Alapon

কবি ফররুখ আহমদের জীবন ও সাহিত্য কর্ম...



আধুনিক বাংলা সাহিত্যের শ্রেষ্ঠ কবি ও শিশু সাহিত্যিক ফররুখ আহমদ ১৯১৮ সালের ১০ জুন মাগুরার শ্রীপুর উপজেলার মাঝাইল গ্রামে জন্মগ্রহণ করেন। তাঁর পিতা সৈয়দ হাতেম আলী ছিলেন পুলিশ ইন্সপেক্টর।

ফররুখ আহমদ প্রথমে কলকাতার আই জি প্রিজন অফিস এবং সিভিল সাপ্লাই অফিসে কয়েক বছর চাকরি করেন। ১৯৪৫ সাল থেকে তিনি মাসিক মোহাম্মদী পত্রিকা সম্পাদনা করেন এবং ভারত বিভাগের পর ঢাকায় এসে রেডিও পাকিস্তানের ঢাকা কেন্দ্রে স্টাফ আর্টিস্ট হিসেবে যোগ দেন। এখানে তিনি ছোটদের খেলাঘর অনুষ্ঠানটি পরিচালনা করতেন।
ফররুখ আহমদ ছাত্রাবস্থায় এম.এন রায়ের র‌্যাডিক্যাল মানবতাবাদের প্রতি আকৃষ্ট হয়ে বামপন্থী রাজনীতিতে সম্পৃক্ত হলেও বিভাগোত্তরকালে তিনি পাকিস্তানী আদর্শ ও মুসলিম রেনেসাঁর সমর্থক হন। পাকিস্তানের রাষ্ট্রীয় কাঠামো ও আদর্শের প্রতি অবিচল থাকলেও ১৯৫২ সালের ভাষা আন্দোলনের প্রতি তাঁর অকুণ্ঠ সমর্থন ছিল। তিনি তখন ধর্মীয় কুসংস্কার ও পাকিস্তানের অপরিনামদর্শী রাজনীতিবিদদের বিরুদ্ধে কঠোর হাতে লেখনী পরিচালনা করেন। ১৯৭১ সালে বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধের প্রতিও তাঁর অনুরূপ সমর্থন ছিল।

কিশোর বয়স থেকেই তিনি কাব্য-চর্চা শুরু করেন। ১৯৪৪ সনে ২৬ বছর বয়সে তাঁর প্রথম কাব্যগ্রন্থ ‘সাত সাগরের মাঝি’ প্রকাশিত হয়। তখন থেকেই বিভিন্ন পত্র-পত্রিকায় তাঁর লেখা প্রকাশিত হতে থাকে এমনকি কলকাতা রেডিওতে তাঁর ওপর আলোচনা সম্প্রসারিত হয়। স্বল্পকালের মধ্যেই তিনি একজন অসাধারণ প্রতিভাবান কবি হিসেবে স্বীকৃতি লাভ করেন। ১৯৪৩ সালে বাংলাদেশের ভয়াবহ দুর্ভিক্ষের মর্মন্তুদ দৃশ্য নিয়ে তিনি অসংখ্য কবিতা রচনা করেন। ঐ সময়ে লেখা তাঁর প্রায় ১৯টি কবিতায় দুর্ভিক্ষের চিত্র ফুটে ওঠেছে। ১৯৪৪ সালে কবি সুকান্ত ভট্টাচার্য ‘আকাল’ নামে যে সংকলন গ্রন্থ প্রকাশ করেন, তাতে ফররুখ আহমদের ‘লাশ’ কবিতাটি স্থান পায়। বাংলা সাহিত্যের শ্রেষ্ঠ কবিতাগুলোর মধ্যে ‘লাশ’ কবিতাটি অন্যতম।

চল্লিশের দশকে ইংরেজ বিরোধী স্বাধীনতা আন্দোলনের সপক্ষে গণজাগরণমূলক কবিতা লিখে ফররুখ আহমদ বিশেষ খ্যাতি অর্জন করেন। তিনি ছিলেন মুসলিম পুনর্জাগরণে বিশ্বাসী এজন্য তাকে মুসলিম রেনেসাঁর কবি হিসেবে আখ্যায়িত করা যায়।

‘সাত সাগরের মাঝি’ ফররুখ আহমদের প্রথম এবং সর্বাধিক উল্লেখযোগ্য কাব্যগ্রন্থ। মূলত: এ গ্রন্থে ফররুখ আহমদের স্বাধীনতা-প্রীতি ও মানবতাবোধের সুস্পষ্ট বিকাশ ঘটেছে।
ফররুখ আহমদ ভাষা আন্দোলনে সক্রিয় অংশ গ্রহণ করেন। ১৯৫২ সালের একুশে ফেব্রুয়ারির রক্তাক্ত ঘটনার পর তৎকালীন পূর্ব পাকিস্তানের জনগণের সাথে কাঁধে কাঁধ মিলিয়ে ফররুখ আহমদ আন্দোলনে ঝাঁপিয়ে পড়েন। তিনি রেডিও পাকিস্তান কর্মরত অবস্থায় শিল্পী-আলতাফ মাহমুদ, আব্দুল আহাদ, আব্দুল হালিম চৌধুরীর সঙ্গে শিল্পী-ধর্মঘটে যোগ দেন। তিনি তদানীন্তন পাকিস্তানী শাসকদের ব্যঙ্গ করে ‘রাজ-রাজরা’ নামে একটি নাটক লেখেন যা ঢাকা বিশ্ববদ্যালয়ে অভিনীত হয়। প্রখ্যাত নাট্যকার মুনীর চৌধুরী তাতে অভিনয় করেন। পরবর্তীতে বেনজীর আহমদ ও আবু জাফর শামসুদ্দীন সম্পাদিত ‘নয়াসড়ক’ সংকলনে প্রকাশিত হয়। গীতি কবিতা, মহাকাব্য, সনেট, গল্প, উপন্যাস, নাটক, সঙ্গীত, প্রবন্ধ, বেতার কথিকা, গীতি-নকশা প্রভৃতি সৃষ্টিশীল রচনায় তিনি নৈপূণ্য প্রদর্শন করেন। কবিতা রচনায় তিনি অধিক স্বাচ্ছন্দ্যবোধ করেছেন।
ফররুখের প্রকাশিত কাব্যগ্রন্থের সংখ্যা ১৫।

যথাঃ
১। সাত সাগরের মাঝি (১৯৪৪)
২। আজাদ কর পাকিস্তান (১৯৪৬)
৩। সিরাজম মুনীরা (১৯৫২)
৪। নৌফেল ও হাতেম (১৯৬১)
৫। মুহূর্তের কবিতা (১৯৬৩)
৬। হাতেম তা’য়ী (১৯৬৬)
৭। হে বন্য স্বপ্নেরা (১৯৭৬)
৮। ইকবালের নির্বাচিত কবিতা (১৯৮০)
৯। কাফেলা (১৯৮০)
১০। হাবেদা মরুর কাহিনী (১৯৮১)
১১। তসবির নামা (১৯৮৬)
১২। দিলরুবা (১৯৯৪)
১৩। ঐতিহাসিক অনৈতিকহাসিক কাব্য (১৯৯৪)
১৪। অনুস্বার
১৫। ধোলাই কাব্য।

বাংলা সাহিত্যে মাইকেল মধুসূদনের পর অত্যন্ত সফল মহাকাব্য ফররুখ আহমদের ‘হাতেম তা’য়ী। কাব্য নাটক রচনার ক্ষেত্রে মুসিলম কবিদের মধ্যে তিনিই পথিকৃৎ। তার ‘নৌফেল ও হাতেম’ একটি সফল কাব্য নাটক। এটি সত্যেন্দ্রনাথ দত্তের ‘আয়ূস্মতীর’ চেয়ে অনেক উন্নতমানের রচনা। সনেট রচনায় ফররুখ আহমদ সবচেয়ে বেশি সাফল্য অর্জন করেছেন। সম্ভবত, বাংলা সাহিত্যে মাইকেলের পর সংখ্যায় এত বেশি সনেট হিন্দু-মুসলিম নির্বিশেষে আজ পর্যন্ত আর কেউ রচনা করতে পারেননি। ফররুখের পূর্ণাঙ্গ সনেট গ্রন্থের মধ্যে ‘মুহূর্তের কবিতা’, ‘দিলরুবা’, ও ‘অনুস্বার’ প্রধান। মুহূর্তের কবিতায় ৯৪টি, দিলরুবায় ৪৯টি, অনুস্বারে ৮৫টি, সিরাজম মুনিরায় ১০টি, সাত সাগরের মাঝিতে ৭টি, আজাদ করো পাকিস্তানে ১টি এবং হাতেমতা’য়ীতে বেশ কিছু সনেট রয়েছে। তার সমগ্র রচনা প্রকাশিত হলে হয়ত সমগ্র সনেট সংখ্যার হিসাব পাওয়া যাবে। ‘রাত্রি’ নামে একটি সনেট রচনার মধ্যদিয়ে ফররুখ আহমদের কাব্য জীবনের সূত্রপাত হয়েছিল এবং ‘১৯৭৪-এ একটি আলেখ্য’ এই সনেটটি রচনার মধ্যদিয়ে তার পরিসমাপ্তি ঘটেছিল।

ব্যঙ্গ কবিতা রচনার ক্ষেত্রে ফররুখ বেশ আলোড়ন সৃষ্টি করেন। প্রায় পনেরটি ছদ্মনামে এসব ব্যঙ্গ কবিতা রচিত হয়েছে। স্বনামেও তিনি প্রচুর ব্যঙ্গ কবিতা লিখেছেন। তাঁর ব্যঙ্গ কবিতা গ্রন্থের মধ্যে ১। অনুস্বার (ব্যঙ্গ সনেট), ২। ঐতিহাসিক অনৈতিহাসিক কাব্য ৩। তসবির নামা ৪। ধোলাই কাব্য প্রভৃতি প্রধান।

‘হাবেদা মরুর কাহিনী’ ফররুখের গদ্য কবিতা গ্রন্থ। গদ্য কবিতা রচনায়ও তিনি যে সিদ্ধহস্ত ছিলেন এটা তার স্বাক্ষর বহন করে।

ফররুখ আহমদ শিশু-কিশোরদের জন্য প্রচুর ছড়া ও কবিতা রচনা করেন। এসব ছড়া কবিতা অত্যন্ত জনপ্রিয়। তাঁর শিশুছড়া গ্রন্থের সংখ্যা ১৫। এর মধ্যে অল্পসংখ্যক ছড়া গ্রন্থ কেবল প্রকাশিত হয়েছে। প্রকাশিত শিশুকিশোর রচনা গ্রন্থের নাম :

১.পাখীর বাসা (১৯৬৫)
২.হরফের ছড়া (১৯৬৮)
৩.নতুন লেখা (১৯৬৯)
৪.ছড়ার আসর (১৯৭৯)
৫.চিড়িয়াখানা (১৯৮০)
৬.কিস্সা কাহিনী (১৯৮৪)
৭.মাহফিল ১ম ও ২য় খণ্ড (১৯৮৪)
৮.ফুলের জলসা (১৯৮৫)।

এছাড়া ফররুখ আহমদ নয়া জামাত (১ম ভাগ, ২য় ভাগ, ৩য় ভাগ, ৪র্থ ভাগ) নামে ৪টি পাঠ্য পুস্তক রচনা করেন যা ১৯৫০ সালে প্রকাশিত হয়। ফররুখ আহমদ মূলত কবি। তবু তিনি বেশ কিছু স্বার্থক গল্প লিখেছেন। এর মধ্যে ‘প্রচ্ছন্ন নায়িকা’, ‘মৃত বসুধা’ বিবর্ণ’ প্রভৃতি বিখ্যাত গল্প। ফররুখের গল্পসমূহ ‘ফররুখ আহমদের গল্প’ নামে আব্দুল মান্নান সৈয়দের সম্পাদনায় প্রকাশিত হয়েছে। সিকান্দার শা’র ঘোড়া নামে একটি উপন্যাস রচনায়ও তিনি হাত দিয়েছিলেন কিন্তু শেষ করে যেতে পারেননি।

ফররুখ আহমদ ভাষা ও সাহিত্য বিষয়ক বেশকিছু প্রবন্ধও রচনা করেন। ভাষা বিষয়ক কিছু কবিতাও তিনি রচনা করেন যা রেডিওতে নিয়মিতভাবে প্রচার হতো। কবিতা রচনার পাশাপাশি ফররুখ আহমদ অসংখ্য হামদ, নাত, দেশাত্মবোধক সংগীত, প্রেম ও ভক্তিমূলক গান এবং আধুনিক বাংলা সংগীত রচনা করেন। মানের দিক থেকে এ গানগুলো প্রশংসনীয় ও জনপ্রিয় ছিল। এক সময় বেতার ও টিভিতে খ্যাতনামা শিল্পীদের কণ্ঠে এগুলো নিয়মিত প্রচার হতো।

সাহিত্যকর্মের জন্য ফররুখ আহমদ ১৯৬০ সালে বাংলা একাডেমী পুরস্কার, ১৯৬১ সালে প্রেসিডেন্ট পুরস্কার প্রাইড অব পারফরমেন্স, ১৯৬৬ সালে আদমজী পুরস্কার এবং একই বছরে ইউনেস্কো পুরস্কার লাভ করেন।

ভাষা আন্দোলনে ফররুখ আহমদের অবদানের যথার্থ স্বীকৃতি দেয়া হয়নি। উপরন্তু বাংলাদেশ স্বাধীন হবার পর ঢাকা বেতারের চাকরি থেকে তাকে বরখাস্ত করা হয় এবং সরকারি বাসা ছেড়ে দেয়ার নির্দেশ দেয়া হয়। অবশ্য বিভিন্ন মহল থেকে এর প্রতিবাদ করার ফলে শেষ পর্যন্ত তাকে বাসা ছাড়তে হয়নি। ইস্কাটন গার্ডেনের সে সরকারি বাসাতেই নানা দুঃখকষ্ট, অনাহারে অর্ধাহারে এবং বিনা চিকিৎসায় কবি অবশেষে মৃত্যুবরণ করেন (১৯ অক্টোবর, ১৯৭৪)। মৃত্যুর পর অনেকে সমবেদনা জানাতে তাঁর বাসায় যান। শেষ জীবনে দুঃসহ দুঃখ-দারিদ্র্যের মধ্যে বাংলা ভাষার এত বড় একজন প্রতিভাবান কবির মৃত্যুতে সকলে কান্নায় ভেঙ্গে পড়েন। কিন্তু কবি তখন সবকিছুর ঊর্ধ্বে। ঐ সময় হংকং থেকে প্রকাশিত ঋধৎ ঊধংঃবৎহ জবারবি পত্রিকায় ১৯৭৪ সালের ৮ নভেম্বর কবির মৃত্যুর দুই সপ্তাহ পর প্রখ্যাত সাংবাদিক মার্টিন ডেভিডসন লেখেন : ‘কিছুদিন আগে বাংলাদেশের অন্যতম প্রধান কবি ফররুখ আহমদ মৃত্যুবরণ করেছেন। তাঁর মৃত্যুর কারণ অনাহার। কর্তৃপক্ষের অনেকেই তাঁর মৃত্যুতে আন্তরিক দুঃখ প্রকাশ করেছেন।’

ফররুখ আহমদের মৃত্যুর পর ১৯৭৭ সনে মরণোত্তর একুশে পদক দিয়ে ভাষা আন্দোলনে তার কৃতিত্বপূর্ণ অবদানের স্বীকৃতি প্রদান করা হয়। ১৯৮০ সালে তাঁকে মরণোত্তর স্বাধীনতা পুরস্কার দেয়া হয়।

- ইমাম হাসান খান

পঠিত : ১৫৮৪ বার

মন্তব্য: ০