Alapon

হৃদয়ের রাজপুত্র মকবুল আহমদ : বড়ো নেতার ছোটো ঘটনা...



কারামত আল্লাহ তায়ালার কুদরতেরই অংশ। কারামত বান্দার ক্ষমতার অংশ নয়, আবার কারও মকবুলিয়াতের চূড়ান্ত সার্টিফিকেটও নয়; বরং তা প্রিয় বান্দার প্রতি আল্লাহর রহমের নিদর্শন মাত্র। এমনকি অনেক সময় আল্লাহ সুবহানাহু তায়ালা বদকার বান্দাকেও অলৌকিক সহযোগিতা দিয়ে থাকেন। সুতরাং কোনো ব্যক্তির অনুসরণীয় দিক হচ্ছে তার সদগুণাবলি, ইখলাস আর আমলে সালেহ; কারামত নয়। হ্যাঁ, আল্লাহর জন্য কাজ করলে যে আল্লাহর খাস রহমত পাওয়া যায়-- সেই এতমিনানের মজবুতির জন্য হলে কারামত আলোচনা ঠিক আছে। কিন্তু কারামত আলোচনা দ্বারা ব্যক্তি কত বড়ো মকবুল আর আধ্যাত্মিক ক্ষমতাসম্পন্ন তা বুঝানো হলে-- সেই আলোচনা উপকারের চেয়ে অপকার বয়ে আনতে পারে।

এতটুকু ভূমিকা বলার উদ্দেশ্য হলো, আজ এক মহান ব্যক্তিকে স্মরণ করতে চাই, তাঁর একটি অনুসরণীয় অসাধারণ গুণকে আলোচ্যে এনে, কিন্তু প্রসঙ্গক্রমে সেখানে তাঁর একটি কারামতও প্রকাশিত হয়েছে। এতদিন এই ঘটনাটি আলাপে না আনার কারণ হলো, আমাদের অতি সরল ও আবেগপ্রবণ বন্ধুরা ঘটনার মূল ও শিক্ষনীয় দিককে ফোকাস না করে কারামতকে ফোকাস ধরার আশঙ্কা! এবং কতিপয় বক্তা সেটাকে আরও তেল চকচকে করে বয়ান করার সমূহ আতঙ্ক থেকে হেফাজতে থাকা।

অসুস্থতা, পারিবারিক জটিলতা, লকডাউনের ব্যবসায়িক ক্ষতি সহ বেশ কঠিন পরীক্ষার সময় পার করছি; অনলাইনে না থাকায় মকবুল চাচার ইন্তেকালের খবর পেয়েছি অনেক দেরিতে, এইমাত্র। আমাদের হৃদয়ের রাজপুত্র মকবুল আহমদকে আল্লাহ সুবহানাহু তায়ালা জান্নাতুল ফিরদাউসের মেহমান হিসেবে কবুল করুন।

কঠিন এক মুহূর্তে নিভৃতচারী, জটিলতাহীন সহজ এ মানুষটি কঠিনতর দায়িত্ব পালন করেছেন। মাত্র একবার সরাসরি দেখেছি মুর্শিদ মকবুল আহমদকে, পল্টনে এক জনসভায়। আর তাঁর গ্রেফতারে অঝোর অশ্রুধারায় একটি কবিতা লিখেছিলাম। এটুকুই হৃদয়ে জাগরুক তাঁর স্মৃতি।

২০১৮'র কোনো একদিন। বায়তুল মুকাররমে সাতকানিয়ার এক ব্যবসায়ীর সাথে ঘটনাচক্রে দেখা। বায়তুল মুকাররমের নিচতলায় তার ব্যাবসা প্রতিষ্ঠান। সেখানেই আমাদের চারজনের দীর্ঘ গল্পসল্প। সাতকানিয়া-লোহাগাড়ার কুখ্যাত নির্বাচন থেকে ঢাকা-চট্টগ্রামের সংগঠন, পরিবার-পরিজন থেকে ব্যবসায় ইত্যাদি বিচিত্র বিষয়ে আলাপের ডালপালা বিস্তৃত হলো। সেই ডালপালা একসময় মকবুল চাচায় গিয়ে ঠেকল। তাঁর বয়স, দক্ষতা, ইখলাস, সামর্থ্য, সীমাবদ্ধতা, পরিস্থিতির কাঠিন্যতা ইত্যাদি নিয়ে নানা মুনি নানা মত দিলাম। ব্যবসায়ী ভাইটি বললেন, আমি মতামতের বাইরে একটা ব্যক্তিগত ঘটনা বলি, খুব কম মানুষকেই এটি আমি বলেছি। তিনি শুরু করলেন...

নব্বইয়ের দশক (তিনি সাল বলেছেন, আমার মনে নেই)। আমার বাসার পাশে একটি প্রোগ্রাম। মোটামুটি বড়সড় আয়োজন। মেহমান মকবুল আহমদ। আমার বাসার সন্নিকটে হওয়ায় মেহমানের আপ্যায়ন ও বিশ্রামের ব্যবস্থার দায়িত্ব পড়ল আমার ওপর। যথাসময়ে তিনি এলেন। মেহমানদারির শুকরিয়া জানালেন। পরিবারের খোঁজ নিতে গিয়ে বললেন, ছেলেমেয়ে ক'জন?

--- এখনও আল্লাহ পাক দেননি।
--- কত বছর হলো বিয়ের?
--- আট বছর। (সম্ভবত আট বলেছেন, অথবা ছয়)
--- বাচ্চা কি আল্লাহ পাক দেননি, নাকি আপনারা নেননি? (মুচকি হেসে, এ হাসি অনন্য, যে এ হাসির সৌন্দর্য দেখে নাই, তার কল্পনাশক্তি এ হাসিকে অনুভব করা কঠিন আছে)
--- না, আল্লাহ পাকই দেননি।
তিনি দুআ করলেন। নির্ধারিত সময়ে বিদায় নিলেন।
এরপর কয়েক বছর কেটে গেল। একদিন বাসায় ফোন এলো, 'অমুক ভাই আছেন?'
--- জি, আমি বলছি।
--- আচ্ছা, লাইনে থাকুন, জামায়াত অফিস থেকে বলছি, মকবুল আহমদ স্যার কথা বলবেন।
আমি ঢোক গিললাম। একদিনের ক্ষণিক সময়ের মেহমানদারি মাত্র! আমি মনে রাখার পর্যায়ের দায়িত্বশীল কেউ নই, সাধারণ রুকন মাত্র। কিন্তু আমার যে বিস্ময়ের ওপরে বিস্ময় অপেক্ষা করছে তা কে জানত!
টেলিফোনের ওপার থেকে স্নেহমাখা কণ্ঠে আমার নাম শোনা গেল...
--- কেমন আছেন? পরিবার কেমন আছে?

কুশল জানালাম। আমার ফ্রি সময়ে জামায়াত অফিসে গিয়ে তাঁর সাথে একটু সাক্ষাতের অনুরোধ করলেন। আমি তখুনি ছুটলাম! এ কেমন নেতা! নিভৃতচারী স্মিত হাসির যে মানুষটি একটু ক্ষণিক দেখার কর্মীকে কয়েক বছর পরও নামসহ মনে রাখেন আর খোঁজ নেন, সে নেতার ডাক উপেক্ষা করার সাধ্য কী!

আন্তরিক অভিবাদন জানালেন তিনি। আবার খোঁজ নিলেন। দুটো খেজুর দিয়ে হাত চেপে ধরে বললেন, রাতে দুজনে খাবেন, আল্লাহর কাছে দুআ করবেন, ইনশাআল্লাহ আল্লাহ পাক আপনাদের সন্তান দেবেন।

আমার চোখে পানি এসে গেল। ঘরে ফিরলাম। আল্লাহর কাছে খুব কাঁদলাম দু জনে। খেজুর দুটো খেলাম। আলহামদুলিল্লাহ। কদিনের মধ্যেই আল্লাহ পাক আমাদের সুসংবাদ দিলেন। আমার ওয়াইফ কনসিভ করল।

আমি আবার ছুটলাম নেতার কাছে। চেপে ধরলাম, আমাকে এর রহস্য জানাতে হবে!
স্মিত হেসে তিনি বললেন, আরে নাহ! কোনো রহস্য নেই। ওমরায় গিয়েছিলাম। খেজুর দুটো হাতে নিয়ে খানায়ে কাবায় আপনাদের সন্তান দানের জন্য আল্লাহর কাছে দুআ করেছি। এটুকুই।

এখানেই ব্যবসায়ী ভাইটির গল্প শেষ। তার চোখে অশ্রুর ঝিলিক, টলটল করছে, কিন্তু ঝরে পড়ছে না, মুখে হাসি।

আমি অভিভূত হয়ে সেই নেতার কথা চিন্তা করছি, যিনি কয়েক মুহূর্তের পরিচয়ের কর্মীর কথা মনে রাখেন কয়েক বছর পর খানায়ে কাবায় মুনাজাতের সময়, তার আরজুর ফরিয়াদ করেন রবের কাছে একান্ত মুহূর্তে। এই দরদের চেয়ে বড়ো কারামত আর কী হতে পারে! অলৌকিক কারামতের চেয়ে এই দরদ আর ভালোবাসার কারামত কোনো অংশে কম নয়; বরং অনুসরণীয়।

- আবু সুফিয়ান

পঠিত : ২৭৭ বার

মন্তব্য: ০