Alapon

মুহাম্মদ সা. অবরুদ্ধ হয়ে গেলেন তিন বছরের জন্য



মক্কায় আল্লাহর রাসূল সা.-এর মিছিলের মাধ্যমে শক্তি প্রদর্শন করেন। এরপর থেকে মুসলিমদের ওপর শারীরিক আক্রমণ বন্ধ হয়ে যায়। মুসলিমরা কা'বা চত্বরে দলবদ্ধভাবে নামাজ আদায় শুরু করেন। সেখানে সমাবেশ করেন। তাওয়াফ করেন। আল্লাহর রাসূল সা. সেখানে মুসলিমদের নসিহত করতে থাকেন। এই নিয়ে কয়েকবার মুশরিকদের সাথে কয়েকবার দ্বন্দ্ব সংঘাতের উপক্রম হয়।

তবে মুশরিকরা পিছিয়ে যায়। মুসলিমরা সংখ্যায় অনেক কম হলেও মুসলিমদের সাথে ছিল বনু হাশিম ও বনু মুত্তালিবের প্রায় সকল লোক। আর শক্তিশালী পুরুষ হিসেবে হামজা রা. ও উমার রা. ছিলেন। তরুণ বীর ছিলেন আলী রা.। এদের সাথে যুদ্ধের জন্য কেউ প্রস্তুত ছিল না।

মক্কার মুশরিকরা একের পর এক মিটিং করে চলছে ইসলামকে ঠেকানোর জন্য। কারণ তাদের আশংকা ছিল, যারা এতোদিন অত্যাচারের ভয়ে ইসলাম গ্রহণ করতে পারেনি তারা এখন দলে দলে ইসলাম গ্রহণ করবে। তারা চিন্তা করে দেখলো মুহাম্মদ সা. সবসময় হামজা রা. ও উমারের রা.-এর পাহারায় থাকবে না। গুপ্তভাবে যদি ও অতর্কিত আক্রমণ চালিয়ে যদি তাঁকে হত্যা করা হয় তবে ইসলাম শেষ হয়ে যাবে।

তবে সমস্যা হলো মুহাম্মদ সা.-কে হত্যা করা হলে এর প্রতিশোধের জন্য বনু হাশিম ও বনু মুত্তালিব চিরস্থায়ী যুদ্ধ শুরু করবে। এর ফলে হয়তো কুরাইশরাই বিলীন হয়ে যাবে। তাই তারা রাসূল সা.-এর চাচা আবু তালিবের কাছে প্রস্তাব নিয়ে গেলেন। তিনি এবং বনু হাশিম যেন ধর্মত্যাগী মুহাম্মদ সা.-কে মক্কার নেতাদের হাতে তুলে দেয়। আর যদি না দেয় তাহলে তারা বনু হাশিমের সাথে সম্পর্ক ছেদ করবে।

আবু তালিব যখন দেখলেন যে মুশরিকরা চারিদিক থেকে তার ভাতিজাকে নাজেহাল করতে উঠেপড়ে লেগেছে তখন তিনি তার পূর্বপুরুষদের মধ্যে দুই বিশিষ্ট ব্যক্তিত্ব হাশিম এবং মুত্তালিবের বংশধরদের একত্রিত করলেন ও সমাবেশের আয়োজন করলেন। তিনি সেই সমাবেশে তার ভ্রাতুষ্পুত্রকে রক্ষার ব্যাপারে ঐক্যবদ্ধ হওয়ার জন্য সকলের প্রতি আহবান জানালেন। তিনি আবেগজড়িত কন্ঠে বললেন, যে দায়িত্ব এতদিন আমি একা পালন করেছি, এবার এসো আমরা সবাই মিলে সে দায়িত্ব পালন করি। আবু তালিবের এ আহবানে তার দুই পূর্বপুরুষের বংশধররা সাড়া দিলেন। আবু তালিবের আপন ভাই আবু লাহাব শুধু ভিন্নমত পোষণ করলো। সে ভাতিজা মুহাম্মদ সা.-কে কোনো প্রকার নিরাপত্তা দিতে অস্বীকৃতি জানিয়ে মুশরিকদের সাথে মিলিত হলো।

এরপর কুরাইশদের মুশরিক নেতারা আবু জাহলের নেতৃত্বে মক্কার সকল গোত্রের সমন্বয়ে বনি হাশেম ও বনু মুত্তালিব গোত্রকে বয়কট করে একটি চুক্তি সম্পাদন করে। চুক্তির পয়েন্টগুলো ছিল,

১. মক্কার কোন ব্যক্তি বনি হাশেম ও বনু মুত্তালিব গোত্রের সাথে আত্মীয়তা করবে না।
২. উক্ত গোত্রদ্বয়ের কোন ব্যক্তি বা গোষ্ঠীর কাছে কোন প্রকার পণ্য সামগ্রী ক্রয়-বিক্রয় করবে না।
৩. তাদেরকে কোনো প্রকার খাদ্য দ্রব্যও পাঠানোও যাবে না।
৪. যতদিন পর্যন্ত তারা মুহাম্মদকে আমাদের হাতে সমর্পণ না করবে ততদিন পর্যন্ত এ চুক্তি বলবৎ থাকবে।

এ চুক্তি পত্রটি লিখেছিলো বোগাইজ ইবনে আমের ইবনে হাশেম। এরপর চুক্তিতে অটল থাকার ব্যাপারে আল্লাহর নামে শপথ করে। লেখার পর দলিল কাবাঘরে টাঙ্গিয়ে দেয়া হল, তাতে আবু লাহাব ব্যতীত বনু হাশেম এবং বনু মোত্তালেবের মুসলিম অমুসলিম নারী পুরুষ শিশু সবাই একঘরে হয়ে পড়ে। শহরে খাবার পাবে না বিধায় তাঁরা শাবে আবু তালিব নামে একটি পাহাড়ি উপত্যাকায় চলে যান এবং এই স্থানে অবরুদ্ধ হয়ে পড়লেন। এটা ছিলো নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের নবী হিসাবে আবির্ভাবের সপ্তম বছরের শুরুর দিকের ঘটনা।

আল্লাহ তায়ালা এই কঠিন বিপদ দিয়ে রাসূল সা.-কে পরীক্ষা করলেন। এ বয়কটে পরিস্থিতি গুরুতর হয়ে উঠলো, খাদ্যসামগ্রীর সরবরাহ বন্দ হয়ে গেল। মক্কায় যে খাবার আসতো মুশরিকরা তাড়াতাড়ি সেগুলো কিনে নিতো। ফলে অবরুদ্ধ মুসলিম অমুসলিম কারো কাছে কোনো কিছু স্বাভাবিক উপায়ে পৌঁছুতো না।

তারা গাছের পাতা এবং চামড়া খেয়ে জীবন ধারণ করতেন। ক্ষুধার কষ্ট এত মারাত্মক ছিল যে ক্ষুধার্ত নারী ও শিশুর কাতর কান্না শাবে আবু তালিব বা আবু তালিবের ঘাঁটির বাইরে থেকে শোনা যেত। তাদের কাছে কোনো খাদ্যসামগ্রী পৌঁছার সম্ভাবনা ছিল খুবই কম। যা কিছু পৌঁছুতো সে সব গোপনীয়ভাবেই পৌঁছাত।

নিষিদ্ধ মাসসমূহ ছাড়া প্রয়োজনীয় জিনিস কেনার জন্য তারা ঘাঁটির বাইরে বেরও হতেন না বাইরে থেকে মক্কায় আসা ব্যবসায়ীদের জিনিস কেনার চেষ্টা করেও অনেক সময় তারা সক্ষম হতেন না। কারণ মুশরিকরা সেসব জিনিসের দাম কয়েকগুণ বাড়িয়ে দিত। কিছু কিছু সময় এমন হতো তারা শুধু লতাপাতা খাওয়াতে তাদের পায়খানা বকরির পায়খানার মতো হয়ে যেত।

এদিকে আবু তালিব সব সময় রাসূলুল্লাহ সা.-কে নিয়ে চিন্তায় থাকতেন। রাতে সবাই শুয়ে পড়ার পর তিনি মুহাম্মাদ সা.-কে বলতেন, যাও, তুমি এবার তোমার বিছানায় গিয়ে শুয়ে পড়ো। তিনি একথা এ জন্যই বলতেন যাতে কোনো গোপন আততায়ী থাকলে বুঝতে পারে যে, তিনি কোথায় শয়ন করেছেন। এরপর সবাই ঘুমিয়ে পড়লে আবু তালিব তার প্রিয় ভাতিজার শোয়ার স্থান বদলে দিতেন। তার বিছানায় নিজের পুত্র, ভাই বা অন্য কাউকে শয়ন করাতেন।

এ অবস্থায় পুরো তিন বছর কেটে যায়, এরপর নবুয়তের দশম বর্ষে মহররম মাসে মুশরিকদের সেই দলিল ছিন্ন হওয়ার ঘটনা ঘটে। এতে অত্যাচার নির্যাতনের অবসান ঘটে। কুরাইশদের মধ্যকার কিছু লোক এ ব্যবস্থার বিরোধী থাকায় তারা অবরোধ বাতিল করারও উদ্যোগ গ্রহণ করে।

এই অমানবিক অবরোধ সম্পর্কিত প্রণীত দলীল বিনষ্ট করার প্রধান উদ্যোক্তা ছিলেন বনু আমের ইবনে লুয়াই গোত্রের হিশাম ইবনে আমর নামক একজন ব্যক্তি। হিশাম রাত্রিকালে চুপিসারে খাদ্য দ্রব্য পাঠিয়ে আবু তালিব ঘাঁটির অসহায় লোকদের সাহায্য করতো। প্রথমে হিশাম যুহাইর ইবনে আবু উমাইয়া মাখযুমির কাছে যান। হিশাম তাকে বললেন, যুহাইর তুমি কি চাও যে, তোমরা মজা করে পানাহার করবে আর, অথচ তোমার মামা ও অন্যেরা ধুঁকে ধুঁকে মারা যাবে। তারা কি অবস্থায় রয়েছে সেটা কি তুমি কি জান না?

যুহাইর বললো, আফসোস, আমি একা কি করতে পারি? যদি আমার সাথে আর কেউ এগিয়ে আসে তবে আমি দলিল বিনষ্ট করার উদ্যোগ গ্রহণ করতে পারি। হিশাম বললেন, অন্য একজন রয়েছেন, যুহাইর বললেন, তিনি কে? হিশাম বললেন, আমি। যুহাইর বললেন, আচ্ছা তবে তৃতীয় কাউকে খুঁজে বের করো। এভাবে তারা কয়েকজন যুবককে খুঁজে বের করলো।

একদিন সকালবেলা নিয়মানুযায়ী সবাই মজলিসে একত্রিত হলো। যুহাইর দামী পোশাক পরিধান করে সেজে গুজে উপস্থিত হলো। প্রথমে কাবাঘর সাতবার তাওয়াফ করে সবাইকে সম্বোধন করে বললো, মক্কাবাসীরা শোন আমরা পানাহার করবো, পোশাক পরিধান করবো, আবু বনু হাশেম ধ্বংস হয়ে যাবে। তাদের কাছে কিছু বিক্রি করা হচ্ছে না, তাদের কাছ থেকে কেনাও হচ্ছে না। খোদার কসম! এ ধরনের অমানবিক দলিল বিদ্যমান থাকা অবস্থায় আমি নীরব হয়ে থাকতে পারি না, আমি চাই এ দলিল বিনষ্ট করে ফেলা হোক।

আবু জেহেল এ কথা শুনে বলল, তুমি ভুল বলছো, আল্লাহর কসম! এ দলিল ছিন্ন করা যাবে না। জাময়া ইবনে আসওয়াদ বললেন, আল্লাহর কসম! তুমি ভুল বলেছ, এ দলিল যখন লেখা হয়েছিল, তখনো আমি রাজি ছিলাম না। আমি এটা মানতে প্রস্তুত নই। এরপর মুতয়াম ইবনে আদী বললেন তোমরা দুজনে ঠিকই বলছো, আমরা এ দলিলে যা কিছু লেখা রয়েছে, তা থেকে আল্লাহর কাছে পানাহ চাই। হিশাম ইবনে আমরও এ ধরনের কথা বললেন। এভাবে কা'বায় অবরোধের বিরুদ্ধে স্পষ্ট প্রতিবা শুরু হলো।

এদিকে মুহাম্মদ সা. আল্লাহর পক্ষ থেকে আদিষ্ট হয়ে চাচা আবু তালিবকে বললেন, দলিল বিনষ্ট করতে আল্লাহ তায়ালা পোকা পাঠিয়েছেন। তারা জুলুম অত্যাচারের বিবরণসমূহ কেটে ছারখার করে ফেলেছে, শুধু যেখানে যেখানে আল্লাহর নাম রয়েছে সেসব অবশিষ্ট রয়েছে।

এরপর আবু তালিব কুরাইশদের বললেন, আমার ভাতিজা আমাকে আপনাদের কাছে এ কথা বলতে পাঠিয়েছেন যে, আল্লাহ তায়ালা তাকে জানিয়েছেন যে, আপনাদের অঙ্গীকার পত্রটি আল্লাহ তায়ালা এক রকম পোকা পাঠিয়ে নষ্ট করে দিয়েছেন শুধুমাত্র আল্লাহ তায়ালার নামটুকু সেখানে অবশিষ্ট আছে। এ কথা মিথ্যা বলে প্রমাণিত হলে আমি তার ও আপনাদের মাঝ থেকে সরে দাঁড়াব এবং আপনারা যা ইচ্ছা তাই করতে পারবেন। আর যদি সত্য বলে প্রমাণিত হয় তাহলে বয়কটের মাধ্যমে আমাদের প্রতি যে অন্যায় আচরণ করেছেন তা থেকে বিরত থাকবেন। এতে কুরাইশরা সম্মত হলো।

মুতয়াম বিন আদী জোর করে অঙ্গীকারপত্র ছিঁড়তে গিয়ে দেখলেন যে, আল্লাহর নাম লেখা অংশ বাদে বাকি অংশ সত্যি সত্যিই পোকা খেয়ে ফেলেছে। মুশরিকরা অত্যন্ত অবাক হলো। এভাবে দীর্ঘ তিন বছর পর অবরোধের অবসান হলো এবং রাসূলুল্লাহ সা. ও অন্য সকলে শাবে আবু তালিব থেকে বেরিয়ে এলেন।

পঠিত : ৫৭৭ বার

মন্তব্য: ০