্য সী’ লিখে পৃথিবীর শীর্ষ দুই পুরস্কার পুলিৎজার ও নোবেল প্রাইজ পান। কিন্তু মাত্র সাত বছরের মাথায়ই আত্মহত্যা করে সবাইকে হতাশ করেন। জাপানের প্রথম নোবেল পাওয়া সাহিত্যিক আর্নেস্ট হেমিংওয়ের মতো একই বছরে জন্ম নেয়া ইয়াসোনারি কাওয়াবাতা (১৮৯৯-১৯৭২) পুরস্কার প্রাপ্তির মাত্র সাড়ে তিন বছরের মাথায় আত্মহত্যা করেন।

কিন্তু কি সেই জিনিস, যার অভাব তাদেরকে সুখ দিতে পারে নি? হ্যাঁ প্রিয় পাঠক, জিনিসটির নাম প্রার্থনা। রাসূল (সা.) তাঁর শত ব্যস্ততার ভেতরও প্রতিদিন কমপক্ষে ৬ থেকে ৮ ঘণ্টা আল্লাহর ইবাদতে কাটাতেন। তিনি পেয়েছিলেন এক শান্তিময় জীবন। তাঁর প্রচারিত আদর্শের নামও শান্তি। সত্যি বলতে, সম্পদ কিংবা খ্যাতির মোহ নয়, এই প্রবল অশান্তিতে তলিয়ে যাওয়া মানুষগুলোকে শান্তি দিতে পারতো কেবলই প্রার্থনা। মাইকেল এইচ হার্ট তাঁর ১০ বছরব্যাপী গবেষণালব্ধ বই ‘ দ্য হান্ড্রেড’ এ লিখেছেন, “মুহাম্মদই পৃথিবীর শ্রেষ্ঠ মানুষ কারণ, তিনি জাগতিক ও পারলৌকিক উভয় জগতেই চূড়ান্তভাবে সফল হয়েছেন।”

বিশ্বের এই শ্রেষ্ঠ মানব রাসূল (সা.)-এর জীবনে আমরা দেখতে পাই- কী কঠিন পরিস্থিতি কত সহজভাবে তিনি ম্যানেজ করেছেন! এমনকি বদর যুদ্ধের সেই কঠিন মুহূর্তেও; যখন তিন গুণ বিশাল কাফের সৈন্যরা হামলে পড়েছে দুনিয়ার বুক থেকে তাঁদের চিরতরে মুছে দিতে, রাসূল (সা.) মুসলিমদের যুদ্ধের ময়দানে রেখেই আল্লাহর কাছে প্রার্থনায় বসে গেলেন। আল্লাহ তাঁকে দিলেন চূড়ান্ত বিজয়। রাসূল (সা.)-এর এই চূড়ান্ত সাফল্যের পেছনে অন্যতম কারণ হিসেবে পাওয়া যায় তাঁর প্রার্থনার শক্তি। এমনকি বৈজ্ঞানিক থেকে রাজনীতিবিদ সবাই সাফল্যের জন্য এই প্রার্থনার শক্তিকে কাজে লাগিয়েছেন।

অথচ বিশ্ব মানবতার মুক্তি আন্দোলনের সিপাহসালারের জীবন সায়াহ্নে একমাত্র সম্পদ ছিলো কয়েকটি মুদ্রা, যার কিছু অংশ দিয়ে তাঁর দেনা শোধ করেছিলেন এবং বাকি অংশ তাঁর দ্বারে আগত এক অভাবী লোককে দেয়া হয়েছিলো। যে কাপড় পরিধানে তিনি শেষ নিঃশ্বাস ত্যাগ করেছিলেন তাতে ছিলো অনেক জোড়াতালি। যে ঘরটি থেকে সারা বিশ্বে আলো ছড়িয়ে গেছেন, সে ঘরটিই ছিল সেদিন অন্ধকার। কারণ তাঁর ঘরের বাতিতে তেল ছিলো না। আকাশের মতো বিশাল বিশ্বাসের সামিয়ানা তিনি তৈরি করেছিলেন। সাগরের মতোই ভালোবাসার উচ্ছ্বাস তিনি মানবতাকে দিয়েছিলেন। প্রশান্তি চাইলে সেই সামিয়ানায় আশ্রয় এবং সেই সাগরে অবগাহন করতেই হবে। নচেৎ আর কোথা পাবো এমন সুখের কল্লোলিত আজদাহা প্রবাহ? আর কোথা?

- মু. লাবিব আহসান

পঠিত : ২৪৭ বার

মন্তব্য: ০