Alapon

একটি বৃষ্টিস্নাত রাতের গল্প...



রাত তখন আনুমানিক ১০ টা! শাহবাগ থেকে হেটে হেটে বাসায় ফিরছি। ইঞ্জিনিয়ার্স ইনস্টিটিউটের সামনে আসতেই মুষলধারে বৃষ্টি শুরু হলো। এতো রাতে বৃষ্টিতে ভেজা বুদ্ধিমানের কাজ মনে হলো না। তাই বৃষ্টির পানি থেকে নিজেকে আড়াল করা যায় এমন একটা জায়গা দেখে দাঁড়ালাম।

কিছুক্ষণ পর একটা মেয়ে কাক ভেজা হয়ে আমার পাশে এসে দাঁড়ালো। প্রথমে ভাবলাম, পতিতা হবে হয়তো! কারণ, এখানে প্রায়ই পতিতারা খোদ্দরের আশায় দাঁড়িয়ে থাকে। মনে মনে ‘ইন্নালিল্লাহ...’ পড়তেছি আর দুআ করতেছি, ‘আল্লাহ বৃষ্টিটা একটু কমাই দেন। বৃষ্টি কমলেই দৌড় দিবো।’

একটু পর মেয়েটা কাঁদতে শুরু করলো। প্রথমে চোখ মুখ চেপে ধরে কাঁদলো তারপর হেচকি দিয়ে কাঁদতে শুরু করলো। তার কান্না দেখে আমি আরও ভয় পেয়ে গেলাম। এখন এই অবস্থায় মানুষ যদি দেখে, তাহলে নির্ঘাত ভাববে আমি তাকে কিছু একটা করেছি! না হলে সে এভাবে কান্না করবে কেন!

আমি ভয় পেয়ে কিছুটা রাগ হয়েই বললাম, ‘কী ব্যাপার, এইভাবে কান্না করছেন কেন?’
আমার কথা তার কান পর্যন্ত পৌঁছালো বলে মনে হয় না। সে যেভাবে কাঁদতেছিল, সেভাবেই কেঁদে চলেছে। এর মাঝে আমি তার পা থেকে মাথা পর্যন্ত একবার দেখে নিলাম। পোশাক-আশাক আর বেশভূষা দেখে পতিতা মনে হচ্ছে না; বরং ভদ্র ঘরের মেয়েই মনে হচ্ছে।
এরপর আমি গলার স্বর নরম করে বললাম, ‘প্লিজ, এভাবে কাঁদবেন না। এভাবে কাঁদলে সাধারণ মানুষ মনে করবে আমি আপনাকে কিছু করেছি। তারপর গনধোলাই দিয়ে আমার ইহজীবনের খেল খতম করে দিবে! আমি এই অল্প বয়সে গণধোলাই খেয়ে মরতে চাচ্ছি না। তাই দয়া করে কান্না বন্ধ করুন!’

আমার কথা শুনে মনে হয় তার একটু মজাই লাগল! কান্নার মাঝেই হেসে দিলো কিনা অন্ধকারে ঠিক বুঝতে পারলাম না। আর বৃষ্টির পানিতে চশমাটা ভিজে তো দুনিয়া আরও ঝাপসা হয়ে গেছে।

কিছুক্ষণ পর সে সত্যিই সত্যি কান্না বন্ধ করলো। তারপর জিজ্ঞেস করলাম, ‘এভাবে কান্না করছেন কেন? নিকটআত্মীয় কেউ মারা গেছে নাকি?’

সে কিছুক্ষণ চুপ করে থেকে বলল, ‘তার চেয়েও বড়ো কিছু! আজ আমার রিলেশনশীপ ব্রেকআপ হয়েছে। দুই বছরের রিলেশন এক মুহুর্তেই ভেঙে দিয়ে গেলো। আমি এতো কাঁদলাম ওর পা পর্যন্ত ধরলাম, কিন্তু সে আমার কোনো কথাই শুনলো না।’

মেয়েটার কথা শুনে মনটা খারাপ হয়ে গেলো। তাকে বললাম, ‘যে নিজেই চলে যেতে চায়, তাকে কোনোভাবেই ধরে রাখতে পারবেন না। যার যাওয়ার সে এমনিতেই চলে যাবে; তাতে আপনার দোষ থাকুক আর নাই থাকুক! ভেঙে পড়বেন না। ’

তারপর মেয়েটা নীরবে কিছুক্ষণ চোখের পানি ফেলল। এরপর সে বলল, ‘আমাদের ব্রেকআপ হওয়ার মূল কারণ কি জানেন? আমি দেখতে কিছুটা কালো! আর এ কারণে নাকি আমাকে নিয়ে ওর বন্ধুরা হাসাহাসি করে। এখন আপনিই বলুন তো, এটা কি আমার দোষ? আমি কি নিজেকে এভাবে কালো করে বানিয়েছি?’

তাকে বললাম, ‘আসলে ব্রেকআপের জন্য এটা কোনো কারণ নয়। মূল কারণ হলো, সে আর আপনার সাথে রিলেশনশীপে থাকতে চায় না। হয়তো সে অন্য কাউকে পেয়ে গেছে। আর এটা যেহেতু আপনার উইকপয়েন্ট, তাই সে এটাকে ব্যবহার করেই আপনার সাথে ব্রেকআপ করলো।’

মেয়েটা দীর্ঘশ্বাস ছেড়ে বলল, ‘হবে হয়তো! কিন্তু আমি তো তাকে ছাড়া কিছুই ভাবতে পারছি না। আমি তাকে ছাড়া সুস্থ থাকবো কীভাবে? আমি বাঁচবো না হয়তো। আমার এখন করণীয় কি? বলুন না ভাইয়া, আমি এখন কীভাবে নিজেকে ঠিক রাখবো?’

তার এমন ব্যাকুলতা দেখে সত্যিই ভীষণ মায়া লাগলো। আর মনে মনে ভাবলাম, ‘একটা মানুষ কতোটা অসহায় বোধ করলে অপরিচিত একটা মানুষের কাছে নিজের দুঃখের কথা শেয়ার করে। এখন রাত বাজে সাড়ে ১০ টা! রাস্তায় তেমন মানুষও নেই। তার তো আমাকে ভয় পাওয়ার কথা। অথচ একটু মানসিক শান্তির জন্য আমার কাছে তার ব্যক্তিগত কথা হড়হড় করে বলে যাচ্ছে।’

এসব ভাবতে ভাবতেই বৃষ্টি কিছু কমে আসলো। মেয়েটাকে বললাম, ‘কোনদিকে যাবেন?’
সে বলল, ‘ধানমন্ডি।‘
চলুন তাহলে সেদিকে হাটতে থাকি।
মেয়েটা কোনো কথা না বলে আমার সাথে হাটতে লাগল। হাটতে হাটতে তার মনের গহীণে লুকিয়ে অনেক কষ্টের কথা বলল। আমি নীরব শ্রোতা হয়ে সব শুনলাম আর দীর্ঘশ্বাস ছাড়লাম।

এভাবে হাটতে হাটতে আমরা শাহবাগ পৌঁছলাম। শাহবাগ পৌঁছে একটা রিক্সা ডাকলাম, উদ্দেশ্য ধানমন্ডি ২৭। রিক্সায় উঠে বসলাম আর মেয়েটাও কোনো কথা না বলে রিক্সায় উঠে বসল। রিক্সা চলতে থাকলো ধানমন্ডির পানে...

কিছুক্ষণ চুপ থাকার পর বললাম, ‘দেখেন, জীবনটা এমনই। জীবন জুড়েই পাওয়া আর না পাওয়ার হিসেব। তাই আজ কিছু একটা হারিয়ে ফেলেছেন বলেই যে জীবনের সবকিছু শেষ, এমনটা ভাবতে যাবেন না। বরঞ্জ, এটা ভাবতে চেষ্টা করুন যে, সে হয়তো আপনার জন্য সঠিক মানুষ ছিলো না।

আর শুনুন, কষ্টটাকে উপভোগ করতে শিখুন। প্রতিটা কষ্টের মাঝে একটা মজা থাকে। সেই মজাটা খুঁজে বের করার চেষ্টা করুন। মজাটা তখনই খুঁজে পাবেন, যখন ধৈর্য ধরতে পারবেন।’

আমি কথা শেষ করতেই মেয়েটা বলল, ‘এই রিক্সা দাঁড়ান। আমরা চলে আসছি।’
তারপর সে জিজ্ঞেস করল, ‘ভাইয়া, আপনার নামটাই তো জানা হলো না? কোথায় থাকেন, কী করেন, কিছুই বললেন না। আর আপনাকে কোথায় গেলে পাবো সেটাও বলুন!’
আমি মুচকি হাসি দিয়ে বললাম, ‘বলার সুযোগ পেলাম আর কোথায়! বলা যখন হয়নি তখন অজানাই থাকুক না। নাম আর পরিচয় দিয়ে কী এসে যায়। আরশের মালিক মনে করেছেন, আপনার সাথে আমার দেখা হওয়া দরকার! তিনি যেকোনো উপায়ে আপনার সাথে আমার দেখা করিয়ে দিয়েছেন। তিনি আবার যেদিন দরকার মনে করবেন, সেদিন দেখা করিয়ে দিবেন।’

আমার কথা শুনে মেয়েটা মুচকি হাসি দিলো। তার হাসিটা অনেক সুন্দর ছিলো। বললাম, ‘এই সুন্দর হাসিটাকে ফিকে হয়ে যেতে দিবেন না। অন্যের জন্য কষ্ট পেয়ে গোমড়ামুখো হয়ে থাকার কোনো মানে হয় না। নিজের জন্য বাঁচুন আর নিজের জন্যই হাসুন।’
মেয়েটা আবারও মুচকি হাসি দিয়ে বলল, ‘চেষ্টা করবো ভাইয়া!’

বিদায় বেলায় বললাম, ‘আপনার জন্য একটা উপহার আছে। বিকেলবেলা টিএসসি থেকে কিনেছিলাম। তারপর পাঞ্জাবীর পকেট থেকে এক গোছা কাঁচের চুড়ি বের করে দিলাম। বললাম, যেদিন আপনার মনের আকাশ থেকে এই কালো মেঘ দূর হয়ে সেখানে সূর্য হেসে উঠবে, সেদিন এই চুড়িগুলো পরবেন। আমার ভালো লাগবে...’!

পঠিত : ১০৪৬ বার

মন্তব্য: ০