Alapon

কোরবানি আমাদের যা শেখায়

পৃথিবীতে কোরবানির সূচনা হয়েছিলো আদম আলাইহিস সালাম এর পুত্র হাবিল ও কাবিলের মাধ্যমে। আল্লাহ রাব্বুল আলামিন বলেন,‘আর তাদেরকে আদমের দু-ছেলের সঠিক কাহিনীও শুনিয়ে দাও । তারা দুজন কুরবানী করলে তাদের একজনের কুরবানী কবুল করা হলো, অন্য জনেরটা কবুল করা হলো না । সে বললো, আমি তোমাকে মেরে ফেলবো। সে জবাব দিল, আল্লাহ তো মুত্তাকিদের নজরানা কবুল করে থাকেন।(সুরা মায়েদা, আয়াত : ২৭)। এ আয়াত থেকে আমরা জানতে পারি কোরবানির অন্যতম উদ্দেশ্য হলো তাকওয়া অর্জন করা। এ তাকওয়া আমরা কীভাবে অর্জন করতে পারি সে বিষয়ে বিস্তর আলোচনা প্রয়োজন। প্রতিবছর কোরবানি আমাদের মাঝে আসে আবার চলে যায় । কিন্তু আমরা আমাদের জাতীয় জীবনে কোরবানির শিক্ষাকে কাজে লাগাতে পারছিনা । এ ক্ষেত্রে আমরা ইবরাহিম ও ইসমাইল আলাইহি সালামে জীবন থেকে শিক্ষা নিতে পারি। আমরা জানি যে, নূহ নবি আলাইহিস সালাম এরপর ইবরাহিম আলাইহিস সালাম এর মাধ্যমে দ্বিতীয় প্রজন্মের বিস্তৃতি ঘটানো হয়েছিলো। তার জীবন ছিলো সংগ্রামময়। ইরাকের বাবেল আঞ্চলে তিনি দ্বীনের দাওয়াতি কার্যক্রম পরিচালনা করেন। কিন্তু নানা জুলুম ও নির্যাতনের পরও তিনি আল্লাহর দ্বীন প্রতিষ্ঠার পথ থেকে পিছু হটেননি । বরং তিনি দ্বীন প্রতিষ্ঠার সর্বত্মক মিশন ও ভিশন নিয়ে ময়দানে ঝাঁপিয়ে পড়েন। তিনি নিজের স্ত্রী ও ভাইপো লুত আ: কে নিয়ে ইরাক থেকে হিজরত করেন। লুত আলাইহিস সালাম কে জর্ডানের দায়ী হিসেবে নিযুক্ত করেন। বড় ছেলে ইসমাইল আলাইহিস সালাম কে মানবহীন জাজিরাতুল আরবে নিয়ে যান। আর ইসহাক আলাইহিস সালাম কে ফিলিস্তিনে নিযুক্ত করেন। দাসী কাতুরা ঘরে জন্ম নেয়া সন্তান মিদিয়ান আলাইহিস সালাম কে সিরিয়ার নিকটবর্তী মা'আন এলাকার নিযুক্ত করেন। তিনি তার পুরো জীবন আল্লাহর পরিক্ষায় অতিবাহিত করেছেন এবং সকল পরিক্ষায় তিনি আল্লাহর সন্তোষ্টি অর্জন করেন। তার একমাত্র বড় ছেলেকে নিজ হাতে জবেহ করার ঘটনা তাঁর সামগ্রিক জীবনের সকল ত্যাগ তিতীক্ষার ঘটনা সমূহকে ছাড়িয়ে যায়। এ ঘটনার গুরুত্ব ও তৎপর্য এত বেশি যে, যুগ যুগ ধরে সকল মুসলমানকে আল্লাহর রাহে জীবন উৎসর্গ করার প্রেরণা জোগায় এবং ভবিষ্যৎ প্রজন্মেকে কীভাবে গড়ে তুলতে হবে, সেই পথ দেখায় । ‘কোরবানি আমাদের যা শেখায়’ এ বিষয়ে কিছু আলোচনা রাখতে চাই।

আমরা সবাই জানি যে, ইবরাহিম আলাইহিস সালাম কে আগুনের কুন্ডলীতে নিক্ষেপ করা হয়েছিলো। আল্লাহর রহমতে এটা তাকে কোন ক্ষতি করতে পারেনি। এরপর তিনি হিজরত করার সিদ্ধান্ত নিলেন । স্বদেশ থেকে বেরিয়ে যাবার কষ্ট অনেক। এই মাজলুম অবস্থায় তিনি আল্লাহর নিকট পুত্র সন্তান লাভের জন্য দোয়া করেন । তিনি আল্লাহর নিকট এ ভাবে দোয়া করেন, ‘হে পরওয়ারদিগার! আমাকে একটি সৎকর্মশীল পুত্র সন্তান দাও।’(সূরা সাফফাত , আয়াত: ১০০)। এ দোয়া কবুলের সুসংবাদ তিনি ৮৬ বছর বয়সে পান । একজন মানুষের পক্ষে এরূপ ধৈর্য ধারণ করা সত্যিই কঠিন । তারপরও তিনি আল্লাহর এ পরিক্ষায় উত্তীর্ণ হয়েছিলেন। একজন মুসলিম মাতা-পিতার জন্য নেক সন্তন পাবার আকাঙ্ক্ষা থাকা উচিত । নেক সন্তানের জন্য দোয়া করা কোরবানির অন্যতম শিক্ষা।

সন্তানদেরকে আল্লাহর পরিচয় শিক্ষা দেওয়া পিতা-মাতার প্রধান কর্তব্য। সকল নবি-রাসূলগণ তাদের সন্তানদেরকে দ্বীনি শিক্ষায় শিক্ষিত করার জন্য অনেক চেষ্টা করেছেন।এ ক্ষেত্রে মা হাজেরার ভূমিকা অসাধারণ। সন্তানকে কীভাবে দ্বীনের শিক্ষা দিতে হয় এবং বাবা দূরে থাকলেও সন্তানকে কেমন করে আল্লাহর প্রিয় বান্দা হিসেবে গড়ে তোলা যায়; তা তিনি জানতেন । যাই হউক,
মা হাজেরার কোলে বড় হতে লাগলেন শিশু ইসমাইল। ধীরে ধীরে তাঁকে রেসালাতের দায়িত্ব ও মর্যাদা শিক্ষা দিলেন। সম্ভবত এর পাশাপাশি বিভিন্ন নবীদের সংগ্রামী জীবনের ইতিহাস শুনিয়ে থাকবেন। হযরত ইসমাইল আলাইহিস সালাম শিশুকাল থেকে বাবাকে দ্বীন প্রচারের কাজে ব্যাস্ত থাকতে দেখেছেন। বাবা মায়ের ত্যাগ ও সেক্রিফাইস দেখে দেখে বড় হতে শিখেছেন যে কীভাবে আল্লাহর আনুগত্য করতে হয় ।
যা তাকে আল্লাহর পরিক্ষায় পাশ করতে সহায়তা করেছে। আল্লাহ তায়ালা তাই পিতা-পুত্রের সেই ঐতিহাসিক পরিক্ষার মূহুর্তটি কোরআনে খুব চমৎকার ভাবে তুলে ধরেছেন। আল্লাহ বলেন , ‘সে পুত্র যখন তার সাথে কাজকর্ম করার বয়সে পৌঁছুলো তখন একদিন ইবরাহীম তাকে বললো, ‘হে পুত্র! আমি স্বপ্নে দেখি তোমাকে আমি যাবেহ করছি, এখন তুমি বল তুমি কি মনে কর?’ সে বললো, ‘হে আব্বাজান! আপনাকে যা হুকুম দেয়া হচ্ছে তা করে ফেলুন, আপনি আমাকে ইনশাআল্লাহ সবরকারীই পাবেন।’(সুরা সাফফাত , আয়াত : ১০২)
এ আয়াতের প্রতি একটু গভীর ভাবে লক্ষ্য করলে দেখা যায় যে , আল্লাহর নির্দেশের ব্যাপারে বাবা ছেলের নিকট মতামত চাইছেন । আর সন্তান বলছে, ‘হে আব্বাজান ! আপনাকে যা হুকুম দেয়া হচ্ছে তা করে ফেলুন, আপনি আমাকে ইনশাআল্লাহ সবরকারীই পাবেন।’ এর মানে হচ্ছে ইবরাহিম আলাই সালাম আল্লাহর নিকট যে নেক সন্তান চেয়েছিলো তার প্রাপ্তিটার বিষয়ে তিনি নিশ্চিত হয়ে নিলেন। ইসমাইল আলাইহিস সালাম এর কথা দ্বারা বুঝা যায় যে তিনি রিসালাতের বিষয় এবং সবরকারীদের ত্যাগ তিতীক্ষা সম্পর্কে ওয়াকিফহাল।যা তিনি তার মা থেকে শিক্ষা পেয়েছিলেন ।
কোরবানি আমাদেরকে আদর্শ পিতা-মাতা হতে শিক্ষা দেয় । আল্লাহর নিদের্শে ইবরাহিম আলাইহিস সালাম তার প্রিয় স্ত্রী ও একমাত্র শিশুপুত্র ইসমাইলকে জনমানবহীন এলাকায় রেখে আসেন । তারা আল্লাহর নির্দেশের ব্যাপারে কোন কম্প্রমাইজ করেননি। তাদের ব্যক্তিগত কোন কষ্ট তারা প্রকাশ করেনি। তারা শুধু আল্লাহর সন্তুষ্টি চেয়েছিলো। হযরত হাজেরা আলাইহিস সালাম নবীকে শুধু আল্লাহর নির্দেশনার বিষয় জানতে চেয়েছেন যে , এটা আল্লাহর নির্দেশ কিনা ? এ ধরনের স্ত্রী /মা হওয়া পৃথিবীর ইতিহাসে বিরল। উপরন্ত ইবরাহিম আলাইহিস সালাম রেখে যাবার সময় পিতৃমমতা জেগে উঠবে; তাই তিনি পিছনে ফিরে তাকাননি। তিনি তাদের জন্য এ বলে দোয়া করেছেন , ‘হে আমাদের রব ! আমি একটি তৃণ পানিহীন উপত্যকায় নিজের বংশধরদের একটি অংশকে তোমার পবিত্র গৃহের কাছে এনে বসবাস করিয়েছি। পরওয়ারদিগার ! এটা আমি এ জন্য করেছি যে, এরা এখানে নামায কায়েম করবে। কাজেই তুমি লোকদের মনকে এদের প্রতি আকৃষ্ট করো এবং ফলাদি দিয়ে এদের আহারের ব্যবস্থা করো, হয়তো এরা শোকরগুজার হবে।’ (সূরা ইবরাহিম, আয়াত: ৩৭)। নবীর দোয়া থেকে এটা পরিস্কার যে, তিনি আল্লাহর নির্দেশের তাৎপর্য বুঝতে পেরেছেন। তিনি এখানে নতুন একটি জাতি গড়ার প্রত্যয়ে তাদেরকে এখানে রেখেছিলেন। তিনি ভবিষৎ বংশধরদের জন্য দোয়া করেছেন । আজকাল আমরা আমাদের সন্তানদের জন্য এবং ভবিষ্যৎ বংশধরদের জন্য দোয়া করিনা । সন্তানকে দ্বীন শিক্ষা দেবার জন্য দূরে কোথাও পাঠাতে ভয় পাই । সন্তানদের দ্বীনদারির বিষয়ে আমাদের কোন পরিকল্পনা থাকেনা । আমরা শুধু কামনা করি যে, সন্তান কীভাবে অনেক অর্থ-বিত্তশালী হবে । তাদেরকে আল্লাহর রাহে বিলিয়ে দিতে পারিনা। অথচ মা হাজেরা একা একা সন্তানকে এই ক্ষুদ্র বালুকাময় মরুভূমিতে লালন পালন করেছিলেন । পিতার আদর্শে বড় করে তোলেন । ইবরাহিম আলাইহিস সালাম ফিলিস্তিন থেকে এসে একমাত্র পুত্র ইসমাইলকে দেখে হতাশ হননি । বরং নেক সন্তানের বাস্তব প্রমাণ পেলেন। বাবা ছেলে মিলে তৈরি করলেন বাইতুল্লাহ। যা সকল বাবাদের জন্য এক অনন্য আদর্শ ।
আমাদের সন্তানদেরকে কিন্তু আমরা মসজিদ আবাদের কাজে লাগাতে পারি । জুমাবারে পিতা-পুত্র মিলে স্থানীয় মসজিদের খাদিমকে সহযোগিতা করতে পারি । এতে ছোট বেলা থেকে সন্তানের নামাজ কায়েমের জযবা তৈরি হবে এবং মসজিদের সাথে সর্ম্পক দৃঢ় হবে।


ইবরাহিম আলাইহিস সালাম তাঁর জীবনে আল্লাহর সকল পরিক্ষায় উত্তীর্ণ হয়েছেন । যেখানে তার দেশ প্রেম ও আত্মীয়-স্বজন দ্বীন কায়েমের পথে বাধা হয়ে দাঁড়ায়নি। বিবি হাজেরা ও একমাত্র শিশু ইসমাইলকে জনমানবহীন এলাকায় কিছু খেজুর ও পানি দিয়ে ফিলিস্তিনে চলে আসেন। প্রিয়তমা স্ত্রী ও একমাত্র পুত্রের ভালোবাসা যেখানে আল্লাহর হুকুম পালনে বাধা হয়নি। একমাত্র পুত্র ইসমাইলকে যবেহ করতে যেখানে কোন দ্বিধা কাজ করেনি। অথচ একজন বাবা হিসেবে ইবরাহিম আলাইহিস সালাম সন্তানের প্রতি ভালোবাসার যেমন কমতি ছিলো না। অনুরূপ তিনি তার পিতার জন্য দোয়া করেছেন। পিতা আল্লাহর দুশমন হওয়ার কারণে সেই দোয়া আবার প্রত্যাহার ও করে নিয়েছিলেন। আ্ল্লাহ কোরআনে এ অংশটি তুলে ধরেছেন এভাবে, ‘ইবরাহীম তার পিতার জন্য যে মাগফিরাতের দোয়া করেছিল তা তো সেই ওয়াদার কারণে ছিল যা সে তার বাপের সাথে করেছিল কিন্তু যখন তার কাছে একথা পরিস্কার হয়ে গেছে যে, তার বাপ আল্লাহর দুশমন তখন সে তার প্রতি বিমুখ হয়ে গেছে । যথার্থই ইবরাহীম কোমল হৃদয়,আল্লাহভীরু ও ধৈর্যশীল ছিল।(সুরা তাওবা, আয়াত:১১৪)। অথচ আধুনিক এই সময়ে আমারা দ্বীন ইসলামের কাজ করার চেতনাটুকু হারিয়ে ফেলছি। কিছু অংশ পালন করছি । আবার অনেকাংশই পালন করছি না । পশু কোরবানি দেই তবে সন্তানকে কোরআন শেখাই না। প্রতিবেশীকে ইসলামের দাওয়াত পৌঁছাই না । নিজেকে ও পরিবারকে আল্লাহর পথে উৎসর্গ করতে পারিনা । এ জন্য জাতীয় জীবনে অনেকাংশেই আমারা কোরবানির সুফল পাচ্ছিনা । আমারা আমাদের সমাজে জাতীয় অনুষ্ঠানগুলোর ব্যাপারে যেভাবে চেতনা লালন করি , কোরবানির বিষয়ে তেমন চেতনা লালন করিনা । শুধু ধর্মীয় আচার হিসেবে পালন করি । একটি পশু জবাই দিতে হবে তাই দেই ; কিন্ত যে চেতনা একটি সভ্যতা ও জাতি বির্নিমান করেছিলো, সেই কোরবানির চেতনা আমরা কয়জনে লালন করি ? দ্বীনের প্রয়োজনে যে কোন ত্যাগের মানসিকতা রাখাই কোরবানির শিক্ষা ।

আমরা কোরবানি থেকে এ শিক্ষা ও নিতে পারি যে বৃদ্ধ বয়েসেও কীভাবে আল্লাহর দেয়া দায়িত্ব যথাযথ ভাবে পালন করা। যেমনি ভাবে হযরত ইবরাহিম আলাইহিস সালাম রেসালাতের কাজ আঞ্জাম দিয়ে গেছেন। একদা তিনি স্বপ্ন দেখলেন আল্লাহর পক্ষ থেকে নিদের্শ ; প্রিয় পুত্রকে যবেহ করার । এমন নির্দেশ পালন করা যেকোন বাবার জন্য খুবই কঠিন। এটা কোন মামুলি বিষয় ছিলো না । নবীদের স্বপ্নও আল্লাহর ওহী ; এবিষয়ে ইসমাইল আলাইহিস সালাম জানতেন । ইবরাহিম আলাইহিস সালাম তার প্রিয় সন্তানের নিকট তাঁর স্বপ্নের কথা বললেন । ইসমাইল সাথে সাথে বললেন বাবা , আপনি আল্লাহর নির্দেশ পালন করুন। আল্লাহর প্রতি পিতা-পুত্রের আনুগত্যের সেই কথোপকথন ও যবেহের সেই দৃশ্য নিঃসন্দেহে কল্পনাকে ছাড়িয়ে যায়।
বাবা সন্তানকে উপুড় করে শোয়ালেন এবং নিজের চোখ বাধঁলেন, যেন সন্তানের মায়াবী চাহনি দেখে পিতৃস্নহ জাগে না ওঠে। ইবরাহিম ছুরি চালিয়েছেন। আল্লাহ বলেন,‘শেষ পর্যন্ত যখন এরা দু’জন আনুগত্যের শির নত করে দিল এবং ইবরাহীম পুত্রকে উপুড় করে শুইয়ে দিলো।’(সুরা সাফফাত, আয়াত ১০৩)। তিান মনে করেছেন যে তার পুত্র যবেহ হয়ে গেছে ।
কিন্তু ইসমাইলের স্থলে একটি বকরি কোরবানি করিয়ে নিলেন। এ দৃশ্য মহান আল্লাহ রাব্বুল আলামিনকে এতো খুশি করেছে যে , তিনি এ ঘটনাকে পুরো মানব জাতির সামনে তুলে ধরেছেন এবং পশু কোরবানির বিধান করে দিলেন । আল্লাহ বলেন, ‘তুমি স্বপ্নকে সত্য করে দেখিয়ে দিয়েছো। আমি সৎকর্মকারীদেরকে এভাবেই পুরস্কৃত করে থাকি। নিশ্চিতভাবেই এটি ছিল একটি পরীক্ষা।’(সুরা সাফফাত, আয়াত ১০৫-১০৬)। অর্থাৎ তোমার হাতে তোমার পুত্রকে যবেহ করা উদ্দেশ্য ছিল না। বরং দুনিয়ার কোন জিনিসকে তুমি আমার মোকাবিলায় বেশি প্রিয় মনে করো কিনা , সে পরীক্ষা নেয়াই ছিল আসল উদ্দেশ্য। সুতরাং আল্লাহর আনুগত্য ও ভালোবাসার সর্বোচ্চটুকু অর্জন করাই কোরবানির আসল শিক্ষা।

শয়তানকে মোকাবেলায় পরিবারের সামগ্রিক প্রচেষ্টা থাকা উচিত। শয়তান সবসময় বনী আদমকে ধোঁকা দেওয়ার চেষ্টা করেছে । ইবরাহিম আলাইহিস সালাম যখন তার পুত্রকে কোরবানী করার জন্য মিনার নিকট নিয়ে যাচ্ছিলেন; তখন শয়তান তিনবার প্রতিবন্ধকতা তৈরি করে। তিনি তিনবারই শয়তানকে নুড়ি পাথর মেরে তাড়িয়ে দেন । ইবরাহিম আলাইহিস সালাম তাঁর পরিবারকে এমন ভাবে গঠন করেছেন, যেখানে শয়তানের কোন কুমন্ত্রণা কাজে আসেনি। আমরা আমাদের পরিবারকে যদি ইসলাম পালনের সহজ ও সুন্দর পরিবেশ তৈরি করতে পারতাম তা হলে আমারা কোরবানির বাস্তব ফলাফল পেতে পারতাম।

দ্বীন কায়েমের পথে সকল যুগে সব সময় বিভিন্ন রূপে শয়তান ধোঁকা দিয়ে আমাদেরকে বাঁকাপথে পরিচালিত করতে চায়। সে ক্ষেত্রে আমাদেরকে আরো সচেতন হতে হবে। আল্লাহ রাব্বুল আলামিন বলেন, ‘হে ঈমানদারগণ ! তোমরা পুরোপুরি ইসলামে প্রবেশ করো এবং শয়তানের অনুসারী হয়ো না, কেননা সে তোমাদের সুস্পষ্ট দুশমন।’ (সুরা বাকারা, আয়াত: ২০৮)।

শুরুতেই বলেছি যে, কোরবানি আমাদেরকে তাকওয়ার গুনাবলি আর্জন করতে শেখায় । জাহেলি যুগের লোকেরাও কোরবানি করতো কিন্তু তারা গোস্ত খেত না । ইসলাম আমাদেরকে আল্লাহর এ নিয়ামত ভক্ষণ করতে এবং শুকরিয়া আদায় করার নির্দেশ দিয়েছে। দেখুন, একটি পশু ঘাস,লতা-পাতা ও দানদার খাবার খেয়ে জীবন ধারণ করে । তাকে আমাদের অধীন করে দেয়া হয়েছে এবং আল্লাহ আমাদের জন্য এ পশুকে হলাল করেছে। সুতরাং এটা আমাদের জন্য বড় অনুগ্রহ । অথচ আমরা তার হুকুমগুলো যাথাযথ ভাবে মানছিনা । ঘুষ , দুর্নীতি ও অবৈধ আয় রোজগার করছি । হালাল-হারামের কোন তোয়াক্কা করছিনা । আবার কেউ কেউ বড় পশু কিনে সুনাম অর্জনের চেষ্টা করেন । যা কোরবানির চেতনা পরিপন্থী।
আল্লাহ রাব্বুল আলামিন বলেন,‘তাদের গোশতও আল্লাহর কাছে পৌঁছে না, তাদের রক্তও না। কিন্তু তাঁর কাছে পৌঁছে যায় তোমাদের তাকওয়া। তিনি তাদেরকে তোমাদের জন্য এমনভাবে অনুগত করে দিয়েছেন যাতে তাঁর দেয়া পথনির্দেশনার ভিত্তিতে তোমরা তাঁর শ্রেষ্ঠত্ব ঘোষণা করো। আর হে নবী! সৎকর্মশীলদেরকে সুসংবাদ দিয়ে দাও।’(সুরা হজ , আয়াত : ৩৭)।


বাংলাদেশসহ সমগ্র বিশ্বে করনা ভাইরাস ছড়িয়ে পড়েছে। বাংলাদেশে প্রতিদিন মৃত্যুর মিছিল বেড়েই চলছে । সারা দেশে লকডাউন । অসংখ্য মানুষ চাকরি হারিয়েছে । এই সময়ে যে সকল সামর্থবান মানুষ কোরবানি দিবে তাদের উচিত কোরবানির গোস্ত বেশি বেশি বিলিয়ে দেয়া। আল্লাহ রাব্বুল আলামিন বলেন : “আর তিনি তাদেরকে চতুষ্পদ জন্তু হতে যে রিযক দান করেছেন, নির্দিষ্ট দিনগুলোতে তার উপর আল্লাহর নাম উচ্চারণ করতে পারে। কাজেই তোমরা নিজেরা) তাথেকে খাও আর দুঃস্থ অভাবীদের খাওয়াও।(সুরা হজ,আয়াত: ২৮)।

গোস্ত ৩ দিনে বেশি জমা না রাখা :
সালামাহ ইবনু আকওয়া‘ (রাঃ) হতে বর্ণিত। তিনি বলেন, নাবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেন ; তোমাদের যে লোক কুরবানি করেছে, সে যেন তৃতীয় দিনে এমন অবস্থায় সকাল অতিবাহিত না করে যে, তার ঘরে কুরবানীর গোশ্ত কিছু থেকে যায়। পরবর্তী বছর আসলে, সহাবীগণ বললেন;
হে আল্লাহর রাসূল! আমরা কি তেমন করব, যেমন গত বছর করেছিলাম? তখন তিনি বললেন; তোমরা নিজেরা খাও, অন্যকে খাওয়াও এবং সঞ্চয় করে রাখ, কারণ গত বছর মানুষের মধ্যে ছিল অনটন। তাই আমি চেয়েছিলাম, তোমরা তাতে সহযোগিতা কর।
(মুসলিম ৩৫/৫, হাঃ ১৯৭৪) (আধুনিক প্রকাশনী- ৫১৬২, ইসলামিক ফাউন্ডেশন- ৫০৫৮)

উপরোক্ত হাদিস থেকে আমরা যেটা বুঝতে পারলাম সেটা হচ্ছে অভাব অনটনের সময় রাসূল সাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম তিন দিনের বেশী গোস্ত রাখতে নিষেধ করেছেন । যেহেতু আমরা একটা মহামারির মধ্য দিয়ে সময় অতিক্রম করছি ,সেহেতু এ সময়ে গরীব, দুঃস্থ ও অসহায় মানুষের মাঝে ঈদের আনন্দ ভাগাভাগির করা উচিত । আল্লাহ রাব্বুল আলামিন আমাদেরকে কোরবানির শিক্ষাগুলো অন্তরে ধারণ ও বাস্তবে পারিপালনের তাওফিক দিন। আমিন ।

পঠিত : ৭০৩ বার

মন্তব্য: ০