Alapon

আপনি আল্লাহর রীতিতে কখনোই কোনো পরিবর্তন পাবেন না...



আমি মনে করি, বিশ্বে এখন যা ঘটছে তা নিয়ে অসচেতন থাকা অসম্ভব। মুসলমানদের বিরুদ্ধে অমুসলিমরা যে ঘৃণ্য অপরাধ চালাচ্ছে এবং মুসলমানরাও অপর মুসলিমের বিরুদ্ধে যে অপরাধ চালাচ্ছে তার দ্বারা আমরা সবাই প্রভাবিত। একজন মুসলিম হিসেবে বড় হওয়ার কালে এই ট্রাজেডিগুলো আমাদের প্রাত্যহিক জীবনের অংশ হয়ে দাঁড়িয়েছে। আপনাদের মধ্যে যাদের বয়স ত্রিশ চল্লিশ বছর আপনারা দেখেছেন গত অর্ধ শতক বা তার চেয়েও বেশি সময় ধরে উম্মাহ শুধু একটি সংকটের পর আরেকটি, এরপর আরেকটি, এরপর আরেকটির মধ্য দিয়ে গত হয়েছে।


এভাবে দীর্ঘ সময় পর কোনো ব্যক্তি একেবারে নিস্তেজ হয়ে পড়তে পারে। "ওহ, আবার শুরু হলো। এরপর আরেকটা। এরপর আরেকটা।" এতবেশি জনপদ আজ জ্বলছে এবং এতবেশি জরুরী অবস্থা আজ মুসলিম জনপদগুলোতে!! যেমন, আমাদের প্রাণপ্রিয় ফিলিস্তিনে এই মুহূর্তে যা ঘটছে...একদিকে হতাশা অন্যদিকে নিরুপায় অবস্থা...আমাদের পক্ষে কী করার আছে। ব্যাপারগুলো আমাদের সম্পূর্ণরূপে অভিভূত করতে ফেলতে পারে।


অনেক মানুষ আমাকে এ বিষয়ে বক্তব্য রাখতে বলেছেন। ফিলিস্তিন সম্পর্কে আমার চিন্তা-ভাবনা কী তা নিয়ে কথা বলতে বলেছেন। উম্মাহর অবস্থা নিয়ে আমি কী মনে করি। আমি আসলে কিছু সময় যাবত চুপ করে ছিলাম। আমি কিছু বলিনি। আর এই খুৎবাতেও এ নিয়ে কথা বলবো না।


আমি সিদ্ধান্ত নিয়েছি প্রথমে নিজের চিন্তা-ভাবনাগুলোকে একত্রিত করতে। কারণ, আমার প্রথম প্রতিক্রিয়া ছিল, আমি আগেও এটা অনুভব করেছি, আমি এই প্রতিক্রিয়া উম্মাহর কাছ থেকে আগেও দেখেছি। বস্তুত, আমি এই প্রতিক্রিয়া দেখেছি চক্রাকারে চলতে। প্রায় প্রতি সিজনে। ঠিক এই পরিস্থিতিতে আমরা বার বার ছিলাম।


অতএব, ক্ষোভ প্রকাশ করা, নির্যাতিত উম্মহার জন্য দুয়া করা-- এ ধারণাগুলোর সাথে সবাই পরিচিত, সবাই এ সম্পর্কে জানে। এই অনুভূতিগুলো সবার হয় এবং সবাই এই দুয়াগুলো করে থাকে। সবাই তাদের সামর্থ্য অনুযায়ী আর্থিক সাহায্যও করে থাকে। সবাই মৌখিক প্রতিবাদ জানায়। প্রতিবাদ- মুসলিম দেশগুলোর বিরুদ্ধে যারা উম্মাহর জন্য কিছু করছে না। প্রতিবাদ- জাতিসংঘের বিরুদ্ধে। প্রতিবাদ- যুক্তরাষ্ট্রের বিরুদ্ধে। প্রতিবাদ- ইসরাইলের মত অপরাধী রাষ্ট্রের বিরুদ্ধে। ইত্যাদি ইত্যাদি ইত্যাদি। আমরা এই কাজগুলো অসংখ্যবার করেছি ইতোমধ্যে।


এই কাজগুলোর পেছনে যৌক্তিকতা আমি বুঝি। আমি সত্যি বুঝি। কিন্তু, আমি আরও অনুভব করি এগুলো যথেষ্ট নয়। আমি আরও অনুভব করি, আমরা এই কাজগুলো বহুবার ধরে করে আসছি। ব্যাপারটা গভীরভাবে কষ্টদায়ক এবং হতাশাজনক যে, আমরা ঠিক একই পরিস্থিতিতে আবারও, যদি পরিস্থিতি আরও খারাপ না হয়ে থাকে সময় যাওয়ার সাথে সাথে।


তাই, আমি শুধু ক্ষোভ প্রকাশ বা একই আবেগের পুনরাবৃত্তি ঘটাতে যাচ্ছি না, কিন্তু একটু পেছনে সরে এসে ভাবা যে, একটি উম্মাহ হিসেবে আমাদের কোন ব্যাপারটা নিয়ে চিন্তা করা উচিত। আমার খুৎবাগুলো প্রায় সময়, গত কয়েক বছর যাবত শুধু ব্যক্তিগত ক্ষমতায়ন নিয়ে কথা বলে আসছে। একজন ব্যক্তি কীভাবে তার ঈমানকে শক্তিশালী করবে। একজন ব্যক্তি কীভাবে তার জীবনের আঘাতগুলোকে কাটিয়ে উঠবেন।


কারণ, আমাদের ধর্ম একদিকে অত্যন্ত ব্যক্তিগত। এটি সত্যই একজন মানুষকে শক্তিশালী করে তুলে। এটি আপনার ঈমান নিয়ে, আপনার গল্প নিয়ে, আপনার জীবন নিয়ে, আল্লাহর সাথে আপনার সাক্ষাৎ নিয়ে, আল্লাহর বইয়ের সাথে আপনার সম্পর্ক নিয়ে, আল্লাহর রাসূলের সাথে আপনার সম্পর্ক নিয়ে। সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম। এটি আপনার সমস্যাগুলো নিয়ে, আপনার পরিবার নিয়ে, আপনার ব্যবসা নিয়ে, আপনার আর্থিক অবস্থা নিয়ে, আপনার যাকাত নিয়ে, আপনার নামাজ নিয়ে-- এটি খুবই ব্যক্তিগত, একদিকে। কিন্তু, অন্যদিকে আমাদের এই চেতনাও প্রদান করা হয়েছে যে, আমরা নিজেদের চেয়েও বিরাট কিছুর অংশ। শুধু পরিবার বা সমাজের নয়। আমরা একটি উম্মাহর অংশ। আমরা অনেক বড় কিছুর অংশ।


যে জিনিসটির আমরা অংশ, যে অস্তিত্বের আমরা অংশ সেটি জাতি গোষ্ঠীকে ছাড়িয়ে যায়। আমরা একই ভাষায় কথা না বলতে পারি, আমাদের মাঝে একমাত্র কমন বিষয় হলো 'লা ইলাহা ইল্লাল্লাহ মুহাম্মাদুর রাসূলুল্লাহ' সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম। শুধু এটাই। শুধু এটাই যথেষ্ট। এটাই যথেষ্ট। আমরা সম্পূর্ণ ভিন্ন সংস্কৃতি, ভিন্ন পরিবেশ, ভিন্ন জাতি থেকে আসতে পারি। এমনকি আমাদের জীবন পদ্ধতিও ভিন্ন ধরণের হতে পারে, সাংস্কৃতিক দিক থেকে। আমরা একে অন্যের থেকে সম্পূর্ণ আলাদা হতে পারি। কিন্তু আমাদের মাঝে রয়েছে একটি দৃঢ় বন্ধন। আল্লাহর বই আমাদের সবাইকে একই বন্ধনে আবদ্ধ করে। তাহলে, উম্মাহর একটি চেতনাও আমাদের মাঝে রয়েছে। ঠিক এই কারণেই, আমরা সামষ্টিকভাবে ব্যথা অনুভব করি উইঘুর মুসলমানদের অবস্থা দেখে। আমরা সামষ্টিকভাবে বেদনা অনুভব করেছি নব্বইয়ের দশকে বসনিয়ার কসোভোর অবস্থা দেখে। আমরা সামষ্টিক ব্যথা অনুভব করে আসছি গত অর্ধ শতকের বেশি সময় ধরে ফিলিস্তিনের অবস্থা দেখে। আফগানিস্তানের অবস্থা দেখে, যা এখনো ঘটে চলছে। ইয়েমেনের অবস্থা দেখে, যা এখনো ঘটছে। রোহিঙ্গা মুসলিমদের অবস্থা দেখে। শ্রীলংকার মুসলমানদের অবস্থা দেখে যখন দাঙ্গার সময় বৌদ্ধ সন্ত্রাসীরা শহরে মুসলমানদের আক্রমণ করেছিল। ভারতের গুজরাটে মুসলমানদের প্রতি যে নির্যাতন চালানো হয়েছিলো। এরপর কাশ্মীর। এই লিস্ট অনেক বড়। খুবই খুবই বড় তালিকা।


এখন, আমরা একটি উম্মাহ হিসেবে উম্মাহর অংশ হওয়ার অর্থ কী? আমি এই জ্বলন্ত আগুন থেকে কিছুটা পেছনে সরে এসে আল্লাহর বইয়ের দিকে ফিরতে চাই। কিছু একটা পেতে চাই। আর আমি দাবি করছি না যে, আমার কাছে এর উত্তর আছে। প্রথমেই এই বিষয়টা পরিষ্কার করে নিতে চাই।


আমাদের কারো কাছে যদি এর জবাব থাকতো, তাহলে আমরা এই পরিস্থিতিতে থাকতাম না। তাই, কারো কাছে এর জবাব আছে এবং সে জানে কী করতে হবে এমনটা মনে করা অহংকারপূর্ণ। কিন্তু আমাদের এর উত্তরের জন্য আল্লাহর দিকে ফিরতে হবে। আল্লাহর বইয়ের কাছে ফিরতে হবে অন্তত কিছু উত্তরের জন্য।

-------------------------


এই খুৎবা আসলে এই ব্যাপারটা নিয়ে—একটি উম্মাহ হিসেবে আমাদের নিকট আল্লাহর কিছু প্রত্যাশা আছে। তিনি আমাদের একটি উম্মায় পরিণত করেছেন—এর দ্বারা আসলে কী বোঝায়। উম্মাহ বানানোর একটি ঘোষণা তিনি সুরাতুল বাকারায় দিয়েছেন। আরও অন্য অনেক স্থানের মাঝে এটা অন্যতম কেন্দ্রীয় একটি স্থান। অন্যতম একটি শক্তিশালী জায়গায় সুরাতুল বাকারার একেবারে মাঝখানে, যেটি কুরআনের দীর্ঘতম সূরা, তিনি সেখানে ঘোষণা প্রদান করেন - وَكَذَٰلِكَ جَعَلْنَاكُمْ أُمَّةً وَسَطًا - এভাবে আমরা তোমাদের একটি মধ্যপন্থী উম্মায় পরিণত করেছি। (2:143)


অনুবাদে প্রায় সময় উল্লেখ করা হয় মধ্যপন্থী জাতি বা ভারসাম্যপূর্ণ জাতি। 'ওয়াসাত' অর্থ ভারসাম্য। এটি আসলে একটি মাসদার। তাই এর অর্থ হবে, এমন জাতি যা ভারসাম্যের গুণে গুণান্বিত। এটা বলা হয়নি যে, উম্মাতান মুতাওয়াসসিসাতা। তখন এটি সিফাত হতো। কিন্তু এখানে সিফাতটি মাসদার। যা আসলে অতিরঞ্জিত রূপ। বেশি টেকনিক্যাল না হয়ে বলছি, এর দ্বারা আসলে বুঝায়— তোমাদের এমন একটি জাতিতে পরিণত করা হয়েছে কেউ যদি তোমাদের দিকে তাকায় তখন প্রথম যে জিনিসটি তাদের মাথায় আসবে তা হলো ভারসাম্য। কিছু সময়ের জন্য ব্যাপারটা নিয়ে চিন্তা করুন। আল্লাহ্‌ বলছেন আমাকে আপনাকে তিনি এমন একটি উম্মাহ বানিয়েছেন যে উম্মাহ আসলে প্রায় নিজেই ভারসাম্যের সংজ্ঞা। নিজেই ভারসাম্যের সংজ্ঞা।


দুনিয়াতে ভারসাম্য একটি গুরুত্বপূর্ণ বিষয়। এটি আসলে ন্যায় বিচারের সাথে সম্বন্ধযুক্ত। পৃথিবীর যে কোনো বিচার বিভাগে দাঁড়িপাল্লা দেখতে পাবেন। আদালতের একটি প্রতীক হিসেবে। দেখবেন এক অন্ধ মহিলা মূর্তি দাঁড়িপাল্লা ধরে দাঁড়িয়ে আছে বা শুধু দাঁড়িপাল্লা ঝুলানো আছে। কারণ, আপনার পক্ষে ন্যায় বিচার পাওয়া সম্ভব নয় যতক্ষণ না ভারসাম্য খুঁজে পাবেন। আর আল্লাহ্‌ সুবহানাহু ওয়া তায়ালা এমনকি ভারসাম্যের প্রতি নির্দেশ করেছেন। মিজানের কথা কুরআনে এসেছে। তিনি বলেছেন তিনি মহাবিশ্বকে ভারসাম্যপূর্ণ করে সৃষ্টি করেছেন। তিনি বলেন, وَالسَّمَاءَ رَفَعَهَا وَوَضَعَ الْمِيزَانَ - আর তিনি আকাশকে সমুন্নত করেছেন এবং ভারসাম্য স্থাপন করেছেন। أَلَّا تَطْغَوْا فِي الْمِيزَانِ - যাতে তোমরা দাঁড়িপাল্লায় সীমালঙ্ঘন না কর। () অর্থাৎ, তোমরা হলে ভারসাম্যপূর্ণ জাতি। তোমরা ন্যায় বিচারের জাতি। তাহলে, ভারসাম্য ঠিক রাখা এবং ন্যায় বিচার করা একে ওপরের সাথে ওতপ্রোতভাবে জড়িত।

----------------

এখন, আমাদেরকে যে মধ্যপন্থী উম্মত বানানো হয়েছে এই ঘোষণাটি কোথায় এসেছে? এটি সুরাতুল বাকারার এমন এক স্থানে এসেছে যা গভীর ভাবনার দাবি রাখে। আমাদের পূর্বে আসা এক জাতি সম্পর্কে আল্লাহ্‌ কথা বলেছেন। যাদেরকে বই দেওয়া হয়েছিল। ঠিক যেমন আমরা একটি জাতি এবং আমাদেরকেও একটি বই দেওয়া হয়েছে। তাদেরকে একটি বই দেওয়া হয়েছিলো আর তারা তাদের বইয়ের সাথে বহু শতাব্দী পার করেছে। আর আজ, ২০২১ সালে, আজ যখন আমরা তাদের সম্পর্কে পড়ছি, আমাদেরও একটি বই দেওয়া হয়েছে আর আমাদের উপরেও বহু শতাব্দী পার হয়ে গেছে। তাহলে, আমাদের এবং তাদের মাঝে একটি কমন বিষয় রয়েছে। তাদের একটি বই দেওয়া হয়েছে আর তারা এর সাথে অনেক শতাব্দী অতিক্রম করেছে। আমাদেরও একটি বই দেওয়া হয়েছে আর আমরাও এর সাথে অনেক শতাব্দী অতিক্রম করেছি।


তারপর আল্লাহ বলছেন এই বইয়ের মাধ্যমে একতাবদ্ধ হয়ে নিজেদের শক্তিশালী করার বিপরীতে তারা নিজেদের মাঝে বিভক্তি তৈরি করলো, পরস্পর সংঘর্ষে লিপ্ত হলো এবং পরস্পরকে হত্যা করলো। আর তারা তাদের কিতাবের জ্ঞানকে ব্যবহার করলো এক গ্রুপের উপর অন্য গ্রুপের শ্রেষ্ঠত্ব প্রতিষ্ঠা করার কাজে। وَمَا تَفَرَّقُوا إِلَّا مِن بَعْدِ مَا جَاءَهُمُ الْعِلْمُ بَغْيًا بَيْنَهُمْ - তারা মতভেদ করেনি জ্ঞান আসা ব্যতীত, বিশেষ করে জ্ঞান আসার পর এক দলকে অন্য দলের উপর বড় করে তোলার উপায় হিসেবে তারা মতভেদে জড়িয়ে পড়লো। (42:14)


সুতরাং, জ্ঞান ব্যবহার করা হলো এই দল সেই দলের মতকে খণ্ডন করার জন্য, সেই দল এই দলের মতকে খণ্ডন করার জন্য। "এই দলের লোকেরা কাফের। না, ঐ দলের লোকেরা কাফের। এই দলের রক্ত হালাল। না, ঐ দলের রক্ত হালাল।" আমাদের আগের জাতির লোকেরা এগুলো করতো। তারা এমনটা করেছিল।


আল্লাহ্‌ আরও কথা বলেছেন কীভাবে তিনি পরিষ্কার জানিয়ে দিয়েছেন যে কোনটা হালাল আর কোনটা হারাম। কিন্তু, তারা আল্লাহর আদেশের সাথে মশকরা করলো। "জাস্ট আমাকে এমন একটি উপায় বলে দিন যেন আমাকে এটা মানতে না হয়, আর আমি নিজেকে যেন দোষ না দিয়ে থাকি।"


আল্লাহ্‌ এই জাতি সম্পর্কে আরও বলেছেন তাদের যখন এই বই দেয়া হয়েছে... কেউ যখন তাদেরকে এই বইয়ের কোনো কথা মনে করিয়ে দিত তারা তাদের বিরুদ্ধে যুদ্ধ ঘোষণা করতো। তারা তাদের বিরুদ্ধে যুদ্ধ ঘোষণা করতো।


আল্লাহ্‌ তাদের মুনাফেকি সম্পর্কে বলেছেন তারা কোনো ধরণের দ্বিধা দ্বন্দ্ব ছাড়াই একে অন্যের রক্ত ঝরাতো। তাদের বিশাল এক দায়িত্ব দেওয়া হয়েছে। তারা তো একটি উম্মাহ ছিল, তাই না? উম্মাহর তো এমন হওয়ার কথা... আমাদের রাসূল (স) যেমন বলেছেন, উম্মাহর একটি শরীরের মত হওয়ার কথা। তাই, আল্লাহ্‌ তাদের বললেন, لَا تَسۡفِکُوۡنَ دِمَآءَکُمۡ وَ لَا تُخۡرِجُوۡنَ اَنۡفُسَکُمۡ مِّنۡ دِیَارِکُمۡ - তোমরা একে অন্যের রক্ত ঝরাবে না…(2:84) তিনি সে সময়ের মুসলমানদের একথা বললেন। যারা আমাদের পূর্বে এসেছিল। তিনি তাদের বললেন, তোমরা একে অন্যের রক্ত প্রবাহিত করবে না। এবং পরস্পরকে স্বদেশ হতে বহিষ্কার করবে না। তোমরা একে অন্যকে নিজের বাড়ি থেকে বহিষ্কার করবে না। ثُمَّ اَقۡرَرۡتُمۡ - অতঃপর তোমরা সবাই তা মেনে নিয়েছিলে। وَ اَنۡتُمۡ تَشۡهَدُوۡنَ - এবং তোমরাই ওর সাক্ষী ছিলে। ثُمَّ اَنۡتُمۡ هٰۤـؤُلَآءِ تَقۡتُلُوۡنَ اَنۡفُسَکُمۡ - “অতঃপর তোমরাই তো তারা, যারা নিজদেরকে হত্যা করছ” وَ تُخۡرِجُوۡنَ فَرِیۡقًا مِّنۡکُمۡ مِّنۡ دِیَارِهِمۡ - এবং তোমাদের মধ্য থেকে একটি দলকে তাদের গৃহ থেকে বের করে দিচ্ছ; تَظٰهَرُوۡنَ عَلَیۡهِمۡ بِالۡاِثۡمِ وَ الۡعُدۡوَانِ - তোমরা নিজেরা তাদের বিরুদ্ধে অন্যায় ও সীমালঙ্ঘন করে পরস্পরের সহযোগিতা করছ। (2:85)


অর্থাৎ, তোমরা মুসলমানরা-মানে সেই সময়ের ইসরাইলীরা- আক্রমণাত্মক পদক্ষেপ নিচ্ছ অন্য মুসলমানদের বিরুদ্ধে। সেই সময়ের আরেক ইসরাইলীদের বিরুদ্ধে।


এরপর, এইসব কিছুর উপরে, যখন তারা এই অন্যায় কাজে নিয়োজিত ছিল, এক দল বিশ্বাসী অন্য আরেক দল বিশ্বাসীর বিরুদ্ধে, যখন পরিস্থিতি একেবারে খারাপ হয়ে পড়েছিল।


যখন মুসলমানরা একে অন্যের বিরুদ্ধে লড়াই করে তখন কী হয়? আগের দিনে যখন ইসরাইলীরা পরস্পর যুদ্ধে লিপ্ত হয়েছিলো, তাদের সাম্রাজ্য দুর্বল হয়ে পড়েছিল। তখন বাহিরের জাতির লোকেরা তাদের উপর আক্রমণ চালিয়েছিল। কারণ, তাদের শক্তি ক্ষয় হয়ে গিয়েছিল পারস্পরিক যুদ্ধে। আর যখনই কোনো জাতি দুর্বল হয়ে পড়ে তখন অন্য জাতি এর সুযোগ গ্রহণ করে। এমনটাই ঘটে।


কোনো জাতিকে দুর্বল করার সবচেয়ে কার্যকরী উপায়- রাশিয়ানরা বর্তমানে যুক্তরাষ্ট্রের ব্যাপারে এটা ভালো বুঝে। কোনো জাতিকে দুর্বল করার সবচেয়ে কার্যকরী উপায় হলো... কী? তাদের নিজেদের মাঝে দ্বন্দ্ব সংঘাত বাঁধিয়ে দেয়া। ঠিক কিনা? তাই, যখন সে সময়ের মুসলমানরা একে অন্যের বিরুদ্ধে দ্বন্দ্ব সংঘাতে জড়িয়ে পড়লো, তখন সিরিয়ানরা, ব্যবিলনীয়রা, সে সময়ের শক্তিশালী জাতিগুলো- যারা শক্তির দিক দিয়ে ইসরাইলীদের সমতুল্য ছিল- তাদের দুর্বলতা দেখল এবং তাদের উপর আক্রমণ চালাতে শুরু করলো। যখন সেই কুফফার শক্তিগুলো এসে আক্রমণ চালাতে শুরু করলো, তখন বহু মুসলিমকে জেলে ঢোকানো হল, বন্দী করা হল, অনেকের উপর নির্যাতন চালানো হল।


এভাবে যখন এক দল মুসলিমের উপর কুফফাররা নির্যাতন চালাত, তখন অন্য মুসলিম দল বলত, তারা তোমাদের ভাই। তাদের উপর কুফফারার অত্যাচার চালাচ্ছে। তাদের মুক্ত করো। وَ اِنۡ یَّاۡتُوۡکُمۡ اُسٰرٰی تُفٰدُوۡهُمۡ - তারা যখন বন্দীরূপে তোমাদের নিকট হাজির হয়, তখন তোমরা বলতে তাদের জন্য মুক্তিপণ দাও, তোমাদের ভাইদের জন্য মুক্তিপণ দাও।


একই আয়াতে আল্লাহ্‌ বলছেন তোমরা নিজেরাই একে অন্যের গলা কাটছিলে আর এই গলা কাটার কারণে তোমরা এতোই দুর্বল হয়ে পড়লে যে, অন্য জাতি এলো এবং তোমাদের পরাভূত করলো। আর যখন তারা এভাবে তোমাদের পরাজিত করতে শুরু করলো তখন তোমরা বলতে শুরু করলে, না, না, আমাদের ভাইদের সাহায্য করো। কিন্তু তোমরাই তো শুরুতে এই দুর্বলতা সৃষ্টি করেছ। এটা তোমাদের হাতের কামাই। তোমরা তো ক্ষমতাশালী এক উম্মাহ ছিলে। আল্লাহ্‌ তোমাদের সাথে ছিলেন। فَضَّلْتُكُمْ عَلَى الْعَالَمِينَ - আল্লাহ্‌ ইসরাইলীদের স্মরণ করিয়ে দিচ্ছেন আমি তোমাদেরকে পৃথিবীর অন্য সব জাতির উপর উচ্চমর্যাদা দিয়েছি।(2:47) আল্লাহ্‌ তাদের সম্পর্কে এ কথা বলেছেন। জানেন? তিনি তাদের সম্পর্কে আরও কী বলেছেন? তাদের স্থিতিশীলতা থাকতো, সুশাসন থাকতো, সমৃদ্ধি থাকতো এই পৃথিবীতেই। শুধু আখিরাতে নয়।


একজন ব্যক্তি হিসেবে কাউকে জীবনে কঠিন সময় পার করতে হতে পারে, ঈমানদার হলেও। তাই না? এই জীবনে আপনি শ্রেষ্ঠ ঈমানদার হতে পারেন এবং আপনার জীবন হতে পারে দারুণ কষ্টকর। এটা একেবারেই সত্য, এমনকি নবীদের ক্ষেত্রেও এটা ঘটেছিল। তাই না?


কিন্তু, জাতির জন্য আল্লাহর ফর্মুলা আলাদা। ব্যক্তির জন্য এক ধরণের নিয়ম আর জাতির জন্য কুরআনে যে নিয়ম রয়েছে তা ভিন্ন রকম। আল্লাহ্‌ বলেন- وَلَوْ أَنَّهُمْ أَقَامُوا التَّوْرَاةَ وَالْإِنجِيلَ وَمَا أُنزِلَ إِلَيْهِم مِّن رَّبِّهِمْ لَأَكَلُوا مِن فَوْقِهِمْ وَمِن تَحْتِ أَرْجُلِهِم - তারা যদি তাওরাত ইঞ্জিল আর তাদের প্রতিপালকের নিকট থেকে যা তাদের প্রতি অবতীর্ণ হয়েছে তার নিয়ম-বিধান প্রতিষ্ঠিত করত, তাহলে তাদের উপর থেকে আর তাদের পদতল থেকে আহার্য পেত। (5:66)


রিজিকের দরজা বন্যার বাঁধের ন্যায় খুলে দেওয়া হতো। আল্লাহর নিরাপত্তা এবং তাঁর রহমত তাদের প্লাবিত করে ফেলত। আল্লাহ্‌ কী বলছেন? তাদের দুর্দশায় পতিত হওয়ার কারণ ছিল তারা আল্লাহর বই পরিত্যাগ করেছিল। তাদের দুর্দশাটা কী ছিল? আল্লাহ্‌ ধাপে ধাপে তা সুরাতুল বাকারায় তুলে ধরেছেন। আমাদেরকে ভারসাম্যপূর্ণ জাতি বলার পূর্বে। তারা ভারসাম্য হারিয়ে ফেলেছিল।


প্রথমত, তারা নিজেদের মাঝে দ্বন্দ্ব সংঘাতে জড়িয়ে পড়েছিল। নিজেদের মধ্যে এতো বেশি সংঘাত হয় যে তারা দুর্বল এবং নগণ্য হয়ে পড়েছিল। আর যখন এভাবে তারা যথেষ্ট দুর্বল এবং নগণ্য হয়ে পড়লো, তারা শত্রুর সহজ শিকারে পরিণত হলো। আল্লাহ্‌ বলছেন এখন তোমাদের কারো কারো তোমাদের বন্ধীদের জন্য খারাপ লাগা শুরু করলো।


এটা আমাদের ইতিহাস নয়। এটা বনী ইসরাইলের ইতিহাস। যাদের সম্পর্কে আল্লাহ্‌ বলছেন তাদেরকে আল্লাহ্‌ একটি সম্মানিত উম্মায় পরিণত করেছিলেন এবং তাদেরকে অন্যদের উপর উচ্চ মর্যাদা দিয়েছিলেন। কিন্তু তারা এটা নষ্ট করে ফেলেছিল। তাদের সে মর্যাদা আর অবশিষ্ট নেই।


এখন, আল্লাহ্‌ সিদ্ধান্ত নিলেন তিনি পরীক্ষা...শুধু সম্মান প্রদান নয় আপনাকে এবং আমাকে, তিনি আমাদের পরীক্ষা করবেন সেই একই মর্যাদা দিয়ে।


কেন সূরার অর্ধেক অংশে তাদের ব্যর্থতার কথা আলোচনা করা হয়েছে এবং এরপর আমাদের উদ্দেশ্য করে বলা হয়েছে আমি তোমাদের একটি ভারসাম্যপূর্ণ জাতি হিসেবে সৃষ্টি করেছি? তার কারণ হলো, তাদের মত বিশৃঙ্খলা সৃষ্টি করো না। তোমাদের অবস্থা যেন তাদের মত না হয়।


কারণ, وَلَن تَجِدَ لِسُنَّةِ اللَّهِ تَبْدِيلًا - “আর তুমি আল্লাহর রীতিতে কখনই কোন পরিবর্তন পাবে না।” (33:62) আল্লাহর ফর্মুলা একই। আল্লাহ্‌ এই দুনিয়ায় একটি রীতি সৃষ্টি করেছেন। যখন মাটিতে কোনো বীজ বুনবেন এবং এর উপর পানি দিবেন, ভালো মাটি দিবেন, সূর্যের আলোর ব্যবস্থা করে দিবেন, তখন একটি চারা গাছের জন্ম নিবে। এটাই আল্লাহর সুন্নাহ। মাটি গাছের জন্ম দেয়নি। পানি গাছের জন্ম দেয়নি। সূর্য গাছের জন্ম দেয়নি। কিন্তু আপনি যদি এই প্রক্রিয়া অনুসরণ করেন তাহলে আল্লাহর সুন্নাহ হলো তিনি একটি গাছকে জন্ম নেয়ার অনুমতি দিবেন।


কিন্তু যদি পানি না দেন, যদি ভালো বীজ না বুনেন চারা গাছটির মৃত্যু হবে। এটাও আল্লাহর সুন্নাহ। আল্লাহ্‌ এভাবেই এই দুনিয়ায় হুকুম বাস্তবায়ন করে থাকেন। এটা হলো একটি গাছ বড় করার সুন্নাহ।


কিন্তু বিশ্বাসী একটি জাতির উত্থান, পতন, শক্তিমত্তা, দুর্বলতা কখন দেখা দিবে তার জন্যেও আল্লাহর একটি সুন্নাহ বর্তমান আছে। আমাদের পক্ষে এমনটি চিন্তা করা অসম্ভব যে, আমাদের ব্যাপারটা ব্যতিক্রম এবং আমাদের পূর্বের জাতির ক্ষেত্রে যা হয়েছিলো আমাদের ক্ষেত্রে তা হবে না। কারণ আমরা স্পেশাল। কারণ আমরা বিশেষ অনুগ্রহপ্রাপ্ত।


আমি আমার বক্তব্য দ্বারা এই মুহূর্তে যারা ভোগান্তির স্বীকার হচ্ছেন কোনোভাবেই তাদের কষ্টকে ছোট করে দেখছি না। এবং কোনোভাবেই তাদের দোষ দিচ্ছি না যে, আল্লাহ্‌ তাদের এই পরীক্ষায় ফেলেছেন কারণ তারা বনী ইসরাইলের মত হয়ে গেছেন। আমি যা বলতে চাচ্ছি তার উল্টো বুঝবেন না। আমরা একটি উম্মাহ হিসেবে, উম্মাহ হিসেবে আমাদের আচরণ, আমাদের চারিত্রিক বৈশিষ্ট্য, আমরা যেভাবে আচরণ করি, আমরা যেভাবে নিজেদের দেখি... যদি আয়নায় ভালো করে তাকান শুধু নিজের প্রতি নয়, একটি জাতি হিসেবে নিজেদের প্রতি, এবং আল্লাহ্‌ ইসরাইলীদের যে ব্যাপারগুলোর সমালোচনা করেছেন, তিনি তাদের কোন কোন ব্যাপারগুলোর সমালোচনা করেছেন যা তাদের থেকে পছন্দনীয় জাতির মর্যাদা দূরীভূত করে দিয়েছিল, তাদের কোন কোন কাজগুলোর তিনি নিন্দা করেছেন।


যদি সৎ দৃষ্টিতে তাকাই তাহলে আমার আপনার জন্য দুই জাতির মধ্যে একই সাদৃশ্য দেখতে না পাওয়া বড়ই কঠিন হবে। খুবই কঠিন হবে। মিল খুঁজে না পাওয়া বিশাল চ্যালেঞ্জের ব্যাপার হবে।


তাই, যখন তিনি বলেছেন- وَكَذَٰلِكَ جَعَلْنَاكُمْ أُمَّةً وَسَطًا - এরপর তিনি কী বলেছেন- لِّتَكُونُوا شُهَدَاءَ عَلَى النَّاسِ - যাতে তোমরা মানুষের উপর সাক্ষী হও।


ভারসাম্যপূর্ণ জাতির তো এমন হওয়ার কথা— তারা আল্লাহর বইয়ের সাথে অবজ্ঞাপূর্ণ আচরণ করে না, তারা ন্যায়পরায়ণতার গুণে গুণান্বিত, তারা ঐক্যবদ্ধ জাতি, তাদের একের জন্য অন্যের রয়েছে চিরন্তন ভালোবাসা।

- নোমান আলী খান

পঠিত : ২৯২ বার

মন্তব্য: ০