Alapon

আবার ফিরে এলো ক্রসফায়ার




ঘটনা সপ্তাহখানেক আগে ১৬ তারিখের। পল্লবীর ডি ব্লকের ৩১ নং রোডে একটি খুন হয়। সিসিটিভি ফুটেজে দেখা যায়, দুই তরুণ দুই পাশ থেকে এক ব্যক্তিকে ধারালো অস্ত্র দিয়ে কোপাচ্ছেন। একপর্যায়ে ওই ব্যক্তি মাটিতে লুটে পড়েন। এরপর হামলাকারীদের একজন চলে যান। অন্যজন ওই ব্যক্তির ঘাড়ে কোপাতে থাকেন মৃত্যু হওয়া পর্যন্ত। নিহত ব্যক্তি পল্লবী এলাকার যুবক সাহিনুদ্দিন।

ঈদের দুইদিন পর সাহিনুদ্দিন বিকেলে ৭ বছরের ছেলেকে নিয়ে মোটরসাইকেলে ঘুরতে বের হন। তার পূর্বপরিচিত সুমন ব্যাপারী ও টিটু মুঠোফোনে সাহিনুদ্দিনকে পল্লবীর ডি–ব্লকে ডাকেন জমিজমা নিয়ে বিবাদ মীমাংসার জন্য। সাহিনুদ্দিন সেখানে গেলে সুমন ব্যাপারী লাথি মেরে মোটরসাইকেল থেকে তাকে ফেলে দেন। এরপর ছেলের সামনেই তাকে কুপিয়ে হত্যা করে সুমন ও তার গুণ্ডাবাহিনী।

এ ঘটনায় সাহিনুদ্দিনের মা আকলিমা বেগম বাদী হয়ে সাবেক সাংসদ আউয়ালসহ ২০ জনের নাম উল্লেখ করে পল্লবী থানায় হত্যা মামলা করেন। মামলাটি বুধবার ডিবিতে স্থানান্তর করা হয়। এখানে সুমন ও তার বাহিনী হত্যা করলেও তাদের সাথে সাহিনুদ্দিনের সরাসরি বিরোধ নেই। সাহিনের বিরোধ হলো লক্ষ্মীপুরের সাবেক সাংসদ এম এ আউয়ালের সাথে। পল্লবীর ১২ নম্বর সেকশনের বুড়িরটেকে (আলীনগর) সাহিন ও তাঁদের স্বজনদের ১০ একর জমি রয়েছে। আশপাশের কিছু জমি দখল করে সেখানে হ্যাভেলি প্রোপার্টিজ ডেভেলপার লিমিটেড নামের আবাসন প্রকল্প গড়ে তোলে আউয়াল।

সাহিনের জমি পেতে চায় আউয়াল। সাহিন তা বিক্রিতে রাজি না হওয়ায় বিরোধ তৈরি হয়। জমি জবরদখলে ব্যর্থ হয়ে আউয়াল সন্ত্রাসী দিয়ে সাহিনুদ্দিনকে কুপিয়ে হত্যা করে। গত বছরের নভেম্বরেও সন্ত্রাসীরা সাহিনকে কুপিয়ে আহত করেছিল। সেই ঘটনায় করা মামলায় পুলিশ কাউকে গ্রেপ্তার করেনি। উল্টো আউয়ালের দেওয়া মিথ্যা মামলায় সাহিনুদ্দিনকে গ্রেপ্তার করে পুলিশ। খুনের ঘটনার সপ্তাহখানেক আগে রমজানে সাহিনুদ্দিন জামিনে মুক্তি পায়।

এম এ আউয়ালের মতো সাধারণ মানের মানুষকে মাফিয়া হিসেবে তৈরি করেছে শেখ হাসিনা। আউয়াল চট্টগ্রামের মাইজভান্ডারির রাজনৈতিক দল তরিকত ফেডারেশনের মহাসচিব ছিল। ২০১৪ সালের নির্বাচনে নৌকা মার্কা নিয়ে বিনা ভোটের নির্বাচনে লক্ষ্মীপুর-১ আসন থেকে এমপি হয় আউয়াল। এরপর সাপের পাঁচ পা দেখে আউয়াল। রাতারাতি ধনকুবেরে পরিণত হয় সে। ২০১৭ সালে নিজ দলের প্রধান মাইজভাণ্ডারির সাথে তার বিরোধ তৈরি হয়। দল থেকে বহিষ্কৃত হয় সে। বহিষ্কৃত হয়ে ইসলামিক গণতান্ত্রিক পার্টি নামে একটি দল তৈরি করে এর চেয়ারম্যান হয়। এই দলের একমাত্র কাজ হাসিনার দালালি করা।

আউয়ালের নির্দেশে খুন এটাই প্রথম নয়। তার আগে আরো বহু খুনের সাথে সে জড়িত। প্রথমে জমি কেনার প্রস্তাব দিতেন সাবেক এমপি আউয়াল। প্রস্তাবে সাড়া না দিলে হামলা, তারপর মিথ্যা মামলা দিয়ে হয়রানি। তাতেও কাজ না হলে খুন করতেও দ্বিধা করতেন না। এসব অপকর্মের জন্য আউয়াল নিয়ন্ত্রণ করতেন সন্ত্রাসী বাহিনী।

এসব বিষয়ে পুলিশে অভিযোগ করলেও কোনো লাভ হয়নি। পুলিশও সবসময় আউয়ালের পক্ষ নিয়েই কথা বলতেন। শুধু গুণ্ডা নয়, পুলিশ দিয়েও খুন করাতেন আউয়াল।

এক সময় মমিন বক্স ছিলেন মিরপুর এলাকার মূর্তিমান আতঙ্ক। রাজধানীর পল্লবীর ৯ নম্বর ও ১২ নম্বরে হত্যা, সন্ত্রাস, চাঁদাবাজি, ভূমিদস্যূতার অভিযোগে তার নামে ছিল ১৮ মামলা। ২০১৫ সালের ৮ জুলাই মোহাম্মদপুর থেকে পুলিশ পরিচয়ে তুলে নেওয়া হয় মমিন বক্সকে। এর চার দিন পর কালশী ব্রিজ থেকে তার মরদেহ উদ্ধার হয়।

২০১৫ সালের ১৪ মে বুড়িরটেকে দুই পক্ষের সংঘর্ষের সময় বঙ্গবন্ধু কলেজের অনার্স প্রথম বর্ষের শিক্ষার্থী চঞ্চল খুন হন। ওই হত্যা মামলায় মমিন বক্স ছিলেন প্রধান আসামি। পুলিশের তদন্তে বেরিয়ে আসে মমিন বক্স ও চঞ্চল খুনের মূল পরিকল্পনাকারী আমান। আমানের বিরুদ্ধে খুন, অপহরণসহ ১৪টি মামলা আছে। মমিন বক্সের পর খুন হন মাছ ব্যবসায়ী পাগলা খোকন ও ডি-ব্লকের স্থানীয় মিন্টু। এরপর কালাপানির মুসা, ডিওএইচএস সড়কে খুন হন মোহাম্মদ আলী।
২০০৪ সালের ১৩ ফেব্রুয়ারি সিরামিকের পেছনে কুপিয়ে হত্যা করা হয় কথিত র‌্যাব-পুলিশের সোর্স আব্বাসকে। আব্বাস হত্যার পর আলোচনায় আসেন সাবেক এমপি আউয়াল। ওই সময় হ্যাভেলি প্রোপার্টিজ গড়ে বুড়িরটেকে শুরু করেন দখলবাজি। স্থানীয়দের দাবি, সবগুলো হত্যার পেছনে সাবেক এমপি আউয়াল জড়িত রয়েছে।

সাহিনুদ্দিন হত্যা মামলায় এম এ আউয়াল গ্রেপ্তার হয়। গ্রেপ্তার হয় তার অন্যান্য গুণ্ডারাও। র‍্যাবের পক্ষ থেকে বলা হয়, সাহিনুদ্দিনদের জমি দখলে ব্যর্থ হয়ে সাবেক সাংসদ আউয়ালের নির্দেশ ও পরিকল্পনায় এ খুনের ঘটনা ঘটে। ঘটনার চার-পাঁচ দিন আগে আউয়ালের কলাবাগানের অফিসে আসামি তাহের ও সুমন চূড়ান্ত পরিকল্পনা করেন। পল্লবী এলাকার সন্ত্রাসী সুমনের নেতৃত্বে ১০-১২ জন হত্যাকাণ্ডে অংশ নেন। তাঁদের সহযোগী হিসেবে আরও কয়েকজন ছিলেন।

তারা আরো বলেন, আউয়াল জমি বেচাকেনা করতেন। সুমনের নেতৃত্বাধীন সন্ত্রাসী গ্রুপ দিয়ে তিনি জমি দখল ও আধিপত্য বিস্তার করতেন। সুমন আউয়ালের কাছ থেকে প্রতি মাসে ১০-১২ হাজার টাকা পেতেন। ক্ষেত্রবিশেষে কাজ অনুযায়ী অতিরিক্ত টাকা পেতেন। সুমন এলাকায় চাঁদাবাজি, ছিনতাই, রিকশা টোকেন–বাণিজ্য, মাদক, জুয়াসহ অন্যান্য অপরাধমূলক কর্মকাণ্ড চালাতেন। তাঁর বিরুদ্ধে মাদকদ্রব্য আইনে পল্লবী থানায় অন্তত ছয়টি মামলা রয়েছে।

আউয়াল ও গুণ্ডাদের গ্রেপ্তারের জন্য আমরা র‍্যাব-পুলিশকে ধন্যবাদ দিতে পারি। পুলিশ সাহিনের পরিবারের প্রতি ও এদেশের বিচার চাওয়া মানুষের প্রতি দয়া দেখিয়ে সন্ত্রাসীদের গ্রেপ্তার করেছে। যদি না করতো তাহলে আসলে কারো কিছু করার ছিল না। এদেশে সরকার ও পুলিশ তাদের ইচ্ছামাফিক আইনের শাসন প্রতিষ্ঠা করে। তাদের ইচ্ছে হলে আইন কার্যকর হয় অন্যথায় হয় না।
সন্ত্রাসীদের গ্রেপ্তার করে আইনের শাসনের দৃষ্টান্ত স্থাপন হলেও পুলিশ তার চিরাচরিত সন্ত্রাসী কার্যক্রম আবারো শুরু করেছে। মাঝখানে টেকনাফ থানার ওসি প্রদিপ কুমার দাসের হাতে সাবেক সেনাবাহিনীর মেজর ক্রসফায়ারে খুন হওয়ার পর প্রদীপ গ্রেপ্তার হয়। এই নিয়ে সারাদেশে ব্যাপক আলোচনা হই। তারপর অনেক দিন ক্রসফায়ারের খবর শোনা যায় নি। পুলিশ এই মামলায় গ্রেপ্তারকৃত দুইজন গুণ্ডাকে ক্রসফায়ারে খুন করে।

সাহিন হত্যা মামলার ৫ নং ও ৬ নং আসামী মানিক ও মনির। এই দুজনই বেশি কুপিয়েছে সাহিনকে। পুলিশ কোনো এক অজানা কারণে এদেরকে আদালতে বিচারের মুখোমুখি করতে রাজি না। তাই এই দুজনকে যথাক্রমে ২১ তারিখ ও ২৩ তারিখ খুন করে। অথবা এমন হতে পারে দীর্ঘদিন খুন না করতে পেরে হাত চুলকাচ্ছিল পুলিশের। তাই তারা এই দুই নিষ্ঠুর গুণ্ডাকে খুন করেছে।

যে কারনেই হোক পুলিশের এই সন্ত্রাসী কার্যক্রমের বিরুদ্ধে সোচ্চার হতে হবে। নইলে এই পুলিশ আবারো নিরীহ মানুষদের পাইকারি হারে খুন করতে থাকবে।

পঠিত : ২৮৯ বার

মন্তব্য: ০