Alapon

দ্বীন প্রতিষ্ঠার বাইয়াত ও শয়তানের চিৎকার



মিরাজে আল্লাহ তায়ালা মুহাম্মদ সা.-কে রাষ্ট্র পরিচালনার ইঙ্গিত দিয়েছিলেন। এবং সে অনুযায়ী মুসলিমদের নিয়মিত প্রশিক্ষণ প্রোগ্রাম সালাত ফরজ করেছেন। সেই সাথে মুসলিমদের উদ্দেশে ১৪ দফা নির্দেশনা নাজিল করেছিলেন। মিরাজের পর আল্লহর রাসূলের জীবনে একের পর এক সাফল্য ধরা দিতে থাকে।

নিশ্চয়ই কষ্টের পরই আছে স্বস্তি। আল্লাহর রাসূল সা. প্রায় ৩ বছর অবরুদ্ধ ছিলেন। বের হয়েই গেলেন তায়েফে। সেখানে চরম মার খেলেন, যেটা তাঁর জীবনে সবচেয়ে কষ্টকর ঘটনা। এরপর মক্কার বাইরে অনেক গোত্রকে দাওয়াত দিয়েছেন, কোনো গোত্রই সাড়া দেয়নি। এরপর আল্লাহ মুহাম্মদ সা.-কে পরীক্ষার পুরস্কার স্বরূপ দিলেন মিরাজ। এরপর থেকে আল্লাহর রাসূল সা. পৃথিবীর নেতা হওয়ার পথে হাঁটতে শুরু করলেন। আর এই পথে হাঁটার সুযোগ হয় মদিনাবাসীদের মাধ্যমে।

বর্তমান মদীনার পূর্ব নাম ছিল ইয়াসরিব। ইয়াসরিবের দু’টি বড় গোত্র ছিল আওস ও খাজরাজ। তারা পরস্পরে দীর্ঘস্থায়ী সংঘর্ষে লিপ্ত ছিল। ইয়াসরিবের এ অভ্যন্তরীণ দ্বন্দ্বের সুযোগে তিনটি ইহুদি গোত্র ইয়াসরিবের কিছু অংশ দখল করে তাদের আধিপত্য প্রতিষ্ঠা করে। ইয়াসরিববাসী আওস ও খাজরাজ ইহুদীদের বহিরাগত বলে অপছন্দ করতো। আবার একে অপরকে দমাতে ইহুদিদের সাহায্য গ্রহণ করতো।

অন্যদিকে ইহুদিরা নিজেদেরকে আসমানী গ্রন্থের অনুসারী বলে দাবি করতো এবং তাদের তাওরাত কিতাবের ভবিষ্যদ্বাণী অনুযায়ী তারা শেষ নবী ও বিশ্বনবীর জন্য অপেক্ষা করছিল। শেষনবীর আবির্ভাব ঘটলে তাঁর দ্বীনে শামিল হয়ে সারা বিশ্বের ওপর তারা আধিপত্য বিস্তার করবে বলে ইয়াসরিববাসীদেরকে হুমকি দিত এবং শেষ নবীর আবির্ভাবের সময় ঘনিয়ে এসেছে বলেও তারা বলাবলি করত। ইতোমধ্যে বিভিন্ন সূত্রে মহানবী সা.-এর মক্কায় আবির্ভাব ও ইসলাম প্রচারের বার্তা ইয়াসরিবে পৌঁছে গিয়েছিল। ইহুদিরা ভেবেছিল তাদের বংশ থেকেই কেউ নবী হবে। কারণ তাদের বংশেই বেশিরভাগ নবী এসেছিল। কিন্তু মুহাম্মদ মক্কায় কুরাইশ বংশে আসায় তারা তা মেনে নেয় নি। যদিও তারা বুঝেছিল ইনিই তাদের কাঙ্ক্ষিত শেষ নবী।

মিরাজের আগে নবুয়্যতের ১১তম বছরে ৬২০ সালে হজ্জের সময় প্রতিবারের মতোই আল্লাহর রাসূল সা.-এর দাওয়াতী কাজে বাধা সৃষ্টি করছিলো। মুশরিকরা আল্লাহর রাসূল সা.-কে অবিশ্বাস করা এবং লোকদের আল্লাহর পথ থেকে দূরে সরিয়ে নেওয়ার যে ষড়যন্ত্র শুরু করেছিলো তা থেকে পরিত্রাণ পেতে রাসূল সা. কৌশলের আশ্রয় নেন। এসময় তিনি রাত্রিকালে বিভিন্ন গোত্রের কাছে গিয়ে তাদের ইসলামের দাওয়াত দিতেন।

রাত্রিকালীন দাওয়াতের একপর্যায়ে রাসূলুল্লাহ সা. আবু বকর ও আলী রা.কে সঙ্গে নিয়ে মক্কার বাইরে বনু যোহাল এবং বনু শায়বান ইবনে ছালাবা গোত্রের লোকদের তাঁবুতে গিয়ে তাদের কাছে ইসলামের দাওয়াত দেন। জবাবে তারা আশাব্যঞ্জক কথা বলে। কিন্তু ইসলাম গ্রহণের ব্যাপারে সুনির্দিষ্ট কোন সাড়া দেয়নি। এরপর মুহাম্মদ সা. মিনার পাহাড়ী এলাকা অতিক্রমের সময় কয়েকজন লোককে আলাপ করতে শোনেন। তারা ইহুদিদের থেকে শোনা শেষ নবী নিয়ে আলোচনা করছিল। এরা ছিলো মদিনার খাজরাজ গোত্রের ছয়জন যুবক।

রাসূলুল্লাহ সা. তাদের কাছে গিয়ে পরিচয় জিজ্ঞাসা করলেন। তারা বললো, আমরা খাযরাজ গোত্রের লোক, রাসূলুল্লাহ সা. বললেন, ইহুদীদের প্রতিপক্ষ? তারা বলল, হ্যাঁ। আল্লাহর রাসূল সা. বললেন, তোমরা একটু বসো। আমি কিছু কথা বলি, তারা বসলো। রাসূলুল্লাহ সা. তাদের কাছে দ্বীনের দাওয়াত দিলেন। সেই ছয়জন যুবক পরস্পরকে বললো, এই তো মনে হয় সেই নবী, যার কথা উল্লেখ করে ইহুদিরা আমাদের ধমক দিয়ে থাকে। ইহুদীরা যেন আমাদের উপর প্রাধান্য বিস্তার না করতে পারে আমাদের সেই ব্যবস্থা করতে হবে। এরপর সেই ছয় ভাগ্যবান যুবক রাসূলুল্লাহ সা.-এর দাওয়াত কবুল করে ইসলাম গ্রহণ করেন।

এই ছয়জন ছিলেন মদিনার বিবেকসম্পন্ন মানুষ। এই ছয়জন মুসলিম মদিনায় ফিরে যাওয়ার সময় ইসলামের দাওয়াত সাথে নিয়ে গেলেন। এদের মাধ্যমে মদিনার ঘরে ঘরে রাসূলুল্লাহ সা.-এর আবির্ভাব ও দ্বীনের দাওয়াত ছড়িয়ে পড়লো। এরপর রাসূল সা.-এর জীবনে মিরাজের ঘটনা ঘটলো।

এর পরের বছর আবার হজ্বের সময় আসলো। ইয়াসরিবের যে ছয়জন মানুষ ইসলাম গ্রহন করেছিলেন তারা আল্লাহর রাসূলের সাথে ওয়াদা করেছিলেন যে, নিজেদের গোত্রে ফিরে গিয়ে নবী সা.-এর রিসালাত ও ইসলামের তাবলীগ করবেন। তারা তাদের ওয়াদা পালন করেন। অনেকেই ইসলাম গ্রহণ করেন। এরমধ্যে আগের ৫ জন সহ ১২ জন লোক রাসূল সা.-এর সাথে দেখা করতে আসেন।

এরা সবাই মিনায় আকাবার কাছে আল্লাহর রাসূলের সাথে দেখা করেন। মুহাম্মদ সা. তাদের স্বাগত জানান। সেখানে তারা আল্লাহর রাসূল সা.-এর কাছে ছয়টি বিষয়ে বাইয়াত বা শপথ করেন।

(১) আমরা একমাত্র আল্লাহর উপাসনা করব।
(২) আমরা ব্যভিচারে লিপ্ত হব না।
(৩) আমরা চুরি-ডাকাতি বা কোনোরূপ পরস্ব আত্মসাৎ করব না।
(৪) আমরা সন্তান হত্যা বা বলিদান করব না।
(৫) কারও প্রতি মিথ্যা অপবাদ বা দোষারোপ করব না।
(৬) প্রত্যেক সৎকাজে আল্লাহর রাসুলকে মেনে চলব এবং কোনো ন্যায় কাজে তার অবাধ্য হব না।

এটি ইসলামের ইতিহাসে প্রথম আনুষ্ঠানিক শপথ বা বাইয়াত। এই বাইয়াতের মাধ্যমে আল্লাহর রাসূল সা.-কে নেতা হিসেবে মানা, তার আনুগত্য করা ও ভবিষ্যত ইসলামী রাষ্ট্রের ভিত্তি স্থাপিত হয়। এই বাইয়াত যখন হয় তখন আল্লাহর রাসূল সা.-এর কাছে কোন ভূমি বা রাষ্ট্র ছিল না। তবে রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠার প্রচেষ্টা ছিল। এই বাইয়াত 'বাইয়াতে আকাবা উলা' বা আকাবার ১ম শপথ নামে পরিচিত। এই বাইয়াত অনুষ্ঠিত হয় গোপনে।

বাইয়াত শেষ হয়ে গেলো এবং হজ্জ ও শেষ হলো। বাইয়াতকারীরা মদিনায় ফিরে যাওয়ার সময় তাদের আবেদনের প্রেক্ষিতে মুহাম্মদ সা. তাদের সাথে তাঁর একজন দূত প্রেরণ করেন। মুহাম্মদ সা. আগত লোকদের সাথে মদিনায় তার প্রথম দূত মুসয়াব বিন উমাইর রা.-কে পাঠালেন। মদিনার মুসলমানদের ইসলামের শিক্ষা প্রদান এবং যারা এখনো ইসলাম গ্রহণ করেনি তাদের কাছে দ্বীনের দাওয়াত প্রদানই ছিল এ এই দূত প্রেরণের উদ্দেশ্য। মুসয়াব বিন উমাইর রা. মদিনায় পৌঁছে হযরত আসআদ ইবনে যুরারা রা.-এর ঘরে অবস্থান করেন। এরপর উৎসাহ উদ্দীপনার সাথে উভয়ে মদীনাবাসীদের ইসলামের দাওয়াত দিতে শুরু করেন। এ সময় হযরত মুসয়াব মুকরিউন উপাধি লাভ করেন এর অর্থ শিক্ষক বা মুয়াল্লিম।

এরপরের বছর আবার হজ্বের সময় আসলো। এটি ছিল নবুয়তের ১৩ তম বছর। মদিনা থেকে ৭০ জন মুসলমান হজ্ব পালনের জন্য মক্কায় আগমন করেন। মক্কায় পৌঁছার পর গোপনে তারা প্রিয় রাসূল সা.-এর সাথে গোপনে যোগাযোগ করলেন। সিদ্ধান্ত হলো ১২ জিলহজ্জ তারিখে মিনার আকাবায় একটি সম্মেলন অনুষ্ঠিত হবে। তবে বিষয়টা থাকবে গোপন নাহলে মক্কার কুরাইশরা ঝামেলা করবে। এই সম্মেলন ইসলাম ও মূর্তিপূজার সংঘাতের মধ্যে সময়ের গতিধারা পরিবর্তন করে দিয়েছিল। একজন আনসার নেতার মুখে সেই সম্মেলনের কথা শুনি।

কাব ইবনে মালিক রা. বলেন, //আমরা হজ্জ এর জন্যে এসেছিলাম মক্কায়। প্রিয় নবী আইয়ামে তাশরিকের মাঝে আকাবায় আমাদের সাথে কথা বলার সময় নির্ধারণ করলেন। অবশেষে সেই রাত এলো। সেই রাতে আমরা নিয়ম অনুযায়ী আমাদের তাঁবুতে শুয়ে পড়লাম রাতের এক তৃতীয়াংশ কেটে যাওয়ার পর আল্লাহর রাসূলের সাথে পূর্ব নির্ধারিত জায়গায় মিলিত হলাম। চড়ুই পাখী যেমন চুপিসারে তার বাসা থেকে বের হয়, আমরাও ঠিক সেভাবেই তাঁবু থেকে বের হয়েছিলাম। এক সময় আমরা আকাবায় সমবেত হলাম সংখ্যায় ছিলাম আমরা ৭৫ জন। ৭৩ জন পুরুষ এবং ২ জন মহিলা। আমরা সবাই ঘাঁটিতে পৌঁছে প্রিয় রাসূল সা.-এর জন্য অপেক্ষা করছিলাম। একসময় তিনি এসে পৌঁছলেন। তাঁর সাথে ছিলেন তাঁর চাচা আব্বাস ইবনে আবদুল মুত্তালিব।

সম্মেলন শুরু হলো। দ্বীনি এবং সামরিক সহায়তাকে চূড়ান্ত রূপ দিতে আলোচনা হচ্ছিল। আব্বাস রা. প্রথমে কথা বললেন, তিনি চাচ্ছিলেন যে, পরিস্থিতির আলোকে দায়িত্বের প্রতি গুরুত্বারোপ করতে। তিনি আমাদের উদ্দেশে বলেন, মুহাম্মদ সা. এর যে মূল্য ও মর্যাদা রয়েছে সেটা তোমরা জানো। আমাদের কওমের মধ্যে মুহাম্মাদ প্রবর্তিত ধর্ম বিশ্বাস যারা সমর্থন করে না, মুহাম্মাদকে তাদের কাছ থেকে আমরা দূরে রেখেছি। তিনি নিজ শহরে স্বজাতীয়দের মধ্যে তিনি নিরাপদ রয়েছেন। তিনি বর্তমানে তোমাদের কাছে যেতে চান, তোমাদের সাথে মিশতে চান যদি তোমরা তার নিরাপত্তা দিতে এবং বিরোধী পক্ষের হামলা থেকে তাকে হেফাজত করতে পারো।

তোমরা যদি তাঁর নিরাপত্তা দিতে পারো তবে আমার কিছু বলার নেই। তোমরা যে দায়িত্ব নিয়েছ সে সম্পর্কে তোমরাই ভালো জানো। কিন্তু যদি তাকে ছেড়ে যাওয়ার চিন্তা করে থাকো, তবে এখনই চলে যাও, কেননা তিনি স্বাজাতীয়দের মধ্যে নিজ শহরে নিরাপদেই আছেন, তার সম্মানও এখানে রয়েছে।

আমরা তখন আব্বাসকে বললাম যে, আপনার কথা আমরা শুনেছি এবং আমরা প্রতিজ্ঞাবদ্ধ। এরপর মুহাম্মদ সা.কে বললাম, হে আল্লাহর রাসূল! এবার আপনি কথা বলুন। আপনি নিজের এবং আপনার প্রতিপালকের জন্য আমাদের কাছ থেকে যে অঙ্গীকার নিতে চান তাই নিন। এরপর মুহাম্মদ সা. কুরআন পাঠ করলেন। আমাদের আল্লাহর আনুগত্যের দিকে আহবান জানালেন। এরপর তিনি আমাদের বাইয়াত গ্রহণ করলেন ৫ টি বিষয়ের ওপরে।

১. ভালোমন্দ সকল অবস্থায় আমার কথা শুনবে এবং মানবে।
২. সচ্ছলতা অস্বচ্ছলতা উভয় অবস্থায়ই ধন সম্পদ ব্যয় করবে।
৩. সৎ কাজের আদেশ দেবে এবং অসৎ কাজ থেকে বিরত রাখবে।
৪. আল্লাহর পথে উঠে দাঁড়াবে এবং আল্লাহর ব্যাপারে কারো ভয়ভীতি প্রদর্শনে পিছিয়ে যাবে না।
৫. তোমাদের কাছে যাওয়ার পর আমাকে সাহায্য করবে এবং নিজেদের প্রাণ ও সন্তানদের হেফাজতের মতোই আমার হেফাজত করবে এতে তোমাদের জন্যে জান্নাত রয়েছে

আমরা আল্লাহর রাসূল সা.-এর সাথে কথা বলছিলাম তখন আমাদের মধ্যেকার আবুল তায়াহাল ইবনে তাইহান বললেন, হে রাসূল! ইহুদিদের সাথে আমাদের যে চুক্তি রয়েছে আমরা তার রজ্জু কেটে ফেলবো। আমরা ইহুদিদের সাথে সম্পর্ক ছিন্ন করলাম। এরপর আল্লাহ তায়ালা আপনাকে জয়যুক্ত করলে আপনি আমাদের ছেড়ে স্বজাতীয়দের কাছে ফিরে আসবেন না তো?

এ কথা শুনে রাসূলুল্লাহ সা. মৃদু হেসে বললেন। না! তা হবে না। তোমাদের রক্ত আমার রক্ত এবং তোমাদের ধ্বংস আমার ধ্বংস হিসেবে গণ্য হবে। আমি তোমাদের অন্তর্ভুক্ত আর তোমরা আমার অন্তর্ভুক্ত। তোমরা যাদের সাথে যুদ্ধ করবে আমিও তাদের সাথে যুদ্ধ করবো। তোমরা যাদের সাথে সন্ধি করবে, আমিও তাদের সাথে সন্ধি করবো।//

এখানে মদিনাবাসী ইসলাম প্রতিষ্ঠার বাইয়াতের বিনিময়ে আল্লাহর রাসূল সা. এর পক্ষ থেকে জান্নাতের ওয়াদা নিলেন। একইসাথে এই ওয়াদাও নিলেন যে, বিজয় অর্জিত হওয়ার পর মুহাম্মদ সা. মদিনাবাসীদের ছেড়ে যাবে না। তিনি মদিনাতেই থাকবেন। বাইয়াত সমাপ্ত হলে সবাই নতুনভাবে উজ্জীবিত হন এবং মুহাম্মদ সা.-এর সাথে হাত মিলান। তবে দুজন মহিলার সাথে মুহাম্মদ সা. হাত মিলান নি।

এরপর মুহাম্মদ সা. মদিনার জন্য নকীব নির্বাচন করার জন্য সিদ্ধান্ত জানালেন। এরা হবে তাদের কওমের নকীব। তাদের দায়িত্ব হবে বাইয়াতের শর্তাবলী নিজ নিজ কওমের লোকদের দ্বারা পূরণ করানো। প্রিয় নবী উপস্থিত লোকদের বললেন, বারোজনের নাম জানাতে। তারা কিছুক্ষণের মধ্যেই ১২ জন নকীব মনোনীত করলেন। এদের মধ্যে ৯ জন খাজরাজ ও ৩ জন আওস গোত্রের ছিলেন।

(১) আসাদ ইবনে যুরারা (২) সাদ ইবনে রাবী (৩) আব্দুল্লাহ ইবনে রাওয়াহা (৪) রাফে ইবনে মালিক (৫) বারা ইবনে মারুর (৬) আব্দুল্লাহ ইবনে আমর ইবনে হারাম (৭) উবাদা ইবনে সামিত (৮) সা’দ ইবনে উবাদা (৯) মুনযির ইবনে আমর ইবনে খুনাইস (১০) উসাইদ ইবনে খুদাইর (১১) সাদ ইবনে খায়সামা (১২) আবুল হাইসাম ইবনে তাইহান

১২ জন নকীব নিযুক্ত হওয়ার পর তাদর কাছ থেকে রাসূল সা. পুনরায় আরো একটি অঙ্গীকার নিলেন কারণ এরা ছিলেন অধিক দায়িত্বশীল। তিনি বললেন আপনারা স্বজাতীয়দের সকল বিষয়েরই জন্যেই দায়িত্বশীল ও জিম্মাদার, হাওয়ারিয়া (১২ জন)। হযরত ঈসা আ. এর পক্ষ থেকে যেমন দায়িত্বশীল ও জিম্মাদার ছিলেন, আপনারাও ঠিক তেমনি আমি মুসলমানদের পক্ষ থেকে দায়িত্বশীল ও জিম্মাদার। তারা সবাই সমস্বরে বললেন, জ্বী হ্যাঁ।

ইসলামী রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠা তথা দ্বীন কায়েমের জন্য এই বাইয়াতের ঘটনা ছিল একটি ঐতিহাসিক ঘটনা। এটি আকাবার ২য় শপথ নামে পরিচিত। ইকামাতে দ্বীনের জন্য বাইয়াতের ঘটনা ঘটবে আর শয়তান চুপ থাকবে তা তো হতে পারে না। ইকামাতে দ্বীনের অগ্রগতি ও মদিনার মুসলিমদের দৃঢ় প্রতিজ্ঞ শপথ দেখে ইবলিশ শয়তানের মাথা খারাপ হয়ে গেল। সে চিৎকার করতে শুরু করলো। একটি উঁচু পাহাড়ের চূড়ায় উঠে সে উচ্চস্বরে বললো, মিনাবাসীরা মোহাম্মাদকে দেখো, বে-দ্বীন লোকেরা এখন তার সঙ্গে রয়েছে। তোমাদের সাথে লড়াই করার জন্য তারা একত্রিত হয়েছে।

তার চিৎকার শুনে মুহাম্মদ সা. আর সেখানে থাকলেন না। সবাইকে বললেন, আপনারা যারা যার তাঁবুতে ফিরে যান। সবাই যার যার স্থানে ফিরে গেল ও ঘুমিয়ে পড়ার ভান করলো। শয়তানের চিৎকার মুশরিকরা শুনতে পেয়েছে। এ খবর পেয়ে তারাও দিশেহারা হয়ে পড়লো। কেননা এ ধরনের বাইয়াতের সুদূরপ্রসারী ফলাফল সম্পর্কে তারা অবহিত ছিল। পরদিন সকালে কোরাইশদের একদল বিশিষ্ট লোক মদীনাবাসী আগন্তুকদের তাঁবুর সামনে গিয়ে গত রাতের সম্মেলনের এবং বাইয়াতের বিরুদ্ধে তীব্র ক্ষোভ প্রকাশ করলো। তারা বললো, ওহে খাজরাজের লোকেরা আমরা শুনলাম তোমরা আমাদের এই লোককে আমাদের কাছ থেকে বের করে নিয়ে যেতে চাও। তোমরা আমাদের সাথে যুদ্ধ করার জন্যে তার হাতে বাইয়াত করেছ। অথচ তোমাদের সাথে যুদ্ধ করা আমরা পছন্দ করি না।

মক্কার কোরাইশরা বিক্ষোভ প্রদর্শন করার পর মদিনা থেকে আসা অমুসলিম হাজীরা অস্বীকার করলো। আসলে তারা তো বিষয়টা জানেই না। তারা বলল, তোমাদের কথা ঠিক নয়। তারা কসম করে বলল, এ ধরনের ঘটনা ঘটতেই পারে না। আবদুল্লাহ ইবনে উবাই এই ব্যাপারে কিছুই জানতো না। সে ছিল খাজরাজদের নেতা। সে বললো, আমার কওমের লোকেরা আমাকে বাদ দিয়ে এত বড় কাজ করবে, এটাতো চিন্তাই করা যায় না। আমি তো এখন মক্কায়। যদি আমি ইয়াসরিবে থাকতাম, তবুও তারা আমার সাথে পরামর্শ না করে এ ধরনের পদক্ষেপ গ্রহন করতো না।

সম্মেলন এবং বাইয়াত রাতের আঁধারে ও গোপনে হওয়ায় মদিনার বাকী লোকেরা কিছুই জানতো। তাদের প্রতিবাদের মুখে মক্কার কুরাইশ নেতারা বুঝলো যে, আশঙ্কা করার মত কিছুই আসলে ঘটেনি। অবশেষে তারা হতাশ হয়ে ফিরে গেল। মক্কায় কুরাইশ নেতারা এ বিশ্বাসের সাথে ফিরে এলো যে, তারা যা শুনেছে, সেটা সত্য নয়। তবে যেহেতু সন্দেহ ছিল, এ জন্যে তারা তথ্য সংগ্রহের জন্য অধীর হয়ে উঠলো, শেষ পর্যন্ত বুঝতে পারল যে, ঘটনা সত্য, বাইয়াতের ঘটনা আসলেই ঘটেছে। নিশ্চিতভাবেই ঘটেছে। কিন্তু এ খবর নিশ্চিতভাবে যখন তারা পেল তখন মদিনার হজ্জ যাত্রীরা রওয়ানা হয়ে গেছেন।

কিছুসংখ্যক অমুসলিম মদিনায় যাত্রীদের পিছু ধাওয়া করল, কিন্তু সুযোগ ততক্ষণে হাতছাড়া হয়ে গেছে। দ্রুতগামী ঘোড় সওয়াররা সাদ ইবনে উবাদা এবং মুনজির ইবনে আমরকে দেখতে পেলো। মুনজির দ্রুত এগিয়ে গেলেন, কিন্তু সাদ ধরা পড়লেন। তাঁকে মক্কায় বেঁধে নিয়ে আসা হলো। তাকে ভীষণ প্রহার কার হলো। মক্কায় নেয়ার পর মুতয়াম ইবনে আদী এবং হারিস ইবনে হবর উমাইয়া তাকে ছাড়িয়ে দিলেন। কেননা এই দুজনের বাণিজ্য কাফেলা মদিনায় সাদ ইবনে উবাদার তত্ত্বাবধানে যাতায়াত করতো।

এদিকে মদিনায় হজ্জ যাত্রীরা তাদের সফরসঙ্গী সাদ ইবনে উবাদার গ্রেফতারের ঘটনায় তীব্র ক্ষোভ প্রকাশ করলেন। তারা মক্কায় ফিরে গিয়ে কুরাইশদের ওপর হামলার সিদ্ধান্ত নিলেন। কিন্তু মক্কার দিকে এগিয়ে যাওয়ার আগেই তারা লক্ষ্য করলেন যে, সাদ ইবনে উবাদা ফিরে আসছেন। এরপর কাফেলার সবাই নিরাপদে রওয়ানা হয়ে নিরাপদে মদিনা পৌঁছলেন। দ্বীন কায়েমের জন্য মদিনার মুসলিমরা যে শপথ নিয়েছিলেন তা দ্বীন কায়েমের গতি তরান্বিত করেছে। যেসব জনপদে দ্বীন প্রতিষ্ঠিত নেই সেসব জনপদের মুসলিমদের দ্বীন প্রতিষ্ঠা করার জন্য বাইয়াত নেওয়া অত্যাবশ্যকীয়। আর যেখানে ইসলাম প্রতিষ্ঠিত ও বৈধ শাসক ক্ষমতায় থাকে সেখানে শাসকের আনুগত্যের বাইয়াত নেওয়া অত্যাবশ্যকীয়।

জেনে রাখবেন বাইয়াতবিহীন মৃত্যু জাহেলিয়াতের মৃত্যু। হযরত আব্দুল্লাহ ইবনে উমার রা. বলেন, রাসূলুল্লাহ সা. বলেছেন, যে ব্যক্তি বাইয়াতের বন্ধন ছাড়াই মৃত্যুবরণ করলো, সে জাহেলিয়াতের মৃত্যুবরণ করলো।

পঠিত : ৩৮৬ বার

মন্তব্য: ০