Alapon

একটি জ্যোৎস্না রাত!

মধ্যরাত। আমি স্কুল মাঠের চারদিকে হাটছি। হাটতে কেন জানি ভীষণ ভালো লাগছে। ভালো লাগার কারণ অবশ্য অজানা নয়। জ্যোৎস্না। রাতটি ছিল জ্যোৎস্নায় ভরা। খালি পায়ে শিশির ভেজা ঘাসে হাটতে আর চাঁদের সৌন্দর্য অবলোকন করতে মন্দ লাগছিল না।


আচমকা, প্রচন্ড পাওয়ারি একটি আলো আমার চোখে এসে বিধল। আলোর সাথে সাথে ওপাশ থেকে ভেসে আসতে লাগল, ‘কে? কে ওখানে? তোমার সাহস তো কম না, এতো রাতে স্কুলে ঠুকছো। দাঁড়াও তোমাকে পুলিশে দিব।’


তার কথাগুলো শুনে আমার কেন জানি মজা লাগল। সে আমার কাছাকাছি আসতেই প্রচন্ড পাওয়ারি টর্চটা বন্ধ করে দিল। দির্ঘক্ষন প্রচন্ড আলোর দিকে তাকিয়ে থাকার কারণেই হয়তো সামনে আর কিচ্ছু দেখতে পাচ্ছিলাম না। আমার কাছাকাছি আসতেই বলল, ‘ও বাবু! আজও বুঝি ঘুমানোর জায়গা পাও নি। তুমি আমার বিছানায় ঘুমাও, আজ আর আমি ঘুমাবো না’।



লোকটি আমাদের স্কুলের নাইটগার্ড। তাকে বারবার আমার পূর্ণনাম বলার পরও তিনি কি কারণে যেন আমাকে বাবু বলে ডাকতেন। জাতের দিক থেকে ওনারা ছিলেন সাঁওতাল। ওনাদের সাঁওতাল পাড়ার মানুষরাও আমাকে বাবু বলেই ডাকত। 
তাকে বললাম, ‘ঘুমানোর জায়গা পাই নি, এটা সত্য। কিন্তু আজ তো ‍ঘুমানো যাবে না। আজ ঘুমালে জ্যোৎস্নাকে অপমান করা হবে। জুতোটা খুলেন এবং খালি পায়ে হাটেন। দেখবেন বিরাট আনন্দ লাগছে।’


সে কিছুদূর পর সত্য সত্যই জুতো গুলো খুলে হাতে নিয়ে, হাটতে শুরু করলেন। তারপর ওভাবেই পুরো স্কুল জুড়ে ‘হুশিয়ার! সাবধান!’ বুলি আওড়াতে লাগলেন।


আমার ইচ্ছাছিল, কোন একদিন স্কুলের অতিকায় প্রকান্ড বটগাছটির বুকে বসে জ্যোৎস্না দেখব। আমি হাটতে হাটতে বটগাছটির দিকে এগুলো লাগলাম আর মনে মনে হাসতে লাগলাম। ছোটবেলায় এই বটগাছটিকেই বিরাট ভয় পেতাম। মাগরিবের সময় এদিকে বল চলে আসলে, বলের আশাই বাদ দিতাম। বলতাম, ‘বল গেলে বল পাওয়া যাবে কিন্তু ঘাড় গেলে ঘাড় পাওয়া যাবে না। বটগাছে ভূত আছে। নিচে গেলেই মড়াৎ। ঘাড় মটকে দিবে।’


এসব ভাবতে ভাবতেই গাছে উঠে বসলাম। এবার পা ছুলিয়ে চাঁদের রূপসী রূপ অবলোকন করতে থাকলাম। কিন্তু এর মাঝে আবারো দাদা এসে আমার দিকে লাইট মারলেন। বললেন, ‘ সর্বনাশ! বাবু, গাছে কি কর! নিচে চলে আসো।’
জবাবে বললাম, ‘দাদা, গাছের ডালে বসে, গাছের পাতার ফাঁক দিয়ে জ্যোৎস্না দেখার মাঝে অতিকায় বিরাট আনন্দ আছে।’
এই কথা বলার সাথে সাথে দাদা বললেন, ‘আমিও তাহলে চলে আসি’।
আমি তাকে হতাশ করে দিয়ে বললাম, ‘দুঃখিত দাদা! গাছ থেকে দু’জন একসঙ্গে জ্যোৎস্না দেখার নিয়ম নাই।’


দাদা মন খারাপ করে যাওয়ার সময় বললেন, ‘কেন যে নিয়ম নাই। এইবার যাক। পরের বার আমিই আগে গাছে উঠে চাঁদ দেখব’।
তার কথা শুনে আমি হাসি। আনন্দে হাসি। কষ্টেও হাসি। আনন্দে হাসি কারণ, নতুন একজন চাঁদপ্রেমিক তৈরী হল। কষ্টে হাসি, কারণ এই দিনটি আর কখনো ফিরে আসবে না।


হায় জীবন! তুমি কতোই না সুন্দর। তার চেয়েও সুন্দর জ্যোৎস্না।


পঠিত : ১০৯৬ বার

মন্তব্য: ০