Alapon

জালিম ও মজলুমের মধ্যে আপনার পক্ষ কোনটি?



বনু আমির গোত্রের সাথে একটি বিষয়ে মধ্যস্থতা করার জন্য আল্লাহর রাসূল সা. মদিনায় থাকা ইহুদি গোত্র বনু নাযিরের সাথে দেখা করেন। বনু নাযিরের নেতা হুয়াই বিন আখতাব বনু আমিরের সাথে আল্লাহর রাসূল সা.-এর মধ্যস্থতা করতে রাজি হয় এবং আল্লাহর রাসূল সা.-কে অপেক্ষা করতে বলেন। রাসূল সা. আবু বকর রা. ও ঊমার রা.সহ আরো কিছু সাহাবী নিয়ে অপেক্ষা করছিলেন।

এদিকে ইহুদী বনু নাযির গোত্র আল্লাহর রাসূল সা.-কে হত্যা করার ষড়যন্ত্র শুরু করলো। তারা রাসূল সা.-এর নিকট হতে সরে গিয়ে পরস্পর পরামর্শ করলো, “এর চেয়ে বড় সুযোগে কি আর পাওয়া যাবে? এখন মুহাম্মদ আমাদের হাতের মুঠোর মধ্যে রয়েছেন। এসো তাকে আমরা শেষ করে (হত্যা করে) ফেলি।” তারা পরামর্শক্রমে এ সিদ্ধান্ত গ্রহণ করলো যে, যে দেয়াল ঘেঁষে তিনি বসে আছেন ঐ ঘরের উপর কেউ উঠবে এবং সেখান হতে সে তার উপর একটি বড় পাথর নিক্ষেপ করবে। এতেই তাঁর জীবনলীলা শেষ হয়ে যাবে।

আমর ইবনে জাহাশ ইবনে কা'ব এই কাজে নিযুক্ত হলো। অতঃপর সে ছাদের উপর আরোহণ করলো। ইতোমধ্যে আল্লাহ তা'আলা হযরত জিবরাঈল আ.-কে নবী সা.-এর নিকট পাঠিয়ে নির্দেশ দিলেন যে, তিনি যেন সেখান হতে চলে যান। সুতরাং তিনি তৎক্ষণাৎ সেখান হতে উঠে চলে গেলেন, ফলে ঐ ইহুদীরা তাদের উদ্দেশ্য সাধনে ব্যর্থ হলো। তিনি সেখান হতে সরাসরি মদীনা অভিমুখে রওয়ানা হন।

রাসূল সা.-এর চলে যাওয়া দেখে সাহাবারা ভেবেছিলেন তিনি হয়তো প্রাকৃতিক কর্ম সারতে যাচ্ছেন। এদিকে ইহুদিরাও পাথর ফেলে হত্যা করতে এসে দেখে মুহাম্মদ সা. নেই। তারাও মুহাম্মদ সা.-এর ফিরে আসার অপেক্ষা করতে থাকে। অনেকক্ষণ অপেক্ষা করে সাহাবার ফিরে যান এবং দেখেন রাসূল সা. মসজিদে নববীতে। তখন মুহাম্মদ সা. ওহীর কথা সাহাবাদের জানান এবং বনু নাযিরের বিশ্বাসভঙ্গ ও মুনাফিকির কারণে তাদের বিরুদ্ধে যুদ্ধের ঘোষণা দেন।

তিনি মুহাম্মদ বিন মাসলামাকে ইহুদীদের কাছে পাঠিয়ে বার্তা পাঠান তিনদিনের মধ্যে মদিনা ছেড়ে চলে যেতে নতুবা তাদের বিরুদ্ধে যুদ্ধ করা হবে। যুদ্ধের ঘোষণা শুনে ইহুদীরা একটুও বিচলিত হয়নি। কারণ তাদের বিশ্বাস ছিল তাদের শক্তিশালী দুর্গগুলো তাদের রক্ষা করবে। আল্লাহর রাসূল সা. তাদের বিরুদ্ধে হত্যার ষড়যন্ত্রের যে অভিযোগ এনেছেন তা তারা অস্বীকার করেনি উপরন্তু তারা আল্লাহর রাসূলের সাথে করা চুক্তি ভঙ্গের ঘোষণা করলো।

আল্লাহর রাসূল সা. বনু নাজিরকে অবরোধ করলেন। এদিকে আরেক ইহুদী গোত্র বনু কুরাইজা তাদের সাহায্যে এগিয়ে আসার গোপন আশ্বাস দিলে আল্লাহর রাসূল সা. বনু নাযিরের ওপর অবরোধ বহাল রেখেই বনু কুরাইজার দুর্গগুলোর উদ্দেশ্যে মহড়া দিয়ে আসলেন। মুহাম্মদ সা.-এর এই কঠিন রূপ দেখে বনু কুরাইজা তাদের সাহায্যে এগিয়ে আসে নি। আবার মুনাফিকদের মধ্য থেকে আব্দুল্লাহ বিন উবাই তাদের সাহায্যে এগিয়ে আসার কথা জানালেও সেও এগিয়ে আসেনি। এরপরেও বনু নাজির আত্মসমর্পন করেনি। কারণ তারা জানতো তাদের দূর্গগুলো ভাঙার ক্ষমতা মুহাম্মদ সা.-এর নেই।

তারা দুর্গের মধ্যে অবস্থান করছিল। অবশেষে মুহাম্মদ সা. তাদের মনোবল দুর্বল করে দেওয়ার জন্য তাদের কিছু কিছু খেজুর বাগান ধ্বংস করে দিলেন। কিছু আঙুর বাগান ধ্বংস করে দিলেন। এবার তারা ভীত হয়। আগামী বছর তারা কী খেয়ে বাঁচবে এমন আশংকা তাদের তৈরি হয়। ভীত হয়ে অবশেষে বনু নাযির আত্মসমর্পন করে।

এই ঘটনাকে উদ্দেশ্য করে মহান রাব্বুল আলামীন সূরা হাশর নাজিল করেছেন। আল্লাহ তায়ালা সূরা হাশরের ২ - ৪ নং আয়াতে বলেন,

//তিনিই আহলে কিতাবদের মধ্যে যারা কাফের, তাদেরকে প্রথমবার একত্রিত করে তাদের বাড়ী-ঘর থেকে বহিস্কার করেছেন। তোমরা ধারণাও করতে পারনি যে, তারা বের হবে এবং তারা মনে করেছিল যে, তাদের দূর্গগুলো তাদেরকে আল্লাহর কবল থেকে রক্ষা করবে। অতঃপর আল্লাহর শাস্তি তাদের উপর এমনদিক থেকে আসল, যার কল্পনাও তারা করেনি। আল্লাহ তাদের অন্তরে ত্রাস সঞ্চার করে দিলেন। তারা তাদের বাড়ী-ঘর নিজেদের হাতে এবং মুসলমানদের হাতে ধ্বংস করছিল। অতএব, হে চক্ষুষ্মান ব্যক্তিগণ, তোমরা শিক্ষা গ্রহণ করো।

আল্লাহ যদি তাদের জন্যে নির্বাসন অবধারিত না করতেন, তবে তাদেরকে দুনিয়াতে শাস্তি দিতেন। আর পরকালে তাদের জন্যে রয়েছে জাহান্নামের আযাব। এটা এ কারণে যে, তারা আল্লাহ ও তাঁর রসূলের বিরুদ্ধাচরণ করেছে। যে আল্লাহর বিরুদ্ধাচরণ করে, তার জানা উচিত যে, আল্লাহ কঠোর শাস্তিদাতা।//

এখানে এটা গুরুত্বপূর্ণ ছিল যে, তারা ভয় পেয়ে গিয়েছিল। এমন পরিস্থিতি হবে তা ইহুদীরাতো কল্পনা করেনি, মুসলিমরাও ভাবতে পারে নি এত সহজে বনু নাযির আত্মসমর্পন করবে। এখানে আল্লাহ তায়ালা আরো বলেছেন তারা যদি আত্মসমর্পন না করে, দেশান্তরী না হয়ে যুদ্ধ করতো তবে তাদের জন্য আরো ভয়ংকর শাস্তি অপেক্ষা করতো। যেমন শাস্তি পেয়েছে খন্দক যুদ্ধের পরে বনু কুরাইজা।

সূরা হাশরের ৪ নং আয়াতে আল্লাহ তায়ালা গাছ কাটার প্রসঙ্গ টেনে এনেছেন যাতে করে মুসলিমরা হীনমন্যতায় না ভুগে। বনু নাযির যাতে দ্রুতই আত্মসমর্পন করে সেজন্য রাসূল সা.-এর নির্দেশে মুসলিম সেনাবাহিনী বনু নাযিরের কিছু খেজুর গাছ কেটে ফেলে। আল্লাহ বলেন,

//তোমরা যে কিছু কিছু খেজুর গাছ কেটে দিয়েছ এবং কিছু না কেটে ছেড়ে দিয়েছ, তা তো আল্লাহরই আদেশ এবং যাতে তিনি অবাধ্যদেরকে লাঞ্ছিত করেন।//

বনু নাযিরের ইহুদীরা সম্পদশালী ছিল। তাদের গর্বের একটি বড় কারণ ছিল তারা অনেক খেজুর বাগানের মালিক। অর্থাৎ তাদের খাদ্যের অভাব হবে না। কিন্তু তারা যখন দেখলো মুহাম্মদ সা. তাদের গাছগুলোর কিছু কিছু কেটে ফেলতে শুরু করেছে তখন তারা বিচলিত হয়ে পড়লো। কারণ তারা জানতো মুসলিমদের যুদ্ধনীতিতে ফসলের গাছ কাটা নিষেধ।

যখন মুসলিম বাহিনী কিছু কিছু খেজুর গাছ নষ্ট করে দিচ্ছিলেন তখন মদিনার মুনাফিকরা ও বনু কুরাইজা এমনকি বনু নাযির গোত্রের লোকও হৈ চৈ করতে শুরু করলো যে, মুহাম্মাদ সা. "ফাসাদ ফিল আরদ" বা পৃথিবীতে বিপর্যয় সৃষ্টি করতে নিষেধ করেন; কিন্তু দেখো, তরুতাজা শ্যামল ফলবান গাছ কাটা হচ্ছে ৷ এটি কি "ফাসাদ ফিল আরদ" নয়? এই সময় আল্লাহ তা'আলা এই নির্দেশ নাযিল করেলেন, "তোমরা যেসব গাছ কেটেছো এবং যা না কেটে অক্ষত রেখেছো এর কোন একটি কাজও নাজায়েয নয় ৷ বরং এ উভয় কাজেই আল্লাহর সম্মতি রয়েছে।"

এ থেকে শরীয়াতের এ বিধানটি পাওয়া যায় যে, প্রয়োজনে যেসব ধ্বংসাত্মক ও ক্ষতিকর তৎপরতা অপরিহার্য হয়ে পড়ে তা "ফাসাদ ফিল আরদ" বা পৃথিবীতে বিপর্যয় ও অশান্তি সৃষ্টির সংজ্ঞায় পড়ে না ৷ "ফাসাদ ফিল আরদ" হলো কোন সেনাবাহিনীর মাথায় যদি যুদ্ধের ভূত চেপে বসে এবং তারা শত্রুর দেশে প্রবেশ করে শস্যক্ষেত, গবাদি পশু, বাগান, দালানকোঠা, প্রতিটি জিনিসই নির্বিচারে ধ্বংস ও বরবাদ করতে থাকে। হযরত আবু বকর সিদ্দিক সিরিয়ায় সেনাবাহিনী পাঠানোর সময় যে নির্দেশ দিয়েছিলেন যুদ্ধের ব্যাপারে সেটিই সাধারণ বিধান। তিনি নির্দেশ দিয়েছিলেন, ফলবান বৃক্ষ কাটবে না, ফসল ধ্বংস করবে না এবং তিনি জনবসতি বিরাণ করবে না।

কুরআনে বিপর্যয় সৃষ্টিকারী মানুষদের নিন্দা ও সমালোচনা করতে গিয়ে এ কাজের জন্য তাদের তিরষ্কার ও ভীতি প্রদর্শন করে বলা হয়েছেঃ "যখন তারা ক্ষমতাসীন হয় তখন শস্যক্ষেত ও মানব বংশ ধ্বংস করে চলে।" (বাকারা ২০৫) হযরত আবু বকরের রা. এর নীতি ছিল কুরআনের এ শিক্ষারই হুবহু অনুসরণ। তবে প্রয়োজন দেখা দিলে বিশেষ নির্দেশ হলো, শত্রুর বিরুদ্ধে যুদ্ধে জয়লাভের জন্য কোনো ধ্বংসাত্মক কাজ অপরিহার্য হয়ে পড়লে তা করা যেতে পারে।

এই যুদ্ধের পর আল্লাহর রাসূল সা. আহযাবের যুদ্ধের সময় শত্রুবাহিনী আসার আগেই মদিনার সকল রাস্তা কেটে গর্ত করে ফেলেন। যাতে আক্রমণকারীরা না ঢুকতে পারে। এখন যদি কেউ অভিযোগ করে বলে, ইসলামের বিধান যেখানে রাস্তা থেকে সামান্য প্রতিবন্ধকও সরিয়ে ফেলা সেখানে পুরো রাস্তায় কেটে ফেলেছেন মুহাম্মদ সা.। তাহলে তাকে নির্বোধ বা শয়তানের দোসর বলা ছাড়া আর কী বলার আছে আমাদের। কিছু কিছু মাদিখালী আলেমকে দেখেছি রাস্তা থেকে প্রতিবন্ধক সরানোর সাধারণ নির্দেশকে হরতালের বিরুদ্ধে ব্যবহার করে তারা প্রচার করেছে।

পৃথিবীতে পক্ষ দুইটা। জালিম ও মজলুম। জালিম ও মজলুমের মধ্যে নিরপেক্ষ থাকার সুযোগ নেই। কেউ জালিমের জুলুম দেখেও নিরপেক্ষ থাকার মানে হলো সে জালিমের পক্ষের লোক। আল্লাহর রাসূল সা. বলেছেন যে ব্যক্তি শাসকের অন্যায়ের প্রতিবাদ করে না সে ঐ অন্যায়ের দায় থেকে মুক্ত হয় না। মুসলিমদের গণহত্যায় নেতৃত্ব দেওয়া মোদিকে রাষ্ট্রীয় মেহমান করার প্রতিবাদ জানানো সব মুসলিমের কর্তব্য। কিছু মুসলিম সে দায়িত্ব পালন করেছে। সরকার তাদের ওপর গুলি চালিয়ে ৫ জনকে হত্যা করেছে।

সেই হত্যার প্রতিবাদে হেফাজতে ইসলাম হরতাল আহবান করে। হরতাল মানে হলো সবাই তাদের নিয়মিত কার্যক্রম বন্ধ রেখে জালিম শাসককে সহায়তা করা বন্ধ রাখা। কিছু অর্বাচিন বলতে চায়, হরতাল মানে হলো শাসকের দোষে জনগণকে শাস্তি দেওয়া। যদি বিষয়টা তাই হতো তবে হরতাল বন্ধে সরকার কেন উঠে পড়ে লাগে। অপরিপক্ক লোকরাই কেবল এসব থার্ডক্লাস কথা বলতে পারে।

মুসলিমদের ইস্যুতে খুনি হাসিনার বিরুদ্ধে দেওয়া হরতাল পালন করা সকল মুসলিমের প্রতি কর্তব্য। কিন্তু তা না করে হরতালের বিরুদ্ধে ফতোয়াবাজী করা দূর্বল ঈমান ও মুনাফেকির লক্ষণ। এমন মুসলিম আল্লাহর রাসূলের সময়ও ছিল। তারা সেসময় রাসূল সা.-কে ইসলামের বিধি-নিষেধ শেখানোর ধৃষ্টতা দেখাতো। এই যুগেও তাদের দেখা যায়।

এখন হরতালের বিরুদ্ধে বলা মানে জালিম শাসকের পক্ষে অবস্থান করা। পৃথিবীতে দল দুইটা। হিজবুল্লাহ আর হিজবুশ শয়তান। জালিম কখনোই হিজবুল্লাহর মধ্যে পড়ে না। অতএব নিজেকে বাঁচান। হিজবুল্লাহর মধ্যে থাকার চেষ্টা করুন।

পঠিত : ৪৯৭ বার

মন্তব্য: ০