Alapon

মুসলিমরা অমুসলিমদেরকে বন্ধু হিসেবে গ্রহণ করতে পারেনা?



ইসলামের প্রসারের শুরু থেকে ইসলাম বিরোধীরা, ইসলাম বা মুসলিমদেরকে ‘হেট মঙ্গার’ জাতি বলে প্রচার করছে! বলা হচ্ছে যে, মুসলিমরা অন্য ধর্মাবলম্বীদের প্রতি মনে-প্রাণে ঘৃণা-বিদ্বেষ পোষণ করে। এর জন্য নাকি আল-কোরআনে স্পষ্ট নির্দেশ দেওয়া আছে, যা একজন মুসলিমকে অবশ্যই পালন করতে হবে! আর তাদের অভিযোগের প্রমাণ হিসেবে তারা যে সকল আয়াত তুলে ধরেন সেগুলোর মধ্যে সূরা আল-মায়েদার ৫:৫১ আয়াত উল্লেখযোগ্য (যে ভাবে বর্তমানে বাংলায় অনুবাদ আছে)-

হে মুমিনগণ! তোমরা ইহুদী ও খৃষ্টানদের বন্ধু এবং অভিভাবক রূপে গ্রহণ করো না। তারা পরস্পর পরস্পরের বন্ধু এবং অভিভাবক। এবং তোমাদের মধ্যে যে কেহ তাদের [বন্ধু এবং অভিভাবক রূপে] গ্রহণ করবে, সে তাদেরই একজন হবে। নিশ্চয়ই আল্লাহ্‌ অন্যায়কারীকে [সুপথে] পরিচালিত করেন না। (কোরআন ৫:৫১)

উপরের আয়াত ইংরেজ অনুবাদকগণ friend শব্দটি ব্যবহার করে থাকেন। এবং বাংলা অনুবাদকগণও friend শব্দটি বাংলা প্রতিশব্দ 'বন্ধু' শব্দটি ব্যবহার করে থাকেন। আর কেউ কেউ মূল আরবি শব্দটির মানে যে নিছক বন্ধু নয় তা বুঝতে পেরে 'অভিভাবক' শব্দ ব্যবহার করে থাকেন। তবে যেহেতু নিন্দা রটনাকারীরা আসল শব্দ ব্যবহার করলে তাদের উদ্দেশ্য হাসিল হবেনা তাই আরবি শব্দের অনেক গুলো প্রতিশব্দের মধ্যে যে প্রতিশব্দ দিয়ে তাদের উদ্দেশ্য পূর্ণ হয় সেই প্রতিশব্দ ব্যবহার করে যান। এই আয়াতের বেলাও সঠিক context প্রকাশ কারক প্রতিশব্দটি ব্যবহার না করে বিভ্রান্ত সৃষ্টির জন্য friend /বন্ধু শব্দটি আকছার ব্যবহার করেই থাকেন! আর যেহেতু আমাদের মাতৃভাষা আরবি না হওয়ার কারণে আমাদের অনেক আরবি ভাষা জ্ঞান সম্পন্ন বিজ্ঞ ব্যক্তিও এই বিভ্রান্ত সৃষ্টিকারী প্রতিশব্দ গুলো অবলীলায় ব্যবহার করে আসছেন। পৃথিবীর প্রতিটি ভাষাতে কিছু কিছু শব্দ আছে যা বানান এক হলেও প্রয়োগের ভিন্নতায় ভিন্ন অর্থ প্রকাশ করে থাকে। আবার কিছু শব্দ আছে যা অন্য ভাষায় তার প্রতিশব্দ পাওয়া যায় না। বাংলায় যেমন-নেংটি,লেংটি,প্যাচকুন্দা ইত্যাদি, এই শব্দটির প্রতি শব্দ আরবি কিংবা ইংরেজিতে পাওয়া যায় না। তেমনি ইংরেজি টেবিল, চেয়ার যার প্রতিশব্দ থাকলেও তা হু বহু ভাবে প্রকাশ করতে অক্ষম। আমাদের আলোচ্য শব্দটি কোরআনে 'আউলিয়া শব্দটি ব্যবহার করা হয়েছে, কিন্তু সাদিক শব্দটি ব্যবহার করা হয় নাই ।' সাধারণতঃ সবাই জানেন যে- আরবিতে ‘বন্ধু’ শব্দের সরল প্রতিশব্দ হল ‘সাদিক’, পুরুষ বন্ধু : sadeek /sədi:k/ صديق or saheb /sɑ:heb/ صاحب

নারী বন্ধু : sadeeka /sədi:ka/ صديقة or saheba /sɑ:həbə/ صاحبة

উপরের আয়াতটি গভীরভাবে খেয়াল করুন, আল্লাহ পাক কোরআনের এই নির্দিষ্ট আয়াতগুলোতে ‘সাদিক’ ব্যবহার না করে ‘আউলিয়া’ শব্দটি ব্যবহার করেছেন। কিন্তু সাদিককে 'সাদিক' না বলে 'আউলিয়া' শব্দটি ব্যবহার করা হল কেন? [দেখুন]

এই প্রশ্নের উত্তর জানতে হলে আমাদের ‘আউলিয়া’ শব্দটির অর্থ জানতে হবে। আরবি ‘অলি’ শব্দটি বহুবচনে ‘আউলিয়া’ হয়েছে। তাহলে দেখি ‘অলি’ শব্দটি দিয়ে কি বুঝায়? আমাদের দেশে যারা একসময় ধর্ম প্রচার করতে এদেশে এসেছিলেন তাদেরকে প্রচলিত ভাষায় পীর,দরবেশ,আউলিয়া বা অলি বলে থাকি কিন্তু তাদের কেন অলি বা আউলিয়া বলা হয় সেটি ভিন্ন প্রসঙ্গ বিধায় এখানে আলোচনা করছিনা। আবার আমাদের দেশে বিয়ে-সাদির আক্দ পড়ানোর সময় বর বা কনে পক্ষের ২ জন মুরুব্বিকে অলি নিযুক্ত করতে হয়, যাদের তত্ত্বাবধানে আক্দ সম্পাদন করা হয়। তিনি বাবা, চাচা, মামা, ভাই বা অন্য কেউ হতে পারেন। ‘অলি’ মানে ‘অভিভাবক’ বা ‘তত্ত্বাবধায়ক’ কাউকে বুঝানো হয়। অলি’র বহুবচন আউলিয়া- মানে অভিভাবকগণ বা তত্ত্বাবধায়কগণ।

এই আয়াতের নাজিলের প্রেক্ষাপটকে সামনে রেখে বিবেচনা করলে যে কেউ বুঝতে পারবে এই আয়াতে 'আউলিয়া' শব্দ দ্বারা 'নিরাপত্তা দানকারী' বোঝাচ্ছে। গোত্র ভিত্তিক আরবে তখন গোত্রীয় রীতি নীতিতে এই রকম প্রথা ছিল যে-গোত্রের চরম শত্রুকে যদি তাদের গোত্রের কোন ব্যক্তি জীবন রক্ষার নিরাপত্তা দান করত তাহলে ঐ গোত্রের কেউ ই সেই শত্রুকে হত্যা বা অত্যাচার করতে পারতোনা।

যেমন রাসুল সাঃ ইসলাম প্রচার শুরু করার পর উনার বিরুদ্ধে গোটা মক্কার মুশরিকরা শত্রুতা পোষণ করতে থাকে, কিন্তু উনাকে উনার আপন চাচা কুরাইশ নেতা আবু তালিব নিরাপত্তা দিয়ে উনার অলি হয়েছিলেন যার কারণে মক্কার কাফিরগণ রাসুল সাঃএর কোন ক্ষতি করতে পারে নাই।

আউলিয়া শব্দের ৪টি শব্দের প্রতিশব্দ পাওয়া যায়, যেমন- মিত্র (allies), বন্ধু (friend), অভিভাবক (guardian) ও নিরাপত্তা দানকারী (protectors)। এবং অবস্থার পরিপ্রেক্ষিতে এই চারটি প্রতিশব্দের যে কোন একটি বা একত্রে চারটি প্রতিশব্দকে প্রয়োগ করা যাবে।

এবার আল-কোরআনের সূরা মুমতাহিনার ১৩ নং আয়াত দেখা যাক-

হে বিশ্বাসীগণ! যে সম্প্রদায়ের প্রতি আল্লাহ্‌ রুষ্ট হয়েছেন, তোমরা তাদের সাথে বন্ধুত্ব করো না। ইতিমধ্যে তারা পরলোক সম্বন্ধে নিরাশ হয়েছে, যেমন নিরাশ হয়েছে অবিশ্বাসীরা কবরস্থদের বিষয়ে। (কোরআন ৬০:১৩)

এখানে দেখুন আল্লাহ বলছেন- লা তাতাওয়াল্লু (তাতাওয়াল্লু শব্দটি এসেছে আউলিয়া থেকে) কাওমান (কওম)। আল্লাহ এখানে স্পষ্ট করে শুধু সম্প্রদায়ের সাথে মিত্রতা না করতে বলছেন, কিন্তু এখানে ব্যক্তিগতভাবে কোন ব্যক্তির সাথে ব্যক্তির সামাজিক বন্ধুত্বের ব্যাপারে কিছু নির্দেশ দেন নাই। এক সম্প্রদায় আরেক সম্প্রদায়ের সাথে বন্ধুত্ব শব্দ নয় মিত্রতা শব্দটির ব্যবহার অধিক গ্রহণ যোগ্য হবে। [দেখুন]

আমি মনে করি সর্ব ক্ষেত্রে ইংরেজি বা বাংলা অনুবাদ আমাদের রেফারেন্স হতে পারেনা, তাই অনুবাদ যদি মূল প্রেক্ষাপটকে যথার্থ ভাবে প্রকাশ করতে না পারে তাহলে আমাদেরকে অবশ্যই মূল আরবি শব্দটিকে গ্রহণ করতে হবে। এক ভাষা থেকে অন্য ভাষার সঠিক রূপান্তর করা সম্ভব না হওয়া জন্য বিশেষ করে কোরানিক আরবি সাহিত্যের ক্ষেত্রে ইসলামি বিশেষজ্ঞরা সব সময় অনুবাদের সাথে মূল আরবিকে মিলিয়ে দেখার উপদেশ দিয়ে আসছেন। এজন্য আমি মনে করি উপরোক্ত আয়াতে মিত্র/ নিরাপত্তা দানকারী প্রতিশব্দ ব্যবহার করা হলে সঠিক হবে, যা ইংরেজিতে Allies/ Protectors বুঝায়।

অতএব, উপরোক্ত দুটি আয়াত থেকে দেখা যায় যে, এখানে আরবিতে আউলিয়া = অভিভাবক/নিরাপত্তা দানকারী হিসাবে দেখানো হয়েছে (৫:৫১) এবং এই নির্দেশ নিছক ব্যক্তি পর্যায়ে নয়, এটি দেওয়া হয়েছে গোত্র গতভাবে (৬০:১৩)। তাই স্বাভাবিকভাবে আরবিতে বন্ধু বলতে যে শব্দ (সাদিক) ব্যবহার করা হয়, উপরোক্ত দুটি আয়াতের একটিতেও তা ব্যবহার করা হয়নি!

এবার দেখা যাক ৫:৫১ আয়াতটি কোন ঐতিহাসিক প্রেক্ষাপটে- অর্থাৎ কখন, কোথায় এবং কি প্রয়োজনে নাজিল হয়েছিল। আপনারা জানেন- ইতিহাসে উল্লেখ আছে যে- মদিনা উপত্যকায় বসবাসকারী প্রভাবশালী দুই গোত্র বানু আওস ও বানু খাযরাজ এক দীর্ঘ স্থায়ী যুদ্ধে জড়িয়ে পড়েছিল, সে যুদ্ধ ১২০ বছর ধরে চলে ৬১৭ খৃঃ বোথা যুদ্ধের মাধ্যমে কোনরূপ আপাততঃ বিরতি নিয়েছিল। সেই যুদ্ধের ফলাফল গোটা মদিনা উপত্যকা দুই ভাগে ভাগ হয়ে গিয়েছিল।

সে যুদ্ধে একদিকে ইহুদি গোত্র বানু নাদর, বানু কুরাইযা ও বেদুঈন গোত্র মুযাইনা বানু আওসদের পক্ষে অন্য দিকে ইহুদি গোত্র বানু কাইনুকা ও বেদুঈন জুহাইনা,আশজা গোত্র বানু খাযরাজদের পক্ষে যুদ্ধে জড়িয়ে পড়ে। মোট কথা সে যুদ্ধের ফলে গোটা মদিনা উপত্যকার জনজীবনে দীর্ঘ স্থায়ী অশান্তি বিরাজ করছিল, তদুপরি বোথা যুদ্ধে দুই পক্ষের প্রধান নেতা নিহত হওয়ায় গোত্রদ্বয় নেতৃত্বহীন হয়ে গোটা অঞ্চল এক অরাজক অবস্থায় পতিত হয়।

মদিনার ইহুদিরা তারা তাদের ব্যবসায়ীক স্বার্থে এই ভ্রাতৃঘাতি সংঘাত জিয়ে রাখে, যাতে তাদের মদের ব্যবসা সূদের ব্যবসাও অস্ত্রের ব্যবসা রমরমা ভাবে চলতে পারে। এর ফলে মদিনার আরবরা যুদ্ধের খরচ চালাতে সুদ কারবারির কাছে নিজেদের সহায় সম্পদ হারাতে হারাতে মদের নেশায় বুঁদ পড়ে থাকে। তখন তাদের মধ্যে নেতৃস্থানীয় জ্ঞানী লোকজন গোত্র থেকে গোত্রের হানাহানি জনিত এই অস্বাভাবিক অবস্থা থেকে মুক্তি জন্য দল গোত্র নিরপেক্ষ মুক্তির দিশারীকে খুঁজতে থাকে।

আর এই যুগ সন্ধিক্ষণে অন্যদিকে রাসুল সাঃ তৌহিদের আমন্ত্রণ মক্কাবাসীদেরকে দিয়ে চলছিলেন। তখন মদিনার কিছু লোক হজ উপলক্ষে মক্কায় আসে, সে সময় তাদের সহিত রাসুল সাঃ সাক্ষাৎ ঘটে, তারা রাসুল সাঃএর দাওয়াত গ্রহণ করে, পরের বছর আবার এক বৃহত্তর দল মদিনা থেকে মক্কায় এসে রাসুল সাঃ আনুগত্যতা স্বীকার করে, উনাকে সদল বলে মদিনায় গিয়ে তাদেরকে নেতৃত্ব দেবার আমন্ত্রণ জানায়।

ঠিক ঐ সময়ে তারা রাসুল সাঃকে মদিনায় যাবার আমন্ত্রণ জানিয়েছিল যখন মক্কাতে শান্তিপূর্ণ ভাবে ইসলাম প্রচার করা যাচ্ছিলোনা। যারা নতুন ধর্ম গ্রহণ করেছিল তাদের প্রতি মক্কার মুশরিক কুরাইশরা অমানবিক ভাবে অত্যাচার অবিচার করে চলছিল। নও মুসলিমদের বাধ্য করা হচ্ছিল হয় তারা নতুন ধর্ম ত্যাগ করবে নতুবা মরবে। চূড়ান্ত পর্যায়ে তারা রাসুল সাঃ কে হত্যা করে ধরা থেকে সদ্য ভূমিষ্ঠ ইসলাম নির্মূল করার সিদ্ধান্তও নিয়ে তা কার্যকর করতে লোক পাঠিয়েছিল।

সেই পরিস্থিতি মক্কার মুসলিমদেরকে তাদের সহায়, সম্পদ, ভিটেমাটি ফেলে জন্মভূমি থেকে দেশান্তরী হতে হয়েছিল। সেই দেশান্তরী মানুষদের তখন মদিনাবাসী আওস ও খাযরাজ গোত্র মদিনাতে আশ্রয় দিয়েছিল এবং নিরাপত্তা দিয়েছিল।


মুসলিমরা মদিনায় আশ্রয় নেবার সাথে সাথে ঐ নগরীর ৮টি প্রধান গোত্র ও মক্কা থেকে আগত মুসলিম মিলে কনফেডারেশন গড়ে তোলা হয়। এই কনফেডারেশনের সংবিধান হিসাবে জাতি-ধর্ম নির্বিশেষে সকলের সহিত ২০ ধারার একটি শান্তিচুক্তি প্রণয়ন করা হয়েছিল। প্রধান ধারাটি ছিল মদিনা কনফেডারেশনের সকল গোত্র,বংশ ধর্ম তথা আরব, বেদুঈন,ইহুদি খৃষ্টান,মুশরিক মিলে নতুন চুক্তির বলে এখন থেকে একক উম্মাহ লোক হিসাবে পরিগণিত হবে এবং এই উম্মাহ ভিতরে কোন প্রকার গোত্রীয়/ধর্মীয় হানাহানিই চলবেনা। উম্মাহর ঐ চুক্তিতে এই মর্মেও শর্ত ছিল যে- এই কনফেডারেশন ভুক্ত যে কোন গোত্র ও ধর্মীয় গোষ্ঠী যদি বহিরাগত শক্তি দ্বারা আক্রান্ত হয়, তাহলে সবাই মিলে তা প্রতিহত করতে হবে। এবং এই ফেডারেশনের অধীনের কেউ কখনো চুক্তি ভুক্ত গোত্রের কোন দুশমনদেরকে সাহায্য করতে পারবেনা। চুক্তি ভুক্ত গোত্রগণ একে অপরের সহিত যুদ্ধও করতে পারবেনা। এবং নিজদের মধ্যে কোন বিরোধ দেখা দিলে রাসুল সাঃ সিদ্ধান্তই চূড়ান্ত বলে মান্য করতে হবে।

ইহুদীদের মধ্যে বানু কাইনুকাইরাই প্রথম মুসলিমদের সাথে চুক্তি ভঙ্গ করে যুদ্ধ বাধিয়েছিল। ইসলাম-পূর্ব সময় থেকে মদিনার খাযরাজ গোত্রের সাথে এই ইহুদী বানু কাইনুকাদের মৈত্রীতা ছিল।তারা পরস্পর পরস্পরের (protectors) ছিল। তাই ঐ মিত্রতার শর্ত ছিল- কাইনুকাইরা আক্রান্ত হলে তাদের মিত্ররাও এদের রক্ষা করতে এগিয়ে যেতে হবে। যেহেতু রাসুল সাঃ নেতৃত্বে ইসলাম গ্রহণের ফলে মদিনার সকল মুশরিক গোত্র এক উম্মাহতে অঙ্গীভূত হয়ে যাওয়ার কারণে তাদের পূর্বকৃত মিত্রতা অকার্যকর হয়ে গেলেও যখন মুসলিমদের সাথে বানু কাইনুকাদের যুদ্ধ বেঁধে যায় তখন কিছু খাযরাজদের মধ্যে পূর্বের মিত্রতা জনিত দুর্বলতা প্রকাশ পায়। আর এই অবস্থায় আল-কোরআনের এই আয়াত দিয়ে আল্লাহ উম্মাহর কি করতে হবে তার স্পষ্ট নির্দেশ বলে দিয়েছিলেন। কাজেই আমার দৃষ্টিকোণ থেকে এই আয়াত নাজিলের প্রেক্ষাপটে একটি অনুবাদ এভাবে হতে পারে-

হে মুমিনগণ! তোমরা ইহুদী ও খৃষ্টানদেরকে তোমাদের মিত্র করনা এবং তাদের নিরাপত্তা প্রদানকারী (Protectors) হবে না। তারা পরস্পর পরস্পরের মিত্র এবং নিরাপত্তা প্রদানকারী। এবং তোমাদের মধ্যে যে কেহ তাদেরকে নিরাপত্তা প্রদান করিবে সে তাদেরই একজন হবে। নিশ্চয়ই আল্লাহ্‌ অন্যায়কারীকে পরিচালিত করেন না।

এন্টি মুসলিমরা ইসলামকে হেয় করার উদ্দেশ্য পূর্ণ হয় এমন অনুবাদিত আয়াত পেলে তৎক্ষণাৎ তুলে নিয়ে আসেন। আর দিকে দিকে প্রচার করতে লেগে পড়েন। তাদের প্রতি আমার প্রশ্ন-একটি ইংরেজি কবিতাকে খুব সহজে ডিকশনারি গেটে বাংলায় অনুবাদ করা গেলে সেটি কি ১০০ভাগ আসল ইংরেজি কবিতার ভাব লক্ষ্য প্রকাশ করতে পারবে! নিশ্চয় না! অনুবাদ কর্মটি খুব জটিল! এজন্য অনুবাদকারীকে ইংরেজি ভাষায় ইংরেজদের মত করে বুঝার ক্ষমতা থাকতে হবে। ইংরেজিতে শতকরা একশতে একশত নাম্বার পেতে হবে নতুবা কবিতাটি কবিতা না হয়ে ফুলকপি বাঁধাকপি ধরণের কবিতায় পর্যবেশিত হবে।

আল-কোরআনের বেলা অনুবাদ কর্মটি আরও জটিল, কারণ আল কোরআনের ভাষা, ভাষার অলংকরণ, বাক্য প্রয়োগের ধারা ইত্যাদি সমকালীন আরবি সাহিত্যের নয়। এটি ১৫শত বছর আগের কোরেশী আরবি ভাষা বিন্যাস, সে সময়ের মানুষের বুঝার উপযোগী বাক্য প্রয়োগ, অলংকরণ ব্যবহার করা হয়েছিল। কাজেই একজন অনুবাদকে শুধু আরবিতে পারদর্শী হলেই হবেনা ১৫ শত বছর আগের কুরাইশী আরবি সাহিত্যে প্রচুর দখল রাখতে হবে।

আল-কোরআনের কোন এক আয়াত পড়েই কেউ তাৎক্ষণিক ভাবে তাসলিমা নাসরীনদের মত সিদ্ধান্ত আসা বেকুবি হবে। আল-কোরানের সব আয়াত গুলোর কোন একক প্রেক্ষাপটে নাজিল হয় নাই বা মুসা নবী আঃ কাছে তৌরাত যে ভাবে নাজিল হয়েছিল সে ভাবে একবারে তা নাজিল হয় নাই। আল কোরআন দীর্ঘ ২৩ বছরে অল্প অল্প করে ঘটে যাওয়া ঘটনার প্রেক্ষাপটে নাজিল হয়েছিল। তাই প্রাথমিক দিকের নাজিল কৃত অনেক আয়াত ছিল অন্তর্বর্তীকালীন সময়ের প্রেক্ষাপটে তাই শেষের দিকে এসে অনেক আয়াত পরিবর্ধন হয়ে নতুন আয়াত দ্বারা পরিপূর্ণতা লাভ করেছিল। তাই কোন এক আয়াত পড়েই আহা পাইছিরে বলে ঝাপ দেবার আগে এই বিষয়ে অন্য আয়াত গুলোও পড়ে নেয়া উচিত!

কোরানিক সুনান হল- কোন এক বিষয়ে সিদ্ধান্ত নেবার আগে আল কোরআনের একাধিক আয়াতকে সামনে এনে বিচার বিশ্লেষণ করে তবেই সিদ্ধান্তে আসতে হয়। তবে খুব গুরুত্ব দিয়ে অনুধাবন করা উচিত যে- কোরানিক ঐতিহাসিক সেই প্রেক্ষাপটকে উপেক্ষা করলে মূল অর্থ পরিবর্তন হয়ে যেতে পারে। কিন্তু এই অজ্ঞতাকে চোখে আঙ্গুল দিয়ে দেখিয়ে দেবার পরও একে নিয়ে চর্বিত-চর্বণ কপটতার শামিল। দুঃখজনক হলো এই চর্চা জণ্ডিস খানরা ব্লগগুলোতে আজকাল অনেকে করে চলছেন!!!

একজন সঠিক মুসলিম জানেন যে- একজন অমুসলিমদের প্রতি একজন মুসলিমের সম্পর্ক কেমন হবে, তার স্পষ্ট দিক-নির্দেশনা আল্লাহ পাক আল-কোরআনে দিয়ে রেখেছেন! বাস্তব সত্য হচ্ছে যে- নানাবিধ প্রতিকূলতার জন্য পৃথিবীর প্রতিটি ব্যক্তির সাথে ব্যক্তির, সম্প্রদায়ের সাথে সম্প্রদায়ের, রাষ্ট্রের সাথে রাষ্ট্রের বন্ধুত্ব গড়ে উঠেনা। কিন্তু তার মানে এই নয় যে- বন্ধুত্ব নেই বলে তারা পরস্পরের দুশমন হয়ে যায়। বন্ধুত্ব অনেক প্রকার হতে পারে। ব্যক্তিক, সামাজিক, ব্যবসায়িক, পেশাভিত্তিক, রাষ্ট্রিক ও আন্তর্জাতিক। তবে যদি ধরে নেয়া হয় যে- এই আয়াত দ্বারা ব্যক্তি সহিত ব্যক্তির বন্ধুত্বকে নিষেধ করা হয়েছে, তবে সেই নিষেধ হবে আত্মিক বন্ধুত্বতা করার উপর, আর আত্মিক বন্ধুত্বের জন্য অবশ্য বেশ কিছু শর্ত পূরণ হবার দাবি রাখে।

ব্যক্তি, সম্প্রদায়, রাষ্ট্র ও আন্তর্জাতিক বন্ধুত্ব বজায় সম্পর্কে আল-কোরআনে আল্লাহ আমাদের নির্দেশ দিচ্ছেন যে- যে সব অমুসলিম, ব্যক্তি, সম্প্রদায়, রাষ্ট্র, ও আমাদের সাথে ভাল ব্যবহার করবে, আমরা যেন তাদের সাথেও ভাল ব্যবহার করি। যারা জানেন না- তাদের জানার জন্য আমি এখানে তার উল্লেখ করছি। উপরের বহুল আলোচিত আয়াতের কিছু পরের আয়াত নং ৫৭-৫৮ তে আল্লাহ পরিষ্কারভাবে ব্যাখ্যা করে দিয়েছেন, কাদের সাথে এক জন মুসলিম বন্ধুত্ব করতে পারবে বা পারবেনা-

হে মুমিনগণ, আহলে কিতাবদের মধ্য থেকে যারা তোমাদের ধর্মকে উপহাস ও খেলা মনে করে, তাদেরকে এবং অন্যান্য কাফেরকে বন্ধু রূপে গ্রহণ করো না। আল্লাহকে ভয় কর, যদি তোমরা ঈমানদার হও। আর যখন তোমরা নামাযের জন্যে আহবান কর, তখন তারা একে উপহাস ও খেলা বলে মনে করে। কারণ, তারা নিবোর্ধ। (৫:৫৭-৫৮)

উপরের আয়াতের আলোকে যদি দেখি তাহলে শুধু ইহুদি নাসারা নয়, যারা যেখানেই হোক এমনকি এই ব্লগেও আমার ধর্মকে উপহাস করে, আমাদের রাসুল সাঃ কে নিয়ে খারাপ উক্তি করে, আমাদের বিশ্বাসকে ভ্রান্ত বলে, আর সে যদি মুসলিম মা-বাবা'র সন্তানও হয়ে থাকে কিংবা আমার আপন ভাই হয়ে থাকে তার সাথেও আমাদের আত্মিক সম্পর্কযুক্ত বন্ধুত্ব হতে পারেনা।

আর যদি কোন ইহুদি-নাসারা কিংবা নাস্তিক যিনি আমার ধর্ম, আমার বিশ্বাস, আমার রাসুল সাঃ, আমার কিতাব নিয়ে নীরব থাকেন, কোন ধরণের নেগেটিভ আচরণ না করেন, তাহলে আত্মিক না হলেও সামাজিক বন্ধুত্ব করতে আপত্তি থাকার কথা নয়। এই নীতি ব্যক্তিক, সামাজিক, রাষ্ট্রিক ও আন্তর্জাতিক সকল ক্ষেত্রে প্রযোজ্য হবে।

সূরা আল-মুমতাহিনার ৯ নং আয়াতে আল্লাহ নিষেধ করেন-

আল্লাহ কেবল তাদের সাথে বন্ধুত্ব করতে নিষেধ করেন, যারা ধর্মের ব্যাপারে তোমাদের বিরুদ্ধে যুদ্ধ করেছে, তোমাদেরকে দেশ থেকে বহিষ্কৃত করেছে এবং বহিস্কার কার্যে সহায়তা করেছে। যারা তাদের সাথে বন্ধুত্ব করে তারাই জালেম। (৬০:৯)

আবার একই সূরার ৮ নং আয়াতে আল্লাহ বলে দিয়েছেন কাদের সাথে সু-সম্পর্ক রাখা যাবে-

ধর্মের ব্যাপারে যারা তোমাদের বিরুদ্ধে লড়াই করেনি এবং তোমাদেরকে দেশ থেকে বহিষ্কৃত করেনি, তাদের প্রতি সদাচরণ ও ইনসাফ করতে আল্লাহ তোমাদেরকে নিষেধ করেন না। নিশ্চয় আল্লাহ ইনসাফকারীদেরকে ভালবাসেন। (৬০:৮)

উপরোক্ত আয়াত দ্বারা- পানি থেকে তেল যেমন আলাদা হয়ে থাকে, তেমনি অমুসলিমদের সাথে সু-সম্পর্ক রাখা আর না রাখার নির্দেশ স্পষ্ট হয়ে গেছে। একজন স্বল্প জ্ঞানী লোকও বুঝতে পারবেন যে- এই আয়াত দ্বারা আল্লাহ ইহুদি খ্রিষ্টানদের মধ্যে এক ক্ষুদ্র মানব গোষ্ঠীকে বোঝাচ্ছেন যারা মুসলিমদের সাথে সশস্ত্র যুদ্ধে জড়িয়ে পড়েছিল। এখনও পৃথিবীতে দুই রাষ্ট্রের মধ্যে যুদ্ধ বেধে গেলে স্বদেশী সদস্য কেউই তখন আক্রমণকারীদের সাথে মিত্রতা রাখতে পারবেনা, কেউ যদি করে বসে তাকে সবাই মীরজাফর বলে ঘৃণা করবে, এবং রাষ্ট্র তার বিরুদ্ধে রাষ্ট্রদ্রোহিতার অভিযোগে শাস্তি দিতে দ্বিধা করবেনা।

-আমি আবারও বলছি ৫.৫১ কোরআনের আয়াত দিয়ে কোনভাবেই পৃথিবীর যে কোন মতবাদে বিশ্বাসী ভাল, সভ্য ও শান্তিকামী মানুষদের বুঝানো হয়নি।

পঠিত : ৩৮৬ বার

মন্তব্য: ০