Alapon

লাল জামা


.......
শাহবাগের সিগন্যালে গাড়ি থেমে গেলো। বরাবরের মতো ই শাহেদ ব্যাগে রেখে দেয়া বই বের করে পড়তে শুরু করলেন। কারণ, এই সিগন্যালে সচরাচর সহজে জ্যাম ছুটে না! তার ওপর সামনে ঈদ! যানবাহনের প্রচন্ড চাপ।

তন্ময় হয়ে পড়তে পড়তে একপর্যায়ে মনোযোগ হারিয়ে ফেললেন শাহেদ। রাস্তার এক পাশ থেকে এক শিশুর কান্নার আওয়াজ আসছে। আশ্চর্য! বাচ্চাটির বাবা-মা কি তাকে থামাতে পারছে না! কোনমতেই মনোযোগ ফিরিয়ে আনতে না পেরে বাধ্য হয়ে বাহিরে উঁকি দিলেন কি হয়েছে দেখার জন্য।

ছেলেটির বয়স পাঁচ কি ছয় বছর হবে। পরনে ধুলো মাখা, ময়লা, চকলেট রঙয়ের হাফপ্যান্ট। গা উদোম, চুলগুলো উসকোখুসকো। পাশে তার মা দাঁড়িয়ে। কোন একটা কারণে শাসিয়ে চলছেন শিশুকে। হঠাৎ কেনো যেনো শিশুটির কান্নার কারণ জানতে ভীষণ কৌতুহল হলো। ড্রাইভারকে গাড়ি সাইডে রাখতে বলে, নেমে পড়লেন।

একটু সামনে গিয়ে দাঁড়াতে ই বাচ্চাটা কান্না থামিয়ে তাকে দেখতে লাগলো, যেনো খুব অবাক হয়েছে। কতোই বা বয়স তার! চোখেমুখে সারল্যের ছাপ। তবে গভীর ভাবে তাকালে মলিনতার ছাপটুকু দেখতে পাওয়া যায়। শাহেদ জিজ্ঞেস করলেন, “নাম কি তোমার?” ছেলে ফ্যালফ্যাল করে তাকিয়ে আছে দেখে মা বললেন, “অর নাম বাদশা! বাপে খালি বাদশা নাম টা ই রাখবার পারসে। আমাগো মতো গরীব মাইনষের এই নাম রাখন কি মানায় নাকি!”

কান্নার কারণ জিজ্ঞেস করতেই অনুযোগের সুরে বললেন, “ হ্যায় এহন বায়না ধরসে তারে ঈদে একখান লাল জামা কিন্যা দেওন লাগবো। আপনে ই কন ছার, আমাগো কি আল্লাহ সেই ক্ষ্যামতা দিসে! নুন আনতেই পান্তা ফুরায়! আজকা ওর বাপ বাঁইচা থাকলে….” বলতে বলতে বছর ত্রিশেকের এই নারীর চোখ ভিজে আসে। পরনের শতচ্ছিন্ন শাড়ির আঁচল দিয়ে সে জলটুকু মুছে ফেলেন তিনি।
__________________

লাল জামা! শুনতে শুনতে শাহেদ হারিয়ে গেলেন অতীতে। তখন তার বয়স ছিলো দশ। সবেমাত্র ক্লাস ফাইভে উঠেছেন। বাবার কাছে বায়না ধরেছিলেন একটা লাল জামার। দিনমজুর বাবা শাহাবুদ্দিন, পুত্রের অনুনয়মাখা মুখের দিকে তাকিয়ে না করতে পারেননি। আশ্বাস দিয়েছিলেন কিনে দেওয়ার। তারপর থেকেই মাথায় সর্বক্ষণ তার চিন্তা, ছেলেকে দেয়া কথা কিভাবে রাখবেন। ছেলেটা তার ভীষণ শান্ত। কখনোই মুখ ফুটে কিছু চায় না। অভাবের সংসার। নিত্যদিনের সদাই আনতে ই সব টাকা শেষ হয়ে যায়। কেমন করে তিনি ছেলের শখ পূরণ করবেন!

“ওই মিয়া, শুনসো নি? গঞ্জে তো কামের লাইগা ম্যালা লোক নিতাছে। তোমার লাগবোনি?”, রইস মিয়ার এই কথায় যেনো আশার আলো দেখলো শাহাবুদ্দিন। গঞ্জে কাজ নিতে পারলেই কিছু অতিরিক্ত টাকা আসবে। তাতে ই ছেলের জামা ও কিনে দিতে পারবে সে। কালই তো ঈদ। কাজ টা অবশ্য একটু কঠিন ই বটে। অত্যধিক পরিশ্রমে শরীর দূর্বল হয়ে যাওয়ায় এখন সে আর মাল ওঠানো নামানোর কাজ করতে পারে না। ডাক্তার বলেছে এতে শ্বাসকষ্টের ঝুঁকি আছে। তাতে কি! ছেলের জন্য এইটুকু কষ্ট তো সে করতে ই পারে৷ এসব ই সাতপাঁচ ভাবতে ভাবতে কাজে রওনা হয়ে গেলো শাহাবুদ্দিন।

শাহেদ ঈদের চাঁদ দেখে বন্ধুদের সাথে হৈ হুল্লোড় করে ফিরে এলো ঘরে। দাওয়ায় বসে মা কে বললো ভাত দিতে। তার মন আনচান করছে৷ কখন বাবা আসবেন লাল জামা নিয়ে! বাবা নিশ্চয়ই কথা রাখবেন। রাত গভীর হলো। তবু বাবার দেখা নেই। অপেক্ষা করতে করতে একপর্যায়ে ঘুমিয়ে পড়লো সে। সকালে মায়ের আর্তচিৎকারে ঘুম ভাঙলো তার। চোখমুখ ডলতে ডলতে বাহিরে এসে দেখলো, উঠানে চাটাইয়ে শোয়ানো বাবার লাশ! রক্তে ভিজে রয়েছে সাদা কাপড়৷ ভারি মাল ওঠাতে গিয়ে শ্বাসের টান উঠেছিলো। সামলাতে পারেন নি। তার গায়ের ওপর পড়ে যায় সমস্ত মালামাল…

“ ছার, আপনে এতোক্ষণ ধইরা কি ভাবতাসেন?”- মহিলার কথায় সম্বিত ফিরে এলো শাহেদের। হাতের উল্টোপিঠ দিয়ে চোখ মুছে বাচ্চাটির হাত ধরে বললেন, “এসো তুমি আমার সাথে। তোমার কোন জামাটা পছন্দ, আমাকে বলবে। আমি তোমাকে কিনে দেবো।” এবার ফিক করে হেসে ফেললো বাচ্চাটা। শাহেদের মনে হলো, এই বেহেশতী হাসি কে উপেক্ষা করবার সাধ্যি কার আছে!

। লাল জামা ।
-সাবিহা সাবা

#জাগরণএক্সক্লুসিভ

বিশেষ নোটঃ

এ শহরের রিক্সাচালক, ফল বিক্রেতা, খেটে খাওয়া মানুষ এমনকি আমার আপনার আশেপাশের অনেকের প্রত্যেকের জীবনে ই এমন বাস্তবতা গুলো বিদ্যমান। একটা ছোট বাচ্চার জন্য ঈদের জামা কিনে দিতে কিংবা সেই বুড়ো চাচার জন্য একটা পাঞ্জাবি কিনে দিতে আমার, আপনার কি খুব বেশি খরচ হবে? হয়তো না। কিন্তু বিনিময়ে আপনি কান্নাভেজা যেই হাসি দেখতে পাবেন, আমার মনে হয়, অন্তর তৃপ্ত হয়ে যাবে। ঈদ আমাদের যেমন রয়েছে, তাদের ও রয়েছে। আসুন না, ঈদের আনন্দ টুকু ভাগাভাগি করে নিই তাদের সাথে। কোন মুসলিম ভাইয়ের প্রয়োজন পূরণ করে তার মুখে হাসি ফুটাতে পারার মাধ্যমে ও কিন্তু জান্নাত লাভের সুযোগ রয়েছে, যা স্বয়ং রাসূল সাঃ বলে গিয়েছেন। এ সুযোগ হেলায় না হারাই… আমাদের ছোট কিছু উদ্যোগ এই মানুষ গুলোর ঈদের আনন্দ উপভোগের মাধ্যম হোক। সামর্থ্য অনুযায়ী সর্বোচ্চ টুকু দিয়ে যেনো আমরা তাদের পাশে দাঁড়াতে পারি সুখে দুঃখে। ভালোবাসা, সৌহার্দ্যে সুন্দর করে তুলতে পারি সমাজ টা কে।

পঠিত : ৫০৫ বার

মন্তব্য: ০