Alapon

সফলতার চার সিঁড়ি...



কুরআনের সবচেয়ে ছোট সূরাগুলোর একটি হলো "সূরা আল আসর"। এ সূরাটি ব্যাপক অর্থবোধক সংক্ষিপ্ত বাক্য সম্বলিত বাণীর একটি অতুলনীয় নমুনা। বলা যায়, এই সূরায় রয়েছে পবিত্র কুরআনের সমস্ত লক্ষ্য ও জ্ঞানের সংক্ষিপ্তসার। এতে যেন রয়েছে বিন্দুর মাঝে সিন্ধুর পূর্ণতা। কয়েকটা মাপাজোকা শব্দের মধ্যে গভীর অর্থের এমন এক ভান্ডার রেখে দেওয়া হয়েছে যা বর্ণনা করার জন্য একটি বিরাট গ্রন্হও হয়তো যথেষ্ট নয়!

এটা এতই অর্থপূর্ণ সূরা যে, ইমাম শাফিয়ী রাহিমাহুল্লাহ বলেছেন, " মানুষ যদি সূরা আল আসরের মর্মার্থ বুঝতে পারতো, তাহলে বাকি কুরআন তাদের জন্য দরকার হতোনা"। সূরা আল আসরের গুরুত্ব সাহাবিদের (রাদিয়াল্লাহু আনহুম) কাছে এতোটাই বেশি ছিলো যে, তারা যখন একে অপরের সাথে সাক্ষাৎ করতেন, বিদায় জানাবার আগে তারা এই ছোট্ট সূরাটা তিলাওয়াত করতেন। সাহাবারা তো জানতেন কুরআনের অনেকটাই, অনেকক্ষেত্রে সমগ্র কুরআন। তাহলে, তারা কেনো সূরা ইখলাস অথবা সূরা ক্বিয়ামাহ কিংবা আয়াতুল কুরসী তিলাওয়াত করেননি? এই সূরায় এমন কী রয়েছে যে, তারা বাছাই করছেন তিলাওয়াত করতে? চলুন তবে, একটু দেখে আসার চেষ্টা করি এই সূরায় কী রয়েছে__


এই সূরার গুরুত্বপূর্ণ একটি শিক্ষা হচ্ছে, শুধু নিজে ভালো হয়ে থাকার চেষ্টা করলেই হবে না; অন্যদেরকেও ভালো হওয়ার তাগাদা দিতে হবে, উদ্বুদ্ধ করতে হবে। আমরা যদি মনে করি; আমি নিজে তো সালাত-সিয়াম আদায় করব, যাকাত দেবো, যতটা সম্ভব ভালো হয়ে জীবনটা পার করে দেবো, অন্যকে নিয়ে মাথা ঘামানোর দরকার কী?_ তাহলে বিরাট ভুল হবে।

সূরা আল-আসর শুরু হয়েছে একটি গুরুত্বপূর্ণ শপথ দিয়ে। আল্লাহ সুবহানাহু ওয়াতাআ'লা বলছেন, ফুরিয়ে যাওয়া সময়ের শপথ আসর عصر হচ্ছে ফুরিয়ে যাওয়া সময়। دهر "সময়" বলতে আমরা সাধারণত যে অনন্ত প্রবাহমান কিছু বুঝি, এটা সে রকম কিছু নয়। আল্লাহ সময়ের ধারণার উপর শপথ করেননি; বরং তিনি আমাদের মনোযোগ আকর্ষণ করেছেন সময়ের ফুরিয়ে যাওয়া বৈশিষ্ট্যের প্রতি। হারিয়ে যাওয়া সেই সময় যা কখনো ফিরে পাওয়া যায় না।

আমাদের সবার কাছে একটি অমূল্য সম্পদ রয়েছে, তা হলো সময়। শিক্ষিত-অশিক্ষিত, ধনী-দরিদ্র, সুস্থ-অসুস্হ, চাকুরিজীবী-গৃহকর্ত্রী যে যেমনই হোক না কেন, সবাইকে সময় নামক এই সম্পদটি দেওয়া হয়েছে। আমরা প্রত্যেকে এই অমূল্য সম্পদ নিয়ে পৃথিবীতে আগমন করেছি। আমরা সবাই আসলে এক-একজন ব্যবসায়ী। কারণ, আমাদের কাজ হচ্ছে মূলধন খাটিয়ে যতটা সম্ভব লাভ করে যাওয়া। কিন্তু প্রতিমুহূর্তে এই মূলধন একটু একটু করে ফুরিয়ে যাচ্ছে। তাই একে আমরা কীভাবে ব্যবহার করছি, তার উপর নির্ভর করছে আমরা কে সফল হব, আর কে দেউলিয়া হয়ে শেষ হয়ে যাব।

পরিক্ষার হলে একজন ছাত্রকে প্রশ্নপত্রের জবাব দেওয়ার জন্য যে সময় দেওয়া হয়ে থাকে তার সাথে এর তুলনা করা যেতে পারে।নিজের ঘড়িতে কিছুক্ষণের জন্য সেকেন্ডের কাঁটাটির চলার গতি লক্ষ্য করলে এ সময়ের দ্রুত গতিতে অতিবাহিত হবার বিষয়টি উপলব্ধি করা যাবে। অথচ একটি সেকেন্ডও সময়ের একটি বিরাট অংশ। একমাত্র একটি সেকেন্ডে আলো এক লাখ ছিয়াশি হাজার মাইলের পথ অতিক্রম করে। এখনো আমরা না জানতে পারলেও আল্লাহর রাজ্যে এমন অনেক জিনিস থাকতে পারে যা এর চাইতেও দ্রুত গতিসম্পন্ন। তবুও ঘড়ির সেকেন্ডের কাঁটার চলার যে গতি আমরা দেখি সময়ের চলার গতি যদি তাই ধরে নেওয়া হয় এবং যা কিছু ভালো-মন্দ কাজ আমরা করি আর যেসব কাজেও আমরা ব্যস্ত থাকি সবকিছুই দুনিয়ায় আমাদের কাজ করার জন্য যে সীমিত জীবন কাল দেয়া হয়েছে তার মধ্যেই সংঘটিত হয়, এ ব্যাপারটি নিয়ে যদি আমরা চিন্তা-ভাবনা করি তাহলে আমরা অনুভব করতে পারি যে, এ দ্রুত অতিবাহিত সময়ই হচ্ছে আমাদের আসল মূলধন।
রাসুলুল্লাহ সাল্লালাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেন, "দুটো নিয়ামত এমন যে দুটোর বিষয়ে বহু মানুষ ধোকায় নিপতিত- স্বাস্থ্য ও অবসর।

ইমাম ইবনুল কাইয়্যিম রাহিমাহুল্লাহ বলেছেন, "সময় নষ্ট করা মৃত্যুর চেয়েও ভয়ংকর, কেননা মৃত্যু তোমাকে দুনিয়া থেকে বিচ্ছিন্ন করবে, কিন্তু সময় নষ্ট করা তোমাকে তোমার রব থেকে বিচ্ছিন্ন করে দিবে"।

ইমাম শাফিয়ী রাহিমাহুল্লাহ বলেন, " সময় এমন এক তলোয়ার যে, একে যদি আপনি ঠিকমতো না কাটান, এর অপব্যবহারের ফলাফল আপনাকেই কেটে ফেলবে"।
ভয়ংকর একটা বাক্য! যা শুনলে আতকে উঠার কথা! সময় হলো একটা দ্বিমুখী তরবারি, যার একটা মুখ হলো যা মানুষকে জান্নাতি হিসেবে কাটবে, আর আরেকটা মুখ যা মানুষকে জাহান্নামি হিসেবে কাটবে। এবার আমরা নিজেরাই বেছে নিবো, আমরা কোন মুখ দিয়ে নিজেদের কাটতে চাই।

'ওয়াল-আসর' হচ্ছে আমাদেরকে তাগাদা দেওয়া "খেয়াল করেছ? সময় কিন্তু ফুরিয়ে যাচ্ছে!"

বর্তমানে আমরা মানবজাতির বিশাল একটা অংশই সময়কে কোনো গুরুত্ব দেই না। লক্ষ্যহীন কাজে আমাদের পুরো জীবনটাই আমরা ব্যয় করে দিচ্ছি। প্রতিদিন ভোরের সময়টা, যে সময়ে সবথেকে বেশি বারাকাহ থাকে, একজন মানুষের সবচেয়ে বেশি প্রোডাক্টিভ থাকার কথা, সেই সময়টাই আমরা অচেতন ঘুমে বিভোর থেকে নষ্ট করি। দিনের ঘন্টাখানেক সময় চলে যায় 'অযথা ম্যাসেজিং, উদ্দেশ্যহীনভাবে ফেসবুকিং" করে। তারপর সময় চলে যায় টিভিতে অপ্রয়োজনীয় অনুষ্ঠান, মুভি, কার্টুন, ভিডিও গেম ইত্যাদি দেখে। দিন যায়,মাস যায়, বছর গড়ায় আর আমরা সেই একই ধরনের কাজের আবর্তে ঘুরতে থাকি, আমাদের কোনো চৈতন্য হয় না। এভাবে সময় নামক মূল্যবান সম্পদটিকে আমরা দু-হাতে উড়িয়ে শেষ করছি। এর পরের আয়াতেই আল্লাহ সুবহানাহু ওয়া তাআ'লা যথার্থই বলেছেন, মানুষ অবশ্যই ক্ষতির মধ্যে রয়েছে প্রথম আয়াতে আল্লাহ সুবহানাহু ওয়া তাআ'লা "ফুরিয়ে যাওয়া সময়ে" র শপথ করেই বলছেন, "মানুষ অবশ্যই ক্ষতির মধ্যে রয়েছে"
চিন্তা করলে দেখা যায়, মানুষের সবচেয়ে বড় পুঁজি বা জীবন তথা আয়ু বরফের মতই ক্রমেই গলে যাচ্ছে। স্রোতের মতই দ্রুত বয়ে যাচ্ছে মানুষের জীবনের মুহূর্ত, ঘণ্টা, দিন-রাত, সপ্তাহ, মাস আর বছরগুলো। যতই দিন যায় মানুষের যৌবনের অমিত-তেজ ও শক্তি ক্ষয়িষ্ণু হতে থাকে। দম দেয়া একটি ঘড়ি বা ব্যাটারি-চালিত একটি যন্ত্রের মতই আমাদের হৃদপিণ্ড একটা নির্দিষ্ট সময় পর্যন্ত সক্রিয় থাকে। সেই নির্দিষ্ট সময় শেষ হলে নিজ থেকেই থেমে যায় হৃদপিণ্ডের স্পন্দন। এমনকি এই হৃদপিণ্ড অকেজো হয়ে যাওয়ার জন্য কোনো কারণ বা অসুখেরও দরকার নেই! এখন, কেউ চাইলে এই সময়কে কাজে লাগিয়ে দুনিয়া ও আখিরাতের বিরাট ও বিস্ময়কর মুনাফাও অর্জন করতে পারে, আবার ভ্রান্তপথে চললে এটাই তার জন্য বিপজ্জনক হয়ে যেতে পারে।

আজকাল আমরা সফলতা বলতে বুঝি — নিজের বাড়ি, গাড়ি, টাকা, জমি-জমা, ডিগ্রি। এগুলো যার যত বেশি আছে, সে তত সফল। আমাদেরকে এই কথা এতবার বলা হয়েছে যে, আমরা বিশ্বাস করে ফেলেছি: সফল হওয়া মানেই হচ্ছে যাবতীয় ত্যাগ স্বীকার করে এগুলো অর্জন করা। এগুলো যারা অর্জন করতে পারেনি তারা বিফল।
কিন্তু আল্লাহ সুবহানাহু ওয়া তাআ'লা কী বলছেন?আল্লাহ বলছেন, না, ভুল! বেশিরভাগ মানুষ আজকে বিফল, কারণ তারা সফলতার এই ভুল ধারনা মেনে নিয়ে নিজেদেরকে শেষ করে ফেলছে। যারা সফলতার এই ভুল ধারনা বয়ে বেড়াচ্ছে, তারা সবাই আসলে ক্ষতির মধ্যে রয়েছে। এই ভুল ধারনার কারনে আজকে মানবজাতির বেশিরভাগই ক্ষতির মধ্যে আছে, কিছু ব্যাতিক্রম বাদে।

কিন্তু তাই বলে কি আমরা সারা জীবন গরিব হয়ে থেকে কোনোমতে তিনবেলা খেয়ে জীবন পার করবো? না! সম্মান, সম্পদ, ক্ষমতা, প্রতিপত্তি অর্জনের চেষ্টা করা দোষের কিছু নয়। দোষ হচ্ছে যখন তা আমাদেরকে আল্লাহর কথা ভুলিয়ে দেয়। আল্লাহর প্রতি অকৃতজ্ঞ করে দেয়। যখন সেগুলোর পেছনে ছুটতে গিয়ে ইসলাম ভুলে যাই। পরিবারকে ভুলে যাই। সন্তানদের ঠিকভাবে সময় দেই না। বাবা-মা’র সাথে সুসম্পর্ক বজায় রাখি না। সময়মত নামাজ পড়তে ভুলে যাই। সমাজের অন্যায়-অনাচার দেখে পাশ কাটিয়ে চলে যাই। নিজের আখের গোছাতে ব্যস্ত থাকি। এলাকার এতিম, গরিবদের দিকে তাকাই না। আত্মীয়দের আবেদন উপেক্ষা করি। যখন আমাদের যাবতীয় চেষ্টা হয়ে যায় মানুষকে দেখানোর জন্য প্রতিযোগিতা। অন্যের থেকে নিজেকে সম্পদশালী বলে জাহির করার মানসিকতা। তখনি তা আমাদেরকে এক ভয়ংকর পরিণতির দিকে নিয়ে যায়।

একারণে আমাদের লক্ষ্য হতে হবে: আমাদের এখন যা কিছুই আছে এবং যা কিছুই আমরা পাওয়ার চেষ্টা করছি, তার সবকিছুই আল্লাহকে খুশি করার জন্য পাওয়ার চেষ্টা করা। তখন স্বয়ংক্রিয়ভাবে আমাদের চেষ্টা এবং যোগ্যতাগুলো পরিবার, বাবা-মা, আত্মীয়, এতিমদের উপকারে লাগবে। ইসলামের প্রচার এবং প্রসারে অবদান রাখবে। তখনি আমরা বলতে পারবো যে, সেগুলো পেয়ে আমরা সত্যিই আল্লাহর প্রতি কৃতজ্ঞতা দেখিয়েছিলাম।
সুন্দর জামাকাপড় পরা, হালাল উপায়ে নিজের বাড়ি করা, গাড়ি কেনা, সম্পদের অধিকারী হওয়া অন্যায় নয়। কিন্তু এটাকে কেউ যদি সফলতা মনে করে, তাহলে সে বিরাট ভুল করেছে। সফলতার সংজ্ঞা এটা নয়।

আমাদের সালাফদের জীবনের দিকে তাকালেই আমরা এর বাস্তবতা দেখতে পাই। তাদের কেউই ধন-সম্পদ, বিত্তবান স্ট্যাটাসকে সফলতা মনে করেননি। তারা ঠিকই উপলব্ধি করেছিলেন সফলতার আসল সংজ্ঞা কী।

এর পরের আয়াতেই আল্লাহ সুবহানাহু ওয়া তাআ'লা
বলে দিচ্ছেন সেই সফলতার সংজ্ঞা। কী সেই সফলতা? দেখে নেয়া যাক__
"তবে তারা নয়, যারা বিশ্বাস করে, ভালো কাজ করে, পরস্পরকে সত্যের প্রতি আহ্বান করে এবং ধৈর্য্য-নিষ্ঠ হতে উদ্বুদ্ধ করে" "তবে তারা নয়" বলেই আল্লাহ সুবহানাহু ওয়া তাআ'লা কিছু মানুষকে উপরের সেই ক্ষতিগ্রস্থদের থেকে আলাদা করে দিয়েছেন। এরা কারা? যারা নিচের চারটি শর্ত পূরণ করবে, তারা আর ক্ষতির মধ্যে থাকবে না। এগুলোকে সফলতার চারটি সিঁড়ি বলা যায়।

নিচের এই চারটি বৈশিষ্ট্য একজন মানুষকে আমূলে বদলে দেবে। সত্যিকারের সফলতা কাকে বলে তা উপলব্ধি করতে শেখাবে। সেই সাফল্য অর্জনের জন্য প্রতিমুহূর্তে কাজ করতে নিজের ভেতরে একধরনের অদম্য আগ্রহ তৈরি করবে। এরা প্রতি মুহূর্তে বুঝতে পারবে ‘সময়’ আসলে কত মূল্যবান সম্পদ।

এই চারটি বৈশিষ্ট হচ্ছে―
১. যারা বিশ্বাস স্হাপন করে।
২. ভালো কাজ করে।
৩.একে অন্যকে সত্যের প্রতি উদ্বুদ্ধ করে।
৪.ধৈর্য-নিষ্ঠ হতে উদ্বুদ্ধ করে।

১) যারা বিশ্বাস করে
প্রথম কাজ হচ্ছে আল্লাহর প্রতি ঈমান আনা। নিছক তার অস্তিত্ব মেনে নেয়া নয়। বরং তাঁকে এমনভাবে মানা যাতে বুঝা যায়, তিনি একমাত্র প্রভু ও ইলাহ। ঈমান, নৈতিক চরিত্র ও জীবনের সমগ্র কর্মকাণ্ডের জন্য এটি একটি মজবুত বুনিয়াদ সরবরাহ করে। এর ওপর একটি পাক-পবিত্র জীবনের ইমারত গড়ে উঠে। নয়তো যেখানে আদতে ঈমানের অস্তিত্বই নেই সেখানে মানুষের জীবন যতই সৌন্দর্য বিভূষিত হোক না কেন তার অবস্থা একটি নোঙরবিহীন জাহাজের মতো। এ জাহাজ ঢেউয়ের সাথে ভেসে যেতে থাকে এবং কোথাও স্হায়ীভাবে দাঁড়িয়ে থাকতে পারে না।

কারও উদ্দেশ্য যদি হয় মানুষের জন্যই মানুষের উপকার করা—“মানব ধর্মই আসল ধর্ম”, “জীবে প্রেম করে যেইজন সেই জন সেবিছে ঈশ্বর”—তখন সে মানুষের উপকার করার এমন সব পদ্ধতি বেছে নেবে, যা আল্লাহ পছন্দ করেন না। মাঝখান থেকে তার মূল্যবান সময় ও সম্পদ নষ্ট হয়ে যাবে। তখন তার কষ্টটাই বাতিল। উপকার করতে গিয়ে তখন সে উল্টো অনেকগুলো গুনাহ কামিয়ে ফেলবে।

এ কারণে ঈমানের একটা মজবুত ভীত দাঁড় করাতে হবে। আল্লাহর প্রতি সঠিক বিশ্বাস আনাটা খুব জরুরি।

সেটা আনতে হলে কুর‘আন পড়তে হবে, ইসলামকে জানার আন্তরিক চেষ্টা করতে হবে। বাপ-দাদার অন্ধ অনুকরণ করা বন্ধ করতে হবে। প্রতিটা কাজের জন্য যে আল্লাহকে যে জবাব দিতে হবে, তা ভালোভাবে উপলব্ধি করতে হবে। ঈমানের যে সাতটি শাখা রয়েছে, তা নিজের ভেতরে পাকাপোক্ত করতে হবে।

ঈমান একটা লম্বা সফর। আমাদের কাজ হচ্ছে ঈমান দৃঢ় করতে আজীবন চেষ্টা করে যাওয়া, যেন আল্লাহর কাছে গিয়ে বলতে পারি যে, আমাদের চেষ্টার কোনো ত্রুটি ছিল না। বাকি সব তাঁর হাতে। তিনিই জানেন আমাদের অন্তরে আসলে কী ছিল।

২) ভালো কাজ করে

মানুষকে ক্ষতি থেকে বাঁচাবার জন্য দ্বিতীয় যে গুণটি অপরিহার্য সেটি হচ্ছে "আমলে সালিহ" তথা সৎকাজ। "আমলে সালিহ" অর্থ হলো সৎকাজ, সংস্কার, ভুল কিছুকে ঠিক করা, ভাঙা জিনিস জোড়া লাগানো, শান্তি প্রতিষ্ঠা ইত্যাদি। সাধারণত ইসলাম-সমর্থিত যেকোনো ভালো কাজকেই "আমলে সালিহ" বলা হয়।

সমস্ত সৎকাজ এর অন্তর্ভুক্ত। কিন্তু কুরআনের দৃষ্টিতে যে কাজের মূলে ঈমান নেই এবং যা আল্লাহ ও তাঁর রাসুল সাল্লালাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম প্রদত্ত হেদায়াতের ভিত্তিতে সম্পাদিত হয়নি তা কখনো "সালেহাত" হতে পারেনা। তাই কুরআন মাজিদের সর্বত্রই এর কথা বলা হয়েছে এবং এই সূরায়ও ঈমানের পরেই এর কথা বলা হয়েছে। অন্যদিকে মানুষ নিজের কাজের মাধ্যমে যে ঈমানের সত্যতার প্রমাণ পেশ করে সেটিই হয় নির্ভরযোগ্য ও কল্যাণকর ঈমান। অন্যথায় সৎকাজ বিহীন ঈমান একটি দাবি ছাড়া কিছুই নয়।

ঈমান ও সংকাজকের সম্পর্ক বীজ ও বৃক্ষের মতো। বীজ মাটির মধ্যে না থাকা পর্যন্ত বৃক্ষ জন্মাতে পারে না। কিন্তু যদি বীজ মাটির মধ্যে থাকে এবং কোনো বৃক্ষ না জন্মায় তাহলে এর অর্থ দাঁড়ায় মাটির বুকে বীজের সামাধি রচিত হয়ে গেছে। এজন্য কুরআনে যতগুলো সুসংবাদ দেওয়া হয়েছে তা এমন সব লোকদেরকে দেওয়া হয়েছে যারা ঈমান এনে সৎকাজ করে। এখানে বলা হয়েছে, মানুষকে ধ্বংসের হাত থেকে বাঁচাবার জন্য দ্বিতীয় যে গুণটির অপরিহার্য প্রয়োজন সেটি ঈমান আনার পর সৎকাজ করা। অন্য কথায় সৎকাজ ছাড়া নিছক ঈমান মানুষকে ক্ষতির হাত থেকে রক্ষা করতে পারে না।

৩) একে অন্যকে সত্যের প্রতি তাগাদা দেয়

"হক" বা "সত্য" হচ্ছে আল্লাহর কথা, ইসলামের কথা, ন্যায়ের কথা, অধিকারের কথা। "হক" শব্দটি বাতিলের বিপরীত। পরস্পরকে হকের উপদেশ দেবার অর্থ হচ্ছে, ঈমানদারদের এ সমাজটি অনুভূতিহীন নয় যে, এখানে বাতিল মাথা উঁচু করতে এবং হকের বিরুদ্ধে কাজ করে যেতে থাকলেও লোকেরা তার নিরব দর্শক হয় মাত্র। বরং যখন ও যেখানেই বাতিল মাথা উঁচু করে তখনই সেখানে হকের আওয়াজ বুলন্দকারীরা তার মোকাবেলায় এগিয়ে আসে, এ সমাজে এ প্রাণশক্তি সর্বক্ষণ প্রবাহিত থাকে। সমাজের প্রত্যেক ব্যক্তি নিজেই কেবল সত্যপ্রীতি, সত্য নীতি ও ন্যায় নিষ্ঠার ওপর প্রতিষ্ঠিত থাকে না এবং হকদারদের হক আদায় করেই ক্ষান্ত হয় না বরং অন্যদেরকে এ কর্মপদ্ধতি অবলম্বন করার উপদেশ দেয়।

সত্যের প্রতি তাগাদা দেওয়া অর্থ মানুষকে ইসলামের পথে ডাকা। আল্লাহর প্রতি সচেতন হতে বলা। ন্যায় প্রতিষ্ঠা করতে বলা। অন্যায় হতে দূরে থাকতে বলা। মানুষকে যাবতীয় ভুল বিশ্বাস, অভ্যাস, সংস্কৃতি, কুসংস্কার থেকে দূরে সরিয়ে আল্লাহর দেওয়া সঠিক শিক্ষার প্রতি ডাকা।

তবে ‘ডাকা’ অর্থ করলে ভুল অনুবাদ হবে। আল্লাহ হকের দিকে শুধুই ডাকতে বলেননি, বরং তাগাদা দিতে বলেছেন। হকের পথে ডাকা সহজ কাজ নয়। এই কাজ করতে গেলে অনেক ঝড়-ঝঞ্ঝাট আসবে জীবনে। মানুষ যখন নিজের পরিবারের মধ্যেইে হকের কথা বলতে যায়, তখনি শুরু হয় তর্ক, ঝগড়া, অশান্তি, সম্পর্ক নষ্ট। আর সমাজ, সংস্কৃতি, সরকারের অন্যায়ের প্রতি প্রতিবাদ করতে গেলে তো জীবন দুর্বিষহ হয়ে যাবেই।

কিন্তু তারপরেও আমাদেরকে হকের কথা বলতে হবে। কারণ এটা হচ্ছে নুন্যতম চারটি শর্তের একটি। প্রজ্ঞা ব্যবহার করে যখন যেখানে যেই কথা বললে সত্যিই কিছু অর্জন হওয়ার সম্ভাবনা থাকবে, সেভাবেই বলতে হবে। যাদেরকে হকের দিকে তাগাদা দিচ্ছি তাদের প্রতি সহমর্মিতা দেখাতে হবে। অল্পতেই রেগে গেলে হবে না। উদারতা, সহনশীলতার সাথে হকের কথা বলতে হবে। কেউ আমার সাথে একমত না হলেই তার বিরুদ্ধে ঝাঁপিয়ে পড়া যাবে না। মাথা ঠাণ্ডা রেখে, ধৈর্যের সাথে ইসলামের বাণী প্রচার করতে হবে। ন্যায়ের কথা বলতে হবে, অন্যায়ের বিরুদ্ধে কাজ করতে হবে। —এগুলো না করলে সর্বনাশ। আমরা তখন প্রতিনিয়ত ক্ষতির মধ্যে ডুবে থাকা আমজনতার একজন হয়ে যাবো। জাহান্নাম থেকে বেঁচে ফেরার নুন্যতম শর্তও পূরণ করবো না।

৪) ধৈর্য-নিষ্ঠ হতে তাগাদা দেয়

একটা ব্যাপার খেয়াল করুন, আল্লাহ সুবহানাহু ওয়া তাআ'লা সত্যের তাগাদা দেওয়ার কথা বলেই তারপর বলছেন "যারা ধৈর্য-নিষ্ঠ হতে উদ্বুদ্ধ করে"। সত্যের তাগাদা দিতে গেলেই জীবনে নেমে আসে দুর্বিষহ কষ্ট, তীর্যক মন্তব্য শুনে যেতে হয় দাঁত কড়মড় করে। আর তখনই প্রয়োজন হয় সবরের। দুটো বিষয় একটা আরেকটার সাথে অঙ্গাঅঙ্গী ভাবে জড়িত। আপনি যখন সত্যের দাওয়াত দিতে শুরু করবেন, তখন চারপাশের পরিবেশটা বদলে যাবে। এতোদিনের চিরচেনা, সবচেয়ে কাছের মানুষগুলোকে অচেনা মনে হবে। মনে হবে কোনো ধূ-ধূ মরুভূমিতে আপনি একাই একজন পথিক।

প্রথমে বুঝা দরকার " সবর" বলতে আসলে কী বোঝায়, বা "সবর" কী।। কারণ, সবর নিয়ে আমাদের মধ্যে ভুল ধারণা আছে।

সবর শব্দটির সাধারণত অর্থ করা হয়: ধৈর্য ধারণ করা। কিন্তু সবর অর্থ মোটেও শুধুই ‘ধৈর্য ধারণ করা’ নয় যে, আমরা হাত-পা গুটিয়ে বসে থাকব, অত্যাচার মুখ বুঝে সহ্য করে যাব, অবস্থার পরিবর্তনে কিছুই করব না, এই ভেবে যে, একদিন আল্লাহ সব ঠিক করে দিবেন। প্রাচীন আরবরা যখন ‘সবর’ বলত, তখন এর মধ্যে কোনো দুর্বলতার ইঙ্গিত ছিল না। প্রাচীন আরব কবি হাতিম আত-তাঈ এর একটি কবিতা আছে—

তলোয়ার নিয়ে আমরা তাদের বিরুদ্ধে সবর করলাম, কষ্ট এবং যন্ত্রণার মধ্যে দিয়ে, যতক্ষণ পর্যন্ত না তারা সবাই নিশ্চুপ হয়ে গেল, স্থির হয়ে গেল।
আরেকটি কবিতা জুহাইর ইবন আবি সুল্মা এর লেখা—
শক্তিশালী যুদ্ধের ঘোড়ায় চেপে রাজার জামাইরা যুদ্ধের ময়দানে সবর করল, যখন অন্যরা আশা হারিয়ে ফেলেছিল।

উপরের উদাহরণে সবর-এর ব্যবহার দেখলেই বোঝা যায়, সবর মানে হাত-পা গুটিয়ে বসে থাকা নয়। সবর এর অর্থ হচ্ছে: প্রতিকূলতার মধ্যে ধৈর্য নিয়ে, লক্ষ্য ঠিক রেখে, অবস্থার পরিবর্তনের জন্য চেষ্টা করা। সবরের তিনটি অংশ রয়েছে: ১) ধৈর্যের সাথে কষ্ট, দুর্ভোগ সহ্য করা, ২) অবস্থার পরিবর্তন করতে গিয়ে কোনো পাপ করে না ফেলা, ৩) আল্লাহর আনুগত্য থেকে সরে না যাওয়া। মানুষ সাধারণত সবর বলতে প্রথমটিকেই বুঝে থাকে। কিন্তু একজন মুসলিমের জন্য এই তিনটিই বাধ্যতামূলক। এই তিনটির একটিও যদি বাদ যায়, তাহলে তা কু’রআন এবং হাদিসের ভাষায় সবর নয়।

দেশে ইসলামের দুর্দিন যাচ্ছে, মুসলিমদের ধরে মেরে ফেলা হচ্ছে, মসজিদে আগুন জ্বালিয়ে দেওয়া হচ্ছে। আপনার টুপি-দাড়ি বা হিজাব দেখে একদিন আপনাকে রাস্তায় কিছু বখাটে যুবক ধরে মারধোর করল, আর আপনি ঘরে বসে শুধুই আল্লাহর কাছে কান্নাকাটি করছেন, যেন আল্লাহ দেশের অবস্থার পরিবর্তন করে দেন, আবার দেশের মুসলিমদেরকে ক্ষমতা দিয়ে দেন, দেশে ইসলামের রাজত্ব কায়েম করে দেন—এটা এই আয়াতের শিক্ষা নয়। এই আয়াতের শিক্ষা হচ্ছে: আপনার প্রতিবাদ করার সুযোগ থাকলে, আপনি ন্যায় বিচার পাবার জন্য পুলিশের কাছে যাবেন, দরকার হলে সেই যুবকগুলোর বিরুদ্ধে মামলা করবেন।
যতদিন ন্যায় বিচার না পাচ্ছেন: চেষ্টা চালিয়ে যাবেন, কয়েকজনের সাহায্য নিয়ে শান্তিপূর্ণ আন্দোলন করবেন, পত্রিকায় লেখালেখি করবেন এবং একই সাথে প্রতিদিন আল্লাহর কাছে নামাজে সাহায্য চাইবেন। কিন্তু কখনই প্রতিশোধ নেওয়ার মনোভাব থেকে কু’রআনের বিরুদ্ধে যায়, এমন কোনো কাজ করে ফেলবেন না। যেমন, বোমাবাজি, রাস্তায় নিরীহ মানুষের গাড়ি ভাঙা, নিরীহ মানুষের জীবনে সমস্যার সৃষ্টি করা ইত্যাদি কু’রআনের শিক্ষার বিরোধী কোনো কাজ করবেন না। আল্লাহর উপর ভরসা রাখবেন যে, তিনি একদিন না একদিন ন্যায় বিচার করবেনই, সেটা এই দুনিয়াতে না হলে, আখিরাতে অবশ্যই হবে।
আমরা বিপদে পড়লে বা জীবনে কোনো কিছু নিজের মন মতো না পেলে একরকমের অন্ধ হয়ে যাই। আমাদের চিন্তা-ভাবনা এক গণ্ডির ভেতরেই ঘুরপাক খেতে থাকে, “কেন আমি এটা পেলাম না? ওরা পায়, আমি পাই না কেন? আমার কেন এমন হয়? ওদের কেন এমন হয় না?” —আমাদের চারপাশের মানুষরা আল্লাহর নির্দেশে কতভাবে এগিয়ে আসছে আমাদের সাহায্য করার জন্য, সেটা তখন আমরা নিজের চোখে দেখেও উপলব্ধি করতে পারি না। আর আমাদের দৃষ্টির অগোচরে কতভাবে আল্লাহ আমাদেরকে সাহায্য করছেন, কত বিপদ থেকে বাঁচিয়ে দিচ্ছেন, সেটা উপলব্ধি করা তো বহু দূরের কথা।

এগুলো হলো আল্লাহর দেওয়া পরীক্ষায় ঈমানের সাথে পাশ না করে ফেল করার লক্ষণ। আর আল্লাহর দেওয়া পরীক্ষায় ফেল করলে তার পরিণাম কখনই ভালো হয় না। একারণে কষ্টের সময়গুলো সবরের সবগুলো শর্ত পূরণ করে পার করার জন্য মানুষকে বার বার বোঝাতে হয়, উৎসাহ দিতে হয়, তাগাদা দিতে হয়। না হলে মানুষের ঈমানের ভিত যে কোনো সময় ভেঙ্গে যায়।

আমরা যারা আজকে ধর্মের পথে ফিরে এসেছি, তারা অনেকেই নিজেকে বাঁচাতে ব্যস্ত। কিন্তু খোঁজ নিলে দেখা যায় আমাদের নিজেদের পরিবারেই সন্তান, স্বামী/স্ত্রী, বাবা-মা ধর্মবিমুখ। তাদেরকে ধর্মের পথে ফিরিয়ে আনার জন্য যথেষ্ট চেষ্টা আমরা করি না। নিজেকে বাঁচাতে যতটা না পরিশ্রম করি, কাছের মানুষকে বাঁচানোর প্রতি তার ধারেকাছেও আন্তরিকতা নেই। সূরাহ আসর আমাদের এই গুরুত্বপূর্ণ শিক্ষা দেয় যে, কিয়ামতের দিন আমাদের বেঁচে যাওয়া নির্ভর করছে: আমরা নিজে ভালো হয়ে চলতে পেরেছি কিনা এবং একইসাথে অন্যর ভালোর জন্য যথেষ্ট চেষ্টা করেছি কিনা।

আল্লাহ কিন্তু বলেননি: যে ঈমান এনেছে, বা ভালো কাজ করেছে, বা একে অন্যকে সত্যের প্রতি তাগাদা দিয়েছে, বা একে অন্যকে ধৈর্য-নিষ্ঠার প্রতি তাগাদা দিয়েছে। বরং আল্লাহ এই চারটি শর্তের মধ্যে ‘এবং’ জুড়ে দিয়েছেন। যার অর্থ: আমাদেরকে এই চারটি শর্তই পূরণ করতে হবে। একটিও বাদ দেওয়া যাবে না। সূরাহ আসর জান্নাতে গিয়ে কোনো বিরাট পুরস্কার পাওয়ার উপদেশ নয়, বরং জাহান্নাম থেকে বেঁচে ফেরার নুন্যতম শর্ত।

নিজের আক্বল, মস্তিষ্কপ্রসূত তথ্যের বাইরে যে সোর্সগুলোর সহায়তা নিয়েছি_
[১] তাফহীমুল কুরআন।
[২] তাফসির ইবনু কাসির।
[৩] তাফসির আল কাবির।
[৪] তাফসির ইবনে আব্বাস।
[৫] তাদাব্বুরে কুরআন - আমিন ইহসান ইসলাহি
[৬] তাফসির আহসানুল বায়ান।
[৭] তাফসিরে তাওযিহুল কুরআন।
[৮] মারিফুল কুরআন।
[৯] A Word for Word Meaning of The Quran -- মোহাম্মাদ মোহার আলী।
[১০] তাফসির আত তাবারি।
[১১] তাফসির ফী যিলালিল কুরআন।
[১২] উস্তাদ নুমান আলী খানের লেকচার ও প্রসিদ্ধ কিছু লেখকের "সূরা আল আসরে" র উপর লেখা আর্টিকেল।

- Habiba

পঠিত : ৬৭৮ বার

মন্তব্য: ০