Alapon

|| ভণ্ড-০৩ ||




১.

আজ একুশে ফেব্রুয়ারি । গাছের ডালে ডালে, পাতার ফাঁক গলে গলে ফোটা ফোটা শিশির বিন্দু টুপটুপ করে ঝরছে অবিরাম। শিশিরভেজা এই সকালে স্বলাতুল ফজর পড়ে একটু পায়চারি করছি। অন্যান্য দিন মৌনতায় জড়িয়ে থাকে চারিদিক। আজ মনে হয় অন্যদিনকার তুলনায় অতোটা মৌনতা নেই। কানে ভেসে আসছে টুকরো টুকরো কিছু আওয়াজ। যদিও তা আগেও যেতো। তবে আজ মনে হয় একটুখানি বেশিই ভেসে আসছে সেই আওয়াজ। আমি উতকর্ণ হয়ে যাই ! শুনতে চেষ্টা করি আওয়াজখানি। ক্ষণকাল পরে কানে ভেজে আসা আওয়াজটি বুঝতে পারি — ‘একসাগর রক্তের বিনিময়ে’ গানটির আওয়াজ। আশপাশের কোথাও যেনো বাজছে সেই গান। পরখ করি চারদিক। তেমন কিছুই চোখে পড়ছে না।

দিগন্ত বিস্তৃত মাঠের পর মাঠ। সবুজে ভরা। ধানের জমি। সবুজ ধান। এখনো অতো বড়ো হয় নি। ধান গাছের সবুজ সবুজ পাতায় জমে আছে বিন্দু বিন্দু শিশির কণা। আমি সেই কণাগুলোকে হাত দিয়ে ছুঁয়ে দেখি। ভীষণ ভালো লাগে আমার কাছে তা। শিশিরভেজা সবুজ ধানের ছোঁয়া আমার হাতের তালুতে—এক অন্যরকম ভালো লাগা কাজ করছে মনে। আমার মনের বাঁকেবাঁকে মুগ্ধতার পরশ স্পর্শিত হচ্ছে। আমি আনমনা হয়ে বিষয়টি দারুণভাবে উপভোগ করতেছি। হটাৎ একটা আওয়াজে আমার সম্বিৎ ফিরে আসে। এতো নিবিড়তম মুগ্ধতায় ছেদ ঘটে। পেছনে ফিরে চাই। তাকিয়ে দেখি রাস্তায়। দেখি আমার বন্ধু ‘তৃতীয় আলোর’ তরুণ সাংবাদিক হাসানুল হক আসতেছে। আর ওই যে আওয়াজ পাচ্ছি , সেই আওয়াজটা আসছে তার কাছ থেকেই। সে-ই জোরেশোরে চালিয়ে রাখছে একটি গান। এখন গানটি —এক সাগর রক্তের বিনিময়ে, বাংলার স্বাধীনতা আনলে যারা। আমরা তোমাদের ভুলবো না..... —আমি পুরোপুরি আর স্পষ্টই শুনতে পাচ্ছি।

আমি তার দিকে মনোযোগী হলাম। খোঁজ খবর নিলাম। জিজ্ঞেস করলাম কই যাচ্ছিস দোস্ত? আমার দোস্ত জবাব দিলো আরেহ!! তুই এই আবার কী জিজ্ঞেস করছিস !! আজ একুশে ফেব্রুয়ারি তুই জানিস না?? বললাম তা জানি। তাই তো আজ ক্লাস বন্ধ বিধায় যাই নি ক্লাসে। সকালে একটু হাঁটতে বের হইছি। কিন্তু তুই তো এতো সকাল বের হোস না কখনো, ঘুম থেকেই উঠিস নিত্যদিনই নয়টার দিকে। আজ কি তাহলে এই জন্যই সকাল সকাল উঠলি?
-সে জবাব দিলো- হুম, তা-ই। জিজ্ঞেস করলাম ফজরের স্বলাত আদায় করেছিলি?
-নাহ। দ্রুত বের হতে হবে, শহিদ মিনারে গিয়ে ফুল দিতে হবে তাড়াতাড়ি। সময় নেই। তাই পড়ি নি। আর এইসব ধর্মকর্ম এতো ভালোও লাগে না!
আমি তো বড্ড তাজ্জব বনে গেলাম। এ-কি বলে! শহিদ বেদিতে ফুল দিতে যাবে, নিত্যদিন ন'টায় ঘুম থেকে ওঠা পাবলিক আজ উঠলো সাড়ে পাচটা- ছ'টায়। কিন্তু এতো দ্রুত ওঠেও স্বলাত আদায়ের সময় হোলো না!! ধর্মকর্ম ভালো না লাগা ব্যক্তিটির কাছে সেক্যুলার কর্মজজ্ঞ কী দিব্যিই না ভালো লাগছে!
আমি নীরব এত্রে চুপচাপ একদৃষ্টে-ই চেয়ে আছি তার দিকে। ভাবনা একটু স্থির হতেই লক্ষ্য করলাম যে, এখন একটা কড়া হিন্দি মিউজিকের আওয়াজ আসছে তার মোবাইল ফোন থেকেই। একটু আগের চলা ‘এক সাগর রক্তের...’ গানটা শেষ। হয়তো বাংলা গান তাকে আর টানে না। তাই হিন্দি গান চালু করে দিয়েছে। আমি কিছুই বুঝে উঠতে পারিনি। এক পর্যায়ে আমি হুজুর, দেশের দরদ নেই, সাংস্কৃতি বুঝি না, শহিদদের মর্যাদা, ভাষার মর্যাদা বুঝি না—এসব বলে আমাকে কিছু খোঁচা দিয়ে সে চলে গেলো। আমিও নিপাট এক ভদ্রলোকের মতো হেসে হেসে চলে আসলাম আমার বাড়িতে। বসলাম এসে আমার রুমে। কোনো প্রকার তর্কে জড়ানোটাকে ভালো মনে করি নি এই কাক ডাকা ভোরে।

২.

হঠাৎ এলোমেলো মনটা আমার আবার ছুটোছুটি করতে লাগলো। ক্যামন একটা আফসোসে আচ্ছন্ন হয়ে পড়েছি আমি। তাঁর বিষয়গুলোই ভাবতে লাগলাম—ও-তো কখনো তাড়াতাড়ি ওঠে না। আজকে ওঠে মিনারে ফুল দিতে এবং এই সংক্রান্ত নিউজ করতে চলে গেলো। কিন্তু স্বলাতটা আদায় করলো না ! তার মানে সে আল্লাহর দাসত্ব করে না বা করতে চায় না ঠিকই, কিন্তু মানুষের কিংবা সেক্যুলার চিন্তার দাসত্ব তো ঠিকই করে ! আচ্ছা ওর ফোন থেকে যে প্রথম গানটা বেজে ওঠেছে —এক সাগর রক্তের বিনিময়ে, বাংলার স্বাধীনতা আনলো যারা...; আচ্ছা, আজ তো একুশে ফেব্রুয়ারি। কিন্তু আজকে স্বাধীনতা দিবসের গান ক্যান? মাথা কি ঠিক আছে ওর? এরপর ভাষার জন্য জান কুরবান হওয়া লোকদের জন্য গঠিত বেদিতে ফুল দিতে যায়, সে জন্য এতো তাড়াতাড়ি ওঠা ঘুম থেকে। সেখানে শ্রদ্ধা জানানোর জন্য স্বলাত আদায়ের সময়ও হোলো না, কিন্তু সেই বাংলা ভাষা দিবসেও দেখলাম ক্ষণকাল পরে কড়া হিন্দি গান চলিয়ে তা শুনছে !! বিষয়গুলো ক্যামন অদ্ভুত লাগছে আমার কাছে ! মনে হচ্ছে আসোলে ও এবং ওর চিন্তার মানুষগুলো নিজের সাথেই নিজেই ভণ্ডামি করছে।

৩.

একসপ্তাহ হয়ে গেছে আমি বাড়িতে। তানিমও আছে বাড়ি। অথচ একদিনও দেখা হোলো না! আমিও ফোন-কল করিনি। কিন্তু তানিম ঠিকই কল করেছে। বিকেলে ঘোরাঘুরির অভ্যাস আমাদের দীর্ঘদিনের। আজও তাই বের হয়ে গেলাম। ঘুরতে। ঘুরতে ঘুরতে দেখা আবারও আমাদের বন্ধু ‘তৃতীয় আলোর’ বড়ো বড়ো মোছওয়ালা সাংবাদিক হাসানুল হকের সঙ্গে। আমাদের দেখে কথা-বার্তা নেই, হুট করেই এসে সে বললো—দেখ দেখ তোদের প্রিয় হুজুর শ্রেণির কর্মকাণ্ড !! আমার তো চক্ষুচড়ক গাছ। কিন্তু তানিম নিতান্তই ঠান্ডা প্রকৃতির মানুষ। আসোলে ছেলেটা সব পরিস্থিতে মাথা ঠান্ডা করে চলতে পারে। আমিই পারি না। যাই হোক; সে বললো, কী হয়েছে, তা তো দেখাবি আগে!
সাংবাদিক বন্ধু ক্যামেরা খুলে কিছু দাড়ি-টুপি আর পাঞ্জাবিওয়ালা কিছু পিকচার দেখিয়ে বললো—দেখ, এই হুজুরগুলো জুতো পায়ে শহিদ মিনারে ওঠেছে। এরা এখানে কী শ্রদ্ধা করবে, ফুল দিবে; তা না করে এখানে জুতো পায়ে উঠে হাসিমুখে ঘোরাঘুরি করে। দেখলি তো! এইটা কালকেই নিউজ হবে আমার পত্রিকায়। হুজুর আর ধর্মান্ধ শ্রেণির মুখোশ জাতির সামনে উন্মোচন করতেই হবে! এরা এখনো পাকিস্তানপ্রীতিতে মশগুল! এর এসব থার্ডক্লাশ কথা শুনে হুট করেই আমার সকালের কথা মনে পড়ে গেলো। আমি জিজ্ঞেস করেই ফেললাম যে, ভাষা দিবসে স্বাধীনতা দিবসের গান চালানোটা শহিদ মিনারের কিংবা বাংলাপ্রীতির অথবা ভাষা দিবসের চেতনার কোনখানে কোন জায়গায় আছে বলতো? দিনের শুরুতে হিন্দিগান বাজাতে বাজাতে শহিদ মিনারে যাওয়াটা কি একুশের চেতনা? এসব তুই আজ সকালেই করেছিস আমার সামনেই। দোস্ত তোর এসবও আমার কাছে একটা অদ্ভুত ব্যাপার মনে হইছে। আমার তো মন চায় তোর তৃতীয় আলো পত্রিকায় কিংবা আমাদের ‘৭৩টিভি’ তে তোদের এসব অসংগতিপূর্ণ কর্মকাণ্ডের নিউজ করি। কিন্তু....
কথা শেষ না করতেই আমার বন্ধু হাসানুল হক বড়ো বড়ো মোছগুলো কচলাতে কচলাতে বললো, তোরা আসোলোই ধর্মান্ধ। সবকিছুতেই পেচানো বা পেচ লাগানোটা তোদের একটা বাতিক। আমি ‘থ’ বনে তার দিকে তাকিয়ে থাকলাম। মনে মনে ভাবি —এরা তো হুজুরদের দোষ মাইক্রোস্কোপ যন্ত্র দিয়েও খুঁজে বের করে। কিন্তু এরা নিজেদের দোষ শুনলে, কেউ তাদের ভুলগুলো বললে এরকম গরম তেলে পানি পড়ার মতো চ্যাঁত চ্যাঁত করে ওঠে ক্যান!!

৪.

আমি আর তানিম এক সাথেই ঢাকায় ফিরছি। অনেকদিন বেড়ানো হলো গ্রামে। যাবার আগে আমরা চিন্তা করছি আমাদের বন্ধু তৃতীয় আলোর সাংবাদিক হাসানুল হকের সঙ্গে দেখা করে যাবো। কবে আবার দেখা হয় আল্লাহ মা'লুম। তানিমের হাতে চিরাচরিত নিয়ম অনুযায়ী রয়েছে একটা বই। ভালো করে লক্ষ্য করে দেখলাম বইটার নাম “ইসলাম ও পাশ্চাত্য সভ্যতার দ্বন্দ্ব”। বইটা আমিও পড়েছি। তানিম তো পাক্কা বস পড়ার ক্ষেত্রে। এটা তো তার আরো বহু আগেই পড়ার কথা। কিন্তু আজকে এটা হাতে ক্যান! নিজেই মনে মনে ভেবেছি কিছুক্ষণ। কিন্তু কিচ্ছু জিজ্ঞেস করি নি। বেশি জিজ্ঞাসাবাদ-প্রশ্ন —এসব ভালো জিনিস না।

একপর্যায়ে আমরা দেখতে পাই আমাদের বন্ধুটি শহিদ মিনারের ওপর তার গার্লফ্রেন্ড নিয়ে বসে বসে সিগারেট টানছে। তার গার্লফ্রেন্ডের হাতে ফুচকা। সে তা খাচ্ছে। আমাদের সাথে চোখে চোখ পড়ে যায় তাদের। আমাদের দেখে সে নেমে আসে সেখান থেকে। কিন্তু আমি খেয়াল করছি তারা দুজনেই জুতো পায়ে শহিদ মিনারে বসা। সেই জুতো পায়েই নেমে এসেছে সে।

আমার ভেতর কিছু চেপে রাখতে পারি না তেমন, এটা আমার এক বিরাট দুর্বলতা। মুখ ফসকে সবই বেরিয়ে যায়। মাঝেমধ্যে এটা নিয়ে তুমুল বিব্রতকর পরিস্থিতিতে পড়ে যাই। এখনো রাখতে পারি নি। তাই তাকে জিজ্ঞেস করেই ফেলেছি —কালই তুই আমাদের কাছে হুজুর-মোল্লাদের, মানে ইসলাম্পন্থীদের ওপর ক্ষোভ উদগীরণ করলি। এবং নিউজও করলি এখানে জুতো পায়ে দু’জন হুজুর ওঠার জন্য। হাবিজাবি কতো কিছুই বললি সেসব নিয়ে তাদের। কিন্তু আজকে তো দেখি তুই নিজেও উঠছিস, গার্লফ্রেন্ডকেও উঠাইছিস। এবং বসে বসে সিগারেট টানিস! এইটা ক্যামন চেতনা রে ভাই তোদের? এইটা কি ভণ্ডামি নয়? তুই-ই বল, এইসব কী?

সে তার বড়ো বড়ো মোছগুলোর ফাঁক দিয়ে দাত বের করে ফিক করে একটা হাসি দিয়ে বললো — আরেহ দোস্ত, কাল তো ২১ ফেব্রুয়ারি গেছে। আজ তো তা নেই! তাই না?

আমি হুট করেই জিজ্ঞেস করেই ফেলেছি যে, ২১ ফেব্রুয়ারিতে জুতো পায়ে ওঠা হারাম, কিন্তু ২২,২৩-এ ফেব্রুয়ারিতে আরাম? আর একুশে ফেব্রুয়ারিতেই তো তুই হিন্দিগান বাজাতে বাজাতে আমার সামনে দিয়ে আসছিস, তো ভাষা এবং ভাষার জন্য নিহত হওয়া মানুষদের জন্য এতো দরদী মানুষটা কী করে হিন্দিগান বাজিয়ে বাজিয়ে ভাষা দিবস চর্চা করে?

আমাকে থামিয়ে দিয়ে তানিম বললো, আচ্ছা বাদ দে, তো কী খবর বল?

এরপর আমরা আবার তর্ক-বাহাস ভুলে গিয়ে একসঙ্গে চা খেয়ে বিদেয় হলাম। বিদায়লগ্নে তানিম তার হাতের—“ইসলাম ও পাশ্চাত্য সভ্যতার দ্বন্দ্ব”—বইটা তার হাতে গিপ্ট হিসেবে তুলে দিলো। আসোলে অনেক্ষণ আড্ডা দেওয়া যেতো, কিন্তু হাসানুল হকের গার্লফ্রেন্ড শহিদ মিনারে বসে অপেক্ষা করছে তার জন্য। তাই মোটামুটি দ্রুতই আড্ডা-গল্প শেষ করলাম আমরা।
আসার সময় তানিম ক্ষণিক সময় নীরবতা অবলম্বন করলো। করলাম আমিও। কিছুক্ষণ পরেই তানিম নড়েচড়ে বসে। একটু ঝেড়েকেশে নিলো। আমি বুঝতে পারছি ও আমাকে কিছু বলতে চায় এক্ষুণি। আমিও মানসিকভাবে প্রস্তুত হয়ে গেলাম, সে কী বলে তা শোনার জন্য।
তানিম আমাকে বলতে লাগলো, জানিস, সবখানে সব বলতে নেই। প্রজ্ঞার পরিচয় দিতে হয়। আর দ্বীনের কাজ যারা করে তথা যারা দা'ঈ হিসেবে কাজ করে —তারা ফুল হতে হয়, কাটা নয়।
- আমি বললাম, তো ওরা যে ভণ্ডামি করে, সেসব ভণ্ডামি নিয়ে কিছু বলাটা কি খুব বেশি অন্যায়?
-তানিম বললো— না। অন্যায় নয়। কিন্তু তুই আর আমি তার ফ্রেন্ড। সেহেতু একটু সহনশীল হয়ে ধৈর্যের সাথে তাদের মতো লোকদের দাওয়াত তো দিতে হবে। তাই না? হয়তো তারা বা সে গ্রহণ করবে না। কারণ তারা আসোলোই ভণ্ড ! এবং স্মার্ট ভণ্ড। কিন্তু তবুও সুন্দর ভাষায় দাওয়াত দেওয়ার পূর্বে আক্রমণ করে কথা বলা ঠিক নয়। আমি বললাম, জি বুঝলাম। বিষয়টি মাথায় রাখবো এখন থেকে, এবং তাদের ভণ্ডামিগুলো সুন্দর করেই ধরিয়ে দেবো। ইন শা আল্লাহ।

|| ভণ্ড-০৩ ||
~রেদওয়ান রাওয়াহা

পঠিত : ৮৬৩ বার

মন্তব্য: ০