||গল্পে গল্পে রাগ নিয়ন্ত্রণ||
তারিখঃ ৮ এপ্রিল, ২০২১, ১৩:৫১
এলাকায় যদি সৎ ও ভালো ছেলে বলে কেউ থেকে থাকে তবে এক কথায় হৃদয় ছেলেটা প্রথম ক্যাটাগরীতে। কেউ কখনো তাঁকে কোনো অসামাজিক-অশালীন কার্যকালাপে দেখে নি। ইদানীং একটু বিগড়ে গেলেও আবারো সে নিজেকে গুছিয়ে নিয়েছে বেশ।
আগে অল্পতেই তেতে যেতো।রাগের মাথায় কাকে কী বলতো হুঁশ থাকতো না।এই বিষয়টা এখনো ছাড়তে পারে নি সে।
বাসায় রাগ করলে তো কথায়ই নেই।কাঁচের গ্লাস, স্টীলের বাটি, প্লাস্টিকের ঝুঁড়ি -সব এক অাছাড়ে নিমিষেই চুরমার করে ফেলে। এতে করে তার রাগ নাকি হালকা হয়। অাজো কী একটা কারণে এ কাজটাই করলো সে।
পাশের গ্রামের তানিম। বেশ নামডাক অাছে ভালো ছেলে হিসেবে। অাসোলে যতোটা নামডাক অাছে, তানিম সেই নাম ডাকের চেয়েও শতোগুণ বেশিই ভালো বলে মনে করে হৃদয়। হৃদয়ের জীবনের মোড় পরিবর্তনের অন্যতম দিকপাল এই তানিম।
ছেলেটার মুখে কুচকুচে কালো চাপ দাড়ি।ঘন গাঁঢ়ো মাথাভর্তি কোঁকড়ানো কালো চুল। মাঝেমধ্যে ধবধবে শাদা একটা টুপি থাকে মাথায়।প্যান্টটাও পরে গোড়ালির ওপর ভাঁজ করে। অবশ্য সে প্যান্ট অাজ ক'বছর গোড়ালির ওপরই সেলাই করে।কিনলেও বাড়িতে অানার অাগে হোসেন দর্জির কাছে সেলাই করে নিয়ে অাসে।
হোসেন দর্জি বুড়ো মানুষ। বেশি বয়সে বিয়ে করেছে। শুভ্র দাড়ি। মাথায় তেল চিটচিটে চুল। গায়ে চিতির দাগ পড়া জামা। কোনো ছেলেপেলে নেই। দুই মেয়ে।একমেয়ে অনার্স সেকেন্ড ইয়ারে। অারেকজনের বিয়ে হয়েছিলো। বর কথিত প্রগতিশীল ছেলে। বড়ো বড়ো গোঁফ। মেয়েদের মতো খোপা বাঁধা পিঠ অবধি বড়ো বড়ো চুল। অঢেল টাকাও ছিলো। ভাগ্যের নির্মম পরিহাস, জামাই অতো ভালো পড়ে নি।বহুগামী পুরুষ। প্রচুর পরিমাণে গাঞ্জা খায়। নেশা করে। বাহিরে নারীবাদি সাজা লোক। ঘরে এসে বউ পিটায়। মন চাইলেই তার বাসায় গার্লফ্রেন্ড নিয়ে অাসে মাঝেমধ্যে। এতে বাঁধা দেয় বলে তার ব্যাক্তি স্বাধীনতায় হস্তক্ষেপ হয় নাকি।
এসব কারণে একপর্যায়ে ডিভোর্স। সে মেয়ের ঘরে একটা নাতিও অাছে। দর্জির কাজ করে যা অায় হয় তা দিয়ে কোনোমতে চলছে দিনকাল।
এখানে তানিম অাসলে হোসেন দর্জির সাথে অনেক্ষণ গল্প করে। অাড্ডা দেয়। সুখ দুখের খোঁজ খবর নেয়। অাসার সময় কিছু টাকা বেশিও দিয়ে অাসে। কিন্তু তিনি কোনো টাকায়-ই রাখতে চায় না।
তানিম ছাত্র মানুষ। দু'টো টিউশনি করে। তাই হোসেন দর্জি ওর কোনো পয়সাকড়ি রাখতে চায় না।কিন্তু সে একরকম জোর করেই দিয়ে অাসে।
তানিম হাদিসে পড়েছে মানুষের সাথে হাসিমুখে কথা বলাটাও সদাকাহ, কয়েকটা উত্তম কাজের মাঝে একটা হলো পরিচিত অপরিচিত সকলকে সালাম দেয়া।(অসহায়কে)খাদ্য খাওয়ানো। বুড়ো মানুষের সফেদ দাড়ি নিয়ে ফেরেশতারা খেলা করে।তানিমেরও বুড়োর শুভ্র-সফেদ চুল-দাড়ি খুব ভাললাগে দেখতে।
তাই সব মিলিয়ে হোসেন দর্জির সাথে মাঝেমধ্যেই একটু খোশগল্প করে অাসে।
-তোহ অাজ তানিম অাসলো হৃদয়দের বাড়িতে।
উদ্দেশ্য হৃদয়ের কাছে তার একটা বই রয়েছে।
সাঈয়িদ কুতুবের "অালকুরঅানের শৈল্পিক সৌন্দর্য "
বইটা। হৃদয়কে মাঝেমধ্যেই চমৎকার কিছু বই পড়তে দেয় তানিম।হৃদয়ও কোনো বই লাগলে তানিমের কাছে চলে অাসে। তানিমের কাছে প্রায় দুই হাজারের মতো সাহিত্য অাছে। ইতিহাস, বিজ্ঞান, অালকুরঅান, অালহাদিস, জীবনীগ্রন্থ,অাল ফিকহ্, গল্প, উপন্যাস, ভ্রমণ কাহিনী, দেশ পরিচিতি সহ বিভিন্ন বিষয়ের।
ওই যে ওদিন হৃদয় হঠাৎ অালকুরঅান পড়তে বসলো, বসেই পাপাচার অার অপরাধবোধ জাগ্রত হয়ে ফিরে অাসলো সব অপরাধ থেকে,মূলত "অালকুরঅানের শৈল্পিক সৌন্দর্য" বইটা এর পেছনের কারিগর।অালকুরঅানের শৈল্পিক সৌন্দর্যের বর্ণনায় অাভিভূত হয়ে সে এখন পুনরায় নিয়মিত কুরআন অধ্যয়ন করে।
বাড়িতে এসে তানিম সালাম করলো হৃদয়কে।দরোজার ওপাশে পাশের রুমেই হৃদয়ের অাম্মু।
ওনাকে সালাম দিয়ে কুশলাদি বিনিময় করলো।
হৃদয়ের অাম্মু চা করে দিলো।লেবু দিয়ে রঙ চা।
চা'য়ের কাপ হতে গরম ধোঁয়া উড়ছে।পৃথিবীতে যতো সুন্দর ভালো লাগার ধোঁয়া অাছে চা'-কপির কাপের গরম ধোঁয়া তারমধ্যে অন্যতম সুন্দর ধোঁয়া।ধোঁয়া ওঠা চা'য়ের কাপে তাকিয়ে থাকতেই ভালললাগে।সাথে যদি একটা বই থাকে তাহলে অারো জোশ!
এখনো তানিমের হাতে বই অাছে। তানিম "স্রষ্টার সৃষ্টি অপার বিষ্ময়" বইয়ের পাতা উল্টোচ্ছে অার চা'য়ের কাপে চুমোক দিচ্ছে।ঘরে মা-চাচিদের বানানো চা-শরবতই ভালো লাগে খুব।দোকানের চা- কোল্ড ড্রিংকস অতোটা টানে না তাকে।
তানিমের বইটা হৃদয়ের মনে ধরেছে খুব।তানিমের কাছে অাবদার করলো বইটা দিয়ে যেতে।অবশ্য একেবারে চায় নি।ধার চেয়েছে।ধার করে বই পড়ায় একটা মজা অাছে।মনোযোগ ভালো হয়।নিজের কেনা বইয়ে এতোটা মনোযোগ থাকে না মানুষের।
ছাত্রজীবনে এটা অারো বেশি সত্য।
অবশ্য অন্যের সব কিছুর ওপরই মানুষের অাকর্ষণ একটু বেশিই থাকে। কিন্তু যে ছাত্রদের বইয়ের ওপর অাকর্ষণ থাকে না তারা অাসোলে অাদর্শ ছাত্র হওয়ার যোগ্যতা রাখে না।ছাত্র মানেই বইয়ের ওপর প্রবল অাকর্ষণ কাজ করবে।না হয় তাকে অাদর্শ ছাত্র বলা চলে না।
ওরা চা' পান শেষে বেরিয়ে পড়লো।ফজরের পর ভোরের স্বচ্ছ পবিত্র বাতাসের স্নিগ্ধতা, অার দিন শেষের পরিশ্রান্ত বিকেলের ঝিরঝিরে বাতাসের হিমেল ছোঁয়া, পাখির নীড়ে ফেরা,চাঁদ-সূর্যের লুকোচুরি,অাকাশ জুড়ে পেঁজা তুলোর মতো শুভ্র মেঘের ওড়াউড়ি -এসব ওদের দারুণ টানে।হৃদয়-তানিমের মনে বেশ রেখাপাত করে।মগজটা নতো হয়ে অাসে এসবের স্রষ্টার অসীম চরণে।
হাঁটতে হাঁটতে ওরা পৌঁছালো রহমত পুলের কাছে।সেখানে খালের পাশে বিশাল এক বটগাছ।গাছটা নিঃসীম মমতায় ছায়া দিয়ে রেখেছে অাশপাশের বিশাল একটা জায়গাজুড়ে।
রহমত পুলও বটের ছায়ায় ঘেরা।ব্যাস্ত দুপুরের ক্লান্ত পথিকেরা এখানে বটের ছায়ায় গা এলিয়ে দেয়।একটু জিরোয়।জিরিয়ে অাবার ছুটে চলে নিজ গন্তব্যের পানে।
খালের ওপর পুল।পুলের ওপর নিবিড় ছায়াঘেরা বটগাছ।খালের পানিতে কচুরিপানা।ওপাশে বিশাল খেলার মাঠ।গা'য়ের দুরন্ত ছেলেগুলো গোল্লাছুট খেলে সেখানে।
পুবদিকে দিগন্তজুড়ে ধান গাছের সবুজ সারি।
পশ্চিমাকাশে সূর্যের লালিমা।লাল তেজোদীপ্ত প্রখর সূর্যটা ঢলে পড়ার দৃশ্য...।মনে হয় বিধাতা নিজ হাতেই এখানে এতোসব সৌন্দর্য ঢেলে দিয়েছেন।
এসব দেখে দেখে মুগ্ধতায় ভরে যায় মন-মনন।
বিকেল হলে তাই অনেক মানুষ এখানে ভিড় জমায়..
অন্যদিন হৃদয়ের মুখে কথার খই ফুটতে থাকে।
অানন্দের উচ্ছলতা ঠিকরে ঠিকরে পড়ে।কিন্তু অাজ
অতোটা নয়।মনে একটা চাপানো অনুভূতি কাজ করে।ঘরে মায়ের অনেকগুলো কাছের গ্লাস চা'য়ের কাপ ভেঙে ফেলায় এখন একটু অপরাধী মনে হচ্ছে নিজেকে।তানিমকে তা বুঝতে দিচ্ছে না।
ভাবনার ছেঁদ ভেঙে তানিম বলে উঠলো -অাচ্ছা হৃদয়, কোন জিনিসটা মানে কোন অাচরণটা মানুষের ক্ষতি একটু বেশিই করে বলো তো?
-হৃদয় চুপ করে রইলো।ক্ষণকাল পর বলে উঠলো জানি না।
-তানিম বললো , রাগ।"রাগ" মানুষের সব দিকেই ক্ষতি করে।মানুষকে যুদ্ধবিনে পরাজিত পরাভূত করে ফেলে।রাগ শেষে নিজেকে নিজে শাসাতে বেশ ইচ্ছে হয়!তখন যে ক্ষতি হয়ে যায় তা পুষে ওঠানো দায়।মনে করো রাগের মাথায় কাউকে কিছু বলে ফেলছো,সেটা তো মানে সেই কথা তো অার ফিরিয়ে অানার সুযোগ নেই। সরি বললে সে হয়তো মনে দুঃখ রাখবে না।কিন্তু কথাটা তার মনে অাজীবন থেকে যায়।হঠাৎ হঠাৎ মনে পড়ে।মনে না রাখতে চাইলেও পড়ে।ভালো মানুষের কারো দেয়া কোনো কষ্ট মনে পড়লে ফিক করে হেসে দেয়।এই হেসে দেয়ার মানে কি,বুঝো?মানে যে কষ্টটা তাকে তাড়িয়ে বেড়ায়।সে কষ্টকে হাসির সাথে বের করে দিলো বুক থেকে।
-তানিম অারো বলতে লাগলো যে,কিন্তু দুর্বল চিত্তের লোকজন দীর্ঘশ্বাস ফেলে।মানে তাদের মনেও এটা তাড়িয়ে বেড়ায়।তারা দীর্ঘশ্বাস ছেড়ে শ্বাসের মাধ্যমে দুঃখটা বের করে দেয়।মানে হলো এককথায় দুর্বল চিত্তের মানুষেরা শ্বাস ছাড়ার সাথে সাথে দুঃখটাও ছেড়ে দেয়।
-অার দুষ্ট মানুষেরা মনে না থাকলেও জোর করে রেখে দেয় মনে।দুষ্ট মানুষের একটা অভ্যেস হলো তারা কথায় কথায় অভিশাপ দেয়।
এখন তুমি যদি কোনো দুষ্ট মানুষের সাথে রাগ করো সে তোমার কথায় বেশি অাঘাত না পেলেও অভিশাপ দিবে। জোর করে মনে রাখবে তুমি কখন কী বলেছো!
-হৃদয়ের মনে খটকা লেগে উঠলো।তাহলে বের হওয়ার সময় যে অাম্মু তানিম বলে ডাক দিয়েছে তখন কী তাহলে তার অাজকের অাচরণের কথাটা বলে দিয়েছে!!
অবশ্য হৃদয়ের চেয়েও হৃদয়ের অাম্মু তানিমের একটু বেশিই ভক্ত।তানিমের উছিলায়ই তো হৃদয়ের এতোটা পরিবর্তন।তাই হৃদয়ের সাথে তানিমকেও নিজ ছেলের মতোই তিনি ভালোবাসেন।
পূব দিক হতে একঝাঁক শালিক এসে বসলো তানিমরা যেখানে বসা বটগাছটার ঠিক সেখান বরাবর।
তানিম এবার শক্তপোক্তভাবে চেপে গলা খাঁকিয়ে নিলো।অবশ্য সে ছোটো ছোটো করে মিষ্টি ভাষায়ই কথা বলে।কিন্তু যখন অনেক্ষণ কথা বলতে মনস্থির করে তখন একটু ঝেড়েকেঁশে নেয় বা গলা খাঁকারি দিয়ে নেয়।বলতে গেলে এটা তার অভ্যেস।
-তানিম বলতে লাগলো শুনো হৃদয়,আল্লাহ্র সন্তুষ্টির জন্য রাগ নিয়ন্ত্রণ খুবই গুরুত্বপূর্ণ একটা গুন।এই রাগ নিয়ন্ত্রণের বিষয়টা আমাদেরকে (রাগের ফলে সৃষ্ট) নানারকম শারীরিক ও মানসিক ক্ষতি থেকে বাঁচিয়ে রাখে।আবু হুরাইরা (রাঃ) বলেন: একদিন রসূলাল্লাহ(সা
এর কাছে এক ব্যক্তি এসে বললেন,“হে আল্লাহ্র রসূল, আপনি আমাকে কিছু অসিয়ত করুন।” উত্তরে নবী করিম(সা
বললেন, “তুমি রাগান্বিত হয়ো না” সে ব্যাক্তি একথাটি কয়েকবার বললো। তিনি প্রতিবারই একই কথা বললেন, “তুমি রাগান্বিত হয়ো না” [সহীহ বুখারী ৫৬৮৬ ইফা]
নবী (সা
আরও বলেন: “সে প্রকৃত বীর নয়, যে কাউকে কুস্তীতে হারিয়ে পরাস্ত করে, বরং সেই প্রকৃত বীর, যে ক্রোধের সময় নিজেকে নিয়ন্ত্রণ করতে পারে।” [সহীহ বুখারী ৫৬৮৪ ইফা]
নবী করিম(সা
এই উপদেশটি দিয়েছিলেন এই কারণে যে,তিনি বুঝতে পেরেছিলেন কেউ রাগান্বিত হয়ে পড়লে তা তার এবং তার আশেপাশের লোকজনের জন্য তা শারীরিক ও মানসিকভাবে কতোটা ক্ষতিকর ও বিপদজনক।
কিন্তু তিনি এটাও জানতেন যে রাগের মুহূর্তে এই উপদেশটা মেনে চলা এতোটা সহজ নয়,তাই তিনি রাগ নিয়ন্ত্রণের উপায়ও শিখিয়ে দিয়েছেন আমাদেরকে। তাঁকে যখন জিজ্ঞেস করা হয়েছিলো, “হে আল্লাহ্র রসূল(সা
, তাহলে (রাগের) চিকিৎসা কী?” উত্তরে নবী করিম(সা
বললেন: “কেউ যদি দাঁড়ানো অবস্থায় রাগান্বিত হয়ে পড়ে তার উচিত সাথে সাথে বসে পড়া, আর রাগ না কমা পর্যন্ত সেই অবস্থায় থাকা। অন্যথায় তার উচিত শুয়ে পড়া।” [আবু দাউদ ৪৭৬৪]
নবী করিম(সা
কেনো এই উপদেশ দিয়েছেন আমাদের তা সঠিকভাবে বুঝতে হলে আমাদের জানতে হবে আমাদের শরীর এবং মনের ওপর রাগের ক্ষতিকর প্রভাবগুলো কী কী, আর শুয়ে-বসে পড়ার সাথে রাগের কী সম্পর্কই বা অাছে!
কেউ যখন রাগান্বিত হয়ে পড়ে তখন তার কিডনির উপরে অবস্থিত অ্যাড্রেনালিন গ্রন্থি থেকে অ্যাড্রেনালিন নামক একপ্রকার হরমোন নিঃসরণ শুরু হয়। রাগ, ভয়, রক্তে শর্করার পরিমাণ কমে যাওয়া বা এজাতীয় যেকোনো শারীরিক বা মানসিক চাপের কারণে এই হরমোনের নিঃসরণ ঘটতে পারে। আর এই অ্যাড্রেনালিন গ্রন্থি থেকে নরঅ্যাড্রেনালিন নামক আরও একপ্রকার হরমোন নিঃসরণ ঘটে, যদিও এই হরমোনের প্রধান উৎস হল হৃদপিন্ডে সিম্পেথেটিক স্নায়ুর প্রান্তে।কিন্তু এ দু'প্রকার হরমোনই পরস্পর সম্পর্কযুক্ত, আর এদের নিঃসরণও ঘটে একই সাথে।
রাগের ফলে আমাদের শরীরে এই যে দুই প্রকারের হরমোন, এই হরমোনই অধিক পরিমাণে নিঃসরিত হতে থাকে। এরমধ্যে একটা হরমোন যেহেতু হৃদপিন্ড থেকে নিঃসরিত হয়, তাই রাগান্বিত অবস্থায় আমাদের হৃদপিন্ড অারো বেশি এক্টিভ হয়ে পড়ে।যার ফলে হৃদকম্পন হয়ে উঠে আরও দ্রুত এবং অনিয়মিত।
শারীরিক বা মানসিক চাপের ফলে হৃদপিন্ডের এই সুতীব্র পরিবর্তন আমরা অনেকেই প্রায় সময় অনুভব করতে পারি। তাছাড়াও আমদের রেগে যাবার ফলে হৃদপিন্ডের বেশি সক্রিয়তার কারণে অতিরিক্ত অক্সিজেনের জোগান দেওয়ার জন্য হৃদপেশীর সংকোচনও কিন্তু বেড়ে যায় কয়েকগুন,ফলস্বরূপ ধমনীতে চাপ পড়ে।সে কারণে রাগান্বিত অবস্থায় হৃদরোগে আক্রান্ত ব্যক্তির স্বাস্থ্যঝুঁকি অনেকগুণে বেড়ে যায়।
আর যাদের ধমনীর প্রশস্ততা কম তাদের হার্ট অ্যাটাকের সম্ভাবনাও বেড়ে যায় অনেক বেশি।কেননা তাদের সংকুচিত ধমনী দিয়ে হঠাৎ অধিক বেগে রক্ত সঞ্চালনের ফলে ধমনীতে অতিরিক্ত চাপের কারণে তা ছিঁড়ে যেতে পারে যেকোনো সময়।
শরীরে এই দুই হরমোনের পরিমাণ বেড়ে যাবার কারণে আমাদের রক্তচাপও বৃদ্ধি পায় অনেক, যা ব্লাড প্রেসারে আক্রান্ত ব্যক্তির জন্য মারাত্মক বিপদজনক।
এছাড়া অামরা জানি ডায়াবেটিক রোগীদের সাধারণত রাগ নিয়ন্ত্রণের পরামর্শ দেওয়া হয়।কারণ রাগ-মানসিক চাপে সৃষ্ট অতিরিক্ত অ্যাড্রেনালীন আমাদের রক্তে শর্করার পরিমাণ বাড়িয়ে দেয়,বিষয়টা একজন ডায়াবেটিক রোগীর জন্য মারাত্মক ক্ষতিকারক।
এছাড়াও কিছু কিছু ক্ষেত্রে রাগ আমদের পুরো শরীরেই নানাবিধ জটিল স্বাস্থ্য সমস্যার সৃষ্টি করে।হয়তো একারণেই নবীজি (সঃ) অনেকবার রাগ-ক্রোধ নিয়ন্ত্রণের উপদেশ দিয়েছেন।রাগ নিয়ন্ত্রণের গুরুত্ব বুঝাতে গিয়ে প্রিয় নবী সঃ একেএকে তিনবার বললেন, “রাগান্বিত হয়ো না।”
চিকিৎসাশাস্ত্রের বিখ্যাত লেখক হ্যারিসন বলেন, “বিষয়টা বৈজ্ঞানিকভাবে প্রমাণিত যে, পাঁচ মিনিট শান্ত-শিষ্ট্যভাবে দাঁড়িয়ে থাকাবস্থায় একজন মানুষের রক্তে নরঅ্যাড্রেনালিনের পরিমাণ দুই হতে তিনগুণ বেড়ে যেতে পারে। দাঁড়িয়ে থাকার কারণে অ্যাড্রেনালিনও সামান্য পরিমাণে বেড়ে যায়।তবে নানান রকমের মানসিক চাপ রক্তে অ্যাড্রেনালিনের মাত্রা অনেক বাড়িয়ে দিতে পারে।”
সোজাসাপ্টা কথা হলো , তুমি যদি শান্তভাবে পাঁচ মিনিট দাঁড়িয়ে থাকো তাহলে তোমার রক্তে নরঅ্যাড্রেনালিনের পরিমাণ দ্বিগুণ বেড়ে যাবে,এর সাথে অ্যাড্রেনালিনও কিছুটা বেড়ে যায়।
একটা বিষয় জেনো রেখো যে,অ্যাড্রেনালিন নামক হরমোনটা প্রধানত রাগ তথা মানসিক চাপের কারণেই বৃদ্ধি পায়।
বিষয়টা একটু খেয়াল করো,আজ থেকে পনেরো'শ বছর আগে যখন চিকিৎসাবিজ্ঞানে মানুষের জ্ঞান বলতে গেলে ছিলোই না।চিকিৎসা শাস্ত্রের অগ্রগতি তো এখন এই যুগেই না হয়েছিলো, কিন্তু দেখো দেড় হাজার বছর পূর্বে রসূলে কারীম (সঃ) এর দিয়ে যাওয়া এই উপদেশ বানীর গুরুত্ব কতোটুকুন!ভাবতে পারো!
-হৃদয় সামান্য একটু নড়েচড়ে বসলো,অার বলে উঠলো -অাসোলেই ভাইয়া,যে মানুষটার একাডেমিক শিক্ষা ছিলোই না,কারো কাছে একটা অক্ষরও শেখে নি।নিজের নামটাও যেই মানুষটা লেখতে পারতো না।তাঁর নির্দেশিত জীবনপদ্ধতি এতোটা অাধুনিক,বিজ্ঞান সম্মত! সুবহানাল্লাহ!
তিনি যে সত্য নবী।অাল্লাহ সুবহানাহু ওয়াতাআলা'র পক্ষ থেকে ওহী দ্বারা পরিচালিত ছিলেন -এই বিশ্বাসের ইমারাতটা অারেকটু দৃঢ়তর হলো!
কারো যদি দাঁড়ানো অবস্থায় রাগ ওঠে তার উচিত সাথে সাথেই বসে যাওয়া।রাগ না কমা পর্যন্ত ওই অবস্থায় থাকা।এরপরও না কমলে তার উচিত শুয়ে পড়া।”- এটাই হল সর্বকালের সর্বাধুনিক ডাক্তারি পরামর্শ!তাই না ভাইয়া? -জিজ্ঞোসু দৃষ্টিতে তাকিয়ে প্রশ্নজুড়ে দিলো হৃদয়।
-হ্যাঁ,সত্যিই তাই।জবাব দিলো তানিম।
গলাটা অারেকবার একটু ঝেড়ে নিয়ে অাবারও বলা শুরু করলো তানিম।
-দেখো হৃদয়, নবীজি সঃ অারো একটা উপদেশ হলো,রাগ অাসে শাইত্বনের থেকে।শাইত্বান হলো অাগুনের তৈরি।অাগুন নেভে বা তার উত্তাপ কমে পানিতে।সুতরাং রাগ নিয়ন্ত্রণের জন্যে নবী কারিম সঃ অজু করারও পরামর্শ দিয়েছেন।(অাবু দাউদ)
অার রাগ করে তো শারীরিক ক্ষতির পাশাপাশি সম্পদেরও ক্ষতি।একপ্রকার অপচয়ই তো তা।
অার জানোই তো সুরা বনী ঈসরাইলে অপচয়কারীকে শাইত্বনের ভাই-ই বলা হয়েছে।
রাগ নিয়ন্ত্রণে রাখার এতোসব দুনিয়াবি উপকারিতার পাশাপাশি যারা নিজেদের রাগ নিয়ন্ত্রণে রাখে, তাদেরকে মহান আল্লাহ সুবহানাহুওয়াতাআ'লা পবিত্র অাল কুরআনের সূরা আল-ইমারানে পরকালে ক্ষমা ও জান্নাতের অধিকারী এবং ভালোবাসার অঙ্গীকার করেছেন; “যারা নিজেদের রাগকে সংবরণ করে আর মানুষের প্রতি ক্ষমা প্রদর্শন করে, বস্তুতঃ আল্লাহ সৎকর্মশীলদিগকেই ভালবাসেন।” [সূরা আল ইমরান, ৩:১৩৪]
কেউ যদি তার মালিকের তরফ হতে এতো এতো ওয়াদা অার ভালোবাসার প্রতিশ্রুতি পায়,তাহলে তার কী করা উচিত বলো তো?
তাছাড়া পূর্বেইতো বলেছি রসূল(সা
তো তাকেই প্রকৃত বীরবাহাদুর বলেছেন,যে নিজের ক্রোধ সংবরণ করতে পারে।বলো তো যুদ্ধ ছাড়াই যদি বীর হওয়া যায় তাহলে সেই বীরোচিত বীর হতে কার না মন চায়?
মোটের ওপর দেখো রাগ নিয়ন্ত্রণ করলে বা করতে পারলে তুমি বীর,না পারলে অভিশপ্ত ইবলিশ শাইত্বনের ভাই!একজন সত্যিকারের মুসলিম অবশ্যই বীরত্বের বিষয়টাই চিনিয়ে নিতে চা'বে।
ইবলিশ থেকে থাকতে চা'বে যোজন যোজন দূরত্বে থাকতে।কারণ ইবলিশ যে বনী অাদমের শত্রু।একেবারে চির শত্রু!
বটের শাখা হতে দোয়েল-কোয়েল-শালিকের ঝাঁক ডানা মেলে উড়াল দিলো অাপন নীড়ে।ওপর থেকে ইয়া বড়ো বটগাছটার ছোট্ট একটা ফল পড়লো তানিমদের মাথায়।চারদিকে সান্ধ্যাকালিন অাবছা অাঁধার।দিনের বুকজুড়ে সন্ধ্যার কালিমা লেপন হচ্ছে ধীরেধীরে...
অাশপাশের মাসজিদগুলোর মিনার হতে মুয়াজ্জিনের সুমধুর অাজানের ধ্বনি ধ্বনিত-প্রতিধ্বনিত হচ্ছে।যেনো হৃদয়টা ছুঁয়ে যায় হৃদয় -তানিমের।
-তানিম বলে উঠলো অন্যদিন না হয় রাগ ও তার নিয়ন্ত্রণ নিয়ে অারো বিশদ অালোচনা করা যাবে।অাজ তাহলে মাসজিদে গিয়ে স্বলাতে শামিল হই,চলো।
-হৃদয়ও সায় দিয়ে মাথা ঝাঁকিয়ে বলে উঠলো, হ্যাঁ চলুন তাহলে!
দু'জনেই পা চালাতে লাগলো সমানতালে। মাসজিদের পানে....
||গল্পে গল্পে রাগ নিয়ন্ত্রণ||
-রেদওয়ান রওয়াহা
রচনাকাল :- ২৪ রমাদান। ১৮-০৫-২০
মন্তব্য: ০