Alapon

তাওহিদের পরিচিতি ও প্রকারভেদ

তাওহিদের পরিচিতি ও প্রকারভেদ :

একজন মুমিন বান্দার জীবনে সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ বিষয় হলো তাওহিদ। আর তাওহিদ শুধু মুখে কিছু বলার মধ্যেই সীমাবদ্ধ নয়; বরং এতে এমন কিছু বিষয় রয়েছে, যা ছাড়া তাওহিদ পূর্ণতাই পায় না। যেগুলো জানা না থাকলে তাওহিদ নিখাঁদও হয় না। অজান্তেই অনেক সময় এতে শিরক ও ভুল ব্যাখ্যা প্রবেশ করে; অথচ এ ব্যাপারে তার কোনো খবরও থাকে না। তাই বিশুদ্ধ তাওহিদ জেনে তদানুসারে নিজের ইমান-আকিদা বিশুদ্ধ করে নেওয়ার কোনো বিকল্প নেই। আমরা সংক্ষিপ্ত এ পরিসরে তাওহিদের ব্যাপারে সম্যক কিছু ধারণা দেওয়ার চেষ্টা করব। আল্লাহই তাওফিকদাতা এবং তিনিই আমাদের সহায়।

তাওহিদের সংজ্ঞা :
তাওহিদ (التوحيد) বাবে তাফয়িল থেকে وحّـد يوحد توحيدا এর মাসদার। এর আভিধানিক অর্থ, একত্রিতকরণ বা একত্ববাদ। (আল-মুজামুল অসিত : ২/১০১৬, প্রকাশনী : দারুদ দাওয়াহ, ইসকানদারিয়া)

এর পারিভাষিক অর্থ হলো :
إفراد الله - سبحانه - بما يختص به من الربوبية والألوهية والأسماء والصفات.
‘রুবুবিয়্যা, উলুহিয়্যা ও আসমা-সিফাতকে এককভাবে আল্লাহ তাআলার সাথেই নিদির্ষ্টকরণ।’ (মাজমুউ ফাতাওয়া ওয়া রাসায়িলিল উসাইমিন : ৯/১, প্রকাশনী : দারুল ওয়াতন)

অর্থাৎ রব হওয়া হওয়া, ইলাহ হওয়া এবং আল্লাহর উত্তম নাম ও গুণাবলি একমাত্র তাঁর জন্যই নির্দিষ্ট। এতে অন্য কারও কোনোরূপ অংশীদারত্ব নেই। নিম্নে তাওহিদের প্রকারভেদের আলোচনায় এ তিনটির ব্যাখ্যা উল্লেখ করা হবে, ইনশাআল্লাহ।

তাওহিদের তিনটি প্রকার রয়েছে। যথা :
১. توحيد الربوبية তাওহিদুর রুবুবিয়্যা।
২. توحيد الألوهية তাওহিদুল উলুহিয়্যা।
৩. توحيد الأسماء والصفات তাওহিদুল আসমা ওয়াস সিফাত।

এক : তাওহিদুর রুবুবিয়্যা
‘তাওহিদুর রুবুবিয়্যা’ অর্থ, আল্লাহর সৃষ্টি, রাজত্ব ও পরিচালনা ইত্যাদি গুণাবলি একমাত্র তাঁর জন্যই সাব্যস্ত করা। এতে অন্য কাউকে শরিক না করা।

এ তাওহিদের ব্যাপারে আল্লাহ তাআলা বলেন :
اللَّهُ خَالِقُ كُلِّ شَيْءٍ وَهُوَ عَلَى كُلِّ شَيْءٍ وَكِيلٌ
‘আল্লাহ সবকিছুর স্রষ্টা এবং তিনি সবকিছুর কর্মবিধায়ক।’ (সুরা আজ-জুমার : ৬২)

আল্লাহ তাআলা আরও বলেন :
قُلِ اللَّهُمَّ مَالِكَ الْمُلْكِ تُؤْتِي الْمُلْكَ مَنْ تَشَاءُ وَتَنْزِعُ الْمُلْكَ مِمَّنْ تَشَاءُ وَتُعِزُّ مَنْ تَشَاءُ وَتُذِلُّ مَنْ تَشَاءُ بِيَدِكَ الْخَيْرُ إِنَّكَ عَلَى كُلِّ شَيْءٍ قَدِيرٌ. تُولِجُ اللَّيْلَ فِي النَّهَارِ وَتُولِجُ النَّهَارَ فِي اللَّيْلِ وَتُخْرِجُ الْحَيَّ مِنَ الْمَيِّتِ وَتُخْرِجُ الْمَيِّتَ مِنَ الْحَيِّ وَتَرْزُقُ مَنْ تَشَاءُ بِغَيْرِ حِسَابٍ
‘বলুন, হে রাজাধিরাজ আল্লাহ, আপনি যাকে ইচ্ছা ক্ষমতা প্রদান করেন এবং যার নিকট হতে ইচ্ছা ক্ষমতা ছিনিয়ে নেন। যাকে ইচ্ছা সম্মানিত করেন আর যাকে ইচ্ছা লাঞ্ছিত করেন। সকল কল্যাণ তো আপনারই হাতে। নিশ্চয়ই আপনি সকল বিষয়ে সর্বশক্তিমান। আপনি রাতকে দিনের মধ্যে প্রবেশ করান এবং দিনকে রাতের মধ্যে প্রবেশ করান। আর মৃত থেকে জীবিতকে বের করেন এবং জীবিত থেকে মৃতকে বের করেন। আর যাকে চান বিনা হিসাবে রিজিক দান করেন।’ (সুরা আলি ইমরান : ২৬-২৭)

আল্লাহ তাআলা আরও ইরশাদ করেন :
إِنَّ رَبَّكُمُ اللَّهُ الَّذِي خَلَقَ السَّمَاوَاتِ وَالْأَرْضَ فِي سِتَّةِ أَيَّامٍ ثُمَّ اسْتَوَى عَلَى الْعَرْشِ يُدَبِّرُ الْأَمْرَ مَا مِنْ شَفِيعٍ إِلَّا مِنْ بَعْدِ إِذْنِهِ ذَلِكُمُ اللَّهُ رَبُّكُمْ فَاعْبُدُوهُ أَفَلَا تَذَكَّرُونَ
‘নিশ্চয়ই তোমাদের রব আল্লাহ, যিনি আসমানসমূহ ও জমিন সৃষ্টি করেছেন ছয় দিনে। তারপর আরশে সমুন্নত হয়েছেন। যাবতীয় বিষয় তিনিই পরিচালনা করেন। তাঁর অনুমতি লাভ না করে সুপারিশ করবে এমন সাধ্য কার? তিনিই আল্লাহ; তোমাদের রব। সুতরাং তাঁর ইবাদত করো। তবুও কি তোমরা চিন্তা (অনুধাবন) করবে না?’ (সুরা ইউনুস : ৩)

আল্লাহ তাআলা আরও ইরশাদ করেন :
اللَّهُ الَّذِي رَفَعَ السَّمَاوَاتِ بِغَيْرِ عَمَدٍ تَرَوْنَهَا ثُمَّ اسْتَوَى عَلَى الْعَرْشِ وَسَخَّرَ الشَّمْسَ وَالْقَمَرَ كُلٌّ يَجْرِي لِأَجَلٍ مُسَمًّى يُدَبِّرُ الْأَمْرَ يُفَصِّلُ الْآيَاتِ لَعَلَّكُمْ بِلِقَاءِ رَبِّكُمْ تُوقِنُونَ
‘আল্লাহ তাআলা-ই আকাশমণ্ডলী স্থাপন করেছেন স্তম্ভ ব্যতীত, তোমরা তো তা দেখতেই পাচ্ছ। এরপর তিনি আরশে সমুন্নত হয়েছেন এবং চন্দ্র-সূর্যকে নিয়মাধীন করেছেন যে, প্রত্যেকটি নির্দিষ্ট কাল পর্যন্ত আবর্তন করতে থাকবে। তিনি সকল বিষয় নিয়ন্ত্রণ করেন এবং নিদর্শনসমূহ বিশদভাবে বর্ণনা করেন, যেন তোমরা তোমাদের রবের সাক্ষাতের ব্যাপারে নিশ্চিত বিশ্বাস করতে পারো।’ (সুরা আর-রাদ : ২)

কুরআনে এ ধরনের আরও অনেক আয়াত রয়েছে। এসব আয়াতে আল্লাহর রুবুবিয়াত বিষয়ক আলোচনা এসেছে। যার সারকথা হলো, মাখলুক সৃষ্টি করা, তাদের রিজিক দেওয়া, প্রতিপালন করা, জীবন দেওয়া, মুত্যু দেওয়া, বিপদ দেওয়া, বিপদ থেকে উদ্ধার করা, পুরো জগতকে সুনিপুণভাবে পরিচালনা করা ইত্যাদি সব কাজ একমাত্র আল্লাহ-ই করেন। এতে তাঁর কোনো শরিক নেই। এ তাওহিদ যে কেবল মুসলিমরাই লালন করে, তেমনটি নয়; বরং অনেক খ্রিষ্টান, ইহুদি ও মুশরিকও এ তাওহিদ লালন করে। কারণ, এটা খুবই কমন ও স্বতঃসিদ্ধ বিষয়, যা কট্টর নাস্তিক ও চূড়ান্ত পর্যায়ের নির্বোধ ছাড়া কেউ অস্বীকার করতে পারে না। তাওহিদ বিশুদ্ধ করার ক্ষেত্রে এটার গুরুত্ব থাকলেও এটা মূল তাওহিদ নয়, যা বান্দাকে আল্লাহর পূর্ণ অনুগত ও একত্ববাদে বিশ্বাসী বলে সাব্যস্ত করবে। এ তাওহিদ লালনের দ্বারা একজন ব্যক্তি আস্তিক বলে প্রমাণিত হয়। তার থেকে নাস্তিক্যবাদের অভিযোগ দূর হয়। কিন্তু আখিরাতে মুক্তিপ্রাপ্ত প্রকৃত মুমিন হতে হলে তাকে 'তাওহিদুর রুবুবিয়্যা'-এর পাশাপাশি অবশ্য অবশ্যই 'তাওহিদুল উলুহিয়্যা'-তে বিশ্বাসী হতে হবে; নইলে মুক্তি পাওয়ার কোনো আশা নেই।

উল্লেখ্য যে, আমাদের সমাজে অধিকাংশ জায়গায় 'তাওহিদে রবুবিয়্যা'-কেই মূল তাওহিদ ও কালিমায়ে তাইয়িবার অর্থ হিসেবে প্রচার করা হয়। বলা হয়, তিনিই আমাদের পালেন, তিনিই সবকিছু করেন, তিনিই সর্বময় ক্ষমতার অধিকারী ইত্যাদি ইত্যাদি। অথচ নবি-রাসুলকে উম্মতের কাছে এ তাওহিদ দিয়ে পাঠানো হয়নি। এ তাওহিদ তো মক্কার মুশরিকরাও লালন করত। কুরআনে এসংক্রান্ত একাধিক আয়াত রয়েছে, যেখানে মুশরিকরা আল্লাহকে রব বলে স্বীকার করেছে। তারাও বিশ্বস করত যে, আল্লাহ এ বিশ্বের সৃষ্টিকর্তা, তিনিই জীবনদাতা, মৃত্যুদাতা এবং সকল কিছু পরিচালনাককারী। কিন্তু যখনই তাদেরকে ‘তাওহিদুল উলুহিয়্যা’-এর দাওয়াত দেওয়া হলো, তখনই তারা অস্বীকার করে বসল। তাই একজন মুমিনের জন্য ‘তাওহিদুর রুবুবিয়্যা’ গুরুত্বপূর্ণ হলেও তার জন্য ‘তাওহিদুল উলুহিয়্যা’-ই হলো মূল ও অধিক গুরুত্বপূর্ণ।

দুই : তাওহিদুল উলুহিয়্যা
‘তাওহিদুল উলুহিয়্যা’ অর্থ, কথা ও কর্মের মাধ্যমে আল্লাহ তাআলার একত্ববাদের স্বীকৃতি দেওয়া। সুতরাং ইবাদত ও গোলামি একমাত্র আল্লাহ তাআলার জন্যই হতে হবে। আর ইবাদত হলো, আল্লাহ ও তাঁর রাসুল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম যা কিছুর আদেশ-নিষেধ করেছেন, তা যথাযথভাবে বাস্তবায়নের মাধ্যমে আনুগত্য করা।

শাইখুল ইসলাম ইবনে তাইমিয়া রহ. ইবাদতের সংজ্ঞায় বলেন :
الْعِبَادَةُ هِيَ اسْمٌ جَامِعٌ لِكُلِّ مَا يُحِبُّهُ اللَّهُ وَيَرْضَاهُ: مِنْ الْأَقْوَالِ وَالْأَعْمَالِ الْبَاطِنَةِ وَالظَّاهِرَةِ
‘আল্লাহ তাআলার পছন্দনীয় সকল অভ্যন্তরীণ ও বাহ্যিক কথা ও কাজের সমষ্টির নাম হলো ইবাদত।’ (মাজমুউল ফাতাওয়া, ইবনু তাইমিয়া : ১০/১৪৯, প্রকাশনী : মাজমাউল মালিক ফাহাদ, মদিনা)

‘তাওহিদুল উলুহিয়্যা’-কে ‘তাওহিদুল ইবাদাহ’-ও বলা হয়। কেননা, مألوه (মালুহ) এর অর্থ হলো معبود (মাবুদ) বা ইবাদতের উপযুক্ত। ‘তাওহিদুল উলুহিয়্যা’-ই হলো সেই তাওহিদ, যার দিকে সকল নবি-রাসুল আহবান করেছেন এবং যার জন্য আসমানি কিতাবসমূহ নাজিল হয়েছে। এটা ‘তাওহিদুর রুবুবিয়্যা’-কেও অন্তর্ভুক্ত করে। কেননা, ‘তাওহিদুল উলুহিয়্যা’ হলো একমাত্র আল্লাহর ইবাদত করা, যার কোনো শরিক নেই। আর ইবাদতের ক্ষেত্রে যার একত্ববাদ মেনে নেওয়া হয়, প্রকারান্তরে সৃষ্টি, রাজত্ব, পরিচালনা ইত্যাদির ক্ষেত্রেও তার একত্ববাদকে মেনে নেওয়া হয়। তাই এ দুটি প্রকারের মাঝে ‘তাওহিদুল উলুহিয়্যা’-ই হলো আসল ও মূল।

এই তাওহিদের হাকিকত হলো, একমাত্র আল্লাহ তাআলারই ইবাদত করা, ইবাদতের ক্ষেত্রে কথায় বা কাজে তাঁর কোনো সৃষ্টিকে শরিক না করা এবং তাঁর আইন ও বিধানের বিপরীতে ব্যক্তি, সমাজ ও রাষ্ট্র্রের সকল আইন-কানুনকে অস্বীকার করা।

আল্লাহ তাআলা বলেন :
وَاعْبُدُوا اللَّهَ وَلَا تُشْرِكُوا بِهِ شَيْئًا وَبِالْوَالِدَيْنِ إِحْسَانًا
‘আর তোমরা আল্লাহর ইবাদত করো, তাঁর সাথে আর কাউকে শরিক করো না এবং পিতামাতার সাথে সদাচরণ করো।’ (সুরা আন-নিসা : ৩৬)

আল্লাহ তাআলা অন্যত্র ইরশাদ করেন :
وَقَضَى رَبُّكَ أَلَّا تَعْبُدُوا إِلَّا إِيَّاهُ وَبِالْوَالِدَيْنِ إِحْسَانًا
‘তোমার রব এটা বিধিবদ্ধ করে দিয়েছেন যে, তোমরা একমাত্র আল্লাহ ব্যতীত অন্য কারও ইবাদত করবে না এবং পিতামাতার সাথে সদ্বব্যবহার করবে।’ (সুরা বনি ইসরাইল : ২৩)

‘তাওহিদুল উলুহিয়্যা’ ততক্ষণ পর্যন্ত বিশুদ্ধ হবে না, যতক্ষণ না আল্লাহর ইবাদত ও আইন মানার পাশাপাশি সব তাগুত ও তাদের রচিত সকল আইন-কানুন পরিপূর্ণভাবে অস্বীকার করা হবে।

আল্লাহ তাআলা বলেন :
فَمَنْ يَكْفُرْ بِالطَّاغُوتِ وَيُؤْمِنْ بِاللَّهِ فَقَدِ اسْتَمْسَكَ بِالْعُرْوَةِ الْوُثْقَى لَا انْفِصَامَ لَهَا وَاللَّهُ سَمِيعٌ عَلِيمٌ
‘অতএব, যে তাগুতকে অস্বীকার করবে এবং আল্লাহর প্রতি ইমান আনবে, অবশ্যই সে দৃঢ়তম রশি আঁকড়ে ধরবে, যা কখনো ছিঁড়বার নয়। আল্লাহ সবকিছু শোনেন, সবকিছু জানেন। (সুরা আল-বাকারা : ২৫৬)

আল্লাহ তাআলা আরও বলেন :
وَلَقَدْ بَعَثْنَا فِي كُلِّ أُمَّةٍ رَّسُولًا أَنِ اعْبُدُوا اللَّهَ وَاجْتَنِبُوا الطَّاغُوتَ
‘আর আমি প্রত্যেক জাতির কাছেই এ দাওয়াত দিয়ে একজন রাসুল প্রেরণ করেছি যে, “তোমরা আল্লাহর ইবাদত করো এবং তাগুতকে বর্জন করো।”’ ( সুরা আন-নাহল : ৩৬)

সুতরাং বুঝা গেল, ইমানের জন্য আল্লাহর প্রতি বিশ্বাস স্থাপনের পাশাপাশি তাগুতকে বর্জন করাটাও জরুরি। কালিমায়ে তাইয়িবার মধ্যেও প্রথম অংশে সকল বাতিল ইলাহ ও তাগুতকে অস্বীকার করার শিক্ষাই দেওয়া হয়েছে এ বলে যে, ‘লা ইলাহা’ অর্থাৎ কোনো ইলাহের গোলামি নেই, কোনো তাগুতের স্বীকৃতি নেই এবং কোনো আইনের আনুগত্য নেই। ‘ইল্লাল্লাহ’ কেবল মহান আল্লাহর জন্যই সকল গোলামি, সকল স্বীকৃতি ও সকল আনুগত্য। আমাদের সমাজে এ জায়গাতে এসেও বেশিরভাগ মানুষ কালিমাটির ভুল অর্থ করে এবং সমাজে এটাকেই ইসলামের বাণী বলে প্রচার করে! অথচ সত্য ও বাস্তবতা থেকে তারা কত দূরে!

তিন : তাওহিদুল আসমা ওয়াস সিফাত
কোনো ধরনের تحريف (তাহরিফ) বা বিকৃতিসাধন, تعطيل (তাতিল) বা নিষ্কৃয়করণ تكييف (তাকয়িফ) বা ধরন নির্ধারণ ও تمثيل (তামসিল) বা সাদৃশ্য প্রদান ব্যতীত আল্লাহ তাআলার নামসমূহ ও গুণাবলির প্রতি বিশ্বাস স্থাপন। অর্থাৎ কুরআন ও সুন্নাহয় আল্লাহর নাম ও গুণাবলি যতটুকু যেভাবে এসেছে, ততটুকু ঠিক সেভাবেই বিশ্বাস করতে হবে। তাতে কোনোরূপ কমবেশ বা তাতে মনমতো ব্যাখ্যা-বিশ্লেষণ জুড়ে দেওয়ার কোনো অবকাশ নেই। আর এগুলো নিয়ে চুলচেরা বিশ্লেষণ ও তর্ক-বিতর্কে লিপ্ত হওয়ারও কোনো অনুমোদন নেই। কেননা, এগুলো হাকিকত ও প্রকৃত রূপ বান্দা কখনো উপলব্ধি করতে পারবে না। তাই কুরআন-সুন্নাহর সুস্পষ্ট নসের বাইরে গিয়ে এগুলো নিয়ে যত গবেষণা করা হবে, বিতর্কের পরিমাণ ততই বাড়তে থাকবে।

আল্লাহ তাআলা বলেন :
اللَّهُ لَا إِلَهَ إِلَّا هُوَ لَهُ الْأَسْمَاءُ الْحُسْنَى
‘আল্লাহ, যিনি ব্যতীত কোনো ইলাহ নেই। উত্তম সব নাম তো তাঁরই।’ (সুরা তহা : ৮)

আল্লাহ তাআলা অন্যত্র বলেন :
هُوَ اللَّهُ الَّذِي لَا إِلَهَ إِلَّا هُوَ عَالِمُ الْغَيْبِ وَالشَّهَادَةِ هُوَ الرَّحْمَنُ الرَّحِيمُ. هُوَ اللَّهُ الَّذِي لَا إِلَهَ إِلَّا هُوَ الْمَلِكُ الْقُدُّوسُ السَّلَامُ الْمُؤْمِنُ الْمُهَيْمِنُ الْعَزِيزُ الْجَبَّارُ الْمُتَكَبِّرُ سُبْحَانَ اللَّهِ عَمَّا يُشْرِكُونَ. هُوَ اللَّهُ الْخَالِقُ الْبَارِئُ الْمُصَوِّرُ لَهُ الْأَسْمَاءُ الْحُسْنَى يُسَبِّحُ لَهُ مَا فِي السَّمَاوَاتِ وَالْأَرْضِ وَهُوَ الْعَزِيزُ الْحَكِيمُ
‘তিনিই আল্লাহ। তিনি ব্যতীত কোনো ইলাহ নেই। তিনি অদৃশ্য ও দৃশ্যের পরিজ্ঞাতা। তিনি দয়াময় পরম দয়ালু। তিনিই আল্লাহ, যিনি ব্যতীত কোনো ইলাহ নেই। তিনিই অধিপতি, তিনিই পবিত্র, তিনিই শান্তিদাতা, তিনিই নিরাপত্তা বিধায়ক, তিনিই রক্ষক, তিনিই পরাক্রমশালী, তিনিই প্রবল, তিনিই অতীব মহিমান্বিত। ওরা (কাফিররা) যাদেরকে শরিক স্থির করে, আল্লাহ তাআলা তা হতে পবিত্র। তিনিই আল্লাহ। সৃজনকর্তা, অস্তিত্বদাতা, রূপদাতা, উত্তম সব নাম তো তাঁরই। আসমানসমূহ ও পৃথিবীতে যা কিছু আছে, সবকিছুই তাঁর পবিত্রতা ও মহিমা ঘোষণা করে। তিনি পরাক্রমশালী, প্রজ্ঞাময়। (সুরা আল-হাশর : ২২-২৪)

শাইখুল ইসলাম ইমাম ইবনে তাইমিয়া রহ. বলেন :
الْإِيمَانُ بِمَا وَصَفَ بِهِ نَفْسَهُ فِي كِتَابِهِ وَبِمَا وَصَفَهُ بِهِ رَسُولُهُ مُحَمَّدٌ صَلَّى اللَّهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ مِنْ غَيْرِ تَحْرِيفٍ وَلَا تَعْطِيلٍ وَمِنْ غَيْرِ تَكْيِيفٍ وَلَا تَمْثِيلٍ بَلْ يُؤْمِنُونَ بِأَنَّ اللَّهَ سُبْحَانَهُ: {لَيْسَ كَمِثْلِهِ شَيْءٌ وَهُوَ السَّمِيعُ الْبَصِيرُ}. فَلَا يَنْفُونَ عَنْهُ مَا وَصَفَ بِهِ نَفْسَهُ وَلَا يُحَرِّفُونَ الْكَلِمَ عَنْ مَوَاضِعِهِ وَلَا يُلْحِدُونَ فِي أَسْمَاءِ اللَّهِ وَآيَاتِهِ وَلَا يُكَيِّفُونَ وَلَا يُمَثِّلُونَ صِفَاتِهِ بِصِفَاتِ خَلْقِهِ لِأَنَّهُ سُبْحَانَهُ لَا سَمِيَّ لَهُ وَلَا كُفُوَ لَهُ وَلَا نِدَّ لَهُ وَلَا يُقَاسُ بِخَلْقِهِ - سُبْحَانَهُ وَتَعَالَى - فَإِنَّهُ سُبْحَانَهُ أَعْلَمُ بِنَفْسِهِ وَبِغَيْرِهِ وَأَصْدَقُ قِيلًا وَأَحْسَنُ حَدِيثًا مِنْ خَلْقِهِ ثُمَّ رُسُلُهُ صَادِقُونَ مَصْدُوقُونَ؛ بِخِلَافِ الَّذِينَ يَقُولُونَ عَلَيْهِ مَا لَا يَعْلَمُونَ وَلِهَذَا قَالَ سُبْحَانَهُ وَتَعَالَى: سُبْحَانَ رَبِّك رَبِّ الْعِزَّةِ عَمَّا يَصْفُونَ وَسَلَامٌ عَلَى الْمُرْسَلِينَ وَالْحَمْدُ لِلَّهِ رَبِّ الْعَالَمِينَ فَسَبَّحَ نَفْسَهُ عَمَّا وَصَفَهُ بِهِ الْمُخَالِفُونَ لِلرُّسُلِ وَسَلَّمَ عَلَى الْمُرْسَلِينَ لِسَلَامَةِ مَا قَالُوهُ مِنْ النَّقْصِ وَالْعَيْبِ وَهُوَ سُبْحَانَهُ قَدْ جَمَعَ فِيمَا وَصَفَ وَسَمَّى بِهِ نَفْسَهُ بَيْنَ النَّفْيِ وَالْإِثْبَاتِ فَلَا عُدُولَ لِأَهْلِ السُّنَّةِ وَالْجَمَاعَةِ عَمَّا جَاءَ بِهِ الْمُرْسَلُونَ؛ فَإِنَّهُ الصِّرَاطُ الْمُسْتَقِيمُ صِرَاطُ الَّذِينَ أَنْعَمَ اللَّهُ عَلَيْهِمْ: مِنْ النَّبِيِّينَ وَالصِّدِّيقِينَ وَالشُّهَدَاءِ وَالصَّالِحِينَ.
‘আল্লাহর প্রতি ইমানের অংশ হলো, আল্লাহ তাআলা তাঁর কিতাবে নিজের জন্য যেসব গুণ সাব্যস্ত করেছেন এবং তাঁর রাসুল মুহাম্মাদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম তাঁর রবকে যেসব গুণে গুণান্বিত করেছেন, সেগুলোর প্রতি কোনো ধরনের তাহরিফ (বিকৃতিসাধন), তাতিল (নিষ্কৃয়করণ), তাকয়িফ (ধরন নির্ধারণ) ও তামসিল (সাদৃশ্য প্রদান) ব্যতীত ইমান আনা। বরং বান্দাগণ বিশ্বাস করবে যে, আল্লাহ তাআলা এমন মহান যে : لَيْسَ كَمِثْلِهِ شَيْءٌ وَهُوَ السَّمِيعُ الْبَصِيرُ “তার মতো কিছুই নেই। তিনি সর্বশ্রোতা, সর্বদ্রষ্টা।” [সুরা আশ-শুরা : ১১] সুতরাং আল্লাহ নিজের জন্য যেসব গুণ সাব্যস্ত করেছেন, সেগুলো অস্বীকার করা যাবে না, আল্লাহর কালাম বিকৃত করা যাবে না, আল্লাহর নাম ও আয়াতসমূহের অপব্যাখ্যা করা যাবে না, তাঁর কোনো আকৃতি বর্ণনা করা যাবে না এবং তাঁর গুণাবলির সাথে মাখলুকের গুণাবলি তুলনা করা যাবে না। কেননা, আল্লাহর সমতুল্য কেউ নেই, তাঁর কোনো সমকক্ষ নেই এবং তাঁর নেই কোনো অংশীদার। সৃষ্টির দ্বারা তাকে অনুমান করা যাবে না। কেননা, তিনিই নিজের ব্যাপারে ও অন্যের ব্যাপারে সৃষ্টির চেয়ে অধিক জ্ঞাত, অধিক সত্যবাদী এবং সর্বোত্তম বর্ণনাকারী। ওই ব্যক্তিরা এর সম্পূর্ণ ব্যতিক্রম, যারা আল্লাহর ওপর এমন বিষয় আরোপ করে, যা তারা জানে না। এজন্যই আল্লাহ তাআলা বলেছেন : سُبْحَانَ رَبِّكَ رَبِّ الْعِزَّةِ عَمَّا يَصِفُونَ. وَسَلَامٌ عَلَى الْمُرْسَلِينَ. وَالْحَمْدُ لِلَّهِ رَبِّ الْعَالَمِينَ “ওরা যা আরোপ করে, তোমার রব তা হতে পবিত্র, যিনি সকল ক্ষমতার অধিকারী। শান্তি বর্ষিত হোক রাসুলদের প্রতি। প্রশংসা সব জগতসমূহের রব আল্লাহরই প্রাপ্য।” [সুরা আস-সাফফাত : ১৮০-১৮২] তো রাসুলদের বিরোধীরা আল্লাহর জন্য যেসব গুণ আরোপ করে, আল্লাহ সেগুলো থেকে নিজেকে পবিত্র ঘোষণা করেছেন এবং রাসুলদের প্রতি শান্তি বর্ষণ করেছেন। কেননা, তাঁরা যা বলেন, তা দোষ-ত্রুটি থেকে মুক্ত। আল্লাহ তাআলা স্বীয় নাম ও গুণের ক্ষেত্রে ইতিবাচক ও নেতিবাচকের সমন্বয় সাধন করেছেন। সুতরাং আহলুস সুন্নাহ ওয়াল জামাআহ’র জন্য রাসুলদের আনীত হিদায়াত থেকে বিমুখ থাকা কোনো অবকাশ নেই। কেননা, এটাই হলো সিরাতে মুসতাকিম বা সরল পথ, তাদের পথ, যাদের প্রতি আল্লাহ অনুগ্রহ করেছেন; তথা আম্বিয়ায়ে কিরাম, সিদ্দিকিনে কিরাম, শুহাদায়ে কিরাম ও সালিহিনের পথ।’ (মাজমুউল ফাতাওয়া, ইবনু তাইমিয়া : ৩/১২৯-১৩০, প্রকাশনী : মাজমাউল মালিক ফাহাদ, মদিনা)

উল্লেখ্য যে, তাওহিদুল আসমা ওয়াস-সিফাতের আলোচনাটি বেশ বড় এবং এর কিছু অংশ খুবই স্পর্শকাতর ও মতানৈক্যপূর্ণ। তাই এ সংক্ষিপ্ত পরিসরে আমরা বিস্তারিত আলোচনার দিকে যাওয়াটা মুনাসিব মনে করছি না। আল্লাহ তাওফিকে আকিদা বিষয়ক প্রমাণ্য ও বড় পরিসরের গ্রন্থ রচনার কাজ শেষ হলে সেখানে বিস্তারিতভাবে দেখে নেওয়া যাবে, ইনশাআল্লাহ।

বি. দ্র. : এ তিনটি প্রকারের পাশাপাশি ইদানিং অনেকের মুখে ‘তাওহিদুল হাকিমিয়্যা’ নামে আরেকটি প্রকারের কথা শোনা যায়। এর মর্মার্থ হলো, আইন বা বিধান একমাত্র আল্লাহরই। এটা প্রণয়নের একচ্ছত্র অধিকার কেবল তাঁরই। এতে বান্দার কোনো শিরকত বা অংশীদারত্ব থাকতে পারবে না। আল্লাহ আইন করবেন, আর বান্দা তা বাস্তবায়ন করবে। এটাই বান্দার দায়িত্ব, এটাই তার কাজ। আল্লাহর আইনের বিপরীতে তার নিজের কোনো আইন বানানোর অধিকার নেই। আল্লাহর আইন বা বিধানের সাথে সাংঘর্ষিক কোনো আইন প্রণয়ন করা সুস্পষ্ট শিরক। তাই এটাও বিশুদ্ধ তাওহিদের জন্য অতিআবশ্যক একটি শর্ত। তবে অনেক উলামায়ে কিরামই এটাকে তাওহিদের তিন প্রকার থেকে অতিরিক্ত একটি প্রকার হিসাবে উল্লেখ করেননি; বরং এটাকে ‘তাওহিদুর রুবুবিয়্যা’ বা ‘তাওহিদুল উলুহিয়্যা’-এর অন্তর্গত করেছেন। আল্লাহ তাআলা ছাড়া যেহেতু অন্য কারও আইন প্রণয়ন করা, আদেশ করা, নিষেধ করা ও পরিচালনা করার অধিকার নেই, সে দিক বিবেচনায় কেউ কেউ এটাকে ‘তাওহিদুর রুবুবিয়্যা’-এর অন্তর্ভুক্ত বলেছেন। আর এসব আইন-শাসন মানা ও বাস্তবায়ন করা যেহেতু বান্দার দায়িত্ব ও ইবাদতের মধ্যে পড়ে; তাই এ দিক বিবেচনায় অনেকে এটাকে ‘তাওহিদুল উলুহিয়্যা’ তথা তাওহিদুল ইবাদতের অন্তর্ভুক্ত বলেছেন। এ দ্বিতীয় মতটিই আমাদের নিকট প্রাধান্যপ্রাপ্ত ও অধিক বিশুদ্ধ মত। আল্লাহ-ই ভালো জানেন।

‘তাওহিদুল হাকিমিয়্যা’-এর মূল বিষয় এটাই। সুতরাং এটা যখন ‘তাওহিদুর রুবুবিয়্যা’ কিংবা তাওহিদুল উলুহিয়্যা’-এর অন্তর্গত, তখন এটাকে আর আলাদা প্রকারে ভাগ করা হয়নি। তবে হ্যাঁ, কেউ বোঝার সুবিধার্থে বা গুরুত্বের বিচারে তাওহিদকে চার ভাগে বিভক্ত করলেও মৌলিক কোনো সমস্যা নেই। এ বিভক্তিকে বিদআত আখ্যা দেওয়া বা ভুল সাব্যস্ত করা সঠিক নয়। কেননা, এসব আলোচনায় মাসআলাই হলো মূল, সংখ্যা নয়। আল্লাহ তাআলা আমাদের সবাইকে তাওহিদের অর্থ ও তার প্রকারগুলো যথাযথভাবে জেনে সে অনুসারে নিজেদের ইমান-আকিদা বিশুদ্ধ করার তাওফিক দান করুন।

©শাইখ তারেকুজ্জামান তারেক!

পঠিত : ৮৪৯ বার

মন্তব্য: ০