Alapon

|| পৃথিবীর কেউ যদি ভালো না বাসে....||

খুব বেশি আপন ভেবে, কাছের মানুষ ভেবে, খুব বেশি ভালোবেসে যে মানুষ বা যাদের কাছে মন খুলে দুটো কথা বলেন, একটু দুষ্টুমি করেন, ইনবক্স করেন, ম্যসেজ করেন, সাক্ষাতে স্মিত হেসে নিজের হৃদয়ের সবটুকুন কথাবার্তাও বলে ফেলেন হড়বড় করে, কষ্ট আর কান্নাসমূহকে উগরে দেন খুব সহজে, স্বাভাবিকভাবেই! দেখা গেছে সেই মানুষের কাছে, সেই ব্যক্তির কাছে আপনার এইসব আবেগ অনুভূতি মূল্যহীন। কোনো মূল্য নেই। আপনার কান্না কিংবা হাসি পায় না কোনো পাত্তা তার কাছে। আপনার সরলতায় গরল ঢেলে আপনাকে উল্টো আরো এমন কিছু কথা বলে, যে কথাগুলো আপনাকে কষ্ট দেয়।
.

আপনার সততা, আপনার আন্তরিকতা, নিখাঁদ-নিঃস্বার্থ ভালোবাসা ও মমতা হচ্ছে তার কাছে, সেইসব মানুষদের কাছে ফাতরামি, ছ্যাঁচড়ামি, ইতরামি।

আপনি সরল মনে মমতার বহর নিয়ে এগিয়ে আসেন, অথচ অপর পার্শ্ব থেকে আপনাকে কী জঘন্যরকমভাবেই না ইগনোর করা হয়, করা হয় অবহেলা ও অবজ্ঞা। এতে আপনার মন ভেঙে যায়। বুক ভেঙে মিসমার হয়ে যায়। আপনি মন খারাপের জগতে তলিয়ে যান। কখনো কখনো এমন অবিচ্ছেদ্য অবহেলা আর অবমূল্যায়নের কারণে আপনি কষ্টের কোলাহলে হারিয়ে যান। কান্নার অশ্রু ঢেলে কষ্ট-সাগরে ডুবুরি হয়ে সাঁতার কাটেন। সেই কষ্ট-সাগর থেকে একপর্যায়ে সাঁতরে উঠতে চেষ্টা করেন। কখনো কখনো পারেন, কখনো পারেন না।

কিন্তু নাহ, আপনার এতো কষ্ট-ব্যথা পেয়ে লাভ নেই। বেদনা বুকে ধারণ করার কোনো কাজ নেই। ভাঙা মন নিয়ে ব্যথার নদীতে সাঁতার কেটে কোনো উপকার নেই।
.

মানুষ আপনাকে মর্যাদা দিচ্ছে না তো কী হয়েছে? অবমূল্যায়ন করছে তো সমস্যা কী ? এতে দুশ্চিন্তার ডুবোচরে ডুবে যাবার কোনো কারণ-ই থাকতে পারে না। মানুষের মূল্যায়ন-মর্যদা দিয়ে আপনি কী করবেন? হয়তো সাময়িক একটু ভালো লাগার ফুল ফুটবে মনের মুকুরে, এইতো!

.

কিন্তু আপনি যদি মুত্তাকি হতে পারেন, রব্বুল আলামিনের প্রিয়পাত্র হতে পারেন—তা হলে সব সম্মান আপনার। সকল প্রকার মর্যাদা-ই আপনার করতলগত। যেহেতু আপনি আল্লাহকে ভয় করে চলেন, সেহেতু সেই সম্মান, সেই মর্যাদা আল্লাহ সুবহানাহু ওয়াতাআ'লা আপনাকে-ই দিয়েছেন।
.

চিন্তা করে দেখুন—আল্লাহ সুবহানাহু ওয়াতাআ'লা তাঁর মুত্তাকি বান্দাদের কতোটা বেশি মর্যাদা দিলে তিনি পবিত্র কুরআনে তা উল্লেখ করতে পারেন, ভাবতে পারেন! পবিত্র কুরআন আমাদের জানাচ্ছে যে, আল্লাহর কাছে সে-সব মানুষই অধিক সম্মানিত, যারা তাক্বওয়ার গুণাবলিতে সিক্ত!
.

তো যে ব্যক্তি স্রষ্টার কাছে, স্রষ্টার চোখে সম্মানিত, তার আর মানুষের অবজ্ঞা-অবহেলায় কিংবা অসম্মানে কষ্ট কীসের!!
.

সৃষ্টির সেরা মানব আমাদের প্রিয় নবি ﷺ। সেই সেরা মানুষের কাছেও আপনি যদি আল্লাহ ভীরুতা ধারণ করতে পারেন, তাক্বওয়ার গুণে গুণান্বিত হতে পারেন তা হলে আপনার মর্যদা বেশি। অন্যান্য লোকজন আপনাকে অবজ্ঞা করে, অবহেলা করে, পাত্তা দিতে চায় না, আপনার কাছে ঘেঁষে না, আপনার কাছে আসে না, আপনার কথা শুনে না, তার বা তাদের মনে আপনার স্থান-ঠাঁই হয় না —কিন্তু তিনি আপনাকে তাঁর হৃদয়ের কোঠরে ঠাঁই দিয়ে রেখেছেন বহুকাল আগেই। তিনি বলেছেন, “নিশ্চয় আমার সবচেয়ে নিকটবর্তী মুত্তাক্বীনগণ; তারা যে-ই হোক, যেখানেই থাকুক।” ( আহমদ ২২০৫২ )

.

ওনার পরিবারপরিজনদের থেকেও বেশি আপনাকে তিনি আপন বলে। ঘনিষ্ঠ মিত্র বলে। তিনি বলেছেন, “আমার পরিবারের লোক মনে করে, ওরা আমার বেশি ঘনিষ্ঠতম। অথচ আমার বেশি ঘনিষ্ঠ হলো পরহেজগার লোকেরা, তারা যে-ই হোক, যেখানেই থাক। (ত্বাবারানীর কাবীর ২৪১, ইবনে হিব্বান ৬৪৭)

সাদ আল আসওয়াদ আস-সুলুমী (রাদ্বিয়াল্লাহু আনহু ) নামক একজন সাহাবী ছিলেন। খুবই গরীব, কুচকুচে কালো, এতিম, সামাজিকভাবে অগ্রহণযোগ্য ও মর্যাদাহীন এক সাহাবী। তিনি এতোটাই কুৎসিত ছিলেন যে আরবের লোকেরা ব্যঙ্গ-বিদ্রুপ করে তাঁর নাম দিয়েছিলো জুলাইবিব ; কদাকার। ওনাকে কেউ পাত্তা দিতো না, গোনায় ধরতো না। তাঁর সাথে মিশতো না, বলতো না কোনো কথাও।
.

বেচারা যুবক মানুষ। যুবকদের মনে থাকে কতো শতো-সহস্র স্বপ্নের ভীড়। সে হিসেবে তাঁর মনেও খেলা করতো অযুত-নিযুত স্বপ্নেরা। কিন্তু সে-সব স্বপ্ন স্রেফ 'স্বপ্ন-ই' ছিলো। তার সে-সব নিটোল সুন্দর স্বপ্নগুলোর কোনো মূল্য ছিলো না কারো কাছেই। কেউ তাঁকে ভালোবাসতো না, ভালোবাসতে চাইতো না। নিজের কন্যাকে তাঁর নিকট বিয়েও দিতে চাইতো না।

একদিন তিনি ব্যথাহত মন নিয়ে, হাহাকার ভরা সুরে রাসুল ﷺ এর কাছে এসে বললেন— ‘ইয়া রাসুল্লাহ ﷺ আমি কি জান্নাতে যাবো? রাসুল ﷺ বললেন; কেনো যাবে না? অবশ্যই যাবে। তিনি বললেন— কিন্তু আমি তো সামাজিকভাবে মর্যাদাহীন একজন মানুষ। লোকজন আমাকে কটাক্ষ করে। বিদ্রুপের তীরে বিদ্ধ করে। রাসুলে কারিম ﷺ বললেন ওহে সাদ! অন্যদের জন্য যেমন পুরুষ্কার হিসেবে জান্নাত রয়েছে, তেমনি তোমার জন্যেও আছে । তিনি বললেন—তাহলে হে আল্লাহর রাসুল ﷺ, দুনিয়াতে কেউ আমার কাছে তাদের মেয়েকে বিয়ে দিতে চায় না কেনো? আমি জান্নাতে গেলে তারপরেই কি শুধু বউ পাবো?

তাঁর কথাগুলো রাসুলুল্লাহ ﷺ মনোযোগ দিয়ে শুনলেন। যাকে কেউ-ই পাত্তা দিতো না, মূল্যায়ন করতো না—রাসুলুল্লাহ ﷺ সেই মানুষটির কথাগুলো খুব নিবিষ্ট মনে শ্রবণ করতে লাগলেন। সে-সব কথামালা ওনার হৃদয়ে বিধলো। তিনি একপর্যায়ে তাঁর পক্ষ হয়ে তাঁর জন্য শহরের একজন সেরা সুন্দরী মেয়ের পিতার নিকট বিয়ের পয়গাম পাঠালেন। অতঃপর ৪০০ দিনার মোহরানায় তাঁকে সেই সুন্দরী মেয়ের সঙ্গে বিয়ে দিলেন।

দেখুন, এই সাহাবীর কিন্তু পৃথিবীতে উল্লেখ করার মতো কিচ্ছু ছিলো না। না সৌন্দর্য, না সম্পদ, না বংশ, না শিক্ষা; যেখানে কেউ-ই তাঁকে ভালোবাসতো না, গণ্য করতো না—সেখানে আল্লাহর রাসুল ﷺ তাঁর প্রতিটি কথা তন্ময় হয়ে শুনতেন। তাঁকে ভালোবাসতেন। তাঁর আক্ষেপগুলো বুঝতে চেষ্টা করতেন। একজন অসাধারণ সুন্দরী নারীর সঙ্গে বিয়েও দিলেন। এর কারণ কী? কারণ একটা-ই— তাঁর ভেতর দ্বীনের বুঝ ছিলো। আল্লাহর ভয় ছিলো। তাক্বওয়া আর পরহেজগারিতা ছিলো। তাই পৃথিবীর আর সকলের কাছে তিনি মূল্যহীন হলেও সৃষ্টির সেরা মানুষ 'আল্লাহর রাসুলের' কাছে তাঁর যথেষ্ট পরিমাণ মূল্যায়ন ছিলো। রাসুলে কারিমের হৃদয়ের গভীর গহনে তাঁর জন্য ভালোবাসা ছিলো।

হাবশি গোলাম, ভয়ংকর রকমের কালো বিলালের ( রাদ্বিয়াল্লাহু আনহু) কথায়-ই ধরুন না, আল্লাহর কাছে তিনি কতো বেশি গ্রহনযোগ্য হলে, সুন্দর-স্মার্ট শারীরিক গড়ন, বিত্তশালী, ভীষণ রকম সুন্দর কন্ঠের অধিকারী, সামাজিক মর্যাদাবান জাঁদরেল সব সাহাবায়ে কেরাম রিদওয়ানুল্লাহি আজমাইনদের চেয়ে তাঁর আযান আল্লাহর কাছে, আল্লাহর রাসুলের কাছে বেশি প্রিয় হতে পারে?
.

এভাবে যদি আপনি-আমিও আল্লাহর এবং তাঁর রাসুল ﷺ এর প্রিয় হতে পারি, তাঁদের ভালোবাসায় সিক্ত হতে পারি, তা হলে তাবত্ দুনিয়ার মানবকূল যদি অবহেলা করে, অমর্যাদা করে, করে আপনার আবেগের অবমূল্যায়ন, কিংবা ভালো না বাসে আপনাকে, আপনার কথা না শুনে—কী আসে যায় তাতে? কারণ আমার-আপনার রব্ব তো আছে আপনার পাশে। আছে সেই রব্বের প্রেরিত শ্রেষ্ঠ মানুষ মুহাম্মদ ﷺ এবং তাঁর ভালোবাসা।


|| পৃথিবীর কেউ যদি ভালো না বাসে....||
~রেদওয়ান রাওয়াহা
২১ শে রমাদান

পঠিত : ৬৭৪ বার

মন্তব্য: ০