Alapon

যে বন্ধন অবহেলিত...



আধুনিক এই যুগে আমাদের পারিবারিক, বৈবাহিক, আত্মীয়তার সম্পর্কগুলো আজ খুবই অসহায়ের মতো বন্ধনহারা হয়ে পড়েছে। সারাদিন প্রযুক্তি আর বিলাসিতার হাতছানিতে এক অবাস্তব জগতে সবার বিচরণ। সম্পদ, সেলিব্রেটিজম নামক মরীচিকার পেছনে ছুটতে ছুটতে ভুলে যাই প্রিয় মানুষগুলোকে। বাস্তবতার সুন্দর সুমধুর ছোঁয়া সবাইকে এখন টানে না। সকালে পাখির কিচিরমিচির ধ্বনি কান পেতে শুনার সময় আমাদের হয়ে উঠে না। গোধূলী বিকেলের মৃদু হলুদ আলোয় কয়জনই বা আর হাঁটাহাটি করি?

সোশ্যাল মিডিয়ায় ইমেজ আর একাউন্টে বড়ো মাপের ব্যালেন্স; এই দুটো রক্ষা করাই এখন আমাদের মূল লক্ষ্য। স্বার্থের খাতিরে চেনা অচেনা মানুষদের সাথে বিনয়-নম্রতা, নিজের পারসোনালিটি বজায় রেখে কত আমোদ প্রমোদ আর উপদেশবহুল কথাবার্তা চলে দিনরাত। কিন্তু পরিবারের মানুষদের হকের ব্যাপারে আমরা বেমালুম হয়ে যাই।

আচ্ছা, শেষ কবে আপনার বাবার দিকে মায়াভরা দৃষ্টিতে তাকিয়েছেন বলুন তো? আম্মাকে সবটুকু ভালোবাসা দিয়ে জড়িয়ে ধরে বলেছেন 'আপনাকে অনেক ভালোবাসি আম্মা?' ভাইবোনদের নিয়ে একসাথে বসে হেসে হেসে কথা বলেছেন? নিজের স্ত্রীর হাতটা ধরে নিচু স্বরে বলেছেন, তোমাকে আমি জান্নাতেও স্ত্রী হিসেবে চাই? সন্তানকে বুকের সাথে আগলে আদর করেছেন? চাচা, মামা, আত্মীয়দের ফোন করে খোঁজখবর নিয়েছেন; সুস্থ আছেন কিনা জিজ্ঞাসা করেছেন?

না! এতো মিষ্টি আবেগ এখন আমাদের নেই। সারাদিন নেটে ব্রাউজিং আর টাকার পেছনে ছুটে এসবের সময় কোথায়?

দিনশেষে আমাদের জীবনে দেখা দেয় একগাঁদা সমস্যা। রিজিকে বরকত নেই, ডিপ্রেশন, একাকীত্ব, হতাশা-বিষাদে ভরে থাকে হৃদয়কোণ। খিটখিটে মেজাজ নিয়ে খাওয়া-ঘুম এইতো চলছে দিন। অন্যদিকে আমাদের একটুখানি হাসিমাখা মুখ, সুন্দর একটা কথার জন্য অধীর আগ্রহে চেয়ে থাকা প্রিয় মানুষদের দিকে তাকানোর সময় আমাদের হয়ে উঠে না। আচ্ছা, রক্তের বন্ধনগুলো কি এতোই ঠুনকো?!

আপনাদেরকে আজ একটি হাদিস শুনাবো। মনে গেঁথে নেন হাদিসটা।
নবী (স.) বলেন, রক্ত সম্পর্কের মূল রহমান। আল্লাহ তাআ'লা বলেন, যে তোমার সাথে সুসম্পর্ক রাখবে, আমি তার সাথে সুসম্পর্ক রাখবো। আর যে তোমার থেকে সম্পর্ক ছিন্ন করবে, আমিও তার থেকে সম্পর্ক ছিন্ন করবো। [সহীহ বুখারি: ৫৫৬২]

অর্থাৎ রক্তের সম্পর্কের মূল আল্লাহর সাথে সম্পৃক্ত। যে ব্যক্তি রক্তের সম্পর্ক বজায় রাখবে আল্লাহ তার সাথে সুসম্পর্ক বজায় রাখবেন।

সুবহানআল্লাহ! কি অমূল্য এক সম্পর্ককে আজ আমরা দূরে ঠেলে দিচ্ছি এক অবাস্তব রঙিন জগতের মোহে। সামান্য রাগ অভিমান আর সম্পদের কারণে আপন মানুষদের সাথে কথা বলা পর্যন্ত বন্ধ করে দেই আমরা। কেনো আজ আল্লাহর সাথে আমাদের এতো দূরত্ব বুঝতে পারছেন? ইবাদতে স্বাদ নেই, জীবনে বারাকাহ নেই, কষ্টে আর দু:খে জর্জরিত জীবন?

জানেন তো জীবনটা খুব ছোট। আজ থেকেই নিজেকে পরিবর্তন করি চলুন। হোক না সে খারাপ তারপরেও তো আমার ভাই, হোক না সে অনেক কঠোর, তারপরেও সে আমার বাবা, সে আমার মা। সব ইগো,রাগ, ক্ষোভ, খ্যাতি আর সম্পদের নেশাকে দূরে ঠেলে ফিরে যাই নীড়ে। প্রিয় মানুষগুলোকে বেশি বেশি সময় দেই।

বাবা, মা, ভাইবোন, স্ত্রী-সন্তান, আত্মীয়দের প্রতি এখন থেকেই যত্নবান হই চলুন। খুব বেশি কিছু করতে হবে না, শুধু একটু মুচকি হাসি নিয়ে কথা বলব তাদের সাথে, আম্মাকে একবার শুধু বলবো কতো অবাধ্যতাই তো করেছি আপনার, ক্ষমা করে দেন! বাবার কাছে গিয়ে বসে ভালোবাসা নিয়ে তাকাব, সম্ভব হলে দু-একটা মিষ্টি কথা বলব। আত্মীয়দের খোঁজখবর নেবো, তাদের সুখ-দু:খে একটু সাথী হবো, সাহায্য নাই বা করতে পারলাম সান্ত্বনা স্বরূপ দুটি কথা বলব। আল্লাহর কাছে প্রচুর দুআ করবো, যেনো আল্লাহ আমাদের অন্তরে এই সম্পর্কের বাঁধন মজবুত রাখার শক্তি দেন।

"অনেক করার পড়েও ভালো হতে পারলাম না" তাদের ভালো বলা দিয়ে আমাদের কি হবে? আমার আল্লাহ আমাকে ভালো বললেই হবে। শুধু চোখ বন্ধ করে, তাদের উপর আমার যেই হক্ব আছে, করে যাবো৷ এইতো ব্যস!

এই সামান্য কিছু সুন্দর ব্যবহারের পর আপনার জন্য রবের পক্ষ থেকে কি উপহার রয়েছে সেটা জানেন?

ইবরাহীম ইবনু মুনযির (রহঃ) ... আবূ হুরায়রা (রাঃ) থেকে বর্ণিত। তিনি বলেন, আমি রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম কে বলতে শুনেছিঃ যে লোক তার রিযক প্রশস্ত করতে এবং আয়ু বৃদ্ধি করতে চায়, সে যেন তার আত্মীয়তার সম্পর্ক রক্ষা করে। [সহীহ বুখারি: ৫৫৫৯]

জ্বি এই রিজিক আর আয়ু দুটোই আপনার জন্য প্রতিদান স্বরূপ রব রেখেছেন। তাহলে বলুন তো দিনশেষে লাভটা কার? আমাদেরই তো তাই না?

জেনে রাখুন, জীবনের চরম দুর্দশা আর বিপদের মুহূর্তে এই রক্তের সম্পর্কগুলোই আমাদের দিকে সাহায্যর হাত বাড়িয়ে দেবে। জাহান্নামের আগুন থেকে বাঁচতে পারি এই আত্মীয়তার বন্ধনকে শক্ত করে বেঁধে রাখার মাধ্যমেই। কিয়ামতের কঠিন দিনে কোনো ভার্চুয়াল ফ্রেন্ডস, ফলোয়ার কিংবা সম্পদের পাহাড় সেদিন আমাদের কাজে আসবে না। এটাই তিক্ত হলেও সত্য!

- ফাইয়ারা জিবা

পঠিত : ৫৪২ বার

মন্তব্য: ০