Alapon

গণতান্ত্রিক ভোট ও ইসলামি শুরা : বিশ্লেষণ ও বিধান

গণতান্ত্রিক ভোট ও ইসলামি শুরা : বিশ্লেষণ ও বিধান

(মুফতি তারেকুজ্জামা সাহেব)

ইসলাম ও গণতন্ত্র; দুটি দুই মেরুতে অবস্থিত। এ দুটি জীবনব্যবস্থার গুরুত্বপূর্ণ দুটি অনুষঙ্গ হলো, শুরা ও নির্বাচন। যার একটি ইমান ও হক এবং অপরটি কুফর ও বাতিল। শুরা হলো শরিয়া-প্রদত্ত বিধান ও পদ্ধতি। আর নির্বাচন হলো মানবরূপী শয়তানদের বিকৃত চিন্তা-চেতনা থেকে উদ্ভাবিত গণতন্ত্রের অন্যতম একটি অনুষঙ্গ।

সংজ্ঞা ও পরিচয় :
নির্বাচন হলো সিদ্ধান্ত গ্রহণের এমন একটি আনুষ্ঠানিক প্রক্রিয়া, যার মাধ্যমে জনগণ আইন প্রণয়ন ও প্রশাসনিক কাজের জন্য একজন প্রতিনিধিকে বেছে নেয়। ("Election (political science)" Encyclpoedia Britanica Online. Accessed August 18, 2009)
অর্থাৎ রাষ্ট্রের নাগরিকদের জীবন-যাপন পদ্ধতি প্রণয়ন, তাদের সমস্যাদিতে বিচারকরণ, তাদেরকে পরিচালনার উদ্দেশ্যে শাসক নির্ধারণের ক্ষেত্রে জনগণ কর্তৃক প্রদত্ত সিদ্ধান্ত প্রদানের একটি আনুষ্ঠানিক প্রক্রিয়া। প্রকৃত অর্থে নির্বাচন হলো, জনগণ নিজেদের জন্যে বিধানদাতা, জীবনব্যবস্থা প্রণেতা ও আনুগত্য করার জন্য কোনো উপাস্যকে বাছাই করার প্রক্রিয়া।

নির্বাচনের সূচনা :
নির্বাচন সম্পর্কে Encyclopedia man, myth's magic- এ বলা হয়েছে :
Election, the word derived from the Greek word eloge (choice).The idea is basic to the traditional structure of Christian theology.
অর্থাৎ নির্বাচন শব্দটি উৎসরিত হয়েছে গ্রীক শব্দ Eloge হতে, যার অর্থ হলো পছন্দ। নির্বাচনের ধারণা প্রাচীন খ্রিষ্টীয় ধর্মতত্ত্বের ঐতিহ্যগত কাঠামোর ওপর প্রতিষ্ঠিত।

প্রাচীন কালে নির্বাচন :
প্রাচীন কাল থেকেই গ্রিস ও রোমে নির্বাচন পদ্ধতি ব্যবহার হয়ে আসছে এবং গোটা মধ্যযুগে রোমান সম্রাট ও পোপের মতো ধর্মীয় নেতা বাছাই করতেও নির্বাচন পদ্ধতি গ্রহণ করা হতো। ("Election (political science)," Encyclpoedia Britanica Online. Accessed August 18, 2009)
প্রাচীন ভারতে নির্বাচনের মাধ্যমে প্রজারা তাদের রাজা নিযুক্ত করত। বাংলার মধ্যযুগের গোড়ার দিকে পাল রাজাদের মধ্যে গোপালকে রাজা নিযুক্ত করতে নির্বাচন পদ্ধতি গ্রহণ করা হয়েছিল। (History of Buddhism in India, Translation: A. Shiefner.)

আধুনিক কালে নির্বাচন :
সপ্তদশ শতাব্দির দিকে উত্তর আমেরিকা এবং ইউরোপে গণতান্ত্রিক সরকার গঠনের চিন্তাধারা শুরু হয়। উত্তর আমেরিকা ও ইউরোপের সংস্কৃতিতে প্রভাবশালী গোষ্ঠী ছিল পুরুষরাই। নির্বাচকমণ্ডলীতেও তাই এদেরই প্রাধান্য থাকত। অন্যান্য বহু দেশেও একই ধারা চলে আসছিল। গ্রেট ব্রিটেন ও মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের মতো দেশগুলোতেও শুরুর দিকের নির্বাচনে জমিদার অথবা শাসক শ্রেণির পুরুষদের প্রাধান্য ছিল। ১৯২০ সাল পর্যন্ত অবশ্য পশ্চিম ইউরোপের সমস্ত দেশে এবং উত্তর আমেরিকার গণতন্ত্রে শুধু পুরুষদেরই ভোটাধিকার চালু ছিল। এর পর থেকেই বিভিন্ন দেশ মহিলাদের ভোটাধিকার দেওয়ার বিষয়ে চিন্তাভাবনা শুরু হয়।
১৮৩২ সালে প্রথম সংস্কার আইনে সমস্ত মধ্যবিত্ত শ্রেণিকে ভোটাধিকার দেয়। এরপর পর্যায়ক্রমে ১৮৬৭ সালে কারখানার শ্রমিকদের, ১৮৮৪ সালে কৃষি মজুরদের, ১৯১৮ সালে সীমিত সংখ্যক নারীদের, এবং ১৯২৮ সালে সকল নারীদের ভোটাধিকার দেওয়া হয়।
এ ব্যবস্থায় দীর্ঘকাল পর্যন্ত দরিদ্র মানুষ, দিনমজুর ও নারীদেরকে ভোটাধিকার দেওয়া হয়নি। অথচ বর্তমানে একজনের নির্বাচন অধিকার না থাকা তাদের দৃষ্টিতেও নিন্দনীয়! এভাবে মানব মস্তিষ্ক থেকে নির্গত এসব ফয়সালা নিজেরাই একসময় বদলাতে বাধ্য হচ্ছে। সুতরাং বলার অপেক্ষা রাখে না যে, মানবরচিত কায়দা-কানুন অপূর্ণাঙ্গতার কারণে দুদিন পরেই পাল্টায়। তাই এটা কখনো প্রকৃত জীবনব্যবস্থা হতে পারে না।

গণতন্ত্র খ্রিষ্টানদের বানানো একটি তন্ত্র :
গণতন্ত্র যে খ্রিষ্টানদের বানানো একটি জীবনব্যবস্থা, এ বিষয়ে কোনো সন্দেহের অবকাশ নেই। "Encyclopedia Man, Myth's magic" গ্রন্থে এ ব্যাপারে উল্লেখ আছে:
’’However that the doctrine of election found its most notable expression in Christianity.’’
অর্থাৎ যাই হোক, নির্বাচনের এ মতবাদটির উল্লেখযোগ্য অভিব্যক্তি খ্রিস্টানদের (বিকৃত) ধর্মতত্ত্বের মাঝে পাওয়া যায়।

নির্বাচন ও শুরা ব্যবস্থা কি এক?
এটা স্বীকৃত ও সন্দেহাতীত যে, ইসলাম ও গণতন্ত্র দুটি ভিন্ন জীবনব্যবস্থা, দুটি আলাদা দ্বীন। তেমনি ইসলামের শুরা ও গণতন্ত্রের নির্বাচন পদ্ধতি দুটিও ভিন্ন। অনেকেই মনে করেন, শুরা হলো একজন মুসলিমের মতামত। অতএব যদি কোনো মুসলিম ভোট দেয় তাহলে ভোটের মাধ্যমে তার নির্বাচনে অংশগ্রহণও শুরার অনুরূপ। কিন্তু মূলত ব্যাপারটি তা নয়। বোঝার স্বার্থে আমরা একটি উদাহরণ পেশ করতে পারি। মনে করুন, কারও টেবিলের ওপর কভারযুক্ত দুটি বই আছে। এখন প্রথম বইটি খুলে দেখা গেলো, তা রাসুল কারিম সা. -এর ওপর অবতীর্ণ পবিত্র ‘কুরআন’। দ্বিতীয় বইটি খুলে দেখা গেল, তা কালমার্ক্সের রচিত ‘দ্যা ক্যাপিটাল’। এখন প্রশ্ন হচ্ছে, দুটি বই-ই কাগজের, দুটি বই-ই কোনো না কোনো কালিতে লেখা। কিন্তু দুটি কি এক? নাউযুবিল্লাহ! যে উভয়টিকে এক বলবে, তার ইমান নিশ্চয়ই প্রশ্নবিদ্ধ হয়ে পড়বে। হয় সে ইসলাম ও কুফরের পার্থক্য সম্পর্কে অজ্ঞ অথবা সে দ্বীন নিয়ে ঠাট্টাকারী।
আবার অনেকেই গণতন্ত্রের মাধ্যমে ইসলাম প্রতিষ্ঠা করার কথা বলেন। তারা মূলত একটি ইসলামি দলকে ভোটদানের জন্য জনগণকে উদ্বুদ্ধ করে এবং ভোটের মাধ্যমে ক্ষমতায় গিয়ে ইসলাম প্রতিষ্ঠার কথা বলেন। এবার আমরা আগের মতো আরেকটি বাস্তব উদাহরণ দেখি। রাসুলে কারিম সা. -এর ওপর কুরআন অবতীর্ণ হয়েছে ইসলামকে অন্যান্য বাতিল ধর্মের ওপর বিজয়ী করার উদ্দেশ্যে। কুরআনের মাঝে দ্বীনকে বিজয়ী করার নির্দেশনা দেওয়া আছে।
এখন আমরা উপরিউক্ত উদাহরণের মতোই আরেকটি প্রশ্ন করতে পারি যে, কালমার্ক্স রচিত ‘দ্যা ক্যাপিটাল’ দিয়ে কি ইসলামকে প্রতিষ্ঠিত করা সম্ভব? অবশ্যই না। তাহলে অহেতুক কেন আমরা নিজেরা গোমরাহ হচ্ছি এবং অন্যদেরকে গোমরাহ করছি?

ভোট কি শুরা?
বর্তমানে কোনো কোনো ব্যক্তি এ ভোট পদ্ধতিকে ইসলামি বলে শুরা ব্যবস্থার প্রতিরূপ বলেন। তারা সাধারণ মুসলমানদেরকে এ আয়াত শুনান :
إِنَّ اللَّهَ يَأْمُرُكُمْ أَن تُؤَدُّوا الْأَمَانَاتِ إِلَىٰ أَهْلِهَا
অর্থাৎ নিশ্চয়ই আল্লাহ তোমাদেরকে নির্দেশ দেন যে, তোমরা যেনো প্রাপ্য আমানতসমূহ প্রাপকদের নিকট পৌঁছে দাও। (সুরা নিসা : ৫৮)
সুতরাং ভোট যেহেতু শরয়ি পরামর্শ তাই এটিও একটি আমানত! তাই তা প্রাপককে ফিরিয়ে দিতে হবে!!
আসুন, দেখা যাক, ভোট কি শরয়ি পরামর্শ নাকি ভিন্ন কিছু?

ভোট ও শুরার মধ্যকার মৌলিক কিছু পার্থক্য:
প্রথমত, ইসলামে শুরা হলো একটি মত ও পরামর্শ,যাকে গ্রহণ ও বর্জন উভয়টি করা যায়। এটাকেই চূড়ান্ত সিদ্ধান্তরূপে গ্রহণ করা জরুরি নয়। এমনকি খলিফা ভালো ও কল্যাণকর মনে করলে অধিকাংশের মতামতের বিপরীত সিদ্ধান্ত নিতে পারেন। কিন্তু ভোটের ক্ষেত্রে অধিকাংশের রায়কে প্রত্যাখ্যান করা যায় না।
দ্বিতীয়ত, ইসলামে পরামর্শদাতাদের বিশেষ যোগ্যতাসম্পন্ন হতে হয়। পক্ষান্তরে গণতন্ত্রে প্রত্যেকেরই ভোট দেওয়ার অধিকার সমান। এমনকি গণতন্ত্রে একজন দেশসেরা বিজ্ঞ লোকের মতামত ও দেশের সবচেয়ে নিকৃষ্ট ও অশিক্ষিত লোকের মতামতের মূল্যায়ন বরাবর।
তৃতীয়ত, শরিয়তের দৃষ্টিতে কাফিররা মুসলিমদের কোনো বিষয়ে পরামর্শ দিতে পারে না। কিন্তু গণতন্ত্র তাদেরকে এ সুযোগ করে দেয়। তাদেরকে বাদ দেওয়ার কোনো সুযোগ নেই। তাদেরকে বাদ দেওয়ার আইন করলে সেটা আর গণতন্ত্র থাকবে না। আর গণতন্ত্রের প্রভু ও পূজারীরা তা কোনোদিন হতেও দেবে না।

ভোটকে শুরা বলে নির্বাচনে অংশগ্রহণকারী মুসলিমদের অবস্থা :
প্রতিপক্ষের উপর বিজয়ী হবার সবচেয়ে সহজ কৌশল হলো, Divide & Rule. গভীর দৃষ্টিতে দেখলে দেখা যায়, এ দেশের অল্পকিছু মানুষই ইসলামপন্থী। অতঃপর বহুদলীয় গণতন্ত্রের ফর্মুলায় এই অল্প সংখ্যক ভোট ভাগ হবে এত এত ইসলামি দলের মাঝে। একদল থেকে কোনো মুফতি বা মুহাদ্দিস দাঁড়াবে, অপরদলে দাড়িবিহীন জেনারেল শিক্ষিত তরুণ দাঁড়াবে। অতঃপর সমর্থকদের মাঝে শুরু হবে নোংরা কাঁদা ছোড়াছুড়ি, গিবত, অপবাদ ও পরনিন্দার বৃষ্টিধারা। দূর থেকে সেক্যুলার-বামপন্থীরা মজা লুটবে। আসলে গণতন্ত্র আর নির্বাচন এই উম্মাহর মাঝে বিভেদ ও অনৈক্যের বিষফোঁড়া রোপণ করে দিয়েছে, যার ফল আমরা আজ দেখতে পাচ্ছি। আমাদের দেশে বর্তমানে ইসলামি রাজনীতিক দলের সংখ্যা প্রায় বিশের অধিক, যারা প্রত্যেকেই নিজেদেরকে ভোট পাওয়ার হকদার বলে দাবি করছে।

নির্বাচনের মুলো ঝুলিয়ে মুসলিমদের ইমান ও শাসন চুরি :
বাংলাদেশের নির্বাচনে আন্তর্জাতিক প্রভাব একটি ওপেন সিক্রেট। প্রতিটা ইলেকশনের পূর্বে বিভিন্ন নেতা-নেত্রীদের ভারত আর ওয়াশিংটনমুখী দৌড়াদৌড়ি আবশ্যক। কারণ, দিল্লী-ওয়াশিংটন থেকেই নির্ধারন করা হয়ে থাকে, আগামী পাঁচ বছর কারা এদেশে তাদের দালাল হিসেবে কাজ করবে।
রাজনৈতিক দলগুলোর তখন এক্ষেত্রে কিছুই করার থাকে না। আর গণতন্ত্রের তথাকথিত ‘সর্বশক্তির উৎস’ জনগণের তো এক্ষেত্রে নীরব দর্শকের ভূমিকা পালন করা ছাড়া আর কিছুই করার থাকে না। এমনকি দুএকটি ফাঁকা বুলিও তারা উচ্চারণ করতে পারে না।
পরিশেষে, মুসলিম জনগণের সামনে মুলো ঝুলিয়ে সর্বপ্রথম তাদের অনেকের ইমান কেড়ে নেওয়া হয়। অতঃপর গণতান্ত্রিকদের প্রভু আমেরিকা ও ভারত তাদেরই একজন দালালকে সরকারপ্রধান করে বসিয়ে দেয়। ব্যস, এখন গণতন্ত্রে বিশ্বাসী মডারেট মুসলিম না ঘরকা আর ঘাটকা। না তারা আল্লাহর হতে পারে আর না গণতান্ত্রিক প্রভুদের আস্থাভাজন হতে পারে।

রাসুল সা. -এর দাওয়াত বনাম গণতন্ত্রবাদীদের দাওয়াত :
আল্লাহর রাসুল সা. ‘লা ইলাহা ইল্লাল্লাহ’-এর মূলনীতি মানুষের অন্তরে দৃঢ়ভাবে প্রোথিত করে দিয়েছিলেন। তাদেরকে পরিষ্কারভাবে বুঝিয়ে দিয়েছিলেন যে, আল্লাহ যা দেন সেটাই আইন। এটা বিনা প্রশ্নে মেনে নেওয়াটা ইমান আর না মানাটা হলো কুফরি। তাদেরকে দ্ব্যর্থহীনভাবে বুঝিয়ে দেওয়া হয়েছিল যে, তোমাদের কাজ হলো মেনে যাওয়া। যাচাই-বাছাইয়ের কোনো অধিকার তোমাদের নেই। আল্লাহ তাআলা বলেন :
وَمَا كَانَ لِمُؤْمِنٍ وَلَا مُؤْمِنَةٍ إِذَا قَضَى اللَّهُ وَرَسُولُهُ أَمْرًا أَن يَكُونَ لَهُمُ الْخِيَرَةُ مِنْ أَمْرِهِمْ وَمَن يَعْصِ اللَّهَ وَرَسُولَهُ فَقَدْ ضَلَّ ضَلَالًا مُّبِينًا.
অথাৎ আল্লাহ ও তাঁর রাসুল কোনো কাজের আদেশ করলে কোনো ইমানদার পুরুষ ও ইমানদার নারীর সে বিষয়ে ভিন্ন কোনো ক্ষমতা নেই। আর যে ব্যক্তি আল্লাহ ও তাঁর রাসুলের অবাধ্য হবে সে প্রকাশ্য পথভ্রষ্টতায় পতিত হয়। (সুরা আহজাব : ৩৬)
অন্যদিকে আজকের গণতন্ত্রবাদীরা মানুষের দ্বারে দ্বারে ঘুরছে। তাদেরকে দাওয়াত দিচ্ছে যে, তোমাদের যাচাই-বাছাই করার সুযোগ আছে। হে জনগণ, তোমরাই সব। তোমরা চাইলে শাহবাগীদের ভোট দিয়ে সমকামিতা বৈধ করতে পারো, আবার চাইলে ইসলামপন্থীদের ভোট দিয়ে মদ নিষিদ্ধ করতে পারো। তোমরা যেটা চাইবে সেটাই হবে। দয়া করে ভোটটা আমাদের দাও।

ইসলামের দৃষ্টিতে নির্বাচন :
শাইখ আবু কাতাদা ফিলিস্তিনি হাফিজাহুল্লাহ বলেন, নির্বাচন হচ্ছে একটি মাধ্যম। কিন্তু তা কীসের মাধ্যম? কী হতে উৎসারিত এই মাধ্যম?
এ সম্পর্কে যা জানা যায় তা হলো, নির্বাচন হলো গণতান্ত্রিক ব্যবস্থার একটি অন্যতম শাখা, যা জনগণকে সিয়াদাহ তথা সার্বভৌম, কর্তৃত্ব, হুকুম, নিয়ন্ত্রণ, প্রভুত্ব, আধিপত্য ও বিধান নির্ধারণের অধিকার দান করে থাকে। শাসনতন্ত্র বিজ্ঞান এবং রাষ্ট্রবিজ্ঞান থেকে জানা যায় যে, সিয়াদাহ হচ্ছে সর্বোচ্চ ও পরিপূর্ণ কর্তৃত্ব, যার ওপর আর কোনো কর্তৃত্ব নেই। তারা বলে, সিয়াদাহ হচ্ছে মানুষের জন্য, সিয়াদাহ জনগণের জন্য। অথচ সিয়াদাহ সম্পূর্ণ আল্লাহ তায়ালার হক। এই সিয়াদাহ হতে উৎসারিত হয় আইন প্রণয়নের অধিকার, আইন প্রণয়নের কর্তৃত্ব, বিচারের কর্তৃত্ব, অতঃপর কার্যে পরিণত করার কর্তৃত্ব। আর তারা বলে, এগুলো মানুষের ইচ্ছার ওপর ভিত্তি করে হতে হবে। মানুষ যা চায় এবং সমর্থন করে তা-ই হবে।
গণতন্ত্র দুটি বুনিয়াদের ওপর প্রতিষ্ঠিত। সংখ্যাগরিষ্ঠ এবং সংখ্যালঘুর ওপর ভিত্তি এবং সংখ্যালঘুর অধিকার লড়াই এবং বিতর্কের মাধ্যমে সংখ্যাগরিষ্ঠে পৌঁছানো। সংখ্যাগরিষ্ঠের অধিকার হচ্ছে শাসন করা, আইন প্রণয়ন করা, আইন কার্যকর করা এবং সিদ্ধান্তগুলো পরিচালনা করা। এটিই হচ্ছে গণতন্ত্রের ভিত্তি। তাই আমরা স্পষ্ট দেখতে পাচ্ছি যে, নির্বাচন ‘সিয়াদাহ’-এর অর্থকেই বোঝায়।
সে ক্ষেত্রে নির্বাচন হচ্ছে মানুষের ইচ্ছার প্রতিফলন। কীভাবে মানুষের ইচ্ছা জানা যাবে? এ প্রশ্নের জবাবে তারা বলে, নির্বাচন এবং ভোটদানের মাধ্যমে।
সুতরাং ভোটদান হচ্ছে মানুষের ইচ্ছার কথা জানানোর একটি মাধ্যম, যেখানে তাদের নিজেদের অধিকার থাকবে আইন প্রণয়নের। যে সংসদীয় ব্যবস্থায় বর্তমানে আমরা আছি, এই সংসদ এমন একটি কেন্দ্র, যেখান থেকে অনেক কিছুর সিদ্ধান্ত গ্রহণ করা হয়। এর মধ্যে সর্বপ্রথম হচ্ছে আইন প্রণয়ন। অন্য কথায় বলতে গেলে, আইন প্রণয়নের অর্থ কোনো কিছুকে হালাল মোড়ক দেওয়া অথবা কোনো কিছুর নিষেধাজ্ঞা উঠিয়ে নেওয়া। আইন প্রণয়নের মানে কোনো কিছুকে হালাল ঘোষণা করা এবং তার হারাম হওয়ার নিষেধাজ্ঞা উঠিয়ে নেওয়া অথবা কোনো কিছুকে হারাম ঘোষণা করা এবং তার অনুমতি ছিনিয়ে নেওয়া।
অথচ এই বিষয়টি সম্পূর্ণ আল্লাহ সুবহানাহু ওয়া তাআলার অধিকার। তাদের এই নীতি আল্লাহর উলুহিয়াত ও প্রভুত্বের সাথে সাংঘর্ষিক। যেহেতু সৃষ্টি আল্লাহ তায়ালার, সেহেতু উলুহিয়্যাত ও সার্বভৌমত্বও একমাত্র তাঁরই। এটিই হচ্ছে তাঁর কর্তৃত্ব (রুবুবিয়্যাত)। আর যিনি ইলাহ, তিনিই হুকুম দেন। তাই আমরা যদি তর্ক করি, স্বতন্ত্রভাবে একজনের হুকুম দেওয়ার অধিকার আছে বলেই বর্ণনা করি তবে নির্বাচনের অর্থ হবে ‘সাইয়িদ’ নির্ধারণ করা।
কোনো মুসলিমের এ ব্যাপারে নূন্যতম সংশয় থাকার অবকাশ নেই যে, আল্লাহ সুবহানাহু ওয়া তায়ালা হলেন, আস-সাইয়্যিদ এবং আল-মুতা। আস-সাইয়্যিদ হলো, যার কোনো হুকুমকে অবহেলা করা যায় না। আর আল-মুতা হলো, যার আদেশ কেউ অমান্য করতে পারে না।
তাহলে নির্বাচন কী? নির্বাচনের অর্থ হচ্ছে- কোনো কিছুকে হালাল এবং হারাম ঘোষণার ক্ষেত্রে আইন প্রণয়নের জন্য আমার ইচ্ছার প্রতিফলনে একজন ব্যক্তিকে প্রতিনিধি হিসেবে পাঠিয়ে তার ওপর সন্তুষ্ট থাকা। আর এটা সুস্পষ্ট যে, তা ‘লা ইলাহা ইল্লাল্লাহ’ এর সাথে সাংঘর্ষিক এবং সেই মুসলিমের ইচ্ছার সাথেও সাংঘর্ষিক যে বলে, আমি নিজেকে আল্লাহর আনুগত্যে উপস্থাপন করছি। অন্য কথায়, আইন প্রণয়নের ব্যাপারে আমি অন্য কাউকে গ্রহণ করি না, আমি আল্লাহ সুবহানাহু ওয়া তাআলা ব্যতীত অন্য কাউকে আইনদাতা হিসেবে গ্রহণ করি না, আমি আমার ওপর কোনো শাসককে গ্রহণ করি না। এ অর্থে শাসক বলতে সে নয়, যে শাসন করে; বরং আল্লাহ ব্যতীত যে হুকুম প্রণয়নের অধিকার রাখে। সমসাময়িক অনেকেই এটাকে হাকিমিয়্যা হিসেবে সঠিক বলে আখ্যায়িত করে থাকেন । (ভোটাভুটি সম্পর্কে একটি সাক্ষাৎকারে শায়খের প্রদত্ত বক্তব্যের একাংশ।)
শাইখের কথার সারনির্যাস হচ্ছে- যে গুণটি একমাত্র আল্লাহর জন্যে নির্দিষ্ট, নির্বাচনের মাধ্যমে জনগণ সেটিকে কোনো মানুষের জন্যে সাব্যস্ত করছে। এক কথায়, নির্বাচনের মাধ্যমে তারা আল্লাহর পরিবর্তে ভিন্ন সত্ত্বাকে ইলাহ হিসেবে গ্রহণ করছে। সুতরাং এটা শিরক বৈ অন্য কিছু নয়।

সকল ভোট প্রদানকারীই কি কাফির?
এক্ষেত্রে ভোটারদেরকে তিনটি ভাগে ভাগ করা যায়।
প্রথমত, যে সমস্ত ভোটার সত্যিকার অর্থেই গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠা করতে চায় এবং সংখ্যাগরিষ্ঠতার রায়কেই আইন বলে বিশ্বাস করে; যদিও তা শরিয়ার বিরুদ্ধে যাক, এরা প্রকৃত অর্থেই কাফের; যদিও তাদের নাম মুসলমানের।
দ্বিতীয়ত, যারা গণতন্ত্র ও ইসলাম; এসব বিষয়ে অজ্ঞতার কারণে ভোট প্রদান করে, তাদের জাহালাত শরিয়তের দৃষ্টিতে ওজরযোগ্য হলে এরা কাফির নয়।
তৃতীয়ত, যারা বিভিন্ন ধরনের ভুল মাসআলা বা ভুল প্রচারণার শিকার হয়ে ভোটদান করে, তাদের ক্ষেত্রে কিছুটা তাবিলের অজুহাত থাকায় এরাও কাফির নয়।

খলিফা নির্ধারণ পদ্ধতি :
নির্বাচন একটি শিরকি ব্যবস্থার অংশ এবং এটা স্বয়ং শিরকের একটি মাধ্যম। তাহলে খলিফা নির্ধারণের পথ কী? খলিফা নির্ধারণের সর্বসম্মত তিনটি পদ্ধতি রয়েছে। ইসলামি রাষ্ট্রের রাষ্ট্রপ্রধান বা খলিফা তিনটি পদ্ধতির কোনো একটির মাধ্যমে নির্ধারণ করা যেতে পারে।
ক. ইখতিয়ার :
ইখতিয়ার হলো, ‘আহলুল হাল্লি ওয়াল আকদ’ এর পক্ষ থেকে মনোনীত বা নির্বাচিত হওয়া। উদাহরণত, আবু বকর রা. -এর খিলাফত। তাঁর খিলাফত সাকিফায়ে বনি সায়িদায় ‘আহলুল হাল্লি ওয়াল আকদ’ এর মনোনয়ন ও নির্বাচনের মাধ্যমে প্রতিষ্ঠিত হয়েছিল। এরপর সমস্ত সাহাবি তাঁর খিলাফতের পক্ষে ঐকমত্য পোষণ করেন, তাঁর হাতে বাইআত হন এবং তাঁর খিলাফতের প্রতি সন্তুষ্টি প্রকাশ করেন।
খ. ইস্তিখলাফ :
পূর্ববর্তী খলিফার নির্ধারণের মাধ্যমে খিলাফত প্রতিষ্ঠিত হওয়া। অর্থাৎ পূর্ববর্তী খলিফা সুনির্দিষ্টভাবে কাউকে তাঁর পরবর্তী খলিফা হিসেবে প্রতিশ্রুতি দেওয়া। যেমন, উমর রা. -এর খিলাফত। তাঁর খিলাফত আবু বকর রা.- এর নির্ধারণের মাধ্যমে সাব্যস্ত হয়েছিল।
গ. শুরা :
শুরা দ্বারা উদ্দেশ্য হলো, পূর্ববর্তী খলিফা কর্তৃক ‘আহলুল হাল্লি ওয়াল আকদ’-কে দায়িত্ব দেওয়া। তাদের দায়িত্ব হবে, তাদের মধ্য থেকে কোনো একজনকে পরবর্তী খলিফা নির্ধারণ করা। যেমন, উসমান বিন আফফান রা.- এর খিলাফত। উমার রা. তাঁর পরবর্তী খলিফা নির্ধারণ করার জন্য শীর্ষস্থানীয় ছয়জন সাহাবির সমন্বয়ে একটি শুরা কমিটি গঠন করেছিলেন। তাঁদের মধ্য থেকে আব্দুর রহমান বিন আওফ রা. মুহাজির ও আনসার সাহাবিদের সাথে পরামর্শ করলেন। যখন দেখলেন যে, বিজ্ঞ সাহাবি ও তাবিয়িরা উসমান রা.-কে খলিফা হিসাবে চাচ্ছেন, তখন তিনিই প্রথম তাঁর হাতে বাইআত হন। এরপর ছয়জনের অবশিষ্ট সাহাবিগণও তাঁর হাতে বাইআত গ্রহণ করেন। এরপর মুহাজির ও আনসার সাহাবাসহ অন্য লোকেরা তাঁর হাতে বাইআত গ্রহণ করে। (আল বিদায়া ওয়ান নিহায়া : ৭/১৪৫-১৪৭, প্রকাশনী : দারুল ফিকর, বৈরূত)

এ তিনটি শরয়ি পদ্ধতিই খিলাফাহ আলা মিনহাজিন নুবুওয়াহ বাস্তবায়িত হওয়ার পদ্ধতি। এছাড়াও আরেকটি পদ্ধতি আছে, যার মাধ্যমে খিলাফায় অধিষ্ঠিত হওয়া যায়। তবে তা শরীয়া কর্তৃক অনুমোদিত নয়। সেটি হলো, তাগাল্লুব তথা শক্তি ও আধিপত্য বিস্তারের মাধ্যমে। কেউ এ রকম পদ্ধতিতে খিলাফায় অধিষ্ঠিত হয়ে গেলে তাকেও খলিফা বলে গণ্য করা হবে। যদিও সেটি খিলাফাহ আলা মিনহাজিন নুবুওয়াহ হবে না।
ইমাম নববি রহ. বলেন:
وَأَمَّا الطَّرِيقُ الثَّالِثُ، فَهُوَ الْقَهْرُ وَالِاسْتِيلَاءُ، فَإِذَا مَاتَ الْإِمَامُ، فَتَصَدَّى لِلْإِمَامَةِ مَنْ جَمَعَ شَرَائِطَهَا مِنْ غَيْرِ اسْتِخْلَافٍ وَلَا بَيْعَةٍ، وَقَهَرَ النَّاسَ بِشَوْكَتِهِ وَجُنُودِهِ، انْعَقَدَتْ خِلَافَتُهُ لِيَنْتَظِمَ شَمْلُ الْمُسْلِمِينَ، فَإِنْ لَمْ يَكُنْ جَامِعًا لِلشَّرَائِطِ بِأَنْ كَانَ فَاسِقًا، أَوْ جَاهِلًا، فَوَجْهَانِ، أَصَحُّهُمَا: انْعِقَادُهَا لِمَا ذَكَرْنَاهُ، وَإِنْ كَانَ عَاصِيًا بِفِعْلِهِ.
অর্থাৎ তৃতীয় একটি পদ্ধতি হলো শক্তি ও আধিপত্য বিস্তারের মাধ্যমে খলিফা হওয়া। সুতরাং খলিফা মারা যাওয়ার পর যদি খেলাফতের উপযুক্ত কেউ নিয়োগপ্রাপ্তি ও বাইআত গ্রহণ ছাড়াই ক্ষমতা ও সৈন্যবলে খেলাফতের দাবি করে এবং মানুষকে তা মেনে নিতে বাধ্য করে, তাহলে এতে তার খেলাফত প্রতিষ্ঠিত হয়ে যাবে; যাতে করে মুসলমানদের শৃঙ্খলা ও ঐক্য বহাল থাকে। তবে সে যদি খেলাফতের উপযুক্ত না হয়ে থাকে; যেমন সে ফাসেক বা মূর্খ তাহলে সে খলিফা হবে কিনা এ ব্যাপারে দুটি মত রয়েছে। বিশুদ্ধতম মতানুযায়ী সে খলিফা বলে বিবেচিত হবে পূর্বোক্ত কারণেই। যদিও সে এর কারণে গোনাহগার হবে। (রওজাতুত তালিবিন : ১০/৪৬, প্রকাশনী : আল মাকতাবুল ইসলামি, বৈরুত)

গণতান্ত্রিক নির্বাচনে ভোটার ও আহলুল হাল্লি ওয়াল আকদ :
গণতন্ত্রে ভোটাধিকারপ্রাপ্ত সকল লোকদের ভোটের মান সমান। সামান্য একজন ব্যক্তি ও বড় বড় জ্ঞানী-বিজ্ঞানীদের ভোটের মান একই। সমাজের একজন নিরক্ষর ও সর্বশেষ্ঠ জ্ঞানীর ভোটের একই মূল্য। এদের ভোট বা মতামতের মাঝে কোনো পার্থক্য নেই। অথচ ইসলামে শুরা ব্যবস্থার যোগ্য ‘আহলুল হাল্লি ওয়াল আকদ’ এর নির্দিষ্ট সংজ্ঞা ও বৈশিষ্ট্য আছে।

‘আহলুল হাল্লি ওয়াল আকদ’ কারা?
ইমাম ইবনে নুজাইম মিসরি রহ. বলেন :
أَهْل الْحَلِّ وَالْعَقْدِ مِنْ الْعُلَمَاءِ الْمُجْتَهِدِينَ وَالرُّؤَسَاءِ.
আহলুল হাল্লি ওয়াল আকদ হলেন, মুজতাহিদ (বিশেষজ্ঞ) উলামায়ে কিরাম ও নেতৃত্বস্থানীয় ব্যক্তিবর্গ। (বাহরুর রায়েক : ৬/২৯৯, প্রকাশনী : দারুল কিতাবিল ইসলামি, বৈরুত))
ইমাম নববী রহ.বলেন :
أَهْل الْحَلِّ وَالْعَقْدِ مِنْ الْعُلَمَاءِ وَالرُّؤَسَاءِ وَوُجُوْهِ النَّاسِ.
অর্থাৎ ‘আহলুল হাল্লি ওয়াল আকদ’ হলেন উলামা, নেতৃত্বস্থানীয় ও দায়িত্বশীল ব্যক্তিবর্গ। (মিনহাজুন তালিবিন : পৃ. ২৯২, প্রকাশনী : দারুল ফিকর, বৈরুত)

‘আহলুল হাল্লি ওয়াল আকদ’ এর বৈশিষ্ট্যাবলী :
‘আহলুল হাল্লি ওয়াল আকদ’ হওয়ার জন্য তিনটি শর্ত থাকা আবশ্যক।
১. ন্যায়পরায়ণতা : ফুকাহায়ে কেরাম ন্যায়পরায়ণতার যে সকল শর্ত বর্ণনা করেছেন, সেগুলো তার মাঝে বিদ্যমান থাকা। যেমন, প্রকাশ্য সব ধরনের কবিরা গোনাহ ও হারাম, মাকরুহে তাহরিমি ইত্যাদি থেকে বেঁচে থাকতে হবে।
২. খলিফা হওয়ার শর্তগুলো জানা থাকা : উক্ত ব্যক্তির এতটুকু ইলম থাকা আবশ্যক, যার ভিত্তিতে তিনি বুঝতে পারবেন যে, খিলাফতের শর্তগুলোর ওপর ভিত্তি করে কে খলিফা হওয়ার যোগ্য আর কে অযোগ্য।
৩. রায় ও হিকমত : প্রজ্ঞা ও সিদ্ধান্ত প্রদানের যোগ্যতা থাকা, যার মাধ্যমে উক্ত ব্যক্তি এমন একজন খলিফা নির্ধারণে সক্ষম হবেন, যিনি এ ইমামতের অধিক উপযুক্ত এবং উম্মাহর কল্যাণে অধিক উপযুক্ত ও জ্ঞাত হবেন।
‘আহলুল হাল্লি ওয়াল আকদ’ এর বৈশিষ্ট্য বর্ণনায় আল্লামা মাওয়ারদি রহ. বলেন :
فَأَمَّا أَهْلُ الِاخْتِيَارِ فَالشُّرُوطُ الْمُعْتَبَرَةُ فِيهِمْ ثَلَاثَةٌ: أَحَدُهَا: الْعَدَالَةُ الْجَامِعَةُ لِشُرُوطِهَا وَالثَّانِي: الْعِلْمُ الَّذِي يُتَوَصَّلُ بِهِ إلَى مَعْرِفَةِ مَنْ يَسْتَحِقُّ الْإِمَامَةَ عَلَى الشُّرُوطِ الْمُعْتَبَرَةِ فِيهَا.وَالثَّالِثُ: الرَّأْيُ وَالْحِكْمَةُ الْمُؤَدِّيَانِ إلَى اخْتِيَارِ مَنْ هُوَ لِلْإِمَامَةِ أَصْلَحُ، وَبِتَدْبِيرِ الْمَصَالِحِ أَقْوَمُ وَأَعْرَفُ
অর্থাৎ আহলুল হাল্লি ওয়াল আকদের যোগ্য হওয়ার জন্য তিনটি শর্ত রয়েছে। প্রথমত, পূর্ণ ন্যায়পরায়ণতা। দ্বিতীয়ত, এতটুকু ইলম থাকা আবশ্যক, যদ্বারা তিনি বুঝতে পারবেন, খিলাফতের শর্তগুলোর ভিত্তিতে কে খলিফা হওয়ার যোগ্য। তৃতীয়ত, সিদ্ধান্ত প্রদানের যোগ্যতা ও প্রজ্ঞা থাকা, যার মাধ্যমে অবগত হওয়া যায়, কে খলিফা হওয়ার উপযোগী এবং উম্মাহর কল্যাণ বিষয়ে অধিক উপযুক্ত ও সজাগ। (আল-আহকামুস সুলতানিয়্যা : পৃ. নং ১৭-১৭, প্রকাশনী : দারুল হাদিস, কায়রো)

গণতন্ত্রে ভোটাধিকার বা নির্বাচন অধিকার প্রাপ্তদের মাঝে কোনোরূপ পার্থক্য করা হয় না। সকলেরই মান এখানে সমান। যেখানে মানুষ সামান্য টাকার লোভে পড়ে কিংবা প্রভাবশালী কোনো নেতার ভয়ে অধিকাংশ সময়ই একজন বখাটে, সন্ত্রাসী বা অযোগ্য কাউকে নিজেদের নেতা বানায়। অন্যদিকে ইসলামে অধিক যোগ্য আলিম ও আমিরদের সম্মতিতে একজন যোগ্য ও উত্তম খলিফা নির্বাচিত হন। দুটোর মাঝে যে বিশাল তফাৎ তা জ্ঞানবান লোক মাত্রই বুঝতে সক্ষম হবেন। যারা বলে থাকে, নির্বাচন ও শুরা একই, তারা যেন শুরাসদস্য হওয়ার যোগ্য ‘আহলুল হাল্লি ওয়াল আকদ’ এর পরিচয় ও বৈশিষ্ট্যাবলী এবং ভোটাধিকারপ্রাপ্ত একজন নাগরিকের মাঝে তুলনা করে দেখেন। এ বিশাল তফাৎ থাকার পরও নিছক গোঁড়া ও অন্ধ হলেই কেবল সে বলতে পারে, নির্বাচন ও শুরা একই বিষয়।

আমাদের আলিমগণ; এমনকি সাধারণ মানুষেরাও এখন অকপটে এ কথা বলে বেড়ায় যে, ইহুদি-খ্রিষ্টানরা ইসলামের বিরুদ্ধে নীলনকশা করে এগুচ্ছে। তারা একশ বছর আগে একটি পরিকল্পনা করে। এরপর ধীরে ধীরে তা বাস্তবায়নের পথে এগিয়ে নিয়ে যায়। মুসলমানরা ইহুদি-খ্রিষ্টানদের ষড়যন্ত্র করার কথা বিশ্বাস করলেও তাদের অধিকাংশই আজ ইহুদি ও খ্রিষ্টানদের প্রণীত সে নীলনকশায় পা দিয়েছে। বরং তাকেই আঁকড়ে ধরে নিজেদের জীবন পার করতে চাইছে। এমনকি একে নেক ও পূণ্যের কাজ বলেও দাবি করছে। অনেকে ষড়যন্ত্র বলতে শুধু সাংস্কৃতিক ও চারিত্রিক অঙ্গনের বিপর্যয়ই বুঝে থাকে। অথচ আমল নষ্ট করার চাইতে আমাদের আকিদা ও ইমান নষ্ট করাই তাদের মূল ও প্রধান টার্গেট। আমরা তাদের দ্বিতীয় ষড়যন্ত্র সম্পর্কে অবগত হলেও আসল ও প্রধান ষড়যন্ত্রের ব্যাপারে অজ্ঞ রয়ে গেছি। আল্লাহ তাআলা যেন আমাদের ইমান-আকিদা রক্ষা করুন এবং তাগুতদের সব ধরনের ষড়যন্ত্র অনুধাবন করার তাওফিক দান করেন।

পঠিত : ৮৯৮ বার

মন্তব্য: ০