Alapon

=তিনি জানেন যা, আমরা জানি না তা=



খুনোখুনি, অরাজকতা, বিশৃঙ্খলায় তারা গোটা ধরণীকে, ধরণীর অবস্থাকে ভয়াবহ আর বিপর্যস্ত করে তুলেছে। এহেন কর্মজজ্ঞ থেকে নিভৃত হবার কোনো লক্ষণ-ই তাদের মধ্যে নেই। সারা দুনিয়ায় ফাসাদ আর ফাসাদ। স্রষ্টার অবাধ্যতার চূড়ান্ত সীমা-পরিসীমা অতিক্রম করে ফেলেছে তারা। বিশ্বের স্রষ্টা ভীষণ অসন্তোষ তাদের প্রতি। তাদের কার্যক্রমের প্রতি। পাঠিয়ে দিলেন ফেরেশতাদের, তাদের উৎখাতের জন্য। শায়েস্তার জন্য। সেই ফেরেশতা দলের নেতৃত্বে ছিলেন ইবলিশ। ইবলিশ তখন বড্ড আবেদ-ফেরেশতা।
ইবলিশের নেতৃত্বে ফেরেশতা দল তাদের ওপর ভীষণ চড়াও হলেন। একে একে কতল করতে লাগলো তাদেরকে। দেশান্তর-দ্বীপান্তর করে দিলো তাদেরকে। কাউকে কাউকে নির্বাসন করা হলো সাগরে, কেউ কেউ লুকিয়ে থাকতে লাগলো পাহাড়ের গুহায়, ভিবিন্ন নির্জন স্থানের অলতে-গলিতে।
হ্যাঁ, তাদের কথা-ই বলা হলো, যারা আমাদের পূর্বে পৃথীবিতে বসবাস করে গেছে, এবং যাদের-ই স্থলাভিষিক্ত করা হয়েছে আমাদেরকে তথা মানবজাতিকে!
শুনশান পৃথিবী। আর কোনো উৎপাত নেই, উত্তাপ নেই তাদের। জগতসমূহের স্রষ্টা আল্লাহ সুবহানাহু ও’তাআলা একটা সমাবেশ ডাকলেন। পবিত্র আর নিষ্পাপ ফেরেশতাদের সমাবেশ। এই শুনশান বিশ্বে আল্লাহ সুবহানাহু ও’তাআলা একটা নতুন জাতি সৃষ্টি করবেন, প্রেরণ করবেন খলিফা, যারা হবে মাটি থেকে সৃষ্ট এবং তারা আল্লাহ পাক প্রদত্ত শরিয়াহ’র বিধি-বিধান পৃথিবীর জমিনে বাস্তবায়ন করবেন —এসব তিনি জানালেন ফেরেশতাদের। এখন এই সীদ্ধান্তের ব্যাপারে নিতে চাচ্ছেন তাদের থেকে পরামর্শ। এই শুনেই তারা যেনো ভীষণ স্তম্ভিত হয়ে পড়লেন। আল্লাহকে শুধালেন তারা—কেনো সৃষ্টি করবেন এমন জাতি, যারা পৃথিবীতে গিয়ে পূর্বের জাতির মতো আবারও করবে অবাধ্যতা, অরাজকতা। করবে হানাহানি-রক্তপাত! আপনার আদেশ-আনুগত্যে তো আমরা সদা-সর্বদা প্রস্তুত। আমাদের মুখে মুখে তো সকাল-সাঁঝে, রাত-দুপুরে আপনার পবিত্রতার কালাম লেগেই থাকে। লেগে থাকে আপনার হামদ-স্তুতির তাসবীহ। আপনার মহাসত্তার পবিত্র গুণাগুণ বর্ণনায় তো আমরাই আছি। আমাদের দ্বারা তো আপনার আদেশ বাস্তবায়নের চিন্তা ও কর্ম ছাড়া আর কিছুই হয় না। পবিত্রতার পেলব ছাড়া তো আমাদের ভেতর আর কিচ্ছু নেই। তবুও কেনো এমন বিবাদ-বিস্বাদে জর্জরিত জাতি সৃষ্টি করবেন ধরার বুকে— হে রব্ব আমাদের বোধগম্য নয়!

মহামহিম আল-হাকিম রব্ব তাঁদের জবাব দিলেন, নাহ, তোমরা যা চিন্তা করছো, যেরূপ চিন্তা করছো বিষয়টা আসোলে তা নয়। হুবহু সেরকম নয়। তারা ফাসাদ করবে বিশৃঙলা করবে, করবে খুনোখুনি-অরাজকতাও। তাদের কেউ কেউ করবে নিজ স্রষ্টার অবাধ্যতাও ! তবুও এদের মধ্য থেকেই জন্ম নেবে ,এদের মধ্য থেকেই তৈরি হবে স্রষ্টার আনুগত্যশীল আবেদ-আলেম, মুজাহিদ-শহিদ। আদল-ইনসাফের বাস্তবায়নকারী। ফিতনা-ফাসাদকারীদের সুপথে আহব্বানের জন্য তাদের মধ্য থেকেই মহৎপ্রাণ নবি-রাসুলদেরও জন্ম হবে। জমিনে আমার নির্দেশনাবলী বাস্তবায়নের জন্য জান-মাল দিয়ে লড়াই সংগ্রামরত একদল মর্দে মুমিন-মুজাহিদও সৃষ্টি হবে। সুতরাং হে আমার পবিত্র ফেরেশতাকূল, আমি যা জানি তোমরা তা জানো না!

আল্লাহ রব্বুল আলামিনের জবাবে তাঁরা সবাই চুপচাপ। আনুগত্যের মস্তকটা যেনো আরো অধিক অবনত হলো। তবুও যেনো তাদের কারো কারো অন্তর থেকে এই বিষয়টা-ই ঠিকরে বেরিয়ে পড়তে চায় যে, পৃথিবী পরিচালনার মতো পবিত্রতা ও যোগ্যতা তো আমাদেরই আছে পুরোদমে। কোনো কোনো কোনো ফেরেশতা ভাবতে লাগলেন এবং নিজেদের মধ্যে বলতে লাগলেন —মর্যদা-সম্মানের দিক থেকে সে আমাদের ওপরে থাকলেও, আমরা তাঁর চেয়ে বেশি জ্ঞানের অধিকারী। আল্লাহর জগতসমূহে আমরা তো তাঁর পূর্বে ছিলামই। সুতরাং আমাদের চেয়ে উত্তম সৃষ্টি এবং বুদ্ধিমান-বিচক্ষণ জাতি আর কীভাবে হতে পারে !!

আল্লাহ রব্বুল আলামিন তাঁর পরিকল্পিত নতুন সৃষ্টি আদম (আলাইহিস সালাম)-এর ভেতর রূহ ফুঁকে দিলেন। নতুন জাতি সৃষ্টির কাজটি সু-সম্পন্ন করলেন। সকল ফেরেশতার সামনে আদমকে দাঁড় করালেন। ফেরেশতা আর আদম মুখোমুখি। আল্লাহ সুবহানাহু ও’তাআলা উভয়ের পরীক্ষা নিতে লাগলেন।

ফেরেশতাদের প্রশ্ন করে বলতে লাগলেন যে—পৃথিবী পরিচালনায় যদি তোমরা সত্যিই যোগ্যতর হয়ে থাকো, তোমরা যদি সত্যিই জ্ঞানগত দিক থেকে অধিক প্রাজ্ঞ হয়ে থাকো, তাহলে বিশ্বচরারের এই যে সৃষ্টিসমূহ— এসব কিছুর নাম-বৈশিষ্ট্য বলো তো! সবাই চুপ। শুনশান নিরবতা চারদিকে। স্তব্ধতার বন্যা যেনো চারিপাশে !
ডাকলেন আদমকে। বললেন—বলে দাও তো এসব কিছুর নাম-বৈশিষ্ট্য! বলতে লাগলেন তিনি সব কিছুর নাম , সব কিছুর বৈশিষ্ট্য, স্পষ্ট করে দিলেন সব কিছুর গুণাগুণ!
ফেরেশতারা বুঝতে পারলেন সব। উপলব্ধি করলেন বিশ্বস্রষ্টা আল্লাহ কর্তৃক আদম সৃষ্টির হাকিকত। আর আল্লাহকে অবনত মস্তকে দাঁড়িয়ে বলতে লাগলেন - ‘ আপনি তো পবিত্র ও মহান ! আমরা তো ততোটুকুই জানি, যতোটুকু আপনি আমাদেরকে শিক্ষা দিয়েছেন। প্রকৃতপক্ষে আপনি ছাড়া আর এমন কোনো সত্তা নেই। যিনি সবকিছু জানেন এবং সবকিছু বুঝেন '।

এই যে ফেরেশতারা, তারা কিন্তু আল্লাহ রব্বুল আলামিনের বিরোধিতা করেনি। প্রতিবাদও নয়। তাঁরা স্রেফ আল্লাহর কাছে এর হাকিকত জানতে চাইলেন। যখন তাঁরা আল্লাহকে বলেছেন যে, পৃথিবী তো পবিত্র-নিষ্পাপ ফেরেশতারাও পরিচালনা করতে পারবে, আল্লাহ তখন আদম (আলাইহিস সালাম)-এর মাধ্যমে তাঁদের প্রমাণ করে দেখিয়েছেন যে, শুধু নিষ্পাপ-নিষ্কলুস হওয়াটা-ই জমিনে খেলাফত পরিচালনার শর্ত-যোগ্যতা নয়। এর মাঝে অবস্থিত বিভিন্ন কিছুর নাম-বৈশিষ্ট্য ও গুণাগুণ, এসবের প্রায়োগিক জ্ঞান না থাকলে খলিফার যে মহান দায়িত্ব, তা কী রূপে সম্ভব হতে পারে? সুতারং জমিনা খলিফা হবার মতো যোগ্যতা শুধু আদম-ই ধারণ করতে পারে— তোমরা নয়।তারা যে শুধু খুনোখুনি, ফিতনা-ফাসাদ করবে এমনও নয়। তারা আদালাত-ইনসাফ কায়িম করবে। তারা আলিম-আবিদও হবে। আর এইজন্য-ই আল্লাহ রব্বুল আলামিন তাঁদেরকে বললেন— আমি যা জানি তোমরা তা জানো না।
এই যে —আমি যা জানি তোমরা তা জানো না—বিষয়টা, এটা আমাদের জীবন চলার প্রতিটি পরতে পরতে সত্য, প্রতিটি ক্ষণে ক্ষণে সত্য। আল্লাহ স্রষ্টা, আমি এবং সৃষ্ট। সুতরাং মাখলুক থেকে খালিক বেশি জানবেন, সব কিছু খালিকের নখদর্পনে থাকবে, বিষয়টি স্বাভাবিক নয় কি? দেখা যায় কোনো একটা জিনিস আমরা মনেপ্রাণে চাই, কোনো একটা কাজ বিষয় আমাদের কাছে ভীষণ প্রিয়; কিন্তু সে জিনিটা আল্লাহ রব্বুল আলামিন আমদের দেন না। এই যে না দেওয়াটা, এই যে আমাদের নয়া পাওয়াটা, এর পেছেনেও সেই একই হাকিকত লুকায়িত যে—তিনি স্রষ্টা, যা জানেন আমি সৃষ্ট তা জানি নয়া। বুঝি না। উপলব্ধি করি না। আমি বিষয়টা ভীষণ পছন্দ করি, কিন্তু তিনি বলেন, ‘তোমরা যে জিনিস ভালোবাসো, পছন্দ করো, হয়তো তা তোমাদের জন্য অকল্যাণকর। হয়তো এমন জিনিস তোমরা অপছন্দ করো, যা তোমাদের জন্য কল্যাণকর। বস্তুতঃ আল্লাহই জানেন,তোমরা জান না।"
কখনো কখনো এমনসব পরিবেশ-পরিস্থিতিতে পড়ি, এমন বিষয়-আশয়ের মুখোমুখি হই, এমন কিছু সময়ের আবর্তে আঁটকে যাই; তখন হয়তোবা-বা মনের ভেতরের চাপা কষ্ট থেকে হাঁপিয়ে উঠে বলি—এই সময়, এই বিষয়, এই পরিস্থিতি যদি আমার জীবনে না আসতো তা হলে কতোই না ভালো হতো! ক্যান এই সময়টা, এই পরিস্থিতিটা আমার জীবনে এলো!! আল্লাহ ক্যান এমন একটা সময়ের মুখোমুখি কিংবা পরিস্থিতির কাঠগড়ায় আমাদের দাঁড় করালেন!!!
কিন্তু এর পেছেনে হয়তো-বা আল্লাহর বড়ো কোনো নিগূঢ় রহস্য লুকায়িত আছে। হতে পারে আল্লাহ আমাকে আপনাকে মানসিকভাবে আরো সু-দৃঢ় ও আরো শক্তিশালী করতে চান। কিংবা হতে পারে এর মাধ্যমে আমাদের ভেতর সচেতন বা অসেচতনভাবে কোনো এক অহংবোধের জন্ম হয়েছে খুব শক্তপোক্তভাবেই। আল্লাহ সেই অহংবোধকে ধুলোয় লুটিয়ে করতে চান আমাদেরকে চূড়ান্ত সংশোধন। কারণ তিনি যা জানেন আমরা তা জানি না। এইজন্যই তিনি যা ইচ্ছে হয় তা-ই করেন। এসব কিছু তিনিই আমাদের জন্য নির্ধারিত করে রেখেছেন। তাঁর অজানা বা নির্দেশনা ছাড়া কিছুই সংঘটিত হয় না। পবিত্র কুরআনুল কারিমে তিনি তা-ই বলেছেন। পৃথিবীতে অথবা ব্যক্তিগতভাবে তোমাদের উপর যে বিপর্যয় আসে আমি তা সংঘটিত করার পূর্বেই তা লিপিবদ্ধ থাকে, আল্লাহর পক্ষে এটা খুবই সহজ।
এখানে আরো একটা বিষয় হচ্ছে যে, আল্লাহ সুবহানাহু ও’তাআলা তো সবই জানেন। তিনি যা চান তা-ই করেন। তবুও ফেরেশতাদের কাছ থেকে পরামর্শ গ্রহণের মানেটা কী? তাঁর পবিত্র সত্তার সাথে এই পরামর্শ গ্রহণের বিষয়টি যায় না। কিন্তু এটার মধ্যে বিরাট এক হিকমাহ এবং শিক্ষা রয়েছে আমাদের মানবমণ্ডলীর জন্য। আমাদের জ্ঞান তো সসীম-সীমিত। আমরা যেনো প্রতিটি গুরুত্বপূর্ণ কর্মে সংশ্লিষ্টদের সাথে পরামর্শ গ্রহণ করি, এবং এরপরে সিদ্ধান্ত নিই। যেমন আল্লাহ সুবহানাহু ও’তাআলা আমাদের প্রিয় নবি (স্বল্লাল্লাহু আলাইহি ও’সাল্লাম)-কে-ও এই বিষয়ে আদেশ দান করেছেন পবিত্র কালামুল্লাহতে।


=তিনি জানেন যা, আমরা জানি না তা=
~রেদওয়ান রাওয়াহা
১২.০৬.২১

পঠিত : ৩৯৪ বার

মন্তব্য: ০