Alapon

আসলেই কি কুরআনের প্রথম বাংলা অনুবাদ করেন গিরিশ চন্দ্র সেন...?



কে প্রথম পবিত্র কুরআন শরীফ উনার বাংলা অনুবাদের সৌভাগ্যজনক এ কাজটি শুরু করেন। বেশিরভাগ মানুষই মনে করে গিরিশ সর্বপ্রথম পবিত্র কুরআন শরীফ বাংলা অনুবাদ করেছে।

১৮৭১ সালে গিরিশ কথিত সনাতন ধর্ম ত্যাগ করে ব্রাহ্ম্যধর্ম গ্রহণ করে। যে ধর্ম ছিলো ইসলামবিদ্বেষী।

পবিত্র কুরআন শরীফ উনার অংশ বিশেষ আমপারা অনুবাদের প্রচেষ্টা গিরিশ এর পবিত্র কুরআন শরীফ উনার অনুবাদের বহু পূর্বে গ্রহণ করা হয়েছিল।

আজ থেকে প্রায় ২১০ বছর পূর্বে ১৮০৮ খ্রিস্টাব্দে রংপুর জেলার গঙ্গাচড়া উপজেলা চিলাখাল মটুকপুর গ্রাম নিবাসী মৌলভী আমিরুদ্দীন বসুনিয়া আমপারার কাব্যনুবাদ করেছিলেন।

বাংলা ভাষায় পবিত্র কুরআন শরীফ আংশিক অনুবাদের তিনিই পথিকৃৎ। এই আমপারা কাব্যানুবাদখানি সেকালের লিথো প্রেসে মুদ্রিত হয়েছিল। এর পৃষ্ঠা সংখ্যা ছিল ১৬৮।
মুদ্রণের তারিখ জানা না গেলেও মুদ্রণ রীতির বৈশিষ্ট্যে গ্রন্থখানি প্রাচীনত্বের দাবী করতে পারে। এর একটি খন্ড বঙ্গীয় সাহিত্য পরিষদের গ্রন্থাগারে অদ্যাবধি রক্ষিত রয়েছে। আমির উদ্দীন বসুনিয়াকৃত, আমপারার কাব্যানুবাদের প্রকাশকাল আনুমানিক ১৮০৮/১৮০৯ খৃ.।
চট্টগ্রামের প্রখ্যাত লেখক ও প্রাচীন পুঁথি সংগ্রাহক আব্দুল করিম সাহিত্য বিশারদ (১৮৭১-১৯৫৩ খ্রি.) তার সংকলিত “বাংলা প্রাচীন পুঁথির বিবরণ” গ্রন্থের একস্থানে আমীর উদ্দিন বসুনিয়ার বাংলা আমপারার কথা লিখেছেন গুরুত্ব সহকারে।

তিনি বলেছেন, “আমার বিশ্বাস, এদেশে বাংলা টাইপ প্রচলনের পূর্বে এ গ্রন্থটি ছাপা হয়েছিল। আবার অনেকে মনে করে থাকেন, আমির উদ্দীন বসুনিয়ার এই সরল বাংলা কাব্যানুবাদখানি মুদ্রিত হয়ে প্রকাশিত হয়েছিল ১৮৬৬ খৃ.তে।”

রংপুরের কুন্ডি পরগনার গোপালপুরের নিকট শ্যামপুর রেলস্টেশনের কাছে মুদ্রণযন্ত্র স্থাপন করে পূর্ববঙ্গের সর্বপ্রথম পত্রিকা “সাপ্তাহিক রঙ্গপুর বার্ত্তাবহ” প্রকাশ করেছিল ১৮৪৭ খৃ. সনে।

খুব সম্ভব এই প্রেসেই পরবর্তীতে ছাপা হয়েছিল উনার এই পবিত্র কুরআন শরীফ উনার বঙ্গানুবাদ গ্রন্থটি। কবি আমির উদ্দীন বসুনিয়ার পবিত্র কুরআন শরীফ উনার আমপারার বঙ্গানুবাদ ১৮৬৬ খৃ.. ছাপার অক্ষরে প্রকাশ পেয়ে অভূতপূর্ব আলোড়ন সৃষ্টি করেছিল।
গিরিশ পবিত্র কুরআন শরীফ উনার বঙ্গানুবাদ করেছিলো ১৮৮১ খৃ.. থেকে ১৮৮৬ খৃ.. পর্যন্ত। এ থেকে প্রমাণিত হয় যে, গিরিশ এর ২০ বছর পূর্বে (১৮৮৬-১৮৬৬ = ২০ বছর পূর্বে) রংপুরের আমির উদ্দীন বসুনিয়া আংশিক হলেও পবিত্র কুরআন শরীফ উনার সর্বপ্রথম বঙ্গানুবাদক হিসাবে ইতিহাসে অমর হয়ে আছেন।

অবশ্য এখানে উল্লেখ করা যেতে পারে, মুসলমানদের মধ্যে টাঙ্গাইলের করটিয়ার মৌলভী মুহাম্মদ নঈমুদ্দীন (১৮৩২-১৯১৬ খৃ.), "আখবার ইসলামীয়া" পত্রিকার সম্পাদক পবিত্র কুরআন শরীফ উনার অনুবাদে প্রবৃত্ত হন। তিনিও আংশিক অনুবাদ করেন।
মুসলমান অনুবাদকদের মধ্যে পূর্ণাঙ্গ পবিত্র কুরআন শরীফ উনার বাংলায় অনুবাদের কৃতিত্ব পশ্চিমবঙ্গের অন্তর্গত চব্বিশ পরগনা জেলার চন্ডিপুর গ্রামের অধিবাসী মৌলভী আব্বাস আলীর (১৮৪৬-১৯২২ খৃ.)।

মৌলভী আব্বাস আলী পূর্ণাঙ্গ পবিত্র কুরআন শরীফ উনার একখানি সুন্দর বঙ্গানুবাদ প্রকাশ করেন ১৯০৭ খ্রি.।

তাই বলা চলে, মুসলমানদের মধ্যে সর্বপ্রথম পূর্ণাঙ্গ পবিত্র কুরআন শরীফ উনার বঙ্গানুবাদের গৌরবের দাবীদার মৌলভী আব্বাস আলী (১৮৪৬-১৯২২ খৃ.)।

এরপর পূর্ণাঙ্গ কুরআন যিনি অনুবাদ করেন, তিনি হলেন- রংপুরের খান বাহাদুর তসলিম উদ্দীন আহম্মদ (১৮৫২-১৯২৭)। তিনি রংপুর জেলার প্রথম মুসলিম গ্র্যাজুয়েট (১৮৭৭) কলকাতার প্রেসিডেন্সি কলেজ থেকে বিএ পাস করেন। খান বাহাদুর তসলিম উদ্দীনকৃত এই মহাগ্রন্থের পূর্ণাঙ্গ তরজমা ১৮৯১ থেকে ১৯১৩ সাল পর্যন্ত সুদীর্ঘ ২২ বছরব্যাপী তার অকান্ত পরিশ্রমের ফসল।

এরপর যার নাম করা যেতে পারে, তিনি হলেন টাঙ্গাইল জেলার মৌলভী আবুল ফজল আবদুল করিম। তিনিও সম্পূর্ণ কুরআনের অনুবাদ করেছিলেন। তার অনুবাদের বৈশিষ্ট্য হলো- সেই অনুবাদের সাথে আরবিও রয়েছে। তিনি প্রথম জীবনে একটি হাইস্কুলের হেড মৌলভী ছিলেন। পরে কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের আরবি ও ফার্সি ছাপার প্রুফ রিডার হিসেবে চাকরি নিয়ে চলে যান। এর পর থেকে নাম না জানা অনেক অনুবাদকই আংশিক কুরআনের অনুবাদ করেছিলেন।

এ ছাড়াও পবিত্র কুরআনের বিশেষ বিশেষ আয়াতগুলোর তরজমা এবং কেউ কেউ ব্যাখ্যা করেছিলেন। তা ছাড়া কুরআন নিয়ে কাব্যানুবাদও করেছেন, বাংলা সঙ্কলন বের করেছেন। তাদের মধ্যে যাদের নাম পাওয়া যায় এবং তারা হলেন- আবদুল মজিদ, মোহম্মদ আবদুুল হাকিম, আলী হাসান, কিরোন গোপাল সিংহ, মুফতি মাওলানা রুহুল আমীন বশীরহাটি রহমাতুল্লাহি (ফুরফুরার মুজাদ্দিদ পীর সূফী আবু বকর সিদ্দিকী রহমাতুল্লাহি আলাইহি এর খলিফা), মাওলানা মুহম্মদ আকরম খাঁ (সম্পাদক, মাসিক মুহম্মদী), এয়ার আহম্মদ, ডঃ কুদরাত-ই-খুদা (বিশিষ্ট বাঙালী বিজ্ঞানী, রেডিও ও উদ্ভিদের প্রাণের আবিষ্কারক), বিদ্রোহী কবী, জাতীয় কবি, কাজী নজরুল ইসলাম, মীর ফজলে আলী, মুহম্মদ আযহার উদ্দীন, ফজলুর রহীম, আবুল ফজল, বিশিষ্ট ভাষাবীদ ডঃ মুহম্মদ শহীদুল্লাহ, সিরাজুল ইসলাম, মুহম্মদ তৈমূর ও খন্দকার সাইদুর রহমানের নাম উল্লেখযোগ্য।

অতএব, দেখা যাচ্ছে, গিরিশচন্দ্র সেন কোনভাবেই বাংলায় পবিত্র কুরআনের প্রথম অনুবাদক হতে পারেননা। কেননা, তারও প্রায় বিশ বছর আগে ১৮৬৬-৬৭ সালে মৌলুভী আমিরুদ্দিন বসুনিয়া কৃত আংশিক কাব্যানুবাদ প্রকাশিত হয়, যার প্রথম প্রকাশকাল ১৮০৮-০৯ বলে জানা যায়।

দ্বিতীয়ত, পবিত্র কুরআন শরীফ কোন সাধারণ গ্রন্থাবলি নয়, তা মহান সৃষ্টিকর্তা আল্লাহ তাআ'লা উনার কুদরতি মুখ নিঃসৃত বাণী, যাঁর শুদ্ধতার শর্ত রক্ষা করা প্রত্যেক মানুষের জন্য ফরজ বা বাধ্যতামূলক। আর এই বাধ্যতামূলক শর্তটি গিরিশচন্দ্র কর্তৃক অনুবাদে কোনভাবেই রক্ষা হয়নি।

উপরন্তু অনেকক্ষেত্রেই কুফরি শিরকি শব্দ-বাক্য ব্যবহার করা হয়েছে যা কোনকালেই কুরআনের অনুবাদে গ্রহণযোগ্য হতে পারেনা। এই অনুবাদ প্রকাশের পর তৎকালে সমালোচনাও হয়েছিলো ব্যাপক।

তথাপি সাম্রাজ্যবাদী ও ঔপনিবেশিক শাসকগোষ্ঠীর রাষ্ট্রীয় স্বার্থে গিরিশচন্দ্র সেনকেই কুরআনের প্রথম অনুবাদক হিসেবে ব্যাপক প্রচারণা চালানো হয়, যার প্রভাব অদ্যাবধি অব্যাহত।

অতএব, এটি সুস্পষ্টভাবে প্রমাণিত হলো যে, পবিত্র কুরআন শরীফ বাংলায় সর্বপ্রথম আংশিক অনুবাদ করেন রংপুরের বিশিষ্ট আলেম, মৌলুভী আমিরুদ্দিন বসুনিয়া ১৮০৮-০৯ সালে। যা লিথো প্রেস থেকে দ্বিতীয় বার প্রকাশিত হয় ১৮৬৬-৬৭ সালে। একই সমসাময়িক কালে টাঙ্গাইলের মৌলুভী নাঈমুদ্দীন সাহেবও আংশিক অনুবাদ করেন।

আর পূর্ণাঙ্গভাবে পবিত্র কুরআন শরীফ প্রথম অনুবাদকারী মওলানা আব্বাস আলী (১৯০৭ সালে) এবং বাংলাদেশ থেকে প্রথম অনুবাদক হিসেবে স্বীকৃত হবেন খান বাহাদুর তসলিম উদ্দীন আহম্মদ (১৯১৩ সালে)।

- জাহিদ সরওয়ার

পঠিত : ৭১৭৫ বার

মন্তব্য: ০