Alapon

শব্দখেলার পরিশিষ্টঃ আসারি, মাতুরিদি ও আশআরি সহ সমানুপাতিক বিষয়গুলো -----



আপাতদৃষ্টিতে আকিদা-বিশ্বাসের ঘরানা তিনটি বলা হয়, মাতুরিদি, আশআরি ও আসারি।

কিন্তু মূলত আসারি দিয়ে বোঝানো হয় দুটা বিষয়, প্রথমত, অ-নজদি হাম্বলি আকিদা ঘরানা।
দ্বিতীয়ত, নজদপ্রভাবিত আকিদা ঘরানা।

আসার শব্দের অর্থ ‘লিখিত বিষয়াবলী’। অর্থাৎ, এটা দিয়ে বোঝানোর চেষ্টা করা হয়, মাতুরিদিরা আকিদায় ইমাম মাতুরিদির ঘরানার অনুসারী। আশআরিরা আকিদায় ইমাম আশআরির অনুসারী। বোঝানো হয়, কিন্তু আসারিরা কোন ইমামের অনুসারী নয়। তারা সরাসরি কুরআন ও সুন্নাহ (হাদিস) এর লিখিতরূপ-উৎসরিত আকিদার অনুসারী।
কিন্তু এটা একটা শব্দকৌশল ছাড়া কিছুই নয়।

কারণ, মাতুরিদিদের নাম যতই ইমাম মাতুরিদি থেকে আসুক না কেন, মাতুরিদি আকিদা ঘরানা ইমাম মাতুরিদির মনগড়া বিষয় নয়। বরং ইমাম মাতুরিদি ও তাঁর ছাত্ররা সবকিছু নিয়েছেন কুরআন ও সুন্নাহ থেকেই।

তেমনি কথা প্রযোজ্য ইমাম আশআরির বেলায়। আশআরিরা ইমাম আশআরি বা তাঁর ছাত্রদের মনগড়া আকিদা নেননি, বরং ইমাম আশআরি ও তাঁর ছাত্ররা এসবকিছুই কিতাব ও সুন্নাহ থেকে উৎসরণ করেছেন।

যতই আশআরি-মাতুরিদিকে ইলমুল কালাম বলে দূরে সরানো হোক, সেই কালাম তো স্রেফ চিন্তাভাবনা-প্রসূত নয়! কালাম অর্থ যতই কথাবার্তা হোক না কেন, বিচার বিশ্লেষণ হোক না কোন, সেই কথাবার্তা বা বিচার বিশ্লেষণ তো কুরআন ও সুন্নাতের বাইরে নয়। কুরআন ও সুন্নাহ নিয়েই তো বিচার বিশ্লেষণ। আর আসারিকে যতই অক্ষরবাদী বলা হোক না কেন, সেই অক্ষরবাদ নিয়েও তো কম আলোচনা, সমালোচনা, বিশ্লেষণ করতে হয়নি!
তাও শব্দনির্ভর একটা তফাত বজায় রাখা কেবল।

তাই ড. ইয়াসির ক্বাদি থেকে শুরু করে অনেক আলিমই আজকে বলেন, মাতুরিদি আকিদাও আসারি আকিদা। আশআরি আকিদাও আসারি আকিদা। আসার ছাড়া কোন আকিদাই নেই।
প্রকৃতপক্ষে চিহ্নিতকরণের সুবিধার্থে আসারি আকিদার আদিরূপকে হাম্বলি আকিদা বলা ন্যায়নিষ্ঠ এবং পরবর্তী রূপকে নজদপ্রভাবিত আকিদা বলা ন্যায়নিষ্ঠ।

ঠিক যেমন কথাটা প্রযোজ্য মাযহাবের ক্ষেত্রে।
গত দুই শতক ধরে বলে আসা হচ্ছে, আপনি হানাফি, নাকি মুসলিম? হাম্বলি, নাকি মুসলিম? শাফিঈ, নাকি মুসলিম? মালিকি, নাকি মুসলিম? আমরা হানাফি-শাফিঈ-মালিকি-হাম্বলি কিছুই নই। আমরা মুহাম্মাদি জামাআত, আমরা সালাফি, আমরা আহলুল হাদিস। আমরা ক্বাদিরি, চিশতি, নকশবন্দি মুজাদ্দিদি তরিকার কিছুই নই, আমরা মুহাম্মাদি তরিকা।

এখন এই স্রেফ শব্দ-খেলার কৌশল আপাতদৃষ্টিতে খুব কাজ করে। যে তক মানুষ বুঝতে না পারছে।

যাঁরা নিজেদেরকে সালাফি হিসাবে চিহ্নিত করেন, এটা খুবই ভাল কথা। এখানে সালাফ মানে সালফে সালিহিন। আদিযুগের সাহাবি-তাবিয়ি-তাবে তাবিয়িদের অনুসরণ।

এখন,
কোন্ হানাফি সালাফি নয়? ইমাম আবু হানিফা কি সালাফদের একজন নন? তাহলে হানাফি হলে কি সালাফি হওয়া হলো না? কোন্ হানাফি কেবল ইমাম আবু হানিফাকে অনুসরণ করে?

কেউ না।
ইমাম আবু হানিফা যে সাহাবাদের কাছে সরাসরি শিক্ষা নিয়েছেন, তারা কি সালাফ নন? আবু হানিফার অগুণতি অসংখ্য শিক্ষকগণ কি সবাই তাবিঈ নন? সেই সমস্ত তাবিঈ কি সালাফ নন? আবু হানিফা কি হাজার হাজার সাহাবার হাদিস নেননি? সেই হাজার হাজার সাহাবা কি সালাফ নন? আবু হানিফার ছাত্রগণ সবাই কি তাবে-তাবিঈ নন? ধার্মিক তাবে-তাবিঈরা কি সবাই সালাফ নন?

দেখা যাচ্ছে, ইমাম নু’মান আবু হানিফার আগে, তাঁর সময় ও তাঁর পরে- পুরোটাই সালাফের ভেতরে আকণ্ঠ ডোবা। কিন্তু তাঁর সাথে পার্থক্য সূচিত করার জন্য ‘সালাফি’ টার্মটা নিয়ে আসা কি স্রেফ একটা কাল্টঘটিত শব্দখেলার চেয়ে বেশি কিছু থাকে? ইমাম মালিক, শাফিঈ, হাম্বল কি সালাফ নন? তাঁরা প্রত্যেকে কি সালাফ থেকেই সব নেননি? নিজেরা সালাফ হয়ে সালাফদের সাথে ক্রমশ প্রতিনিয়ত ক্রস-চেক করে সালাফ ছাত্রদেরই শিক্ষা দেননি?

সমস্যা হলো, শব্দ নেয়ায়।
খারিজিরা আমিরুল মু’মিনিন মেনে নিতে রাজি তো ছিল না, বরং আমিরুল মু’মিনিন মানাকে শিরক সাব্যস্তই করেছিল। কিন্তু ঠিকই তারা নিজেদের একজন প্রধান সাব্যস্ত করেছিল। সেই প্রধানের মৃত্যুর পর আরেক প্রধানও ঠিকই সাব্যস্ত করেছিল। তাদের উভয়েরই অনুসরণ করেছিল। তাদের সুনামও করেছিল।
কিন্তু তাদের নামটা আমির বা প্রধান হিসেবে বলতে তাদের দ্বিধা।

তাদের সমস্যা কেবল ওই শব্দটুকুয়।
পার্থক্য-প্রাধান্যময় কাল্ট-মানসিকতায় শব্দভীতি, শব্দপ্রীতি ও প্রচলিত শব্দের সাথে ব্যাপক ভিন্নার্থ আনার প্রবণতা সুস্পষ্ট।
বিশেষ করে, মৌলিক কোন শব্দের দাবিদার হয়ে গিয়ে স্রেফ শব্দটাকে অনুসরণের উপর সমস্ত জোর প্রয়োগ করে মতাদর্শকে সর্বোচ্চ স্থান দেয়ার প্রবণতাই আসল কথা। ইতিহাস চিৎকার করে তাই বলে।

বলা হচ্ছে ‘আহলুল হাদিস’,
তো কোন্ মাযহাব আহলুল বিদআহ? কোন্ মাযহাব হাদিস ত্যাগ করছে? কোন্ মাযহাব হাদিস গ্রহণ করে না? কতবড় একটা কৌশল! স্রেফ ‘আহলুস সুন্নাহ’ কে একটু ঘুরিয়ে দিয়ে চার মাযহাবের এবং দুই আকিদা স্কুলের প্রতিদ্বন্দ্বী করে তোলা। যা সুন্নাহ, তাই তো হাদিস। চার মাযহাবই তো আহলুস সুন্নাহ।

মুহাম্মাদি জামাআত, তো চার মাযহাবের কোন জামাআতটা কাদিয়ানি, দ্রুজ, বাবি, বাহাঈ? চার মাযহাবের কোন জামাআতটা নবী দ.’র পর নবী সাব্যস্ত করলো? মুহাম্মাদি তরিকা। কোন ক্বাদরি, চিশতি নকশবন্দি মুজাদ্দিদি আদতে মুহাম্মাদি নয়। শুনতে মুখরোচক। কোন্ তরিকা নবী দ.’র পর নবী সাব্যস্ত করলো?

তেমনি, আকিদায় ‘আসারি’ ও দলে ‘সালাফি’ শব্দের আড়ালে স্রেফ ইমাম আহমাদ ইবনু হাম্বলকে, তাঁর ছাত্রদেরকে, এরপর বড় একটা ধাপে ইবনু তাইমিয়াকে, তারপর মূল ধাপে ইবনু আবদুল ওয়াহাবকে আড়াল করার তো কিছু নেই।
ঠিক যে প্রাধান্য দিয়ে ইমাম আবু হানিফাকে মানা হচ্ছে, সেই প্রাধান্য দিয়েই ইবনু তাইমিয়ার নাম মানার কথা বলা হচ্ছে এবং ঠিক সেই প্রাধান্য দিয়েই ইবনু আবদুল ওয়াহাবকে মানা হচ্ছে।

কিন্তু ইবনু আবদুল ওয়াহাবের অনুসারীদল বাকী সবার ‘আসার’ বা ‘আদিতে লিখিত বিধিবিধান’ এর অনুসরণ থেকে, কুরআন ও হাদিসের অনুসরণ থেকে কী অবাক কৌশলেই না খারিজ করে দিচ্ছে। অনুসরণ ঠিক হানাফিদের মতই ইবনু আবদুল ওয়াহাবের হচ্ছে। কিন্তু বাকীদের ‘আসার’ থেকেই বরবাদ করে দেয়া হচ্ছে।

অনুসরণ হচ্ছে ইবনু আবদুল ওয়াহাবের, নাম ভাঙছে পুরো সালফে সালিহিনের।
ইবনু তাইমিয়া-ইবনু আবদুল ওয়াহাবের যে প্রাধান্য ও পুনরুক্তি, বারবার উপস্থাপন ও উল্লেখ ও প্রবল অনুসরণ, এটার সাথে অপর কোন মাযহাবের অনুসরণের পথের কোন তফাত নেই।

হ্যা, তাকলিদের কথা আসতে পারে।
তাকলিদ শব্দটাকেও শব্দকৌশলে দূষিত করা হয়েছে। কেউই রাসূল দ.’র উপরে ইমাম আবু হানিফার তাকলিদ করে না। না আল্লাহর উপরে করে। না কুরআনের উপরে, না হাদিসের উপরে। প্রকৃতপক্ষে মাযহাবিরা ‘তাকলিদ করা’ বলতে যে অনুসরণ করা বোঝায়, সেটা হল আল্লাহ ও তাঁর রাসূল দ.’র অধীনে সাহাবায়ে কিরামের জামাআতের ছায়ায় প্রথম তিন প্রজন্মের আলোকে অনুসরণ। এই সবকিছুকে অবজ্ঞা করে নয়। পাশ কাটিয়ে নয়।

সালাফিগণ ‘তাকলিদ না করা’ বলতে ঠিক এটাই বোঝান। আল্লাহ ও তাঁর রাসূল দ.’র অধীনে সাহাবায়ে কিরামের জামাআতের আলোকে প্রথম তিন প্রজন্মের জ্ঞানের অনুসরণ।
তাই মাযহাবিদের ‘তাকলিদ করা’ ও নজদিদের ‘তাকলিদ না করার’ অর্থ হুবহু একই।

কারণ, প্রয়োগটা যে একই।
উভয় পক্ষ কোন একজন ব্যক্তির সংস্কার ও অবদানকে অনুসরণ করে যাচ্ছে। কেউই হুবহু অনুসরণ করছে না, বেশিরভাগ গ্রহণ করছে, সামান্য কিছুর তাবিল করছে এবং বাকী অতি সামান্যর বেলায় দ্বিমত রাখছে। কিন্তু নিজ নিজ ইমামকে অত্যন্ত প্রাধান্য দিচ্ছে, সম্মান দিচ্ছে, বারবার তার উল্লেখ করছে।
সালাফিদের বেলায় সেটা ইবনু তাইমিয়া-ইবনু আবদুল ওয়াহাব, হানাফিদের বেলায় আবু হানিফা-ইমাম মুহাম্মাদ।

পুরো পার্থক্যটাই শব্দখেলার বাইরে আর কিছু নয়।
এটুকু আলোকিত হতে না পারার মধ্যেই যত গন্ডগোল নিহিত।

পঠিত : ১২৩৪ বার

মন্তব্য: ০