Alapon

বাংলাদেশে মধ্যপন্থী আলেমদের পথের দিশা হলেন শায়েখ জাফরী (হাফি.)। তিনি এখন অসুস্থ



আলিম শ্রেণীতে পড়ার সময় ফজর নামাজের পর প্রায়ই বক্তব্য রাখতেন শায়খুনা আল্লামা কামালুদ্দীন আব্দুল্লাহ আজ্ জাফরী হাফিজাহুল্লাহ। সকল ছাত্র ও উস্তাদগণ চাতক পাখির মত চেয়ে থাকতেন শায়েখের নুরাণী চেহারার দিকে। শায়েখের সূরা ফাতিহার তিলাওয়াত ছিল স্বতন্ত্র। ফজরের কোরআনের তিলাওয়াত যখন করতেন মনে হতো যেন আর শেষ হবেনা। থেমে থেমে তিলাওয়াত করেই চলতেন। শায়েখ, আল্লাহ শব্দটিকে এত বেশি দরদ ও মায়া নিয়ে মুখভরে উচ্চারণ কিভাবে করেন তা আমার কাছে এখনও বিস্ময়। শায়েখের জুতো জোড়া বহনের সুযোগ হয়েছিল বলে নিজেকে ধন্য মনে করি।

আল্লামা কামালুদ্দীন আব্দুল্লাহ আজ্ জাফরী হাফিজাহুল্লাহ আওলাদে রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম। মাতৃ ও পিতৃ বংশের পূর্বপূরুষরা প্রায় সবাই বিশিষ্ট আলেমে দ্বীন। তার দাদা ছিলেন ফুরফুরা পির সাহেবের খলিফা। সব মিলিয়ে একটি দ্বীনি পরিবার ও পরিবেশে ১৯৪৫ সনের ৩ মার্চ তারিখে বরিশালের ভোলা জেলার বোরহানুদ্দিন থানার সৈয়দ আওলিয়া গ্রামে তাঁর জন্ম হয়। যদিও পরবর্তী জীবনের বেশিরভাগ সময় নরসিংদী ও ঢাকায় যাপন করছেন।

তিনি পড়ালেখা করেছেন ভোলায় মির্জাকালু ইসলামিয়া সিনিয়ার ফাজিল মাদরাসায় ও নরসিংদীর তৎকালীন বিখ্যাত কুমরাদী মাদ্রাসায়। তাছাড়া কামিল পড়েছেন দুর্বাটি আলিয়া মাদরাসায় ১৯৭৩ সালে। সবশেষে তিনি মক্কার কিং আব্দুল আজিজ বিশ্ববিদ্যালয়ে অধ্যয়নের সুযোগ পান। বরাবরের মত কোন সার্টিফিকেটকে তিনি প্রাধান্য দেননি। মাওলানা জ্ঞানার্জনকেই তার জীবনের ব্রত হিসেবে গ্রহন করেছিলেন। তিনি আলেমদের খেদমত করাকে তার ইলমের বরকতের একটি মাধ্যম মনে করেন।

বাংলাদেশে ইসলামী রাজনীতি, অর্থনীতিতে শায়েখ জাফরীর অবদান অসামান্য। বাংলাদেশে ইসলামী অর্থনীতিকে পরিচয় করিয়ে দিয়েছেন শায়েখ জাফরী (হাফি.)।জীবনে প্রতিটি ক্ষেত্রে তিনি রেখেছেন মেধা ও যোগ্যতার স্বাক্ষর। ইলম এবং আমলের সমন্বয়ে ভাষ্বর এক প্রকৃত হিকমত সম্পন্ন আলেমে দ্বীন হলেন আল্লামা কামালুদ্দীন আব্দুল্লাহ আজ্ জাফরী হাফিজাহুল্লাহ। বাংলাদেশে সমসাময়িক ইসলামের ইতিহাস লিখতে গেলে যার নাম স্বর্ণাক্ষরে লিখা থাকবে বলে আমার বিশ্বাস।

শায়েখ তার বক্তৃতায় প্রায়ই বলেন, ইসলামী শিক্ষা বলতে কিছু নেই। যা কিছু কল্যাণকর ও বৈধ জ্ঞান তার সবটাই হলো ইসলামী। তিনি ইসলামী জ্ঞান ও সাধারণ জ্ঞানকে বিভাজনের বিরোধীতা করেন। শায়েখ বুদ্ধিজীবীতা নিয়ে বলেন, “জ্ঞানার্জনের জন্য দরকার আকল বা বুদ্ধি। আর বুদ্ধি হলো জ্ঞানের ছাত্র। বুদ্ধি জন্মগত কিন্তু জ্ঞান অর্জন করতে হয়। তাই আমাদের দেশের বুদ্ধিজীবীরা জ্ঞানী হতে পারেনি। কারন তারা প্রকৃত জ্ঞান কোরআন থেকে বঞ্চিত। জ্ঞান মানুষকে পথ দেখায় বুদ্ধি নয়। মাওলান রুমি বলেন, অন্ধের পথচলার জন্য লাঠি প্রয়োজন পাশাপাশি একজন পথ দেখানে ওয়ালা ব্যক্তির প্রয়োজন। কিন্তু ব্যক্তির চোখে যদি আলো ফিরে আসে তবে লাঠিরও দরকার নেই আবার পথ দেখানেওয়ালারও দরকার নেই। তাই জ্ঞানেই হলো আলো এ জ্ঞান থাকলে মানুষ সঠিক পথ পেতে পারে অন্যথায় নয়।

বাংলাদেশে মধ্যপন্থী আলেমদের পথের দিশা হলেন শায়েখ জাফরী (হাফি.)। শায়েখ খাওয়ারিজ ও উগ্রপন্থিতের থেকে সতর্ক থাকার পরামর্শ দেন। শায়েখ সারা জীবন নিজে মধ্যপন্থি হিসেবে জীবন যাপন করার চেষ্টা করেন এবং সকলকে মধ্যম পন্থাকে আঁকড়ে ধরার নাসিহা করেন। শায়েখের প্রতিষ্ঠিত মাদ্রাসা ও প্রতিষ্ঠান সমূহ থেকে যারা বের হয়ে আসেন তারাও সে মধ্যম পন্থাকে প্রাধান্য দেন। মাযহাবী, লা-মাযহাবী, হানাফী, আহলে হাদিস ইত্যাদি বিভাজনকে শায়েখ সবসময় নিরূৎসাহিত করেন। সকল শ্রেনী, পেশা, গোত্র ও দলের মানুষকে তিনি সম্মান করেন।

তিনি বলেন, ” আমি একজন হানাফী”। তিনি মধ্যম পন্থার উদাহরণ দিতে গিয়ে বলেন, আলেমদের প্রধান কাজ মধ্যপন্থায় চলা আর দ্বিতীয় কাজ হলো জ্ঞানার্জন করা। আলেমদেরকে অবশ্যই জ্ঞানের গভীরতা অর্জন করতে হবে। ইসলামে ইখতিলাফ একটি স্বীকৃত ব্যপার এটা থাকবেই কিন্তু ইফতিরাখ বা বিচ্ছিন্নতা না জায়েযা। ইমামে আ’যম আবু হানিফার সাথে ইমাম মুহাম্মদ, ইমাম ইউসুফ (রহ.) ইখতিলাফ করতেন। এক ইমাম অন্য ইমামের সাথে ইখতিলাম করেছেন কিন্তু ইফতিরাখে জড়াননি। তাই উম্মাহের ঐক্যকে গুরুত্ব দেয়া জরুরী। ইলম সম্পর্কে শায়েখ বলেন, ইলম অর্জন করতে হবে আমলের আগে, ইমাম বুখারী একটা অধ্যায়ের উপ শিরোনাম দিয়েছেন আল ইলমু কাবলাল ফেইলে ওয়াল আমালি। আমালের আগে জ্ঞান অর্জন করা। ইলম থেকেই হিকমাহের জন্ম হয়। আর এই হিকমাহ আল্লাহ সবাইকে দান করেননি।

দ্বীনের খেদমতে অসংখ্য প্রাতিষ্ঠান তিনি গড়েছেন। দেশে ও দেশের বাইরে শত শত মসজিদ, মাদ্রাসা, ইসলামী সেন্টার শায়েখের মাধ্যমে গড়ে উঠেছে। তার অক্লান্ত পরিশ্রমে গড়ে উঠেছে ঐতিহ্যবাহী তাওহীদী প্রতিষ্ঠান জামেয়া কাসেমিয়া কামিল(বালক)মাদ্রাসা। জামেয়া কাসেমিয়া কামিল(মহিলা)মাদ্রাসা। বাংলাদেশ ইসলামী বিশ্ববিদ্যালয়, ঢাকা। এরকম ছোট বড় অসংখ্য প্রতিষ্ঠানের সাথে জড়িয়ে আছেন অধ্যক্ষ্য কামালুদ্দীন আজ্ জাফরী হাফিজাহুল্লাহ।

আজীবন দ্বীনের দা’য়ী এ মহান মানুষটি তার বক্তৃতা, বিবৃতি, লেখনীসহ প্রতিটি সনাতন ও আধুনিক মাধ্যমকে কাজে লাগিয়েছেন দ্বীনের দাওয়াত দানের জন্য। টেলিভিশনে দ্বীনের দাওয়াত ও প্রশ্নোত্তরমূলক যত প্রোগ্রাম আমরা এখন দেখি তার প্রায় সবকটি শুরু হয় জাফরী হুজুরের মাধ্যমে। তিনি একজন সব্যসাচী আলেমে দ্বীন। মানুষের জীবনের প্রতিটি দিক ও বিভাগ নিয়ে তিনি গভীরভাবে ভেবেছেন এবং সাধ্যানুযায়ী মানুষের সমস্যার শরঈ সমাধান দিয়েছেন।

আজ শুনলাম শায়েখ অসুস্থ হয়ে হাসপাতালে ভর্তি হয়েছেন। আল্লাহ শায়েখকে পরিপূর্ণ সুস্থ করে দিন। আরও লম্বা সময়ব্যাপী যেন দ্বীনের খেদমতের আন্জাম দিতে পারেন সেই তাওফীক এনায়েত করুন। (আমীন)।

~লুৎফুর রহমান ভূঁইয়া

পঠিত : ৬১১ বার

মন্তব্য: ০