Alapon

❝প্রথম বিশ্বযুদ্ধ ও আধুনিক মুসলিম বিশ্বের রূপায়ন❞



প্রথম বিশ্বযুদ্ধ ও আধুনিক মুসলিম বিশ্বের রূপায়ন

গতো শতাব্দীর একেবারে শুরুর দিকে, ১৯১৪ সালে বিশ্বে এক বিরাট পালাবদলের সূচনা ঘটে। এটি ছিলো এমন এক পরিবর্তন, যা ইয়োরোপ এবং বিশেষভাবে মধ্যপ্রাচ্যে গভীর প্রভাব বিস্তার করেছিলো। চলুন জেনে আসা যাক, ১৯১৪ সালের পূর্বে পৃথিবীর সামগ্রিক পরিস্থিতি আসলে কেমন ছিলো।

এক চতুর্থাংশ স্থানের ভূমি-মালিকানা ছিলো ইংরেজদের হাতে। আমেরিকা, কেবলমাত্র বিশ্ব রাজনীতিতে পদার্পণ করেছিলো। ইয়োরোপের দেশগুলোর প্রভাবের কারণে তাদের কার্যক্রম অনেকটা ই ঢাকা পড়েছে, এরকম একটা অবস্থা। মুসলিম বিশ্ব, নানা প্রতিকূলতার মুখোমুখি হয়ে রাজনীতিতে পূর্বসময়ের মতো অতো সক্রিয়তা না থাকা সত্ত্বেও একটি তুলনামূলক শক্তিশালী খেলাফতের অধিকারী ছিলো, যা একত্রীভূত করে রেখেছিলো মুসলিম দেশগুলোকে। ইংল্যান্ড, ফ্রান্স, জার্মানি প্রভৃতি দেশ উপনিবেশ তৈরি তে মন দিলেও মুসলমানদের জন্য উসমানীয় বা অটোম্যান সাম্রাজ্য ক্ষীণ আলোকচ্ছটা রূপে “মুসলিম উম্মাহ”-র প্রতিনিধিত্ব করছিলো।

বিরাজমান সকল পরিস্থিতির ঝটিকা পরিবর্তন ঘটতে চলেছে ১৯১৪ এর পর থেকে, যা আমরা সামনের দিকে জানতে পারবো।

বিশ্লেষকগণ প্রথম বিশ্বযুদ্ধের নিয়ামক হিসেবে আর্চডিউক ফ্রান্স ফার্ডিন্যান্ড এর গুপ্তহত্যার ঘটনা কে প্রধান কারণ সাব্যস্ত করেছেন। আর্চডিউক ফ্রান্স ফার্ডিন্যান্ড, সারায়েভো তে যাকে কিছু সার্বিয়ান গ্রুপ হত্যা করেছিলো- ছিলেন অস্ট্রো হাংগেরিয়ান সাম্রাজ্যের ভাবী উত্তরাধীকার- যা ছিলো সেসময়ের বৃহৎ সাম্রাজ্যসমূহের মাঝে অন্যতম। ইয়োরোপ জুড়ে অনেকটা সময় ধরেই জাতিপ্রীতির প্রজ্বলিত মশালের শিখা ক্রমশ বৃদ্ধি পাচ্ছিলো, যা এই ঘটনাকে কেন্দ্র করে দপ করে জ্বলে ওঠে এবং মহাযুদ্ধ বা প্রথম বিশ্বযুদ্ধের সূত্রপাত ঘটে। প্রথম বিশ্বযুদ্ধ ছিল পৃথিবীর তখন পর্যন্ত ঘটে যাওয়া সর্ব বৃহৎ সামরিক যুদ্ধ। ৭০ মিলিয়ন সৈন্য রণক্ষেত্রে অংশ নিয়েছিলো, মারা যায় প্রায় ১০ মিলিয়ন সৈন্য। সেবার ই প্রথম রাসায়নিক যুদ্ধাস্ত্র আবিষ্কৃত হয় এবং তা ব্যবহার করা হয় যুদ্ধের জন্য। এরোপ্লেন থেকে বোমা, গুলিবর্ষণ করবার পন্থা ইতোপূর্বে ব্যবহৃত হয়নি।

এ যুদ্ধ চার বছরকাল স্থায়ী হয়, এবং ১৯১৮ সালের শেষের দিকে যখন যুদ্ধে শেষ হলো, দেখা গেলো যে তৎকালীন বিশ্বের শক্তিশালী চারটি সাম্রাজ্য ই তাঁদের অস্তিত্ব হারিয়েছে। এবং, সর্ব বৃহৎ সাম্রাজ্য ইংল্যান্ডের সীমানা অর্ধেকে এসে দাঁড়িয়েছে। অস্তিত্ব বিলুপ্ত হওয়া সাম্রাজ্যগুলো ছিলোঃ জার্মানি সাম্রাজ্য, যা পরবর্তীতে জার্মানী নামক ছোট একটি রাষ্ট্রের আকার লাভ করে; রাশিয়ান সাম্রাজ্য, যা রাশিয়া নামক রাষ্ট্রে পরিণত হয়; অস্ট্রো হাংগেরিয়ান সাম্রাজ্য, যা ছোট ছোট কয়েকটি দেশে বিভক্ত হয়ে পড়ে; এবং সর্বশেষ, ওসমানীয় সাম্রাজ্য, যা আমাদের আজকের আলোচনার মূল বিষয়বস্তু।

প্রথম বিশ্বযুদ্ধ! যা এমনকি একবিংশ শতাব্দীতে চলমান অনেক পরিবর্তনের জন্যও দায়ী। কিভাবে? এটি পৃথিবীকে একটি যুগের অবসান এবং নতুন যুগের আগমণী বার্তা দিয়েছিলো। কয়েক শতাব্দী ধরে চলে আসা ভিক্টোরিয়ান শাসনামলের অবসান ঘটলো এবং সূচনা হলো নব্য আধুনিক যুগের। ১৯৩০ এর দশকে এডলফ হিটলারের উত্থান প্রকৃতপক্ষে ছিলো, প্রথম বিশ্বযুদ্ধের ই একটি পরিণতি। জার্মান সাম্রাজ্যের কাঠামো ভেঙ্গে যাওয়া এবং বিশ্ব রাজনীতিতে তাঁদের ক্ষমতা হারিয়ে ফেলা, জার্মানিদের মাঝে প্রান্তিক জাতীয়তাবাদের সূচনা ঘটায়। তখন তাঁদের কাছে উগ্র স্বদেশপ্রেমী হিটলারকে ত্রাণকর্তা হিসেবে ই মনে হয়েছিলো। এসব ই ছিলো প্রথম বিশ্বযুদ্ধের প্রভাব। প্রথম দুটি বিশ্বযুদ্ধের পর সমগ্র ইয়োরোপ জুড়ে ক্ষমতার শূণ্যস্থান সৃষ্টি হলো। এ শূণ্যতা পূরণে এগিয়ে এলো কে? আমেরিকা! অর্থাৎ দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পরবর্তী সময়ে একমাত্র সুপারপাওয়ার হিসেবে পৃথিবীর কাছে আত্মপ্রকাশ করলো আমেরিকা। এবং যদি এ কথা বলা হয় যে বর্তমান সময়ের অলমোস্ট প্রত্যেকটি গুরুত্বপূর্ণ রাজনৈতিক ইস্যু আকার লাভ পেতে শুরু করেছিলো ১৯১৪ থেকে- তবে তা কিছুমাত্রও বাড়িয়ে বলা হবে না।

এখানে একটি বিষয় লক্ষণীয় যে, অস্ট্রো হাঙ্গেরীয়-রা, জার্মানির সাথে মিত্রভাবাপন্ন ছিলো। অন্যদিকে সার্বিয়রা, রাশিয়ার সাথে মৈত্রী গড়েছিলো। তাই যখন অস্ট্রো হাঙ্গেরীয় যুবরাজের গুপ্তহত্যার পর, তাঁরা সার্বিয়দের উপর আক্রমণ করতে চাইলো, দৃশ্যপটে স্বাভাবিকভাবেই রাশিয়ার আগমন হলো। এদিকে জার্মানী কি করলো? তাঁরা এ মহাসুযোগ হাতছাড়া করতে চাইলো না। তারা ফ্রান্স, সুইজারল্যান্ড, বেলজিয়াম ও নেদারল্যান্ডকে আক্রমণের পরিকল্পনা করলো। তারা এটিকে ক্ষমতা দখলের লড়াই হিসেবে দেখছিলো। আস্তে আস্তে পৃথিবীর সবগুলো পরাশক্তি এ যুদ্ধে জড়িয়ে পড়লো। প্রথম বিশ্বযুদ্ধ তখন হয়ে গেলো দু’পক্ষের যুদ্ধ। যার এক পক্ষে ছিলো ইংল্যান্ড, ফ্রান্স, রাশিয়া, ইটালি এবং একেবারে শেষের দিকে আমেরিকাও এ যুদ্ধে কিছুটা ভূমিকা রাখে। কাদের বিপক্ষে? জার্মানি এবং অস্ট্রো হাঙ্গেরীয় সাম্রাজ্য!

এখন প্রশ্ন হলো, ইয়োরোপীয়ান এ গৃহযুদ্ধে অটোম্যান সাম্রাজ্যের প্রবেশ কি করে ঘটলো? তাঁদের সেখানে আদৌ কি ভূমিকা ছিলো?! তারা কেনো ই বা প্রথম বিশ্বযুদ্ধ নিয়ে মাথা ঘামালো?

প্রথম বিশ্বযুদ্ধের সময়ে সুলতান মাহমুদ ৫ম (১৯০৯-১৯১৮) এর শাসনামল চলছিলো। দুঃখজনক হলেও সত্য যে, দেড়শোরও বেশি সময় ধরে চলে আসা ট্র্যাডিশন ‘পুতুল খলীফা’ রা তখন খেলাফতের দায়িত্বাসীন ছিলেন। তাঁদের প্রকৃতপক্ষে নিয়ন্ত্রণ করতো দরবারের আমলা মন্ত্রীরা এবং কার্যত তারাই খেলাফতের দায়িত্বের অধিকারী ছিলেন। উনবিংশ- বিংশ শতাব্দীতে অটোম্যান সাম্রাজ্যের এতোটাই ভগ্নপ্রায় অবস্থা ছিলো যে, এঁকে উপহাস করে “ইয়োরোপের রুগ্ন ব্যক্তি” নাম দেয়া হয়। প্রযুক্তিগত দিক দিয়ে পিছিয়ে থাকবার কারণে অটোম্যানদের পশ্চিমাদের প্রতি নির্ভরশীল হয়ে থাকা লাগতো। ১৮০০ সালের পূর্ব পর্যন্ত তারা ইংল্যান্ড থেকে এসকল কিছু আমদানী করতো। কিন্তু ১৮১৮ সালে ইংল্যান্ড এ সংক্রান্ত যাবতীয় সম্পর্ক ছিন্ন করে। রইলো বাকি কে? তৎকালীন দ্বিতীয় সুপারপাওয়ার জার্মানী। জার্মানী থেকে তখন যাবতীয় প্রয়োজনীয় সরঞ্জামাদি আমদানী করতো অটোম্যানরা। শুরু হলো মিত্রতার এক নয়া অধ্যায়, যা কালক্রমে শক্তিশালী হয়ে ওঠে। জার্মানির মিউনিখ শহর থেকে তুরস্কের ইস্তাম্বুল গামী ডিরেক্ট রেলযান, “অরিয়েন্ট এক্সপ্রেস”, বিভিন্ন সময়ে জার্মান কাইজারেদের সম্মানে তৈরিকৃত স্থাপনাগুলো আজও ইস্তাম্বুলের নানা শহরে শোভা পাচ্ছে- যা এ কথার সাক্ষ্য দিয়ে চলছে যুগ যুগ ধরে। “অরিয়েন্টালিজম”, জার্মানিতে ই সর্বপ্রথম এর চর্চা শুরু হয় এবং জার্মানিতে এটি বেশ জনপ্রিয় ছিলো। ফলস্বরূপ, এখনকার অরিয়েন্টালিজম সংক্রান্ত অধিকাংশ মূল ধারার বইয়ের মূল ভাষা হিসেবে জার্মানী পাওয়া যায়।

তো, সুলতান চাচ্ছিলেন এ যুদ্ধে নীরব দর্শকের ভূমিকা পালন করতে। কিন্তু গ্র্যান্ড ভাইসরয় সাঈদ পাশা, যুদ্ধমন্ত্রী এনভার পাশার সাথে শলাপরামর্শ করে জার্মানীদের সাথে একটি চুক্তি বাস্তবায়ন করেন। এ কাজটি সুলতানের পরামর্শ এবং অনুমতি ব্যতিরেকে ই করা হয়। ১৯১৪ এর আগস্টে এ চুক্তি বাস্তবায়িত হয়। পরিস্থিতি এমন পর্যায়ে গিয়ে দাঁড়ালো যে, প্রকাশ্যে এ চুক্তির কথা ঘোষণা দেয়া এবং তা মেনে নেয়া ছাড়া সুলতানের সামনে অন্য পথ খোলা রইলো না। ১৯১৪ সালের নভেম্বরে, অটোম্যান সুলতান ৫ম মাহমুদ, শেষবারের জন্য একটি জিহাদের ডাক দিলেন। শেষবারের জন্য, কেননা একজন খলীফার ই কেবল ক্ষমতা রয়েছে উম্মাহর প্রতি জিহাদের আহ্বান জানানোর এবং তিনিই ছিলেন এ কাজের জন্য আহ্বানকৃত শেষ খলীফা। যুদ্ধে অটোম্যানদের অংশ নেবার প্রকাশ্য ঘোষণা চলে আসার পর বিরোধী জোটের জন্য অটোম্যান সাম্রাজ্য আক্রমণ কেবল একটি সময়ের ব্যাপার ছিলো এবং হলো ও তাই।

কিছু মাস পরেই, ১৯১৫ সালের এপ্রিলে ইংল্যান্ড ও ফ্রান্স একযোগে ইস্তাম্বুল জয় করবার উদ্দেশ্যে আক্রমণ চালায়। ইতিহাসে এ ঘটনা “ গালিপোলি ক্যাম্পেইন” নামে পরিচিত। দার্দানেলিস প্রণালীর অধিকার নিজেদের করে নেয়া তাঁদের জন্য খুব ই গুরুত্বপূর্ণ ছিলো। কেন? কারণ, যদি এ প্রণালী করায়ত্ত করা সম্ভব হয়, তাহলে “মারমারা সাগর”, ইস্তাম্বুল হয়ে তারা কৃষ্ণ সাগর অবধি পৌঁছাতে পারবে, যা তাঁদের জন্য রাশিয়ায় প্রবেশের দুয়ার খুলে দিবে। তাই তারা রাশিয়ান নেভির নিয়ন্ত্রণ পাবার জন্য এ জায়গাগুলো নিজেদের অধিকারে নিতে মরিয়া হয়ে উঠেছিলো। অবশ্য এ সম্মিলিত আক্রমণ তাঁদের জন্য বয়ে এনেছিলো বিরাট পরাজয়। প্রায় ১ লাখ পঞ্চাশ হাজার সৈন্য প্রাণ হারায়। এটাই ছিলো সে যুদ্ধ, সেই “গালিপোলি” অ্যাটাক! যে যুদ্ধে বীরত্ব প্রদর্শন করে জনমানুষের কাছে নায়ক বনে যান এবং পদোন্নতি ঘটে আধুনিক তুরস্কের প্রতিষ্ঠাতা মোস্তফা কামালের, যাকে বলা হয় “আতাতুর্ক”। দুঃখজনক হলেও সত্য যে, গালিপোলির এ বিজয় ই প্রথম বিশ্বযুদ্ধে অটোম্যান সাম্রাজ্যের সেনাবাহিনী কর্তৃক প্রাপ্ত একমাত্র জয়।

১৯১৫ সালে ব্রিটিশ বাহিনী ইরাক আক্রমণ করে। এবং ১৯১৭ এর মার্চের মাঝেই তারা পৌঁছে যায় আব্বাসী খেলাফতের রাজধানী বাগদাদে। পৌঁছে ই ইংরেজেরা অটোম্যান পতাকা ভূলুন্ঠিত করে, সেস্থানে উড়িয়ে দেয় ব্রিটিশ পতাকা।

অন্যদিকে, ব্রিটিশ প্রধানমন্ত্রী দ্বারা নিয়োগপ্রাপ্ত জেনারেল, জেনারেল অ্যালেনবি; যাকে প্রধানমন্ত্রী ক্রিসমাসের পূর্বে জেরুসালেম জয় করবার দায়িত্ব অর্পণ করেছিলেন; যুদ্ধ কৌশলে নানাবিধ পরিবর্তন প্রণয়ন করেন। তার এ কৌশলগুলোর মাঝে সর্বাধিক সাড়া ফেলেছিলো টি.ই.লরেন্সের নিযুক্তি। ইতিহাসে যে, “লরেন্স অফ এরাবিয়া” নামে ই সমধিক প্রসিদ্ধি লাভ করেছিলো। তার কাজের নামকরণ করতে চাইলে তাকে ‘ব্রিটিশ গোয়েন্দা’ বলা যেতে পারে। ব্রিটিশরা তাকে মাসিক দুই লক্ষ পাউন্ড ভাতা প্রদান করতো। আমাদের সময়েই এটা বেশ ভাগ্যের ব্যাপার। তাহলে একশো বছর আগের সেসময়ের কথা ভেবে দেখুন! এত টাকা তাকে কেন দেয়া হতো? সবচেয়ে সহজ ভাবে বললে, আরবীয়দের প্ররোচিত করতে, যেনো তারা অটোম্যানদের সাথে যুদ্ধে লিপ্ত হয়। তাঁদের মাঝে ভাঙ্গন সৃষ্টি করা ই ছিলো তার মূল কাজ। অর্থাৎ, গৃহযুদ্ধ বাঁধিয়ে দেবার মতো পরিস্থিতি সৃষ্টির জন্যই তাকে অর্থ দেয়া হতো।

জেনারেল অ্যালেনবি স্বয়ং এগিয়ে চলেছেন গাজা, জাফা হয়ে জেরুসালেমের দিকে। ৯ ডিসেম্বর, ১৯১৭ তে জার্মান ও অটোম্যান সৈন্যদের পর্যুদস্ত করে তিনি বাইতুল মুকাদ্দাস নিজেদের অধিকারে নিয়ে নেন এবং এ জয় ছিলো ব্রিটিশ প্রধানমন্ত্রীর ক্রিসমাস গিফট! মুসলিমদের জন্য এ মূহুর্তটি ছিলো বেদনাদায়ক এক অধ্যায়।

অক্টোবর,১৯১৮! সিরিয়ায় ব্রিটিশদের আগমন ঘটে এবং তারা এক সময়ের উমাইয়্যা খেলাফতের রাজধানী দামেস্ক দখল করে নেয়। এরপর অন্য স্থান গুলো দখল ছিলো সময়ের ব্যাপার। যার বাস্তবায়ন ঘটে নভেম্বর ১৩, ১৯১৮ তে ইস্তাম্বুল দখল করে নেবার পর। ইসলামি খেলাফতের তিনটি রাজধানী শহর একে একে শত্রুর পতাকাতলে চলে যাওয়া- আমার কাছে মনে হয়, একজন মুসলিম হিসেবে এর চাইতে লজ্জাজনক আর কোন অধ্যায় আমাদের জন্য কোনদিন রচিত হয়নি। এর চাইতেও বেশি ভয়াবহ বিপর্যয় কেবল একটি ই হতে পারে, তা হলো মঙ্গোলদের আক্রমণ।

একের পর এক আক্রমণে দিশেহারা হয়ে জার্মানি শেষাবধি আত্মসমর্পণের সিদ্ধান্ত গ্রহণ করে। এখন আমরা আলোচনা করবো তিনটি প্রাথমিক চুক্তি নিয়ে, যা প্রথম বিশ্বযুদ্ধ চলাকালীন ইংরেজেরা সম্পাদন করেছিলো।

প্রথমত, আরবদের প্রতি দেয়া প্রতিশ্রুতি। জুলাই ১৯১৫তে মিসরের ব্রিটিশ হাইকমিশনার স্যার হেনরি ম্যাকমাহান মক্কার শরীফ, শরীফ হুসেইন ইবনু আলীর সাথে পত্রবিনিময়ের মাধ্যমে যোগাযোগ শুরু করেন। শরীফ হুসেইন ইবনু আলি ছিলেন, রাসূল(সাঃ) এর ৪০তম উত্তরপুরুষ। আরবদের কাছে তারা অনেক বেশি সম্মানিত ছিলেন এবং মক্কায় ৭০০ বছরেরও বেশি সময় ধরে কর্তৃত্ব স্থানীয় হয়ে রয়েছে তাঁদের পরিবার। একমাত্র পুরুষ, যিনি অটোম্যান সাম্রাজ্যের জন্য হুমকি হতে পারেন। তাই চতুর এই হাইকমিশনার তাঁদের “বিভক্ত করো এবং জয় করো” নীতি বাস্তবায়নের জন্য তাকেই বেছে নিলেন। কেননা মুসলিমদের কাছে খলীফার পরিবর্তে নেতা হিসেবে তার ই সর্বাধিক গ্রহণযোগ্যতা ছিলো। এ ষড়যন্ত্রের বাস্তবায়ন করতে ম্যাকমাহান ঘন ঘন পত্রালাপে শরীফ হুসেইনের সাথে যোগাযোগ রাখতে লাগলেন। অন্যদিকে, টি ই লরেন্স তাঁদের ঘনিষ্ঠ পারিবারিক বন্ধু হয়ে পরিবারের সিদ্ধান্তসমূহে প্রভাব বিস্তার করার ক্ষমতা লাভ করলেন।

এখন, আপনাকে এ বিষয়ে বুঝতে হবে যে, কেউ “আহলুল বাইত” হলেই তার মানে এই নয় যে সে ফেরেশতা এবং তার দ্বারা কোন ভুল, ত্রুটি হতে ই পারে না। প্রকৃত কথা হচ্ছে এই ই যে, শরীফ হুসেইনের নিজস্ব দীর্ঘকালীন অভিলাষ ছিলো যে তিনি খলীফা হবেন। তিনি সর্বদা এ স্বপ্ন লালন করতেন। এবং এমনকি প্রথম বিশ্বযুদ্ধের পূর্বেও ইংরেজদের কাছে প্রেরিত পত্রের মাধ্যমে এ কথা জানা যায় যে তিনি অটোম্যানদের বিরুদ্ধে যেকোন সাহায্য করতে প্রস্তুত আছেন। তখন ব্রিটিশদের এ নিয়ে কোন কাজ না থাকায় তারা তাঁর পত্রের প্রতি কর্ণপাত ও করে নি। কিন্তু যখন ই তাঁদের প্রয়োজন হলো, সুযোগ হাতছাড়া না করে তারা তাকে আশ্বাস দিলো, আপনি আপনার মুসলিম ভাইদের বিরুদ্ধে বিদ্রোহ করুন। তাঁদের সাথে বেঈমানী করুন। যদি এ অভ্যুত্থান সফল হয়, আপনি ই হবেন পরবর্তী খলীফা! ব্রিটিশরা, খাঁটি বাংলায় বলতে গেলে শরীফ হুসেইন কে ঘুষ দিয়েছিলো। অর্থসম্পদের ঘুষ না, বরং এ ছিলো ক্ষমতার প্রলোভন, যা মানুষের কাছে সবচাইতে বেশি পছন্দনীয়। তারা তাকে এক “আরব রাষ্ট্র” গঠনের স্বপ্ন দেখিয়েছিলো, যার একচ্ছত্র অধিপতি হবেন তিনি। দামেস্ক, সিরিয়া, বাগদাদ, জর্ডান, লেবানন এবং মধ্যবর্তী সমস্ত অঞ্চল নিয়ে গঠিত আরব রাষ্ট্র। আমরা হয়তো ব্রিটিশদের চাতুর্যে ভীষণ রকম উষ্মা দেখাচ্ছি এখন, তাঁদের মন থেকে ঘৃণা করছি, কিন্তু নির্মম সত্য তো এটাই যে, তারা আমাদেরকে আমাদের বিরুদ্ধে ই ব্যবহার করেছে।


এ সমস্ত মিথ্যে প্রলোভনে, মিষ্টি কথায় ভুলে শরীফ হুসেইন ইবনু আলী, অটোম্যানদের বিরুদ্ধে বিদ্রোহ সংগঠিত করে। পুরো সময়টাতে আরবদের ব্রিটিশরা দিকনির্দেশনা দেয়, তুর্কীদের বিরুদ্ধে কোথায় কি করতে হবে। আরবীয়রা সেনাবহরে বৃহৎ না হলেও তারা সড়কপথ, রেলপথ গুলো ধ্বংস করে দিচ্ছিলো। ফলে, অটোম্যান সৈন্যদের চলাচল, আসা-যাওয়া বন্ধ হয়ে যাবার উপক্রম হয়।

টি.ই.লরেন্স কে ইতিহাসের সর্বত্র ই আরবীয়দের স্বাধীনতা পুনরুদ্ধারে সোচ্চার একজন ইংরেজ হিসেবে বেশ মহান নায়ক রূপে দেখানো হয়ে থাকে। কিন্তু আমরা কখনোই এ ইতিহাস ভুলে যেতে পারি না যে সে ছিলো একজন ব্রিটিশ গুপ্তচর! এমনকি, ইংরেজদের অন্য দুটো চুক্তি সম্বন্ধে অবগত হবার পরেও সে আরবদের তা জানায় নি। তাদের সামনে পূর্বের মূল্যহীন চুক্তি বহাল রাখবার কথা বলে গিয়েছে দিন রাত!

(প্রথম পর্ব)

মূলঃ ড ইয়াসির ক্বাদি
অনুবাদঃ সাবিহা সাবা

পঠিত : ৪৬৭ বার

মন্তব্য: ০