Alapon

সব হারানোর কালে...



একটা সময় ছিল, যখন খুব গর্ব করে নিজের পঠিত বইয়ের সংখ্যা বলে বেড়াতাম।

৫/৭ হাজার বই পড়া মানুষ প্রতিটা গলিতেই এক-দুইজন রয়েছে বলে বিশ্বাস করতাম। নিজেকে তেমনই খুব সাধারণের মধ্যে একটুখানি অসাধারণ একজন বলে জ্ঞান করতাম...

সমরেশের গর্ভধারিণী আর স্টিফেন হকিংয়ের ব্রিফ হিস্ট্রি অব টাইম- আমি ও আমার বন্ধুরা তখন এক বৈঠকে পাঠ করেছি। হুমায়ূন আহমেদের বই প্রতিদিন চারটা/ছয়টা গিলে খেয়েছি। শুধু পরীক্ষার মৌসুমগুলি বাদে এই ধারা সমস্ত বছর ভরে অব্যাহত ছিল।

গল্প, কবিতা, বিজ্ঞান বা দর্শনের বই বাদ। শুধুমাত্র ইতিহাসের বইয়ের কথা বিবেচনা করলেও সংখ্যাটা হাজার পাঁচেক ছাড়িয়ে যায়।

মানুষ নদী থেকে সমুদ্রে যায়।

আমি সমুদ্র থেকে নদী, নদী থেকে কুয়োর দিকে ধাবিত হচ্ছি। শুধুমাত্র সাহিত্যের গ্রুপগুলিতে নিয়মিত কিছু পাঠক দেখতে পাই। বাস্তবে, এমনকি, আমার নিজের ছাত্রছাত্রীদের দিকেও তাকিয়ে করুণা হয়...

হাজার পৃষ্ঠার একটা বইকে কেটেকুটে পঞ্চাশ পৃষ্ঠার একটা নোট করে ওদের হজম করাতে হয়। সাহিত্য, বিজ্ঞান, ইতিহাস, দর্শন- ওদের কাছে আজাইরা বই। এইগুলা দিয়ে জীবনে কিছু হয় না। কিচ্ছু হয়না মানে অর্থ উৎপাদন হয় না!

আগে কষ্ট হতো। এখন মেনে নিয়েছি।

হাজার বছরের কালপরিক্রমায় অতিশয় ধীরে ধীরে সভ্যতার বিকাশ ঘটেছে। সভ্যতার উত্তরণের ধাপে ধাপে মানুষ যে জ্ঞান ও নন্দনবোধ সঞ্চয় করেছে... শত সহস্র বইয়ের পাতায় সেগুলো লিপিবদ্ধ করে গিয়েছে। ওরা এইসব অনুভব করতে পারে না। চায়ও না।

জীবন যেখানে পশুর চাইতেও পাশবিক, জ্ঞান ও নন্দনবোধ সেখানে আলগা বিলাসিতা।

বিগত কুড়ি বছরে এই দেশের সবচেয়ে বড় যে ক্ষতিটা হয়েছে তা হচ্ছে, মধ্যবিত্ত শ্রেণির বিলুপ্তি। এই দেশে এখন আর প্রকৃতই শান্ত সৌম্য মধ্যবিত্ত নেই। উচ্চবিত্ত হতে না পারার অপরাধে ক্রন্দসী "নিম্ন-উচ্চবিত্ত" আছে, খাদ্যের অভাবে ক্রন্দসী "ভয়ংকর রকমের নিম্নবিত্ত" আছে। কিন্তু সত্যিকারের মধ্যবিত্ত নেই। মধ্যবিত্তের এই বিলুপ্তির সঙ্গে সঙ্গে শিল্পবোধ, নন্দনবোধের ভাঙন লেগেছে...

হুমায়ূন আহমেদের মধ্যবিত্তের গল্পগুলিকে এখন আমার কাছে রূপকথার গল্প বলে মনে হয়। কেননা, যতদূর চোখ যায়, নিজের অবস্থানে স্থির ও তুষ্ট কোন পরিবারে এখন আর চোখে দেখি না। বিত্তের অভাবে কাতর নিম্ন-উচ্চবিত্ত দেখি, আর শুধু নিম্নবিত্ত দেখি...

আর এই দুইধারার মানুষের কাছেই, সরাসরি অর্থ উৎপাদনে ভূমিকা রাখে না এমন যেকোনো কিছুই আজাইরা প্রোডাক্ট, আজাইরা ইনভেস্টমেন্ট...

সভ্যতা সবসময়ই ঊর্ধ্বগামী হয় না। মাঝেমধ্যে পাতালগামীও হয়। আর এই পাতালগামী অভিযাত্রার দায় শুধুমাত্র কিছু ব্যক্তিমানুষের নয়, সমকালীন প্রশাসন, আমলাতন্ত্র এবং রাষ্ট্রনায়কদের কাধেও বর্তায়।

মধ্যবিত্তের এই ভাঙনের পেছনে সবচেয়ে বড় দায় হচ্ছে সরকারের বিভিন্ন বিভাগের আমলাদের ঔদাসীন্য আর ক্ষমতাসীন দলের সাথে সম্পৃক্ত মানুষগুলির সীমাহীন দুর্নীতি।

জন্মের পর থেকেই আমি আমার হাওর তল্লাটে এইরূপ শত শত পরিবার দেখেছি, যাদের একমাত্র কাজ ছিল চাষাবাদ। যাদের প্রত্যেকের গোলায় বছর শেষে হাজারমণ ধান উঠতো। এইরূপ প্রায় হাজার হাজার পরিবার দেখেছি, যারা সমগ্র বছর ধরে চাষাবাদ করে মাত্র এক থেকে দেড়শো মণ ধান তুলতো গোলাঘরে। কিন্তু কী দারুণ সুখ আর সৌম্যধারার জীবন ছিল ওদের...

এখন আর নেই। নগরীর মতোই সেখানেও আছে এক নিম্নবিত্ত, আর আছে সেই উচ্চ-নিম্নবিত্ত। এবং এই দুই ধারার বাইরে আছে একটা কঠোরভাবে দুর্নীতিবাজ রাজনৈতিক গোত্র।

মাথায় যখন পচন ধরে কীভাবে তা সর্ব প্রত্যঙ্গে আঘাত করে তারই নগ্ন একটা রূপ গ্রাম থেকে নগর, জীবন থেকে শিল্প, ধর্মগৃহ থেকে সিনেমাপাড়া... সবখানে, ঘুরে ঘুরে দেখে দেখে বড় হচ্ছি...

এখন মানুষ "আউট বই" কম পড়ে, এই সত্য জানা সত্ত্বেও তাই ঘুরেফিরে ঐ তথাকথিত গল্প উপন্যাসের দিকেই ধাবিত হচ্ছি।

মানুষ কম পড়ছে সেইটা বড় কথা নয়। মানুষের জীবনে দারুণ এক ভাঙন চলছে। এই ভাঙনের কথাগুলি আমাকে অবশ্যই লিখে যেতে হবে। অবশ্যই মানে অতি অবশ্যই।

আজ থেকে দুই হাজার বছর পর কেউ যখন আমাদের সময়টাকে জানতে চাইবে, জানি সে এই গল্পগুলির দিকেই ফিরে তাকাবে। যেভাবে আমরা এখনও ফিরে তাকাই, চর্যাগীতির দিকে... ময়মনসিংহ গীতিকার কাজলরেখা কিংবা মহুয়া কিংবা দস্যু কেনারামের দিকে...

"ভাবিয়া দেখহ ঠাকুর যত টাকাকড়ি

কেবলি লোভের চিহ্ন জগতের বৈরী।"

...

"দেশে যত ধনী আছে

তাহাদের ধনে

ভিক্ষুক লোকের আসে

কোন প্রয়োজনে?"

(- চন্দ্রবতী প্রণীত)

আসে না, কোন প্রয়োজনেই আসে না। তাইজন্যেই ধনলোভী ধনী কিংবা ক্ষুৎকাতর ভিক্ষুক নয়। ফিরে চাই, অন্তর থেকেই ফিরে চাই, সেই সে মধ্যবিত্ত।

ফিরে চাই স্বর্ণগ্রাম।

পরিশিষ্টঃ

সাহিত্য করে কালজয়ী হবো, এইটা একজন লেখকের জন্যে অপেক্ষাকৃত নিরীহ ভাবনা। সাহিত্য করে কোটিপতি হতে চাওয়া কালজয়ী হওয়ার চাইতে চতুর্গুণ অশ্লীল ভাবনা! অতএব, সম্মানিত লেখকবর্গ, কেউ পড়ুন বা না পড়ুন, আপনি লিখুন। বাঁচতে হলে, লিখতে হবে।

- সংগৃহিত

পঠিত : ২৫৫ বার

মন্তব্য: ০