Alapon

উহুদের ভয়াবহতা ও মুসলিমদের দৃঢ় অবস্থান



মুনাফিক ও দুর্বল মানসিকতার মুসলিমরা ফিরে যাওয়ার পর রাসূল সা. সামনে অগ্রসর হয়ে উহুদ পাহাড়ের পাদদেশে পৌঁছে সেখানেই তাঁবু স্থাপন করলেন। সামনে ছিলো মদিনা আর পেছনে ছিলো উহুদের উঁচু পাহাড়। মুশরিক বাহিনী তখন মুসলমান এবং মদিনার মাঝামাঝি অবস্থান করছিলো।

এখানে পৌঁছে নবী সা. সৈন্যদের বিন্যস্ত ও সংগঠিত করলেন। তিনি সৈন্যদের কয়েকটি সারিতে বিভক্ত করলেন। তীরন্দাজদের একটি বাহিনী গঠন করলেন। এদের সংখ্যা ছিলো পঞ্চাশ। হযরত আবদুল্লাহ ইবনে জুবায়ের রা.-কে এই বাহিনীর নেতৃত্ব দেওয়া হলো। রাসূল সা. তাকে দক্ষিণ দিকে অবস্থিত একটি গিরিপথে নিযুক্ত করে বললেন, ঘোড়সওয়ার শত্রুদেরকে তীর বর্ষণ করে তাড়িয়ে দিও। যুদ্ধে আমরা জয়লাভ করি আর পরাজিত হই কোন অবস্থায়ই কাউকে পেছন দিক থেকে আসতে দেবে না। দৃঢ়ভাবে নিজ অবস্থানে দাঁড়িয়ে থেকো, যেন তোমার দিক থেকে আমরা আক্রান্ত না হই। এই গিরিপথ মুসলিম বাহিনীর অবস্থান থেকে দেড়শত মিটার দক্ষিণ পূর্ব দিকে অবস্থিত ছিলো।

রাসূল সা. আরো বলেছিলেন, যদি তোমরা দেখো যে, আমাদেরকে চড়ুই পাখি ঠোকরাচ্ছে তবুও জায়গা ছাড়বে না- যদি আমি ডেকে না পাঠাই। যদি তোমরা দেখো যে, আমরা শত্রুদের পরাজিত করছি এবং এক সময়ে তাদের নিশ্চিহ্ন করে দিয়েছি, তবু নিজের জায়গা ছাড়বে না- যদি আমি ডেকে না পাঠাই। এমনি কঠোর সামরিক নির্দেশসহ রাসূল সা. তীরন্দাজ সৈন্যদের নিযুক্ত করে গিরিপথ বন্ধ করে দিয়েছিলেন। কারণ সেই পথের বিপরীত থেকে এসে শত্রুরা মুসলমানদের ওপর সহজেই হামলা করতে সক্ষম হতো। সৈন্যবাহিনী বিন্যস্ত ও দায়িত্ব বুঝিয়ে দেওয়ার পর মুহাম্মদ সা. জ্বালাময়ী ভাষণ দিয়ে সাহাবাদের উদ্দীপ্ত করলেন।

যুদ্ধ শুরুর প্রাক্কালে মুশরিকরা মুসলিম সেন্যদের মধ্যে ভাঙ্গন এবং পারস্পারিক কলহ সৃষ্টির চেষ্টা করলো। আবু সুফিয়ান আনসারদের কাছে খবর পাঠালো যে, আপনারা যদি আমাদের এবং আমাদের চাচাতো ভাই মুহাম্মদের মাঝখান থেকে সরে যান, তবে আমরা আপনাদের প্রতি হামলা করবো না। কেননা আপনাদের সাথে লড়াই করার কোন প্রয়োজন আমাদের নেই। মদিনাবাসীরা মুহাম্মদকে আশ্রয় দেওয়ার পর কী কী অসুবিধা ও বিপদে পড়েছে তা বলে তাদেরকে মুহাম্মদ সা. থেকে পৃথক করতে চাইলো আবু সুফিয়ান। কিন্তু ঈমানের বলে সমৃদ্ধ আনসাররা আবু সুফিয়ানকে রূঢ়ভাবে ফিরিয়ে দিলো।

এরপর উভয় দল মুখোমুখি এসে দাঁড়ালো এবং যুদ্ধ শুরু হয়ে গেলো। মুশরিকদের পক্ষ থেকে তালহা ইবনে আবু তালহা সামনে এগিয়ে এলো। এক লোকটি তাদের মধ্যে শ্রেষ্ঠ বীর হিসাবে পরিগণিত ছিলো। উঠের পিঠে সওয়ার হয়ে তালহা তার সাথে মুকাবিলার জন্যে আহ্বান জানালো। হযরত জুবায়ের রা. সামনে অগ্রসর হয়ে চোখের পলকে বাঘের মত তালহার উটের ওপর লাফিয়ে উঠলেন। পরক্ষণেই তালহাকে নিজের কাবুতে এনে নীচে ঝাঁপিয়ে পড়লেন। তালহাও নীচে পড়ে গেলো। হযরত জুবায়ের রা. তলোয়ার বের করে তালহাকে জবাই করে দিলেন। মুহাম্মদ সা. ও সাহাবারা তাকবির ধ্বনি দিয়ে উচ্ছ্বাস প্রকাশ করলেন।

এরপর চারদিকে যুদ্ধের দাবানল ছড়িয়ে পড়লো। সমগ্র ময়দানে চললো এলোপাতাড়ি হামলা, জবাবি হামলা। মুশরিকদের পতাকা রণক্ষেত্রের মাঝামাঝি জায়গায় ছিলো। বনু আবদুদ দার তাদের কমান্ডার তালহা ইবনে আবু তালহার হত্যাকান্ডের পর নিজেদের মধ্যে পর্যায়ক্রমে পতাকা বহন করছিলো। কিন্তু তারা একে একে সবাই নিহত হলো।

বনু আবদুদ দার গোত্রের দশ ব্যক্তি যারা মুশরিকদের পতাকা হাতে তুলেছিলো তারা সবাই একে একে মারা গেলো। এরপর পতাকা তোলার মতো কেউ জীবিত রইলো না। সেই সময় মওয়াব নামে তাদের এক ক্রীতদাস পতাকা তুলে নিয়ে তার পূবর্বর্তী পতাকাবাহী মনিবদের চেয়ে অধিক বীরত্বের সাথে যুদ্ধ করে। শেষ পর্যন্ত সেও মৃত্যুবরণ করে। মওয়াব নিহত হওয়ার পর পতাকা মাটিতে পড়ে যায় এবং ওটা ওঠাতে পারে, এমন কেউ বেঁচে ছিলো না। এ কারণে পতাকা মাটিতেই পড়ে রইল।

এদিকে আল্লাহর রাসূল সা. থেকে তলোয়ার পাওয়া আবু দুজানা রা. অসম বীরত্বের সাথে যুদ্ধ করে সেই তলোয়ারের হক আদায় করে চলেছেন। তিনি কাতারের পর কাতার ছিন্ন ভিন্ন করে সামনে এগিয়ে গেলেন। এক সময় মুশরিকদের তাঁবুর কাছে নারীদের সামনে গিয়ে পৌঁছুলেন। তিনি জানতেন না যে, ওরা নারী। তিনি বলেছেন, আমি দেখলাম একজন লোক যোদ্ধাদের আরো বেশী সাহসিকতার পরিচয় দেয়ার জন্যে উদ্বুদ্ধ করছে। আমি তাকে নিশানা করলাম। কিন্তু তলোয়ার দিয়ে হামলা করতে চাইলে সে মরণ চিৎকার দিয়ে উঠলো। এই চিৎকার শুনে হযরত আবু দোজানা রা. বুঝলেন যে, সে মহিলা। তিনি বলেন, আমি ভাবলাম, রাসূল সা.-এর তলোয়ার দিয়ে কোন মহিলাকে হত্যা করে এই তলোয়ার কলঙ্কিত করবো না। এই মহিলা ছিলো হিন্দা বিনতে উতবা। আবু সুফিয়ানের স্ত্রী।

এদিকে রাসূল সা.-এর চাচা হযরত হামজা রা. বরাবরের মতো ত্রাস সৃষ্টি করে যাচ্ছিলেন। তিনি গত যুদ্ধেও সবচেয়ে ভালো ভূমিকা রেখেছিলেন। তাই তাকে আটকানোর জন্য মুশরিকদের ভালো পরিকল্পনা ছিলো। কিন্তু তাদের সব পরিকল্পনা উড়ে গেলো হামজা রা.-এর অসম বীরত্ব ও সাহসিকতার কাছে। তিনি শত্রুদের সারি ভেদ করে সামনের দিকে এগিয়ে যাচ্ছিলেন। তাঁর সামনে বড় বড় বীর বাহাদুর উড়ে যাচ্ছিল। অবশেষে তার সামনে সরাসরি মুকাবিলা না করে ওয়াহশী দূর থেকে বর্শা নিক্ষেপ করে হামজা রা.-এর দিকে। বর্শা বিদ্ধ হয়ে লুটিয়ে পড়েন হামজা রা.।

শহীদ হামযা রা.-এর আততায়ীর নাম ছিলো ওয়াহশী ইবনে হারব। তিনি পরে মুসলিম হয়েছিলেন। মুসলমান হবার পর তিনি বলেন, আমি ছিলাম জুবায়ের ইবনে মোয়াত্তামের ক্রীতদাস। তার চাচা তুয়াইমা ইবনে আদী বদরের যুদ্ধে নিহত হয়েছিলেন। কুরাইশরা উহুদ যুদ্ধে রওয়ানা হওয়ার প্রাক্কালে যুবায়ের ইবনে মোয়াত্তাম আমাকে বললেন, যদি তুমি মুহাম্মদের চাচা হামজাকে আমার চাচার হত্যার প্রতিশোধস্বরূপ হত্যা করতে পারো, তবে তুমি মুক্তি পাবে। এই প্রস্তাব পাওয়ার পর মুশরিকদের সাথে উহুদের যুদ্ধের জন্যে আমি রওয়ানা হলাম। আমার নিক্ষিপ্ত বর্শা কম সময়েই লক্ষ্যভ্রষ্ট হতো। ব্যাপকভাবে যুদ্ধ ছড়িয়ে পড়ার পর আমি হামযা রা.-কে খুঁজতে শুরু করলাম। এক সময় তাঁকে দেখতেও পেলাম। তিনি জেদী উটের মতো সামনের লোকদের ছিন্নভিন্ন করতে করতে এগিয়ে যাচ্ছিলেন। তাঁর সামনে কোন বাধাই টিকতে পারছিলো না। কেউ তাঁর সামনে দাঁড়াতেই পারছিলো না।

আমি তখন বর্শা তুলে হযরত হামযা রা.-এর প্রতি নিক্ষেপ করলাম। বর্শা পেটে বিদ্ধ হয়ে দুই পায়ের মাঝখান দিয়ে পেছনে পৌছে গেলো। তিনি পড়ে গিয়ে উঠতে চাইলেন কিন্তু সক্ষম হননি। তাঁর শেষ নিঃশ্বাস ত্যাগ করা পর্যন্ত আমি তাকে যন্ত্রণাকাতর অবস্থায় রেখে দিলাম। এক সময় তিনি শেষে নিঃশ্বাস ত্যাগ করলেন। আমি যখন তাঁর কাছে গিয়ে বর্শা বের করে কুরাইশদের মধ্যে গিয়ে বসে রইলাম। হযরত হামজা রা. ছাড়া অন্য কাউকে আঘাত করার ইচ্ছা ও প্রয়োজনই আমার ছিলো না। আমি মুক্তি পাওয়ার জন্যেই হযরত হামজা রা.-কে হত্যা করেছি। এরপর মক্কা ফিরে এসেই আমি মুক্তি লাভ করলাম।

শহীদ হামজা রা.-এর শাহদাত কয়েক মুহূর্তের জন্য উহুদের ময়দানকে থমকে দিয়েছিলো। মনে হলো এক বিশাল পাহাড় ভূপাতিত হলো। সাহাবাদের বজ্রকঠিন হাতগুলো শিথিল হয়ে পড়লো। কিন্তু তা কয়েক সেকেন্ডের জন্য। এই শাহদাতের প্রতিক্রিয়ায় আবু বকর, উমার, আলী, জুবায়ের, মসআব ইবনে উমায়ের, তালহা ইবনে ওবায়দুল্লাহ, আবদুল্লাহ ইবনে জাহাশ, সা’দ ইবনে মায়া’য, সা’দ ইবনে ওবাদা, সা’দ ইবনে রবি, নযর ইবনে আনাস প্রমুখ সাহাবী রা. এমন কঠিন আঘাত হানলেন যে, মুশরিকরা হতবাক হয়ে গেল। তারা আর যুদ্ধ করার মতো অবস্থায় ছিল না। পিছু হটতে শুরু করলো। সাহাবারা তাদের ধাওয়া দিতে থাকেন।

মাত্র ৭০০ জন যোদ্ধা মুশরিকদের ৩০০০ জন যোদ্ধার ওপর বিজয়ী হওয়ার সময় তীরন্দাজদের অধিকাংশ ব্যক্তি এক ভয়াবহ ভুল করে ফেললেন। অথচ মুসলমানদের সাফল্য এই যুদ্ধে বদরের যুদ্ধের চেয়ে কোন অংশে কম ছিলো না। কিন্তু তীরন্দাজদের এক ভয়াবহ ভুলে যুদ্ধের চিত্রই পরিবর্তিত হয়ে গেলো। মুসলমানরা মারাত্মক ক্ষতির সন্মুখীন হলেন। এই ভুলের কারণে বদরের যুদ্ধে অর্জিত মুসলমানদের ভাবমূর্তি ক্ষুন্ন হয়ে পড়েছিলো।

ইতিপূর্বে উল্লেখ করা হয়েছে যে, নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বিজয় ও পরাজয় উভয় অবস্থাতেই তীরন্দাজদের স্বস্থানে অটল ও অবিচল থাকার নির্দেশ দিয়েছিলেন। কিন্তু প্রিয় নবী সা.-এর নির্দেশ থাকার পরেও অন্য মুসলমানদের গনীমতের মালামাল সংগ্রহ করতে দেখে তীরন্দাজরা লোভ সামলাতে পারলো না। এক অন্যকে বললেন, গনীমত, গনীমত। তোমাদের সঙ্গীরা জয়ী হয়েছে, এখন আর কিসের প্রতীক্ষা।

তীরন্দাজদের মধ্যে থেকে এ ধরনের আওয়ায ওঠার পর তাদের কমান্ডার হযরত আবদুল্লাহ ইবনে জুবায়ের (রা.) তাদেরকে রসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের নির্দেশ ষ্মরণ করিয়ে দিয়ে বললেন, তোমরা কি ভুলে গেছো, রসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম তোমাদের কি আদেশ দিয়েছেন? কিন্তু অধিকাংশ তীরন্দাজ হযরত আবদুল্লাহ রা.-এর কথার প্রতি ভ্রুক্ষেপ করলেন না। তারা বললেন, আল্লাহর শপথ, আমরাও ওদের কাছে যাবো এবং কিছু গনীমতের কিছু মাল অবশ্যই করবো।

এরপর চল্লিশজন তীরন্দাজ নিজেদের দায়িত্ব উপেক্ষা করে গনীমতের মাল সংগ্রহ শুরু করলেন। আর হযরত আবদুল্লাহ ইবনে জাবের (রা.) এবং তাঁর নয়জন সঙ্গী পাহারায়ই নিযুক্ত রইলেন। তাঁরা দৃঢ় সংকল্পের সাথে দায়িত্ব পালন করছিলেন। তাঁরা বলছিলেন, এখান থেকে যাওয়ার জন্যে যদি নবী রসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেন, তখনই যাবো অথবা নিজেদের প্রাণ উৎসর্গ করবো।

খালিদ বিন ওয়ালিদ ছিল মুশরিকদের ঘোড়সওয়ারদের নেতা। তিনি শুরু থেকেই মুসলিম তীরন্দাজদের কবলে পড়ে যুদ্ধে ভালো করতে পারছিলেন না। তীরন্দাজরা তাকে ও তার বাহিনীকে এক প্রকার অবরুদ্ধ করে রেখেছিলো। তা সে যুদ্ধ থেকে পিছু হটে পাহাড় ঘুরে গিরিপথ ধরে আক্রমণের পরিকল্পনা করেছিলো। আর যে জন্য মুহাম্মদ সা. সেখানে ৫০ জনকে নিযুক্ত করেছিলেন।

খালেদ ইবনে ওয়ালিদ এই গিরিপথে এসে তিনবার ব্যর্থ হয়ে ফিরে গিয়েছিলো। এবার এ সুবর্ণ সুযোগ সে হাতছাড়া করলো না। অল্পক্ষণের মধ্যে খালেদ আবদুল্লাহ ইবনে জুবায়ের রা. এবং তাঁর সঙ্গীদের নিহত করে মুসলমানদের ওপর পেছনের দিক থেকে হামলা করলো। মুশরকরা উচ্চস্বরে শ্লোগান দিয়ে পলায়নপর সৈন্যদের আবারো মাঠে ফিরিয়ে নিয়ে আসলো। কাফেররা যুদ্ধক্ষেত্রের পরিবর্তিত পরিস্থিতি সম্পর্কে অবহিত হলো এবং মুসলমানদের ওপর পুনোরোদ্যামে হামলা চালালো। এদিকে বনু হারেস গোত্রের আসরাহ বিনতে আকলামা নামের এক মহিলা কাফেরদের ধুলি ধুসরিত পতাকা উচ্চে তুলে ধরলো। ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কাফেররা তার চারদিকে জড়ো হতে শুরু করলো। একে অন্যকে ডাকতে থাকলো। ফলে অল্পক্ষণের মধ্যেই কাফেররা মুসলমানদের বিরুদ্ধে ঐক্যবদ্ধ লড়াই শুরু করলো। মুসলমানরা তখন সামনে পেছনে উভয় দিক থেকেই ঘেরাও-এর মধ্যে পড়ে গেলো। মনে হয় যেন, যাঁতাকলের মাঝখানে তাদের অবস্থান।

মুশরিকদের ঘেরাও-এর মধ্যে পড়ে যাওয়ার পর একদল মুসলমান কিংকর্তব্যবিমূঢ় হয়ে পড়লো। নিজের জীবন রক্ষার চিন্তাও তাদের মাঝে বড় হয়ে দেখা দিলো। ফলে তারা রণক্ষেত্র থেকে পলায়নের পথ ধরলো। পেছনে কি হচ্ছে, সে সম্পর্কে তারা কিছু জানতো না। এদের মধ্যেকার কয়েকজন মদীনায় গিয়ে উঠলেন, কয়েকজন পাহাড়ের ওপরে আশ্রয় নিলেন। অন্য একদল পেছনের দিকে গিয়ে কাফেরদের সাথে মিশে গেলেন। কে যে কাফের আর কে যে মুসলমান সেটা চিহ্নিত করা যাচ্ছিলো না। এর ফলে মুসলমানদের হাতে মুসলমানরা আক্রান্ত হতে লাগলো।

মুশরিকরা গুজব ছড়িয়ে দিন, মুহাম্মাদকে আমরা খুন করে ফেলেছি। এতে একদল সাহাবি হতাশ হয়ে গেলেন। তারা যুদ্ধ ছেড়ে পাহাড়ের ওপর বসে রইলেন। কিছু জানবাজ সাহাবী তাদের উৎসাহ দিয়ে বললেন, যদি মুহাম্মদ সা. নিহতও হন তবে তিনি আমাদের কাছে দ্বীন পৌঁছে দিয়েছেন। এই দ্বীন রক্ষার জন্য আমাদের এখন লড়াই প্রয়োজন। এ ধরনের সাহস প্রদান এবং উদ্দীপনাময় কথায় হতাশ সাহাবারা চাঙ্গা হয়ে উঠলেন। তারা অস্ত্র ফেলে দেয়া এবং মোনাফেক নেতা আবদুল্লাহ ইবনে উবাইয়ের মধ্যস্থতায় কাফের আবু সুফিয়ানের কাছ থেকে নিরাপত্তার নিশ্চয়তার চাওয়ার পরিবর্তে অস্ত্র তুলে নিলেন। এরপর কাফেরদের দুর্ভেদ্য ঘেরাও ভেদ করে নিজেদের কেন্দ্রীয় নেতৃত্বে পোছে যাওয়ার পথ তৈরীর চেষ্টা করতে লাগলেন। এমন সময় খবর শোনা যে, রসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের হত্যাকান্ডের খবর একটি গুজব। এতে মুসলমানদের সাহস ও মনোবল বহুগুণ বেড়ে যায় এবং তারা দুর্ধর্ষ লড়াইয়ের মাধ্যমে কাফেরদের বেষ্টনী ভেদ করে নিজেদের মূল দলের কাছে পৌঁছে যেতে সক্ষম হয়।

সাহাবাদের তৃতীয় একটি দল একমাত্র মুহাম্মদ সা.-এর নিরাপত্তার কথা ভাবছিলেন। এরা কাফেরদের বেষ্টনীর খবর পাওয়ার পরই নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের দিকে ছুটে গেলেন। এসকল সাহাবার মধ্যে ছিলেন আবু বকর রা., উমার রা., আলী রা. প্রমুখ। যুদ্ধক্ষেত্রেও এরা ছিলেন প্রথম সারিতে, কিন্তু নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের জীবনাশঙ্কা দেখা দেয়ায় তাঁরা তাঁর হিফাজতের জন্যে তাঁর কাছে ছুটে এলেন।

অল্প কিছু সাহাবা রাসূলের পাশে ছিলেন। তারা মানবঢাল তৈরি করে মুহাম্মদ সা.-কে কাফেরদের হাত থেকে রক্ষা করে চলেছিলেন। সেই সময়ে উতবা ইবনে আবু ওয়াক্কাস রাসূল সা.-কে পাথর নিক্ষেপ করেছিলো। সেই আঘাতে রাসূল সা. মাটিতে পড়ে গিয়েছিলেন। তাঁর কিছু দাঁত ভেঙ্গে ও মুখ থেতলে গিয়ে তিনি রক্তাক্ত হয়ে গিয়েছিলেন। সন্ত্রাসী ইবনে কামআহ তরবারী তুলে প্রিয় নবীকে দ্বিতীয়বার আঘাত করলো। এ আঘাত ডান চোখের নীচের হাড়ে লাগলো। আঘাতের ফলে শিরনাস্ত্র ভেঙ্গে প্রিয় নবীর মুখে বিঁধে গিয়েছিল।

নিঃসন্দেহে মুশরিকরা প্রিয় নবী সা.-কে প্রাণে মেরে ফেলতে চেয়েছিলো। কিন্তু তালহা রা. এবং সা’দ ইবনে আবু ওয়াক্কাস রা. তুলনাবিহীন আত্মত্যাগ, অসাধারণ বীরত্ব ও সাহসিকতার মাধ্যমে তাদের প্রচেষ্ঠা ব্যর্থ করে দিয়েছিলেন। এরা উভয়ে ছিলেন আরবের সুদক্ষ তীরন্দাজ। তারা কার্যকর তীর নিক্ষেপ করে করে মুশরিকদের প্রিয় নবী সা.-এর কাছ থেকে দূরে সরিয়ে দিয়েছেন।

আয়েশা রা. বলেন, আবু বকর সিদ্দিক রা. উহুদের যুদ্ধের প্রসঙ্গে আলোচনার সময়ে বলতেন, সেদিনের যুদ্ধের একক কৃতিত্ব ছিলো তালহার। সেই কঠিন মুহূর্তে আল্লাহ তায়ালা সাহায্য প্রেরণ করেছেন। সা’দ রা. বলেন, আমি উহুদের দিনে লক্ষ্য করেছি, রাসূল সা.-এর কাছে সাদা পোশাক পরিহিত দু’জন লোক। তারা রাসূল সা.-কে নিরাপত্তা দিচ্ছিলেন। এর আগে বা পরে সেই দুইজন লোককে আমি কখনো দেখিনি। অপর এক বর্ণনায় রয়েছে, ওরা দু’জন ছিলেন জিবরাঈল আ. ও মিকাইল আ.।

মুসলিমরা মুহূর্তেই সামলে নিল। আবু বকর রা. মহানবীর কাছে পোঁছে গেলেন। আবু বকর রা.-কে দেখে মুহাম্মদ সা. বললেন, তোমাদের ভাই তালহাকে সামলাও। সে নিজের জন্যে জান্নাত ওয়াজিব করে নিয়েছে। হযরত আবু বকর রা. বলেন, এরপর আমরা হযরত তালহা রা.-এর প্রতি মনোনিবেশ করলাম। তার দেহে আশিটির বেশী আঘাত লেগেছিলো। তালহা রা. সেদিন কীরূপ বীরত্ব, আত্মত্যাগ ও সাহসিকতার সাথে লড়াই করেছিলেন তা এতেই বোঝা যায়।

সেই সঙ্কটময় মুহূর্তে রসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের কাছে নিবেদিত প্রাণ সাহাবাদের আরো একটি দল এসে পৌঁছুলো। তারা হলেন, আবু দোজানা, মুসআব ইবনে উমায়ের, আলী ইবনে আবু তালেব, সহল ইবনে হুনাইফ, মালেক ইবনে সানান (হযরত আবু সাঈদ খুদরী (র.)-এর পিতা), উম্মে আম্মারা নুসাইবা বিনতে কা’ব মাজেনা, কাতাদা ইবনে নো’মান, ওমর ইবনে খাত্তাব, হাতেব ইবনে আবু বলতায়া এবং আবু তালহা।

এদিকে মুশরিকরাও মুহাম্মদ সা.-কে হত্যা করার সুযোগ হাতছাড়া করতে চাইলো না। পুরো যুদ্ধ এখন মুহাম্মদ সা.-কে ঘিরে। শুরুর দিকে যারা মুহাম্মদ সা.-কে নিরাপত্তা দিচ্ছিলেন তারা শাহদাত বরণ করেছেন বা মারাত্মকভাবে আহত হয়েছেন। বাকি যারা নতুনভাবে মুহাম্মদ সা. পাশে এসে দাঁড়িয়েছেন তারা প্রচণ্ড আক্রমণ ঠেকাতে লাগলেন। আবু দোজানা রা. তার বিশাপ বপু নিয়ে নবী সা. সামনে এসে তাঁর দিকে মুখ করে দাঁড়ালেন এবং নিজের পিঠকে ঢাল স্বরূপ পেতে দিলেন, তাঁর পিঠে এসে শত্রুদের নিক্ষিপ্ত তীর বিঁধেছিলো, কিন্তু তিনি একটুও নড়াচড়া করছিলেন না।

কাতাদা রা.-এর চোখে এমন আঘাত লেগেছিলো যে, চোখ চেহারার ওপর বেরিয়ে পড়েছিলো। নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম তার পবিত্র হাতে সেই চোখ ভেতরে প্রবেশ করিয়ে দিলেন। পরবর্তী সময়ে দু’টি চোখের মধ্যে সেই চোখটিই বেশি সুন্দর দেখাতো। সেই চোখের দৃষ্টি ছিলো অধিক প্রখর। আবদুর রহমান ইবনে আওফ (রা.) লড়াই করতে করতে মুখে প্রচন্ড আঘাত পেলেন। এতে তাঁর সামনের মাড়ির দাঁত ভেঙ্গে গেলো। তিনি বিশ বাইশটি আঘাত পেয়েছিলেন। পায়েও আঘাত লেগেছিলো। এতে তিনি খোঁড়া হয়ে গিয়েছিলেন।

মালেক ইবনে মানানা রা. নবী সা.-এর চেহারার রক্ত চুষে পরিস্কার করেন। নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম তাকে বললেন, থুথু ফেলে দাও। তিনি বললেন, আল্লাহর শপথ আমি থুথু ফেলব না। এরপর মুখ ফিরিয়ে লড়াই করতে লাগলেন। মুহাম্মদ সা. বললেন, কেউ যদি কোন জান্নাতি মানুষকে দেখতে চায় তবে যেন মালেক ইবনে মানানাকে (রা.) দেখে। এরপর তিনি লড়াই করতে করতে শহীদ হয়ে গেলেন।

মুসআব ইবনে উমায়ের রা. অসাধারণ বীরত্ব ও সাহসিকতার পরিচয় দেন। তিনি রাসূল সা.-এর প্রতি ইবনে কুমআহ ও অন্যদের আঘাত প্রতিরোধ করেন। তাঁর হাতেই ছিলো ইসলামের পতাকা। শত্রু সৈন্যরা তাঁর ডান হাতে এমন আঘাত করে যে, তাঁর হাত কেটে যায়। তিনি তখন বাম হাতে ইসলামের পতাকা তুলে ধরেন। কিন্তু শত্রুদের হামলায় বাম হাতও কেটে যায়। তিনি তখন বাহু দিয়ে বুকের সাথে জড়িয়ে পতাকা উর্ধ্বে তুলে ধরেন। সেই অবস্থায় শাহাদাত বরন করেণ। তাঁর হত্যাকারী ছিলো আবদুল্লাহ ইবনে কুমআহ। ইবনে কুমআহ ভেবেছিলো সে মুহাম্মদ সা.-কে হত্যা করেছে কারণ মুসআব রা. গঠন রাসূলের মতো ছিল। সে উচ্চস্বরে ঘোষণা করলো, আমি মুহাম্মদকে হত্যা করেছি।

শহীদ মুসআব ইবনে উমায়ের রা.-এর শাহাদাতের পর রাসূল সা. পতাকা হযরত আলী রা.-এর হাতে তুলে দিলেন। হযরত আলী রা. অসম বীরত্বের সাথে লড়াই করলেন। সেখানে উপস্থিত অন্য কয়েকজন সাহাবাও তুলনাবিহীন বীরত্ব ও সাহসিকতার সাথে প্রতিরোধ যুদ্ধ এবং পাল্টা আক্রমণাত্মক যুদ্ধ করলেন। বেশ কিছুক্ষণ যুদ্ধের পর এ ধরনের সম্ভাবনা দেখা দিলো যে, রাসূল সা.-কে মুসলিমদের মূল দলের কাছে নিয়ে যাওয়া যাবে। নবী সা. সাহাবাদের কাছে নিরাপদ আশ্রয় পাওয়ার জন্যে পা বাড়ালেন।

প্রাণপণ প্রচেষ্টায় রাসূল সা. এবং সীমিতসংখ্যক সাহাবা পাহাড়ের ঘাঁটিতে অবস্থিত মুসলমানদের শিবিরে গিয়ে পৌঁছুলেন। এতে মুসলিমরা একত্রিত হওয়ার সুযোগ পেল এবং এতে খালেদ ইবনে ওয়ালিদের রণকৌশল ম্লান হয়ে গেলো।

মক্কার মুশরিকরা ফিরে যাওয়ার জন্যে প্রস্তুতি নিচ্ছিলো। আবু সুফিয়ান তখন উহুদ পাহাড়ের উপর উঠে জিজ্ঞাসা করলো, তোমাদের মধ্যে কি মুহাম্মদ আছেন? কেউ কোন জবাব দিলেন না। সে আবার বললো, তোমাদে মধ্যে কি আবু কোহাফার পুত্র আছেন? কেউ কোন জবাব দিলেন না। সে পুনরায় জিজ্ঞাসা করলো, তোমাদে মধ্যে কি উমার ইবনে খাত্তাব আছেন? কেউ এবারও জবাব দিলেন না। নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম জবাব দিতে নিষেধ করেছিলেন। আবু সুফিয়ান উল্লিখিত তিনজন ছাড়া অন্য কারো কথা জিজ্ঞাসা করলো না। কারণ, সে ভালো করেই জানতো যে, এই তিনজনের মাধ্যমেই ইসলামের প্রচার ও প্রসার ঘটছে। কোন জবাব না পেয়ে আবু সুফিয়ান স্বগতোক্তি করলো, যাক এই তিনজন থেকেই রেহাই পাওয়া গেলো।

একথা শুনে উমার রা. সহ্য করতে পারলেন না। তিনি বললেন, ওরে, আল্লাহর দুশমন, তুমি যাদের নাম উচ্চারণ করেছো, তারা সবাই জীবিত আছেন। আল্লাহ তায়ালা তোমার অবমাননার আরো বীভৎস উপকরণ রেখেছেন। একথা শুনে আবু সুফিয়ান বললো, তোমাদে নিহত লোকদের অঙ্গপ্রত্যঙ্গ কেটে বীভৎস করা হয়েছে। আমি এসব করতে বলিনি। তবে এতে আমি নাখোশও নই। এরপর সে ধ্বনি দিলো, হোবালের জয় হোক!

নবী সা. বললেন, তোমরা জবাব দিচ্ছো না কেন? সাহাবায়ে কেরাম বললেন, কি জবাব দেব? নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বললেন, বলো, আল্লাহ তয়ালা মহান এবং সর্বশক্তিমান।

আবু সুফিয়ান উচ্চস্বরে বললো, আমাদের জন্যে উজ্জা আছে, তোমাদের নেই।
নবী সা. বললেন, তোমরা জবাব দিচ্ছো না কেন? সাহাবারা জিজ্ঞাসা করলেন, কী জবাব দেবো?
নবী সা. বললেন, বলো ,‘আল্লাহ তায়ালা আমাদের প্রভু তোমাদের কোন প্রভু নেই।

এরপর আবু সুফিয়ান বললো, কি চমৎকার কৃতিত্ব। আজ বদরের যুদ্ধের প্রতিশোধ গ্রহণের দিন। যুদ্ধ হচ্ছে একটা বলতি। কখনো এক পক্ষ জয় লাভ করে কখনো অন্য পক্ষ। যেমন বালতি দিয়ে কখনো একজন টেনে পানি তোলে, কখনো অন্যজন তোলে।

হযরত উমার রা. জবাবে বললেন, সমান নয়। আমাদের যারা নিহত হয়েছেন, তারা জান্নাতে রয়েছেন, আর তোমাদের যারা নিহত হয়েছে, তারা জাহান্নামে রয়েছে।

এরপর আবু সুফিয়ান বললো, ওহে উমার! একটু কাছে আসো। নবী সা. বলেন, যাও, দেখো কি বলে। হযরত ওমর রা. এগিয়ে গেলেন। আবু সুফিয়ান বললো, ওহে উমার! তোমাকে আল্লাহর নামে শপথ দিয়ে জিজ্ঞাসা করছি, আমরা কি মোহাম্মদকে হত্যা করতে পেরেছি? উমার রা. বললেন, আল্লাহর শপথ, পারো নাই। বরং এখন তিনি তোমার কথা শুনছেন। আবু সুফিয়ান বললো, উমার! তুমি আমার কাছে ইবনে কুমআহ চাইতেও অধিক সত্যবাদী ব্যক্তি।

আবু সুফিয়ান এবং তার সাঙ্গপাঙ্গরা ফিরে যাওয়ার সময় বললো, আগামী বছর বদর প্রান্তরে পুনরায় লড়াই করার প্রতিজ্ঞা রইলো। নবী সা. পাশে থাকা একজন সাহাবীকে বললেন, বলে দাও, আচ্ছা, ঠিক আছে। তোমাদের এবং আমাদের মধ্যে একথাই রইলো।

তারা চলে গেলেও মহানবী সা. নিশ্চিন্ত হননি। তিনি আলী রা. নেতৃত্বে একটি বাহিনীকে ধাওয়া দেওয়ার জন্য পাঠালেন। কিছুদূর যাওয়ার পর মুশরিকদের মধ্যে আলোচনা হয়, তারা যুদ্ধ শেষ না করেই ফিরে চলেছে। তাদের মধ্যে কেউ কেউ আবারো মুসলিমদের ওপর আক্রমণ করার শপথ করলো। তারা যখন দ্বিধার মধ্যে ছিলো তখন তারা আলী রা.-এর নেতৃত্বে মুসলিম বাহিনীকে দেখে মক্কার দিকে ফিরে যেতে থাকলো।

পঠিত : ৩২২ বার

মন্তব্য: ০