Alapon

|| জুলুমের স্বীকৃতি—ক্ষমা পাবার পূর্ব শর্ত-০৩||




জান্নাত মানেই এক মনোরম-মনোহর স্থান। নয়নাভিরাম সুখ-সমৃদ্ধি ও প্রশান্তিতে ঘেরা এক চমৎকার চির সবুজ জায়গা! যেখানে কোনো ক্লেশ নেই। হতাশা নেই । অপ্রাপ্তির হাহুতোশ নেই। আর সেই জান্নাতেই আল্লাহ সুবহানাহু ও’তাআলা পৃথিবীর প্রথম মানব-প্রথম নবি আদম আলাইহিস সালামকে স্থান দেন। তিনি একা। এটাই তাঁর সবচাইতে বড়ো অপ্রাপ্তি। তাঁর কোনো সঙ্গী নেই। সহচর নেই। পার্টনার নেই। কিন্তু আল্লাহ রব্বুল আলামিন তাঁর এই অপ্রাপ্তিটা বুঝলেন। এই অপ্রাপ্তিটাও অবশেষে বিদূরিত করে দিলেন। তাঁর-ই প্রাণ থেকে সৃষ্টি করলেন তাঁর স্ত্রী, জীবন সাথি হাওয়াকে।[ আল-কুরআন-০৪/০১] এতে তাঁর প্রাণোচ্ছলতা যেনো আরো বেড়ে গেলো। তাঁর আনন্দ-উদ্দীপনা ও সুখ শান্তি-স্বস্তি যেনো দ্বিগুণ হলো। অতঃপর আল্লাহ সুবহানাহু ও’তাআলা তাদেরকে একটি নির্দেশনামা প্রদান করলেন। তিনি বললেন—
হে আদম! তমি এবং তোমার স্ত্রী উভয়ে মিলে জান্নাতেই থাকো। যা খুশি খাও। কিন্তু খবরদার,ঐ গাছটি নিকটেও যেয়োনা! সেটার ফল খেয়ো না। যদি খাও, তা হলে তুমি জালিমদের অন্তর্ভুক্ত হবে”। [ আল-কুরআন-০২/৩৫]

এই নির্দেশনা মেনে খুব সুখেই এখন তাঁরা দু’জন মিলে স্বর্গীয় জীবন উপভোগ করতে লাগলেন। অভিশপ্ত ইবলিশের তা সহ্য হলো না। হিংস্র আর হিংসাত্মক মনে সে তাঁদের বিরুদ্ধে ষড়যন্ত্র পাকাতে লাগলো। তাঁদের বিপথগামী করার নানান ফিকির সে এঁটে যেতে লাগলো। কিন্তু কোনোভাবেই সে সফল হচ্ছে না। এবার সে আসলো তাদের হিতাকাঙ্ক্ষী হয়ে। তাঁদেরকে উন্নতির সু-উচ্চ শিখরে নিয়ে যাবার প্রলোভন দেখাতে লাগলো—মানবিক পর্যায় থেকে উন্নতি করে সফলতা ও উন্নতির উচ্চতর মার্গে পৌঁছে যাবার এবং চিরন্তন জীবন লাভের প্রলোভনে প্রলুব্ধ করে আল্লাহর আদেশ অমান্য করার জন্যে প্ররোচিত করলো। ইবলিশের এই টোপ সফল হয়। অসৎকর্মের দিকে আহ্বান করার ক্ষেত্রে অসৎ পথের পথিককে কল্যাণকামীর ছদ্মবেশে আসতে হয়। [ তাফহীমুল কুরআনঃ টিকা-১৩] সে তা-ই করেছে। কল্যাণকামীর ছদ্মবেশে এসেছে সে। নিজেকে উপস্থাপন করেছেন তাদের খুব বেশি হিতাকাঙ্ক্ষী হিসেবে। সে তাঁদেরকে বলতে লাগলো যে—
“আল্লাহ যে তোমাদেরকে ঐ গাছটির নিকটে যেতে নিষেধ কেনো করেছেন জানো? এর কারণ হলো এই যে, তোমরা এর ফল খেলে ফেরেশতা হয়ে যাবে। এখানের চিরস্থায়ী বাসিন্দা হয়ে যাবে। অতঃপর সে কসম খেয়ে বলল যে, আমি অবশ্যই তোমাদের কল্যাণকামী। এভাবেই সে আদম ও হাওয়াকে সম্মত করে ফেললো এবং তার প্রতারণার জালে আঁটকে গিয়ে তারা উক্ত নিষিদ্ধ বৃক্ষের ফল আস্বাদন করলো”। [ আল-কুরআন-৭/২০-২২]

সাথে সাথেই তাঁদের দেহ থেকে আল্লাহ প্রদত্ত ফেরদৌসি পোশাকের যে আবরণ, তা খসে পড়লো। তাঁরা প্রচণ্ড লজ্জা অনুভব করলো। আর সেজন্য তাঁরা বিভিন্ন লতা-পাতা দিয়ে তাঁরা তাদের লজ্জাস্থান আবৃত করতে শুরু করলো। আল্লাহ রাব্বুল আলামিন তাঁদের ডেকে বললেন—
“ আমি কি তোমাদের নিষেধ করে বলি নি এই গাছটির নিকটেও যেও না? আমি কি বলি নি শয়তান হচ্ছে তোমাদের প্রকাশ্য শত্রু?” [ আল-কুরআন-৭/২২]

তাঁরা নিজেদের ভুল বুঝতে পারলেন। ভীষণরকম অপরাধবোধে তাঁরা গফুরুর রহিম আল্লাহর নিকট ক্ষমাপ্রার্থনা করে ব্যাকুল কণ্ঠে কাঁদতে লাগলেন। তাঁরা আল্লাহর কাছে আকুল কণ্ঠে মিনতি করলেন এই বলে— “
হে আমাদের রব ! আমরা নিজেদের প্রতি জুলুম করে ফেলেছি। অন্যায় করে ফেলেছি। এখন তুমি যদি আমাদের ওপর দয়া না করো এবং ক্ষমা না করো, তা হলে আমরা ধব্বংসের অতলে তলিয়ে যাবো”। [ আল-কুরআন-৭/২৩]

আল্লাহর কাছে নিজ ভুলের স্বীকৃতি দিয়ে ক্ষমা চাওয়ার আল্লাহ তাঁদের ক্ষমা করে দিলেন। এবং পাঠিয়ে দিলেন দু’দিনের দুনিয়ায়। বসবাসের জন্য। পৃথিবীর জমিনকে চাষাবাদের জন্য। তাঁর বিধি-বিধানকে বাস্তবায়নের জন্য।

উপরোল্লিখিত লেখাটি থেকে যে সমস্ত বিষয় বিশেষভাবে প্রতিভাত হয় আমাদের দৃষ্টিতে, তা হলো এই যে—
১. আমরা তো আদম সন্তান। আমাদের প্রধান ও প্রথম শত্রু ইবলিশ। ইবলিশের কাজ হলো আমাদের কুমন্ত্রণা দিয়ে রব্বুল আলামিনের অবাধ্য করা। সেজন্য ইবলিশ আমাদের ওপর হামলার জন্য নানামুখী অপতৎপরতা চালায়। হামলার ধরণ-প্রকৃতি হলো প্রলোভন দেখানো। দীর্ঘজীবী তথা দীর্ঘদিন বেঁচে থাকার প্রলোভন। মর্যদার প্রলোভন। উচ্চতর সাফল্যের প্রলোভন। আর শয়তান প্রথম হামলাতেই মানবের দেহ থেকে লজ্জাবৃত বস্ত্র খসিয়ে তাকে নগ্ন করে দেওয়ার কাজ সম্পাদন করে। সে চেয়েছি্লো স্বাভাবিক লজ্জানুভূতিতে আঘাত করে মানবকে বেহায়াপনার দিকে নিমজ্জিত করতে। আজকেও ইবলিশের অনুসারীরা ফেমিনিজম, নারীর ক্ষমতায়ন, কথিত বৈষম্য দূরিকরণ; এরকম নানাবিধ চটকদার নামে নারীকে অর্ধবস্ত্র করে অপ্রয়োজনে ঘর হতে বাহিরে এনে তার রূপ-যৌবন-সৌন্দর্য উপভোগ করছে। তাঁদের বোকা বানিয়ে নিজেদের মনোরঞ্জন করে যাচ্ছে।
তারা একটা গাড়ির উদ্ভোধনে, সামান্য খেলায় দর্শককে বিনোদিত করার জন্যেও নগ্ন নারীদেহ প্রদর্শন করে থাকে। এভাবে তারা নারীকে স্রেফ পন্য হিসেবে ব্যবহার করছে। এদের এহেন অনভিপ্রেত কর্মকাণ্ডের সমালোচনায় বিগত শতাব্দির অন্যতম মুজতাহিদ আলিম, দার্শনিক, দা’ঈ ইলাল্লাহ ইমাম আবুল আ’লা মওদূদী রহিমাহুল্লাহ বলেন—
“ শয়তান ও তার শিষ্যবর্গের এ কর্মনীতি আজো অপরিবর্তিত রয়েছে। মেয়েদেরকে উলঙ করে প্রকাশ্য বাজারে দাঁড় করানো পর্যন্ত তাদের ‘প্রগতির’ কোনো কার্যক্রম শুরুই হতে পারে না । [ তাফহীমুল কুরআ-৪র্থ খণ্ডঃ পৃষ্ঠা- ১৪-১৫]

যাইহোক সভ্য-ভদ্র ও আল্লাহভীরু বান্দাদের নিকটে ঈমানের পর সর্বপ্রথম ফরয হলো স্ব স্ব সতর-লজ্জাস্থান আবৃত রাখা ও ইজ্জত-আবরূর হেফাযত করা। অন্যান্য যতো ফরজ আছে, সবই এর পরে।.........অতএব লজ্জাশীলতাই মুমিন নর-নারীর অঙ্গভূষণ ও পারস্পরিক নিরাপত্তার গ্যারান্টি। নারী ও পুরুষ প্রত্যেকে একে অপরের থেকে স্ব স্ব দৃষ্টিকে অবনত রাখবে ( সুরা নূর ২৪/৩০-৩১)।[ নবিদের কাহিনী-ডঃ মুহাম্মাদ আসাদুল্লাহিল গালিব- পৃষ্ঠা-২১]

২. ইবলিশের আরো একটি কৌশলাক্রমণ হলো স্রষ্টা সম্পর্কে, তাঁর বিধানবলি সম্পর্কে ভুল ধাওরণা দেওয়া। সন্দেহ সংশয় সৃষ্টি করার অপচেষ্টা করা। এই আজকের যুগেও ইবলিশি কর্মকাণ্ডে লিপ্ত ব্যক্তিবর্গ কিন্তু এই কাজটাই করে মুক্ত চিন্তার নামে। প্রগতিশীলতা ও উদারতার নামে। আর এভাবেই আল্লাহর দ্বীন এবং এই দ্বীনের বিধি-বিধান সম্পর্কে মানব মনে খুব সুক্ষ্মভাবেই সংশয় আর অবিশ্বাস সৃষ্টির অপচেষ্টা করেছে এবং করে যাচ্ছেও।

৩. ইবলিশ যখন ধোকা দিতে চায়, তার শয়তানি কর্মের সাথি হিসেবে মানবকে পেতে চায়, আল্লাহর অবাধ্য করে বিপথগামী করতে চায়; তখন সে সর্বোচ্চ কল্যাণকামী সাজে, শুভাকাঙ্ক্ষী হিসেবে উপস্থিত হয়। এখনকার দিনেও আমরা এই বিষয়টা লক্ষ্য করি যে—ইবলিশের চ্যালাচামুণ্ডারা যখন স্বাভাবিকভাবে আল্লাহর কোনো মুত্তাকি বান্দাকে জাগতিক লোভ-লালসার টোপ দিয়ে ধরতে তথা ধোকা দিতে না পারে, তখন তারা আল্লাহওয়ালা, মুত্তাকি, মুহসীন সাজে। ইসলামের মোড়কে ইসলামের মূল শিক্ষা থেকে আল্লাহ ভীরু ব্যক্তিবর্গকে দূরে সরাবার অপচেষ্টা করে।

৪. আমাদের সমাজে যেভাবে প্রচলিত আছে যে, প্রথমে হাওয়া নিষিদ্ধ গাছের ফল খেয়েছে। মা হাওয়ার প্ররোচনায় এরপর তা বাবা আদম আলাইহিসালাম-ও খায়। মানে নারীকে একপ্রকার দোষারোপ করা হয় সরাসরিই। কিন্তু আসোলে বাস্তবে তা নয়। ইসলাম তেমনটি বলে না। ইসলাম বলে ,
“ দুজনেই ইবলিশের প্রতারণার ফাঁদে আঁটকে গেলো”।

এবং আরো একটা কথা প্রচলিত আছে, যা আমরা শুনি হররোজ। তা হলো এই; আল্লাহর আদেশ অমান্য করার শাস্তিস্বরূপ আদম আলাইহিস সালামকে জান্নাত থেকে বের করে দুনিয়ায় পাঠালো। বিষয়টি আসোলে সেরকম নয়। আল্লাহ সুবহানাহু ও’তালার নিকট তাঁরা ভুলের পরে প্রার্থনা করলে আল্লাহ তাদেরকে ক্ষমা করে দেন। ক্ষমা করার পরেই দুনিয়ায় পাঠান। দুনিয়া আবাদ করার জন্যে। আল্লাহর দ্বীনের বিধিমালা বাস্তবায়নের জন্য। আর দুনিয়ায় আসার পরেই আদাম আলাইহিস সালামকে নবুওয়াত প্রদান করেন। শাস্তি যদি হতো তা হলে নবুওয়ত কেনো দিতে যাবেন?

৫. আল্লাহ রাব্বুল আলামিন ক্ষমাশীল। মানুষ যদি ভুলক্রমে আল্লাহর নির্দেশ অমান্য করে ফেলে, সে যখন এই ভুল বুঝে, আর তাঁর যে ভুল হয়েছে, আল্লাহর নির্দেশ অমান্য করে যে জুলুম করেছে; সেটার স্বীকৃতি দিয়ে মহান আল্লাহর কাছে ক্ষমা চাইলে তিনি ক্ষমা করে দেন। তা হলে বুঝা গেলো যে— আল্লাহর ক্ষমা পাবার পূর্বশর্ত হলো নিজকৃত ভুলের স্বীকৃতি, জুলুমের স্বীকৃতি দিয়ে কাতরকন্ঠে ক্ষমাপ্রার্থনা করা। যেমন প্রথম মানব প্রথম নবি আদম আলাইহিস সালাম তাঁর স্ত্রীসহ আল্লাহর কাছে চরম অনুতপ্ত হয়ে এই বলে ফরিয়াদ করেছে যে; — “হে আমাদের রব ! আমরা নিজেদের প্রতি জুলুম করে ফেলেছি। অন্যায় করে ফেলেছি। এখন তুমি যদি আমাদের ওপর দয়া না করো এবং ক্ষমা না করো, তা হলে আমরা ধব্বংসের অতলে তলিয়ে যাবো”। [ আল-কুরআন-৭/২৩]

আমরাও তো দৈনন্দিন জীবনে কতো ভুলই করি। ইচ্ছেয় হোক বা অনিচ্ছায়। শয়তানের প্ররোচনায় প্ররোচিত হই-ই আমরা। আমরাও যদি আল্লাহর কাছে নিজ ভুলের স্বীকৃতি দিয়ে, ভুল কাজ ভুল পথ গুনাহের পথ থেকে ফিরে আসার প্রতিজ্ঞা করে রব্বুল আলামিনের দরবারে ক্ষমাপ্রার্থনা করি, তা হলে আল্লাহ রব্বুল আলামিন আমাদেরকে অবশ্যই ক্ষমা করে দিবেন। শয়তান যেভাবে শুরুতেই ব্যর্থতায় পর্যবসিত হয়েছে, তদ্রূপ সে আমাদের কাছে আবারও ব্যর্থ হবে। ইন শা আল্লাহ। আল্লাহ সুবহানাহু ওয়াতাআ'লা আমাদেরকে তাঁর দয়া ও ক্ষমা নসীব করুন । আ-মী-ন!!


|| জুলুমের স্বীকৃতি—ক্ষমা পাবার পূর্ব শর্ত-০৩||
~রেদওয়ান রাওয়াহা
[ আল্লাহর ওয়াস্তে কপি করবেন না। কপি করা নিষেধ ]
০৩. ০৭. ২১

পঠিত : ৩৬৩ বার

মন্তব্য: ১

২০২১-০৭-০৪ ০৭:১৩

User
Zariful Azam

অসাধরণ নাসিহা

submit