Alapon

আফগান যুদ্ধঃ মার্কিনদের গলার কাঁটা...



যুক্তরাষ্ট্রের ইতিহাসে দীর্ঘতম যুদ্ধের সমাপ্তির রূপরেখা ঘোষণা করেছে প্রেসিডেন্ট বাইডেন। ভিয়েতনাম যুদ্ধের পর আফগান যুদ্ধই ছিল যুক্তরাষ্ট্রের ইতিহাসে দ্বিতীয় সর্বোচ্চ পরাজয়। এ পরাজয়ে ব্যাপক পরিমান আর্থিক ও সামরিক ক্ষয়ক্ষতির পাশাপাশি বৈশ্বিকভাবে ভাবমূর্তি সংকটে পড়েছে যুক্তরাষ্ট্র ও ন্যাটোর সামরিক নীতি। বস্তুতপক্ষে, ২০০১ সালে "ওয়ার অন টেররিজম" এবং "অপারেশন এনডিউরিং ফ্রিডম" নাম দিয়ে আফগানিস্তানে যুক্তরাষ্ট্রের সামরিক উপস্থিতির যে লক্ষ্য ও উদ্দেশ্যগুলো ছিল, তার কোনোটিই সফলভাবে অর্জন করতে পারেনি তারা। মূল পরাজয়টা এখানেই। তালেবান ইতোমধ্যে বিজয়ের ঘোষণাও দিয়ে দিয়েছে। এ যুদ্ধের কোনো আউটকাম না-থাকায় প্রেসিডেন্ট বাইডেন এ বছরের ১১ সেপ্টেম্বরের আগেই আফগানিস্তান থেকে সেনা প্রত্যাহারের সিদ্ধান্ত নিয়েছে।

মূলত আফগানিস্তানের অভ্যন্তরীণ রাজনৈতিক অস্থিরতা নিরসন ও একটি সার্বজনীন সরকার গঠন করার কথা বলে "অপারেশন এনডিউরিং ফ্রিডম" পরিচালনা করতে আফগানিস্তানে এসেছিল আমেরিকা ও ন্যাটো বাহিনী। কিন্তু গত ২০ বছর ধরে দেশটিতে সামরিক আগ্রাসনের মাধ্যমে লক্ষাধিক বেসামরিক নাগরিক হত্যা করে দেশটিতে কোনো রাজনৈতিক সমঝোতা করে না-দিয়েই মার্কিনদের পলায়ন নানা প্রশ্নের জন্ম দিয়েছে। বরং, দীর্ঘ ২০ বছরের যুদ্ধে ঝাঁজরা হয়ে যাওয়া আফগানিস্তানের সাধারণ জনগণ ২০০১ সালের তুলনায় এখন আরও বেশি রাজনৈতিক ঝুঁকিতে রয়েছে। ২০ বছরের একটি যুদ্ধ একটি জাতিকে অর্থনৈতিক, শিক্ষাগত, সামাজিক নিরাপত্তাগত ও সংস্কৃতিগতভাবে কী পরিমান ক্ষতিগ্রস্ত করতে পারে, সে আলোচনা নাহয় পরেই করা যাবে।

মার্কিনরাও কম ক্ষতির সম্মুখীন হয়নি এ যুদ্ধে। প্রায় ১ ট্রিলিয়ন ডলার আর্থিক ক্ষতির পাশাপাশি ২৫০০ মার্কিন সেনা এবং হাজার খানেক ন্যাটো সেনা প্রাণ হারিয়েছে, আহত হয়েছে ২০ হাজারের অধিক সৈন্য। মার্কিনদের পক্ষে যুদ্ধ করা ৬০ হাজারের অধিক আফগান সেনার জীবন গেছে এ যুদ্ধে। আফগান যুদ্ধের নিস্ফল পরাজয় ন্যাটোর সামরিক নীতি ও গ্রহনযোগ্যতাকে প্রশ্নের সম্মুখীন করেছে বিশ্বব্যাপী, ন্যাটোর সদস্য দেশগুলোর মধ্যেও পারষ্পরিক আন্তঃসম্পর্কের অবনতি ঘটেছে।

প্রকৃতপক্ষে, মার্কিনদের এ ত্যাগের মূল উদ্দেশ্য কী ছিল? আফগানিস্তানে রাজনৈতিক স্থিতিশীলতা রক্ষা করা, নাকি নিজেদের ভূ-রাজনৈতিক স্বার্থ হাসিল করা?

৯০ এর দশকের শুরুতে আমেরিকার চিরশত্রু সোভিয়েত ইউনিয়ন (USSR) ভেঙ্গে গেলে প্রাকৃতিক সম্পদে ভরপুর মধ্য এশিয়ার প্রজাতন্ত্রগুলো স্বাধীন দেশ হিসেবে আত্মপ্রকাশ করে, যেগুলোর ভৌগোলিক অবস্থান আফগানিস্তানের সীমান্ত-ঘেঁষা (তুর্কমেনিস্তান, উজবেকিস্তান ও তাজিকিস্তান)। উক্ত অঞ্চলে মার্কিনরা সামরিক উপস্থিতি টিকিয়ে রাখতে পারলে এবং একটি পাপেট রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠা করতে পারলে "দ্য বিগেস্ট এনিমি" রাশিয়ার ঘাড়ে নিশ্বাস ফেলা যাবে। আফগানিস্তানের পূর্ব-সীমান্ত ঘেঁষা এ অঞ্চলে আমেরিকার প্রধান প্রতিদ্বন্দ্বী চীনকে হুমকির মুখে রাখা যাবে। এ শতাব্দীর সর্ববৃহৎ প্রকল্প চীনের "বেল্ট এন্ড রোড" ইনিশিয়েটিভে বাঁধা সৃষ্টি করার সুযোগ পাওয়া যাবে। এতে রাষ্ট্রীয় দরকষাকষিতে বাড়তি কিছু সুবিধা ভোগ করবে আমেরিকা। প্রয়োজন ব্যাপক সামরিক উপস্থিতি ও একটি সেনা ঘাটি। তাই, তৎকালীন আফগানিস্তানে ঘটমান রাজনৈতিক অস্থিরতাকে কাজে লাগিয়েছিল তারা। ৯/১১ এর জঙ্গি হামলার দোহাই দিয়ে বিশ্বব্যাপী আফগানিস্তানে সামরিক উপস্থিতির নৈতিকতা তৈরি করে মার্কিনরা। নিজেদের প্রতিষ্ঠিত "গ্লোবাল ইসলামিক টেররিজম" থিওরিকে সামনে এনে "ওয়ার অন টেররিজমের" নামে শুরু করে আফগানিস্তান ও মধ্যপ্রাচ্যে সামরিক ও রাজনৈতিক হস্তক্ষেপ।

আফগানিস্তানের পশ্চিম সীমান্তবর্তী দেশ মধ্যপ্রাচ্যের "Axis of evil" খ্যাত ইরানকে কৌশলগতভাবে মোকাবেলার জন্য এ অঞ্চলে সামরিক উপস্থিতির দরকার ছিল আমেরিকার। ইরানের পারমাণবিক প্রকল্পে চোখ রাখতে এবং মধ্যপ্রাচ্যে প্রক্সি যুদ্ধ পরিচালনায় এ অঞ্চলটি কৌশলগতভাবে খুবই গুরুত্বপূর্ণ। সুন্নি মতাদর্শের ইসলামিক স্টেইট ও তালেবানকে নিয়ন্ত্রণ করে শিয়া অধ্যুষিত ইরানের বিরুদ্ধ-শক্তি হিসেবে ব্যবহার করার স্বপ্ন ছিল মার্কিনদের, কিন্তু তালেবানকে পরাস্ত করতে পারলেই তো!

অন্যদিকে, মধ্য এশিয়ার প্রজাতন্ত্রগুলোর জ্বালানি সম্পদ আমদানির জন্য আফগানিস্তানকে ট্রানজিট (পাইপলাইন ট্রানজিট) হিসেবে ব্যবহার করার কোনো বিকল্প নাই, যেহেতু দেশগুলোর অধিকাংশই ল্যান্ডলকড্ বা ভূ-বেষ্টিত। তাছাড়া এ অঞ্চলে আমেরিকার কোনো সামরিক ঘাটি নাই, বিশ্বব্যাপী তাদের "Military presence chain" পলিসি রক্ষা করতেও এ অঞ্চলে একটি সামরিক ঘাটি অত্যন্ত প্রয়োজনীয় ছিল। সে লক্ষ্যেই সোভিয়েত ইউনিয়ন ভেঙ্গে যাওয়ার ১০ বছরের মধ্যেই মার্কিনরা "ওয়ার অন টেররিজমের" নামে এ অঞ্চলে (আফগানিস্তানে) সৈন্য সমাগম করে। শুরু করে তাদের ইতিহাসের দীর্ঘতম যুদ্ধ, "প্রজেক্ট আফগান"। আফগান তালেবানরাই ছিল এ প্রকল্পে আমেরিকার একমাত্র গলার কাঁটা।

আমেরিকার আফগান প্রজেক্টে তাদের সহচর ছিল ন্যাটো ও এক সময়ের বেস্ট ফ্রেন্ড পাকিস্তান। পাকিস্তানের সহযোগিতা ছাড়া তাদের আফগান প্রজেক্ট কল্পনাতীত ছিল। বিশ্বরাজনীতির দীর্ঘ ২০ বছরের পথ পরিক্রমায় পাকিস্তান আজ দক্ষিণ এশিয়ায় ইউএস এলাইয়েন্সের বাইরে চলে গেছে। বিশ্বরাজনীতির নতুন মেরুকরণে পাকিস্তান যেহেতু হাত ফস্কে বেরিয়ে গেছে, তাই যুক্তরাষ্ট্র তার ন্যাটো এলাইদের কাছে মুখাপেক্ষী হয়ে গেছে। "আইএসআই" গোয়েন্দা সহযোগিতা দেয়া বন্ধ করে দেয়ায় এবং পাকিস্তানের ভুমি ব্যবহারের সুযোগ ও রাওয়ালপিন্ডির সহায়তা পাওয়ার সুযোগ সীমিত হয়ে আসায় আফগান যুদ্ধের কাঁটা মার্কিনদের গলায় লোয়ার এঙ্গেলে বিঁধে গেছে।

ফলশ্রুতিতে মার্কিনরা এমন একটি পরিস্থিতিতে পড়ে গেছে, আফগান যুদ্ধের কাঁটা তারা না-পারছে ফেলতে, না-পারছে গিলতে। কভিড-১৯ মহামারির কারণে আমেরিকা এখন এরকম ফ্রুটলেস প্রজেক্টের পেছনে অর্থ অপচয়ের কোনো মানেই খুঁজে পাচ্ছে না। তাই, বাইডেন প্রশাসন এসে সে "আফগান যুদ্ধের কাঁটা" বমি করে ফেলে দিতে চাচ্ছে। ট্রাম্প প্রশাসন একগুঁয়েমি করে আফগান থেকে সেনা প্রত্যাহারের বিষয়টি "দোহা চুক্তির" মাধমে সম্পন্ন করতে চাইলেও বাইডেন প্রশাসন এ প্রজেক্ট যত দ্রুত সম্ভব শেষ করতে প্রতিজ্ঞ। বাইডেন প্রশাসন তালেবানের সাথে কোনো জোরালো দরকষাকষিতে যাবে বলে মনে হয় না। উল্লেখ্য, সাম্প্রতিক বছরগুলোতে নানা কারণে তালেবানের বার্গােইনিং পাওয়ার বৃদ্ধি পেয়েছে। ফলে, দাবি আদায়ের ক্ষেত্রে তারা আরও কঠোর অবস্থান অবলম্বন করবে, এটাই স্বাভাবিক।

আফগান যুদ্ধে আমেরিকার একমাত্র জোটসঙ্গী ছিল ন্যাটো। ট্রাম্প প্রশাসন সামরিক তহবিল কমিয়ে দেয়াতে মার্কিনদের সাথে ন্যাটোর সম্পর্কের অবনতি ঘটেছে। আফ্রিকা ও মধ্যপ্রাচ্যে ন্যাটোভুক্ত দেশগুলো অত্যন্ত চাপে রয়েছে। সিরিয়া, ইরাক ও লিবিয়ায় অন্তর্দ্বন্দ্বে জড়িয়ে পড়ায় ন্যাটোভুক্ত দেশগুলোতে বিভাজনের সৃষ্টি হয়েছে। লিবিয়ায় ফিল্ড মার্শাল হাফতার ও জাতিসংঘের প্রতিষ্ঠিত ন্যাশনাল একর্ড সরকারের (GNA) পক্ষে প্রক্সি যুদ্ধ করছে ফ্রান্স ও তুরস্ক। জার্মান, কানাডা ও ব্রিটিশরাও প্রক্সি যুদ্ধের ব্যাপারে নিজেদের দেশে চাপে রয়েছে। এমতাবস্থায় আফগান যুদ্ধকে তারা "আনপ্রোডাক্টিভ প্রজেক্ট" বলতে দ্বিধা করছে না। এদিক থেকে মার্কিনরা আফগানিস্তানে নিঃসঙ্গ হয়ে পড়েছে।

মার্কিনদের কাছে আরেকটি অস্ত্র ছিল, ন্যাটো এলাই তুরস্ক। এরদোয়ান ও ইমরান খানের গলায় গলায় বন্ধুত্বকে কাজে লাগিয়ে পাকিস্তানের সাপোর্ট নেয়া যেতো। কিন্তু সিরিয়ায় কূর্দি যোদ্ধাদের সামরিক সহায়তা দিয়ে তুরস্কের সাথে সম্পর্কের অবনতি হয়েছে মার্কিনদের, পরষ্পরের বিরুদ্ধে প্রক্সি যুদ্ধ করেছে সাবেক দুই বন্ধু। মধ্যপ্রাচ্যসহ বেশ কয়েকটি আন্তর্জাতিক ইস্যুতে তারা এখন বিপরীত মেরুতে অবস্থান করছে।

মার্কিনদের স্বপ্ন ছিল আফগানিস্তানে একটি পাপেট সরকারকে ক্ষমতায় রেখে দেশটিকে একটি পাপেট রাষ্ট্রে পরিণত করা। তাদের নানামুখী স্বার্থোদ্ধারে দেশটিকে ব্যবহার করে যাবে একটি ব্যাটল গ্রাউন্ড হিসেবে। কিন্তু আফগানিস্তানের ভৌগোলিক বৈচিত্র্য ও তালেবানের কৌশলগত শক্ত অবস্থানের কাছে পরাজিত হয়ে এখন ব্যাগ এন্ড ব্যাগেজ গোছাচ্ছে মার্কিন সেনারা। মলিন মুখে পরাজয়ের চুনকালি নিয়ে বিদায় নিচ্ছে তারা। বস্তুতপক্ষে, আফগান যুদ্ধ ছিল মার্কিনদের জন্য একটি রুঢ় বাস্তবিক অভিজ্ঞতা, যে অভিজ্ঞতা ভূ-রাজনৈতিক স্বার্থ-হাসিলে বিদেশের মাটিতে তাদের সামরিক আগ্রাসনের নীতিকে ভবিষ্যতে চ্যালেঞ্জ করবে নিঃসন্দেহে। কথায় আছে, "A burnt child dreads the fire."

- সংগৃহিত

পঠিত : ৩৩৪ বার

মন্তব্য: ০