Alapon

চরিত্র হনন প্রসঙ্গ..

চরিত্র হনন প্রসঙ্গ:

ট্রাইবুনালে শুনানির সময় আমাদের শহীদ নেতৃবৃন্দের একেকজনের স্টাইল ছিল একেকরকম। কেউ হয়তো প্রসিকিউশনের সাক্ষ্য দেয়ার সময় সেগুলো ভালোমতো শুনতেনই না। কুরআন তেলাওয়াত করতেন। কেউ বা অন্য কিছু পড়তেন। যারা বেশি বয়স্ক ও অসুস্থ তারা অনেকে ঝিমুতেন। মোদ্দা কথা, কে কী বললো, সেগুলো নিয়ে তাদের খুব একটা মাথাব্যথা ছিল না।

তবে আব্বা খুব মনোযোগ দিয়ে শুনতেন। তাই তাকে নিয়ে আমার ভয়ও বেশি ছিল। আব্বা, কামারুজ্জামান চাচা, মোল্লা চাচাদের নোট দেয়ারও অভ্যাস ছিল। তারা উকিলদেরকে নানা পরামর্শ দিতেন। আবার কোনো কোনো দায়িত্বশীল মৌখিকভাবে সরাসরি আইনজীবীদের পরামর্শ দিতেন। কেউ বা পরের দিন নোট করে আনতেন। আর পরিবারের সদস্যদের মাধ্যমে পরামর্শ দেয়ার স্বভাব ছিল সকলেরই।

তাদের বিরুদ্ধে আনীত সবগুলো অভিযোগই ছিল নোংরা, কুৎসিত এবং ভীষণভাবে শ্রুতিকটু। তারপরও খুন ও ধর্ষন সংক্রান্ত অভিযোগগুলো আমাদের মনে একটু বেশিই আঘাত করতো। ওনারা কীভাবে সহ্য করতেন কে জানে।

আমাদের ও নিজামী চাচার মামলায় একজন কমন সাক্ষী ছিল। অভিযোগও কমন। তাই সাক্ষীও কমন। এই সাক্ষীর মুখের ভাষা ছিল জঘন্য। তিনি যে বর্ননাগুলো সাজাতেন, সংগে নতুন মসল্লা হিসেবে গালি সংযোজন করতেন। ‘চ’ ক্যাটাগরির গালি। আমাদের উকিলরা আদালতের দৃষ্টি আকর্ষণ করলেন। বললেন, “এগুলো আইওর কাছে তিনি বলেননি। তার লিখিত স্টেটমেন্টে এগুলো নেই। তিনি ট্রাইবুনালে এসে যুক্ত করছেন।” আদালত আমাদের আইনজীবীদের সেই অনুরোধ খারিজ করে দিলেন। বললেন, এখানে তিনি যেভাবেই বলছেন, সেভাবেই লিখিত হবে।

ব্যস। গ্রীন সিগন্যাল পেয়ে এই সাক্ষী মনের মাধুরি মিশিয়ে ঘন্টার পর ঘন্টা ধরে অশ্নীল সব গালি দিয়ে গেলেন। ‘চ, ম আর ব’ অক্ষরের গালি। এমন গালি যা আমরা মুখে বলতেও বিব্রত বোধ করি। নিজেদের পিতামাতার সামনে বলার তো প্রশ্নই আসে না। অথচ সে সময় আমি দিনের পর দিন আব্বার সামনে বসে সেই সব গালি শুনেছি। আর টাইপিস্ট সাহেব সুন্দর করে তা টাইপ করছে। আব্বার সামনেও একটি মনিটর ছিল। তিনিও মনোযোগ দিয়ে সেই লেখা পড়ছেন। আমি শুনেই বিব্রত হয়ে মাথা নীচু করে আছি। আর ভাবছি, তারা কীভাবে সহ্য করছেন!!

কিংবা মোল্লা চাচার ক্যামেরা ট্রায়ালের কথা ভাবতে পারেন। এরকম ক্যামেরা ট্রায়াল বোধ হয় একবারই হয়েছিল। অভিযুক্তের দুজন আইনজীবী, প্রসিকিউশনের দুজন, ভিকটিম মহিলা সাক্ষী, তিনজন বিচারক আর মোল্লা চাচা। আর কেউ নেই। কেমন লাগতে পারে তার!! আমার সাথে এমন হলে আমি বোধ হয় নিতেও পারতাম না। অথচ কত ধৈর্যের সাথে তারা সময়গুলো পার করেছেন। পরিবারগুলো তাদেরকে সাহস জুগিয়েছেন।

আজ থেকে ৮-৯ বছর আগের ছোট্ট দুটো ঘটনা স্মৃতিচারণ করলাম। এই ভূখন্ডে চরিত্র হননের ইতিহাসের সূচনালগ্নটা এমনই ছিল। এগুলো অনেকে জানেনা। কারো জীবনে এই পরিণতি আসুক তা কামনাও করি না। কিন্তু গতকাল থেকে অনেকের লেখনিতে মনে হলো, ইসলামপন্থীদের চরিত্র হননের সিলসিলা বোধহয় মাত্রই শুরু হলো। নারে ভাই। বহু আগেই শুরু হয়েছে। হয়তো তখন নিরব ছিলেন বলে সেই কষ্টকর ইতিহাসকে আপনারা সুকৌশলে ভুলে গেছেন। আর আমাদের ভাই ব্রাদারদের মধ্যেও ট্রাইবুনালের ইতিহাস পড়ার প্রবনতা কম। তাই তারাও এগুলো সঠিকভাবে জানেন না। অপরকেও বলতে পারেন না।

আমি আল্লাহর ফায়সালায় অবাক হই। আমরা যারা নিরবে তখন শুধু কষ্ট পেয়েছি আল্লাহই নানাভাবে বিভিন্ন ঘটনাবলীর মধ্য দিয়ে সেই মিথ্যাচারের উত্তর দিয়েছেন। যারা তাদের লাঞ্ছিত করেছিলেন, তারা পরবর্তীতে নিজেরাই লাঞ্ছিত হয়েছেন। আমরা এখনো আল্লাহর ফায়সালার অপেক্ষায়।

© আলী আহমদ মাবরুর

পঠিত : ৩০৩ বার

মন্তব্য: ০