Alapon

আমার মায়ের কান্না...



রমজানের শেষদিকে সেহরি করতে উঠলে মনটা ফিরে যায় গ্রামে আম্মার কাছে। উনি বেঁচে থাকতে প্রায় প্রতি ঈদেই বাড়ি যেতাম। ছুটির দিনগুলোতে যথাসম্ভব ওনার কাছাকাছি থাকার চেষ্টা করতাম।

সেহরির সময় উঠে যখন উঠানে বসে রান্না করতেন তখন আমিও পাশে কাঠের পিঁড়ি নিয়ে বসতাম। চুলায় খড়ি ঠেলতাম আর দু'জনে কুটুর-কুটুর করে কথা বলতাম। হঠাৎ আব্বার ঘুম ভেঙে গেলে ঘর থেকে কিছুটা জোরে আওয়াজ দিতেন; 'এতো রাতে মা-ছেলে মিলে আমার নামে কী এতো ষড়যন্ত্র হচ্ছে শুনি?'

আম্মা মুচকি হেসে উত্তর দিতেন; 'কতোদিন পর ছেলেকে কাছে পেয়েছি তাই চোখের আড়াল করতে ইচ্ছে করে না। আগেতো সারাক্ষণ শাড়ির আঁচল ধরে ঘুরঘুর করতো।' হারিকেনের অল্প আলোতেও মায়ের মুখটা উজ্জ্বল হয়ে উঠতো।

বাড়িতে খুব বেশি হলে শেষ রোজা দুটো পেতাম। ঈদের দিন সকালে নিজ হাতে গোসল করিয়ে, নতুন পাঞ্জাবি পরিয়ে, সেমাই খাইয়ে, দোয়া পড়ে মাথায় হাত বুলিয়ে ঈদগাহে পাঠিয়ে দিতেন। পায়ে হাত দিয়ে সালাম করে বেরিয়ে যাওয়ার মূহুর্তে জড়িয়ে ধরে কাঁদতেন। কান্নার কারণ জিজ্ঞেস করলে কিছু বলতেন না তবে বুঝতাম;
- মায়ের কান্নার কোনো কারণ লাগে না। সন্তানের সুখে কাঁদেন, দুঃখে কাঁদেন, পাশে পাবার আনন্দে কাঁদেন, দূরে যাবার বিরহে কাঁদেন। কারণে অকারণে আজীবন কেঁদেই যান। কান্নায় যেন ক্লান্তি নেই।

শখের বশে টুকটাক লেখালেখি করি অনেক আগে থেকেই। 'দৈনিক দেশ জনতা' পত্রিকায় কয়েকটা লেখা প্রকাশিত হলে সেগুলোর ফটোকপি ও আরো কিছু টাইপ করা লেখা আম্মার কাছে পোস্ট করে পাঠাই। সেখানে 'মা' বিষয়ক কিছু কবিতা ছিল। একবার খুলনায় নানির বাড়ি বেড়াতে গেলে সেগুলো নিয়ে যান। মামা-খালা, আত্মীয়-স্বজন যার বাড়িতে গেছেন সেখানেই লেখাগুলো দেখিয়ে বলেছেন; 'এই যে দেখ! পাগল ছেলেটা আমাকে নিয়ে কবিতা লিখেছে।' পড়ে শোনাতেন আর কেঁদে বুক ভাসাতেন। আব্বাও উৎসাহ যোগাতেন। ওনারা বই আকারে লেখাগুলো দেখে যেতে পারেননি।

কয়েকদিন হৈচৈ শেষে যেদিন বিদায় নিয়ে আসতাম সেদিন আম্মার চোখে ঘুম থাকতো না। গভীর রাতে উঠে রান্না করতে বসতেন ছেলেকে গরম ভাত-তরকারি খাওয়ানোর জন্য। রাস্তায় কষ্ট হবে ভেবে টিফিন বক্স ভর্তি করে খাবার দিতেন। সবচেয়ে কষ্টকর ছিল বিদায়ের ক্ষণটা। বুকের সাথে জড়িয়ে ধরে বার বার মাথায় হাত বুলাতেন আর অশ্রু বিসর্জন করতেন। বাড়ি থেকে বেরিয়ে যখন রাস্তায় উঠতাম তখন তিনি জানালার গ্রিল ধরে দাঁড়াতেন। যতক্ষণ দৃষ্টি সীমার আড়াল না হতাম ততক্ষণ সেখানে স্থির হয়ে থাকতেন। তারপর মন আরো খারাপ করে ঘরের দরজা লাগিয়ে শাড়ির আঁচলে চোখ মুছতেন।
আব্বা সে দৃশ্য দেখতে চাইতেন না। তাই বিদায় নেয়ার অনেক আগেই যেকোনো উসিলায় বাইরে চলে যেতেন। ঢাকায় ফেরার পর সংবাদ পেতাম; আম্মা নাকি কয়েকদিন ঠিকমতো রান্নাবান্না ও খাওয়াদাওয়া করতেন না। সন্তান চলে যাবার শোকে দিনরাত বিছানায় শুয়ে-বসে নীরবে চোখের পানি ফেলতেন।

এখন আম্মা আর কাঁদেন না; আব্বাও মন খারাপ করে বাড়ি থেকে বেরিয়ে যান না। দুজনেই চলে গেছেন হাসি-কান্না, আনন্দ-বেদনার ওপারে। অনুভুতিহীন হয়ে নির্জনে শুয়ে আছেন নিজ নিজ মাটির ঘরে।

অন্তর থেকে দোয়া করি; আল্লাহ পাক হারিয়ে যাওয়া সকল বাবা-মাকে জান্নাতের সুশীতল ছায়াতলে আশ্রয় দান করুন।

- মারুফ চৌধুরী

পঠিত : ১৭৬২ বার

মন্তব্য: ০