Alapon

দ্বান্দ্বিক প্রান্তিকতায় তারুণ্যে




আমার চোখে সমকালীন মুসলিম তারুণ্যের ঐতিহ্যবাদী অংশে মোটাদাগে দুইটি ক্ষেত্রে দ্বান্দ্বিক প্রান্তিকতার সাক্ষাৎ মেলে। সংগত মনে করলে এ বিষয়ে একাডেমিক আলাপ তুলবেন স্কলারগণ। আমি দুই টাকার কবি; পূর্বসুরীদের দুইটি কবিতা সামনে রেখে ভাসা ভাসা কিছু কথা বলে যাই সাহস করে। ভুল কিছু বললে শুধরে দেওয়ার জন্যে প্রাজ্ঞজনেরা তো আছেনই।
১.
উম্মাহর সঙ্গীন অবস্থায় একদল তরুণ মনে করেন, মুখের কথা আর কলমের লেখা দিয়ে, এক কথায় বুদ্ধিবৃত্তিক সক্রিয়তার মাধ্যমে পুনর্জাগরণে অবদান রাখা চাই। এই সচেতন দৃষ্টিভঙ্গি প্রশংসার্হ ও অপরিহার্য।
তাঁদের অনেককে দেখা যায় সমরশক্তির প্রসঙ্গ পুরোপুরি এড়িয়ে যান অথবা বিব্রতবোধ করেন; প্রতিরোধকামীদের প্রশ্নে তাঁরা অ্যাপোলোজেটিক হয়ে থাকতে স্বস্তিবোধ করেন। এই হীনম্মন্যতা পরিত্যাজ্য ও পরিত্যক্ত।
ইতিহাসে এমন একটি সভ্যতাও নেই, যারা বাহুবল ও সমরশক্তি ছাড়া নিজেদের অস্তিত্ব রক্ষা করতে পেরেছে। পৃথিবীতে যারা অহিংসার ফাঁকা বুলি ও শান্তির মৃগতৃষ্ণিকা ছড়িয়ে মুসলিম উম্মাহকে প্রত্যক্ষ-পরোক্ষভাবে শক্তিচর্চায় নিরুৎসাহিত করছে, খেয়াল করলে দেখা যায়, তাদের সকলেই পূর্ণ রণসজ্জায় সজ্জিত, সমরশক্তিতে সমৃদ্ধ, উত্তরোত্তর শক্তি বৃদ্ধিতে তৎপর ও ঐকান্তিক। নিজেদের পথের কাঁটা সাফ করার জন্যেই তারা আমাদের নপুংসক হবার সবক দেয় - এই সত্যটা ধরতে পারা জরুরি।
এদিকে রণসজ্জায় উৎসাহী অনেক তরুণ মনে করে, বুদ্ধিবৃত্তিক ক্রিয়া-প্রতিক্রিয়া পুরোপুরি অর্থহীন। এমন অপরিণামদর্শী মানসিকতাও একেবারে শিশুসুলভ ও আত্মঘাতী। উভয় প্রান্তিকতা থেকে বেরিয়ে আসা প্রয়োজন।
উহুদের যুদ্ধের দৃশ্যটা স্মরণ করি। মুসলিম বাহিনি সম্মুখ সমরে যুদ্ধ করছে। আবার যেসব মুশরিক কবি যুদ্ধের মাঝে মুসলিমদের লক্ষ করে বিদ্রুপাত্মক কবিতা গেয়ে যাচ্ছে, তাদের বিপরীতে হাসসান বিন সাবিত ও অন্যান্য কবি সাহাবিরা প্রতিকবিতা রচনা করে যাচ্ছেন। যোদ্ধাদের কাছে হাসসানদের কাজ অর্থহীন ছিল না, হাসসানরাও যোদ্ধাদের কাজকে ছোট করে দেখেননি। তাঁরা জানতেন, তাঁরা উভয়ে পরস্পরের পরিপূরক। নবিজি ﷺ সমরজয়ী খালিদ বিন ওয়ালিদ-কে ‘সাইফুল্লাহ’ উপাধিতে সম্মানিত করেছেন, আবার অনলবর্ষী বাগ্মী কবি হাসসান বিন সাবিত-এর সম্মানে মসজিদে নববিতে স্বতন্ত্র মিম্বর বানিয়ে দিয়েছেন। খালিদের তরবারির ঝলক, হাসসানের কবিতার ফলক - দুয়ে মিলেই রচিত কালজয়ী সভ্যতার চলক। এটা ভালোভাবে উপলব্ধি করেছিলেন কাজী নজরুল ইসলাম। বোধ করি সেজন্যই তিনি বলেছিলেন, ‘সুর আমার সুন্দরের জন্য, তরবারি সুন্দর-বিদ্বেষী অসুরের জন্য।’
সাইয়িদুনা হাসসান বিন সাবিত (রা) একটা কবিতায় বলছেন:
لنا في كل يوم من معد * سباب أو قتال أو هجاء
فنُحكم بالقوافي من هجانا * ونضرب حين تختلط الدماء
(কুরাইশদের কাছ থেকে গালি আসে প্রতিদিন
খুনাখুনি কিবা কুৎসা রটানো প্রতিদিন চলছেই।
বিদ্রুপ এলে শক্ত জবাব দেই কবিতায়
রক্ত ঝরলে তরবারি দিয়ে পাল্টা আঘাত দেই।)
বাহুবল ও বুদ্ধিবলের এই অন্বয় ও প্রেক্ষিতোপযগী প্রয়োগের সমন্বয়ই সভ্যতার প্রাণশক্তি।
কবিতা ও প্রতিকবিতা রচনা ছিল সে সময়কার সবচেয়ে বড় বুদ্ধিবৃত্তি। আজকের দুনিয়ায় বৌদ্ধিক চ্যালেঞ্জ আরও ব্যাপক ও বিস্তৃত। সঙ্গীন অবস্থা থেকে ঘুরে দাঁড়ানোর স্বপ্ন দেখে যেসব তরুণ, তাদের জন্যে নেহায়েত জরুরি - এই চ্যালেঞ্জগুলো বোঝা এবং তা মোকাবিলার সক্ষমতা বৃদ্ধিতে নিজের আন্তরিক অংশগ্রহণ নিশ্চিত করতে সচেষ্টা হওয়া।
২.
বুদ্ধিবৃত্তিক ক্রিয়াশীলতায় আগ্রহী ও উৎসাহী তরুণদের একটি অংশকে দেখা যায় আনুষ্ঠানিক ইবাদতগুলোতে অমনোযোগী ও উদাসী। কখনো কখনো এই ঔদাসীন্য অবহেলার দিকে গড়ায়। আত্মশুদ্ধির চর্চা ও হৃদয়ের পরিশীলনে তাঁরা নিরুৎসাহী। সুন্নাত ও নফল পালনকে গুরুত্বহীন মনে করছে, এমনকি কেউ কেউ ফরয সালাত পর্যন্ত হেলায় পার করে দিচ্ছে - দেশে-বিদেশে নানা পর্যায়ের পুনর্জাগরণবাদী মুসলিম তারুণ্যের সাথে মিশে এই দৃশ্যটা আমি কাছ থেকে দেখেছি। তাঁদেরকে In the Early Hours বা এ ধরনের অন্য কোনো বই নিয়মিত পড়ার পরামর্শ দিই। একইভাবে, আত্মশুদ্ধির প্রতি অধিক জোর প্রদান করতে গিয়ে কেউ কেউ চিন্তা-প্রতিচিন্তার চর্চাকে একেবারেই গুরুত্ব দিতে চান না। এমনকি অনেকে তো জ্ঞান-বিজ্ঞানকে রূহানিয়তের প্রতিবন্ধক হিসেবে ধরে নিয়েছেন। এই প্রান্তিক দৃষ্টিভঙ্গিগুলো আজকের নয়, বহু আগে থেকেই এর সূচনা। তার প্রমাণ পাওয়া যায় ইমাম শাফিঈর জবানিতে:
فقيهاً وصوفياً فكن ليسَ واحداً
فَإني وَحَقِّ اللَّهِ إيَّاكَ أَنْصَحُ
فذلك قاسٍ، لم يذق قلبه تقى
وهذا جهولٌ، كيف ذو الجهل يصلحُ؟
(আল্লাহর রাহে তোমাকে একটা উপদেশ দিয়ে যাই
‘শুধু সুফী’* কিবা ‘শুধু জ্ঞানী’ হতে চেয়ো না কখনো ভাই
পাষাণ-কঠিন হৃদয় তাদের, ‘শুধু জ্ঞানী’ হয় যারা
হৃদয়ে তাকওয়া আস্বাদনের সুখটি পায় না তারা
‘শুধু সুফী’ জ্ঞান থেকে দূরে রয়, অজ্ঞ-মূর্খ থাকে
মূর্খ কীভাবে সংশোধনের গুরুভার কাঁধে রাখে?)

[* কাঠামোবদ্ধ বা শাস্ত্রাকারে তাসাউফকে বোঝানো হয়নি। সে সময় আত্মশুদ্ধি-সচেতন ও পরহেযগারিতা অবলম্বনে সচেষ্ট ব্যক্তিদের সাধারণভাবে ‘সূফী’ বলে সম্বোধনের প্রচলন ছিল।]

ইমাম দেখেছিলেন, তাঁর সময়ে কিছু লোক তাযকিয়ার চর্চা করতে গিয়ে জ্ঞানচর্চাকে হেলা করছেন। আবার ফিকহ চর্চায় রত বিদ্বৎসমাজ তাসাউফচর্চাকারীদের ত্রুটি-বিচ্যুতি দেখে আত্মশুদ্ধির প্রয়োজনীয়তাকেই একেবারে অস্বীকার করে বসলেন। এই বাড়াবাড়ির ফলে দুইদল মুসলিমের দেখা মিললো: (১) অজ্ঞ সুফী, যাঁরা কুরআন-সুন্নাহর বিধি-বিধান নিয়ে ওয়াকিফ না থাকায় বাড়াবাড়ি ও সীমালঙ্ঘন করতে দ্বিধাবোধ করছেন না; (২) দেখা মিললো একদল ফকিহ ও বিদ্বানের, যাঁরা ঈমান-আমলের পরিশুদ্ধির ব্যাপারে আলাদা জোর দেওয়াকে গুরুত্বহীন আখ্যা দিয়ে ধীরে ধীরে ছোট-বড় পাপকে গা-সওয়া করে ফেলছেন, মাঝেমধ্যে তাতে আকণ্ঠ নিমজ্জিত হচ্ছেন অকুণ্ঠচিত্তে [এই ‘অকুণ্ঠচিত্ততা’ই বিশেষ কনসার্ন-এর বিষয়, সাধারণভাবে ‘পাপে আপতিত হওয়া’টা নয়; কারণ, হাদিসই বলে দেয়, পাপ ছাড়া কোনো মানুষ নেই]। এ পরিস্থিতিতে ইমাম তাঁর কবিতায় প্রস্তাব করেন, তাযকিয়া-তাসাউফ ও ইলমের চর্চা - দুটোকে পরস্পরের বিপরীতে দাঁড় না করিয়ে একটি সমন্বিত অ্যাপ্রোচ নেওয়া গেলে উভয়দিকের সংকট একইসাথে হ্রাস পেতে পারে। তাঁর পর্যবেক্ষণের সত্যতা আমাদের সমকালেও অক্ষুণ্ন রয়েছে, আত্মজিজ্ঞাসু দৃষ্টিতে নিজেদের দিকে চোখ বুলালেই আমরা তা ধরতে পারবো; সুতরাং, তাঁর প্রস্তাবনাকেও সমান প্রাসঙ্গিক মনে করা আমাদের জন্যে মঙ্গলজনক।
আমার বিবেচনায় অধুনা তরুণদের মধ্যে দ্বিতীয় শ্রেণিটির অস্তিত্ব অধিক দৃশ্যমান। অথবা আমার দৃষ্টিসীমার মধ্যে এই শ্রেণিকে বেশি দেখা যায়। অর্থাৎ, জ্ঞানানুশীলন ও চিন্তাচর্চায় যতটা সিরিয়াস, অন্তরের পরিশীলনে ততটা নয়। আমি নিজেও এর অন্তর্ভূক্ত। এই আত্মঘাতী প্রবণতাকে আসুন আর প্রশ্রয় না দেই। জ্ঞানচর্চার পাশাপাশি আনুষ্ঠানিক ও অনানুষ্ঠানিক সকল ইবাদতের প্রতি যত্নবান হই। ফরয আদায়ের ব্যাপারে নিজের ওপর কড়াকড়ি আরোপ করি, সুন্নাতকে গুরুত্বের সাথে নিই, যথাসম্ভব নফল আদায়ের ব্যাপারে নিজেকে উৎসাহিত করি।
শাফিঈর কবিতার এসেন্স বুঝতে পারলে প্রয়াত ড. সাঈদ রামাদান (বিগত শতাব্দীর একজন খ্যাতিমান চিন্তক)-এর আপাতসরল কথাটিকে আপনার কাছে আর হালকা বলে মনে হবে না:
“Our problem is one of spirituality. If a man comes to speak to me about the reforms to be undertaken in the Muslim world, about political strategies and of great geostrategic plans, my first question to him would be whether he performed the dawn prayer in its time.”
“আমাদের সমস্যা রূহানিয়তে। যদি কোনো লোক আমার কাছে আসে, মুসলিম বিশ্বের সংস্কার কার্যক্রম কিংবা রাজনৈতিক কৌশল ও বৃহত্তর ভূ-রাজনৈতিক পরিকল্পনার বিষয়ে কথা বলতে চায়, (আমি কথা বলতে রাজি, তবে) আলাপের শুরুতে তাঁর প্রতি আমার প্রথম প্রশ্ন থাকবে, আজকে তিনি যথা সময়ে ফজর পড়েছেন কি-না।”
সচেতন মুসলিম তারুণ্যের প্রতি আরজ, আমার কথাগুলো বাদ দিয়ে এই লেখায় উদ্ধৃত চারজন মণীষাকে আপনাদের আলাপে-আড্ডায় তুলে ধরবেন, মত-দ্বিমত সহকারে এখান থেকে কোনো ভাবনার খোরাক তুলে আনা যায় কি-না চেষ্টা করবেন।


-কবি আব্দুল্লাহ মাহমুদ নজীব

পঠিত : ৪৬৭ বার

মন্তব্য: ০