Alapon

┇আল-ওয়ালা ওয়াল-বারা┇আল্লাহর জন্যই বন্ধুত্ব স্থাপন এবং তাঁর জন্যই শত্রুতা পোষণ┇

┇আল-ওয়ালা ওয়াল-বারা┇আল্লাহর জন্যই বন্ধুত্ব স্থাপন এবং তাঁর জন্যই শত্রুতা পোষণ┇

সম্মানিত উপস্থিতি!
আজকে আমরা ইসলামের একটি মৌলিক আকিদা ‘আল ওয়ালা ওয়াল বারা’ নিয়ে সামান্য কিছু আলোচনা করব। ইন শা আল্লাহ্।

প্রিয় উপস্থিতি!
সৃষ্টির শুরু থেকেই মানুষের অনুভূতির দুটি দিক ছিলো। ভালোবাসা ও ঘৃণা। একটি বিষয়কে যদি মানুষ পছন্দ করে তবে এর বিপরীতধর্মী বিষয়টিকে অবশ্যই সে অপছন্দ করবে, ঘৃণা করবে। এটা মানুষের স্বভাবধর্ম। এটাই ফিতরাহ।

ভালবাসার দাবি কী?
আপনি যদি কাউকে ভালবাসেন তবে তার সাথে অন্তরঙ্গ সম্পর্ক গড়বেন, ভালোবাসবেন, বন্ধুত্ব হবে। আর যদি কাউকে ঘৃণা করেন, তবে তার সাথে আপনার শত্রুতা থাকবে।

এই যে বন্ধুত্ব ও শত্রুতা, ইসলামী শরিয়ায় এই বিষয়কেই ‘আল ওয়ালা ওয়াল বারা’ বলা হয়। এটা শরীয়তের পরিভাষা। ‘ওয়ালা’ শব্দের অর্থ হচ্ছে ‘বন্ধুত্ব’ এবং ‘বারা’ শব্দের অর্থ হলো ‘শত্রুতা’। ইসলামী আকীদার অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ, মৌলিক একটি দিক হচ্ছে এই আল ওয়ালা ওয়াল বারা। আল ওয়ালা ওয়াল বারার শুদ্ধি ছাড়া কারো তাওহীদ পরিশুদ্ধ হবে না।

এটা ঈমান ও কুফরের মাঝে দ্বন্দ্বের বিষয়। একে হালকা করে দেখার কোন সুযোগ নেই। এটাই দ্বীনের ভিত্তি, এটাই মিল্লাতে ইব্রাহিমের সারকথা।

সূরা মুমতাহিনার ৪ নম্বর আয়াতে, আল্লাহ তা'আলা আমাদের লক্ষ্য করে বলছেন:

قَدْ كَانَتْ لَكُمْ أُسْوَةٌ حَسَنَةٌ فِىٓ إِبْرَٰهِيمَ وَٱلَّذِينَ مَعَهُۥٓ إِذْ قَالُوا۟ لِقَوْمِهِمْ إِنَّا بُرَءَٰٓؤُا۟ مِنكُمْ وَمِمَّا تَعْبُدُونَ مِن دُونِ ٱللَّهِ كَفَرْنَا بِكُمْ وَبَدَا بَيْنَنَا وَبَيْنَكُمُ ٱلْعَدَٰوَةُ وَٱلْبَغْضَآءُ أَبَدًا حَتَّىٰ تُؤْمِنُوا۟ بِٱللَّهِ وَحْدَه ۞

“ইবরাহীম ও তাঁর সঙ্গী-সাথীদের মধ্যে তোমাদের জন্য আছে উত্তম আদর্শ। যখন তাঁরা তাঁদের সম্প্রদায়কে বলেছিল- ‘তোমাদের সঙ্গে আর আল্লাহকে বাদ দিয়ে তোমরা যাদের ‘ইবাদাত কর তাদের সঙ্গে আমাদের কোন সম্পর্ক নেই। আমরা তোমাদেরকে প্রত্যাখ্যান করছি। আমাদের আর তোমাদের মাঝে চিরকালের জন্য শত্রুতা ও বিদ্বেষ শুরু হয়ে গেছে যতক্ষণ তোমরা এক আল্লাহর প্রতি ঈমান না আনবে।”

ইব্রাহিম আলাইহিস সলাতু ওয়াস সালাম ও তাঁর সাথীদের আদর্শকে কেনো উত্তম বলা হয়েছে? কেন আমাদের জন্য অনুসরনীয় আদর্শ হিসেবে তুলে ধরা হয়েছে?

একটু চিন্তা করে দেখুন, ইব্রাহীম আলাইহিস সালাম কেবল এতোটুকু বলেননি যে, আমরা তোমাদের উপাস্যদের প্রত্যাখ্যান করলাম। আমরা এদের থেকে মুক্ত।
না! তিনি এতোটুকু বলেই ক্ষান্ত হলেন না বরং তিনি নিজ জাতির প্রতিও একই কথা ছুড়ে দিলেন, একই চ্যালেঞ্জ ছুড়ে দিলেন অর্থাৎ তিনি ভ্রান্ত মতবাদ এবং বাতিল মা'বুদের ইবাদত ও অনুসরণকে প্রত্যাখ্যান করলেন। আর যারা এগুলোর ইবাদত ও অনুসরণ করে- একইসাথে তাদেরকেও প্রত্যাখ্যান করলেন। তাদের সাথেও শত্রুতার ঘোষণা দিলেন, প্রত্যাখ্যানের চ্যালেঞ্জ ছুড়ে দিলেন।

আল্লাহর আয়াতের দিকে লক্ষ্য করুন। ইব্রাহিম আলাইহিস সালাম বলছেন :

’’…إِنَّا بُرَءَٰٓؤُا۟ مِنكُمْ وَمِمَّا تَعْبُدُونَ مِن دُونِ ٱللَّهِ…‘‘

‘‘...তোমাদের থেকে এবং আল্লাহর পরিবর্তে তোমরা যা কিছুর উপাসনা করো তা থেকে আমরা সম্পূর্ণরূপে মুক্তো...’’

এখানে ইবরাহীম আলাইহিস সলাতু ওয়াস সালাম ভ্রান্ত ধর্মের অণুসারীদের কথা আগে বলেছেন এবং তারপর মিথ্যা উপাস্যদের কথা বলেছেন।

একটা বাস্তব উদাহরন দেই, আপনার যদি কোন হিন্দু সহপাঠী থাকে তবে আপনি কিন্তু ওর মা'বুদদের প্রতি, মূর্তিগুলোর প্রতি সহজে ঘৃণা ও শত্রুতা পোষণ করতে পারেন এবং তাদের থেকে সম্পর্কচ্ছেদ করতে পারেন কিন্তু ঐ মুশরিক সহপাঠীর সাথে শত্রুতা ও সম্পর্কচ্ছেদ করতে পারেন না। এটা আপনার জন্য অত সহজ হয় না।

মূর্তিকে ত্যাগ করা সহজ। কিন্তু মূর্তি ওয়ালাদের ত্যাগ করা সহজ না।

তাওহীদের দাবি এটাই যে, মূর্তি, গণতন্ত্র, সমাজতন্ত্র, পুঁজিবাদ, সেকুলারিজম যত কুফর ও শিরকী মা'বুদ আছে, আদর্শ আছে সেগুলোকে ত্যাগ করো। সাথে সাথে এইসব বাতিল মতবাদ ও ধর্মের অণুসারী কাফির-মুশরিকদেরকেও ত্যাগ করো। ঘৃণা করো। তাদের বিরুদ্ধে শত্রুতা পোষণ করো।

ইবরাহিম আলাইহিস সলাতু ওয়াস সালাম তাঁর পুরো জাতির বিরুদ্ধে শত্রুতার ঘোষণা দিলেন। তিনি বললেন:

’’…وَبَدَا بَيْنَنَا وَبَيْنَكُمُ ٱلْعَدَٰوَةُ وَٱلْبَغْضَآءُ أَبَدًا حَتَّىٰ تُؤْمِنُوا۟ بِٱللَّهِ وَحْدَه...‘‘

‘‘...এবং তোমাদের সাথে আমাদের চিরকালের জন্য শত্রুতা ও বিদ্বেষের সূচনা হলো, যতক্ষণ না তোমরা এক আল্লাহর প্রতি ঈমান আনো...’’

কিসের ভিত্তিতে তিনি চীরশত্রুতার ঘোষণা দিলেন?
কিসের মাপকাঠিতে তিনি তাঁর জাতিকে পরিত্যাগ করলেন?
এক আল্লাহর প্রতি ঈমান না আনা পর্যন্ত তিনি শত্রুতা ও ঘৃণার কথা প্রকাশ্যে বলে দিলেন?
এই শত্রুতা কি দেশের জন্য?
এই শত্রুতা কি ক্রিকেট খেলার জন্য?
এই শত্রুতা কি রাজনৈতিক কোন্দলের জন্য?
এই শত্রুতা কি লাল-সবুজ, চাঁদ-তারার পতাকার জন্য?

ওয়াল্লহি! না। এই শত্রু ও ঘৃণা বিশ্ব প্রতিপালক আল্লাহর জন্য। কত মহান সেই শত্রুতা! কত পবিত্র সেই ঘৃণা! আল্লাহ আমাদের সবাইকেই তাঁর জন্য শত্রুতা ও ঘৃনা করার তাওফীক দিন।

আজ যদি কাফের মুশরিকের সাথে শত্রুতার কথা বলা হয় তবে একদল বলে ওঠে, আরে ইসলাম শান্তির ধর্ম এখানে কেন ঘৃণা, এগুলো উগ্রতা। আসলে এসব মানুষ বাস্তবতাকে অস্বীকার করে চলেছে। এদের দেখবেন পাকিস্তানিদের সাথে শত্রুতার জের ধরে একাত্তর নিয়ে এখনো জমি পূজায় ব্যস্ত। কিন্তু ২০০ বছর ধরে যারা উপমহাদেশ ধ্বংস করল, সেই ইংরেজদের, সেই সাদা চামড়াদের এখনো তারা ভালোবাসে। ফিরিঙ্গীদের অনুসরণীয় আদর্শ মনে করে। ক্রিকেট খেলার মাঝেও আপনারা এগুলো দেখতে পাবেন। তখন যে শত্রুতার ঘৃণা এরা প্রকাশ করে এর মানদন্ড কি? আর এই মানদণ্ডের শুদ্ধি বা দলিল কি?

ইসলাম আপনাকে শেখায় ব্যক্তিগত কারণে নয়, পতাকার জন্য নয়, জমির জন্য নয়, বরং শত্রুতা ও ভালোবাসা হবে শুধুমাত্র আল্লাহর জন্য। আল্লাহর রাসূলের জন্য। আল্লাহর দ্বীনের জন্য।

যারা আল্লাহর দ্বীনের শত্রু তারা আমাদেরও শত্রু।
যারা আল্লাহর রাসূলের শত্রু তারা আমাদেরও শত্রু।
যারা আল্লাহর শত্রু তারা আমাদেরও শত্রু।
নিঃসন্দেহে আল্লাহর কথাই শেষ কথা।

সূরা মাইদার ৫১ নম্বর আয়াতে আল্লাহ তাআলা বলছেন:

يَٰٓأَيُّهَا ٱلَّذِينَ ءَامَنُوا۟ لَا تَتَّخِذُوا۟ ٱلْيَهُودَ وَٱلنَّصَٰرَىٰٓ أَوْلِيَآءَۘ بَعْضُهُمْ أَوْلِيَآءُ بَعْضٍۚ وَمَن يَتَوَلَّهُم مِّنكُمْ فَإِنَّهُۥ مِنْهُمْۗ إِنَّ ٱللَّهَ لَا يَهْدِى ٱلْقَوْمَ ٱلظَّٰلِمِينَ ۞

‘‘হে মুমিনগণ! ইয়াহুদি ও নাসারাদেরকে তোমরা বন্ধুরূপে গ্রহণ করো না। তারা একে অপরের বন্ধু। আর তোমাদের মধ্যে যে তাদের সাথে বন্ধুত্ব করবে সে নিশ্চয়ই তাদেরই একজন। নিশ্চয়ই আল্লাহ জালেম কওমকে হেদায়েত দান করেন না।’’

এখানে আল্লাহ তাআলা কাফিরদের সাথে বন্ধুত্ব করাকে কুফুর সাব্যস্ত করেছেন। আল্লাহর কাছে এই ভয়াবহ কাজ থেকে পানাহ চাই।

সূরা তাওবার ২৩ নম্বর আয়াতে আল্লাহ তা'আলা আরও বলেছেন:

يَٰٓأَيُّهَا ٱلَّذِينَ ءَامَنُوا۟ لَا تَتَّخِذُوٓا۟ ءَابَآءَكُمْ وَإِخْوَٰنَكُمْ أَوْلِيَآءَ إِنِ ٱسْتَحَبُّوا۟ ٱلْكُفْرَ عَلَى ٱلْإِيمَٰنِۚ وَمَن يَتَوَلَّهُم مِّنكُمْ فَأُو۟لَٰٓئِكَ هُمُ ٱلظَّٰلِمُونَ ۞

‘‘হে ঈমানদারগণ! তোমরা নিজেদের পিতা ও ভাইদেরকে বন্ধুরূপে গ্রহন করো না। যদি তারা ঈমান অপেক্ষা কুফরকে প্রিয় মনে করে। তোমাদের মধ্য থেকে যারা তাদেরকে বন্ধুরূপে গ্রহণ করে তারাই জালেম।’’

আল্লাহু আকবার!
আল্লাহ এখানে নিজ রক্তের সম্পর্ককেও অর্থহীন করে দিলেন। আল্লাহকে ছাড়া আল ওয়ালা ওয়াল বারা হতে পারেনা।

সুরা ফাতহ্-এ এরশাদ হয়েছে:

مُّحَمَّدٌ رَّسُولُ اللَّهِ ۚ وَالَّذِينَ مَعَهُۥٓ أَشِدَّآءُ عَلَى الْكُفَّارِ رُحَمَآءُ بَيْنَهُمْ ۖ

‘‘মুহাম্মাদ আল্লাহর রাসূল এবং তাঁর সাথে যারা আছে তাঁরা কাফিরদের প্রতি অত্যন্ত কঠোর এবং পরস্পরের প্রতি সদয়।’’ (সূরা ফাতহ্–৪৮:২৯)

সূরা হুজরাতে এরশাদ হয়েছে:

إِنَّمَا الْمُؤْمِنُونَ إِخْوَةٌ

‘‘নিশ্চয়ই মুমিনরা পরস্পর ভাই ভাই।’’ (সূরা হুজুরাত–৪৯:১০)

আল্লাহ তাআলা সূরা মুজাদালাহ ২২ নম্বর আয়াতে বলেছেন:

لَّا تَجِدُ قَوْمًا يُؤْمِنُونَ بِٱللَّهِ وَٱلْيَوْمِ ٱلْءَاخِرِ يُوَآدُّونَ مَنْ حَآدَّ ٱللَّهَ وَرَسُولَهُۥ وَلَوْ كَانُوٓا۟ ءَابَآءَهُمْ أَوْ أَبْنَآءَهُمْ أَوْ إِخْوَٰنَهُمْ أَوْ عَشِيرَتَهُمْۚ أُو۟لَٰٓئِكَ كَتَبَ فِى قُلُوبِهِمُ ٱلْإِيمَٰنَ وَأَيَّدَهُم بِرُوحٍ مِّنْهُۖ وَيُدْخِلُهُمْ جَنَّٰتٍ تَجْرِى مِن تَحْتِهَا ٱلْأَنْهَٰرُ خَٰلِدِينَ فِيهَاۚ رَضِىَ ٱللَّهُ عَنْهُمْ وَرَضُوا۟ عَنْهُۚ أُو۟لَٰٓئِكَ حِزْبُ ٱللَّهِۚ أَلَآ إِنَّ حِزْبَ ٱللَّهِ هُمُ ٱلْمُفْلِحُونَ ۞

“আল্লাহ ও পরকালে বিশ্বাসী এমন কোন সম্প্রদায় তুমি পাবে না যারা আল্লাহ ও তাঁর রসূলের বিরোধিতাকারীদেরকে ভালবাসে- হোক না এই বিরোধীরা তাদের পিতা অথবা পুত্র অথবা তাদের ভাই অথবা তাদের জ্ঞাতি গোষ্ঠী। আল্লাহ এদের অন্তরে ঈমান বদ্ধমূল করে দিয়েছেন, আর নিজের পক্ষ থেকে রূহ দিয়ে তাদেরকে শক্তিশালী করেছেন। তাদেরকে তিনি দাখিল করবেন জান্নাতে যার তলদেশ দিয়ে বয়ে চলেছে নদী-নালা, তাতে তারা চিরকাল থাকবে। আল্লাহ তাদের প্রতি সন্তুষ্ট আর তারাও তাঁর প্রতি সন্তুষ্ট। এরাই আল্লাহর দল; জেনে রেখ, আল্লাহর দলই সাফল্যমন্ডিত।”

যারা আল্লাহর জন্য বন্ধুত্ব ও শত্রুতা করে এই আয়াতে তাঁদেরকে সম্মানিত করা হয়েছে। আল্লাহ তাদের নিজ দলের লোক বলে ঘোষণা দিয়েছেন। এর চেয়ে বড় সৌভাগ্য আর কি হতে পারে! আল্লাহ তাআলা আমাদের সকলকেই এর উপর আমল করার তাওফীক দান করুন। আমাদের প্রকৃত আল ওয়ালা ওয়াল বারা চর্চা করার তৌফিক দান করুন। আল ওয়ালা ওয়াল বারার নামে বাড়াবাড়ি-উগ্রতা এবং ছাড়াছাড়ি-ইরজা থেকে হেফাজত করুন। আমীন। ওয়ামা আ’লাইনা ইল্লাল বালাগ।

পঠিত : ৫৬৮ বার

মন্তব্য: ০