Alapon

????বইনোট : আদর্শ কিভাবে প্রচার করতে হবে?



????বইনোট
আদর্শ কিভাবে প্রচার করতে হবে?
লেখক : আবু সালীম মুহাম্মদ আবদুল হাই

প্রকাশকের কথা :
ইসলামী বিপ্লবের জন্য প্রয়োজন ইসলামী আদর্শের প্রচার। ইসলামী আদর্শ প্রচারের জন্য প্রয়োজন যথেষ্ট জ্ঞান ও প্রজ্ঞা। এ উদ্দেশ্যকে কার্যকরী করার পথে সহায়ক এমন কতিপয় পরামর্শ এ পুস্তকে সন্নিবেশিত করা হয়েছে। এ থেকে উপকৃত হওয়ার জন্য শর্ত হিসেবে নিম্নোক্ত বিষয়াবলীর প্রতি লক্ষ্য রাখা একান্ত আবশ্যক।
• যে ব্যক্তি ইসলামী আদর্শের প্রচারকালে এসকল পরামর্শ থেকে উপকৃত হতে ইচ্ছুক, তাঁকেই সর্বাগ্রে ঈমান ও ইসলাম সম্পর্কে সুষ্ঠু ধারণা রাখতে হবে। এবং নিজের মধ্যে সকল আকীদা-বিশ্বাসকে যথাযথভাবে কার্যকরী রাখতে হবে।
• জীবনের যে লক্ষ্য ইসলাম নির্ধারণ করে দিয়েছে তাকে নিজের জীবনের একমাত্র লক্ষ্যে পরিণত করতে হবে।
• আদর্শ প্রচারকের চরিত্রে এমন কোন বৈষম্য থাকতে পারবে না, যা তাঁর দাবি ও আদর্শের পরিপন্থী।
• যে কোনো কাজ করবে, সম্পূর্ণ আল্লাহর সন্তুষ্টি অর্জনের জন্য করবে —এতে অন্য কোনো স্বার্থ নিহিত থাকতে পারবে না।
• ইসলামী আদর্শের এ প্রচারকার্য একটি আন্দোলন হিসেবে ধারাবাহিকভাবে চলতে থাকবে। কেননা সাময়িক কোনো তৎপরতার দ্বারা কোনো সুষ্ঠু ও স্থায়ী বিপ্লব সাধিত হতে পারে না।

???? মানুষের সঙ্গে সম্পর্ক :
প্রতিটি মানুষই অপরের প্রিয়পাত্র হতে চায়। আর এর একমাত্র কারণ হলো প্রতিটি মানুষেরই সহজাত আকাঙ্ক্ষা হলো অন্যের কাছে উচ্চ মর্যাদা লাভ করা।
সকল মানুষই চায়—সকলেই তার সম্বন্ধে ভালো ধারণা পোষণ করুক, আর এজন্য মানুষ দাওয়াত করে অপরকে খাওয়াচ্ছে, দরিদ্রকে সাহায্যের জন্য উপদেশ দিচ্ছে। কেউ বস্ত্রহীনদের, অন্য হারাদের ডাল-ভাতের দাবি নিয়ে মানবপ্রেমের পরাকাষ্ঠা দেখাচ্ছে।

???? সত্যিকার মুমিনের জীবনে সম্পর্ক স্থাপনের দিক :
যে ব্যক্তি ইসলামী আদর্শে বিশ্বাস করে, এবং চায় যে মানব জীবনের প্রতিটি বিভাগই ও আল্লাহর অবর্তীর্ণ বিধানের প্রাধান্য প্রতিষ্ঠা হোক—তাঁর জন্য প্রথম পদক্ষেপেই মানুষের সাথে নিবিড় ও ঘনিষ্টতর সর্ম্পক স্থাপন এবং একে ব্যাপকতর করা অপরিহার্য হয়ে পড়ে।
একজন নিছক অর্থলোভী ও মর্যাদাকাঙ্ক্ষী ব্যক্তির মানুষের সঙ্গে সম্পর্ক বাড়ানোর এক উদ্দেশ্য হয়ে থাকে, এবং সত্যের পথে আহবানকারী ও আল্লাহর দ্বীনের প্রচারকারীর সম্পর্ক বাড়ানোর উদ্দেশ্য হয় এ ক্ষেত্রে সম্পূর্ণ ভিন্নতর। দ্বীনের প্রচারকদের জন্য মানুষের সঙ্গে সম্পর্ক উন্নত করার জন্যে স্বচেষ্ট থাকা কর্তব্য।

???? নিজেকে সবাই ভালো মনে করে :
-মানব মনের কতিপয় দুর্বলতাঃ-
• প্রত্যেক ব্যক্তিই নিজের সম্পর্কে ভালো ধারণা পোষণ করে এবং নিজের কাজকে নির্ভুল মনে করে।
• মানুষ যতই ভুলের মধ্যে থাকুক না কেন অন্য কেউ তার ছিদ্রান্বেষণ করলে বা ত্রুটি নির্দেষ করলে সে কখনোই তা বরদাস্ত করতে পারে না।
• এমন কর্মী দ্বারা কখনো সমাজের কোনরূপ সংস্কার বা মঙ্গল সাধনের আশা করা যেতে পারে না। যে সর্বদা নিজেকে উচ্চ মর্যাদার অধিকারী বলে মনে করবে, আর সমালোচনা করবে অপরের যাবতীয় দোষ-ত্রুটির।
• নৈতিক অধঃপতনের অতল গহ্বর থেকে হাত ধরে কোন মানুষকে মানবতার উচ্চশিখরে অধিষ্ঠিত করতে হলে চেষ্টা সাধনা প্রয়োজন। এ জন্যে সত্যিকার সহানুভূতিশীল ব্যক্তিকে শরীরের রক্ত, পানি এবং মাথার ঘাম পায়ে ফেলতে হবে।

???? সমাজে বিরূপ প্রতিক্রিয়া এবং পারস্পরিক সম্পর্ক নষ্ট হওয়ার কারণ :
• নিজের ইচ্ছার বিরুদ্ধে কোন কিছু দেখেই মানুষ ক্ষুব্ধ হয়।
• নিজের ত্রুটি বিচ্যুতি উপেক্ষা করে অপরের দোষ ত্রুটির প্রতি দৃষ্টি অধিক নিবন্ধিত করা।
• মানুষকে এ ধারণা আনন্দ দেয় যে, সে যাবতীয় দুর্বলতা থেকে মুক্ত।
• মানুষ নিজেকে বড় এবং অপরকে ছোট মনে করাতে তৃপ্তি অনুভব করে থাকে।

???? মনের ঝাল প্রকাশ করা :
• চরিত্রকে সমালোচনার দূরবীন দ্বারা পরীক্ষা-নিরীক্ষা করা হলে একদিকে যেমন নিজের সংশোধনের পথ সুগম হবে, তেমনি অন্যদিকে অপরের ছিদ্রান্বেষন এবং তাকে অভিযুক্ত করার প্রবণতা থেকে রক্ষা পাওয়া যাবে।
• যখনই আপনি নিজের প্রতি লক্ষ্য রেখে অপরের দোষ-ত্রুটি বিচার করবেন, তখন আপনি তার সংশোধনের জন্য এমন পন্থাই গ্রহণ করবেন, যাতে করে মনে হয় যেন আপনি নিজের সংশোধনের জন্য এগিয়ে আসছেন।
• যাদের সঙ্গে আপনার সম্পর্ক, তারা মূলত কল্পনাপ্রবণ মানুষ নয় এবং তাদের কর্ম প্রবণতাও আপনার ইচ্ছার অনুগত নয় যে—আপনি যখন যা বলবেন তখন তা-ই হয়ে যাবে। বরং আপনাকে যা কিছু করতে হবে— তা এমন সব লোকের মধ্যে করতে হবে, যারা বিভিন্ন মেজাজ এবং বিভিন্ন ভাবাবেগের অধিকারী।


???? সমান ব্যবহার :
আপনার কাছে দ্বীনের দাবী হলো এই যে, আপনি এই জাতীয় পরিবেশে নিজেকে অন্যের সমপর্যায়ের নিয়ে আসবেন এবং সকলের সাথে আন্তরিকতার সাথে কথাবার্তা বলবেন ও মেলামেশা করবেন। তাদেরকেও নিজেদের স্বাধীন মতামত প্রকাশের সুযোগ দান করবেন। যদিও উচ্চ মর্যাদাবোধ আপনাকে তা করার অনুমতি দেয় না।
এ জাতীয় পরিবেশে কাজ করার জন্যও আপনাকে সেসব পরামর্শকেই সম্মুখে রেখে অগ্রসর হতে হবে, যা অন্যের ক্ষেত্রে অনুসৃত হওয়ার জন্যে আলোচিত হয়েছে। এই পরিবেশেও আপনাকে শ্রোতার মনের গতি-প্রকৃতির প্রতি লক্ষ্য রেখে কাজ করতে হবে।

????হাস্যোজ্জ্বল চেহারা :
মহানবী (সাঃ) বলেছেন, তোমরা হাসিমুখে যদি নিজের ভাইয়ের দিকে তাকাও, তাও সদকায় পরিণত হয়। হাসিমুখে একে অপরের সঙ্গে সাক্ষাৎ করার গুরুত্ব অপরিসীম। হাসির মধ্যে মানুষের ব্যাক্তিত্ব লুকায়িত থাকে, হাসলে তা ফুটে উঠে।

????কথা বলার ধরন :
আদর্শের প্রচারকের জন্যে প্রয়োজন :
• ধৈর্য্য সহকারে অপরের বক্তব্য শোনার অভ্যাস করা।
• শ্রোতাকেও নির্বিঘ্নে প্রাণখোলা আলোচনার সুযোগ দেওয়া।
• শ্রোতার বক্তব্য এবং আলোচনা থেকে যুক্তি-তথ্য সংগ্রহ করে নিজের বক্তব্যের সত্যতা প্রমাণ করা।
• শ্রোতার বক্তব্যের বিষয়বস্তু বা আলোচনা যদি সুদীর্ঘ হয় এবং আনুপূর্বিক সকল কথা স্মরণ রাখা অসম্ভব বলে মনে হয়, তাহলে এক্ষেত্রে আলোচনার মাঝে মাঝে নিজের যুক্তিগুলো নোট করে নেওয়া।
• ধৈর্য্য সহকারে বক্তব্য শ্রাবণই যথেষ্ট নয়, বরং জবাব দানকালে যথেষ্ট সংযম সর্তকতা এবং ধৈর্য্যর পরিচয় দেয়া।
—'কথা বলার ধরনঃ মানুষের সঙ্গে সুন্দর ও উত্তম তথা প্রাঞ্জল ভাষায় কথা বল।' (সুরা বাকারা : আয়াত ৮৩)।
—যে বিষয়ে জ্ঞান নেই, সে সম্পর্কে কথা না বলা অর্থাৎ জ্ঞানহীন অসাড় কথা না বলা।' (সুরা বনি ইসরাঈল : আয়াত ৩৬)।

???? গুনের সমাদর :
প্রত্যেক মানুষেরই বাসনা থাকে, মানুষ আমাকে সম্মানের চোখে দেখুক, আমাকে ভালো বিবেচনা করুক। মানুষের মনে একান্ত ইচ্ছা থাকে যে, তাঁর সৌন্দর্য, গুণাবলী এবং যোগ্যতার স্বীকৃতি দিক। তাকে সম্মান করুক।
ব্যক্তির মধ্যে কি কি যথার্থ গুণাবলী এবং যোগ্যতা রয়েছে তা আপনাকে খুঁজে বের করতে হবে। আপনার প্রতিটি কথা এবং কাজের মাধ্যমে এটি প্রকাশ হওয়া প্রয়োজন। তাহলে মনে হবে আপনি তার যোগ্যতাকে সঠিক মর্যাদা দিচ্ছেন।
মানুষের কিছু গুণাবলীর সূত্র ধরে, তার দোষ-ত্রুটি সংশোধনের পথ বের করা যায় না। মানুষের ছিদ্রান্বেষণ করাটা সহজ কাজ। তার গুণাবলীর প্রতি লক্ষ্য করতে নিজেকে অভ্যস্ত করুন। তারপর দেখতে পাবেন কিভাবে মানুষ আপনার ডাকে সাড়া দেয় এবং আপনার প্রতি তাদের আকর্ষণ বেড়ে যায়।
—কথা বলার আওয়াজ 'আর কণ্ঠ স্বর নিচু করা। নিঃসন্দেহে গাধার স্বরই সর্বাপেক্ষা অপ্রীতিকর।' (সুরা লোকমান : আয়াত ১৯)।

???? জয় পরাজয়ের ভাব :
তর্কে জয়ী হওয়ার জন্য একটা মাত্র পথই সর্বোত্তম। আর তা হচ্ছে মানুষের সঙ্গে তর্ক করা থেকে দূরে অবস্থান করা।

(হে রাসুল!) আপনি আপনার পালনকর্তার পথের দিকে আহবান করুন জ্ঞানের কথা বুঝিয়ে ও উপদেশ শুনিয়ে উত্তমরূপে এবং তাদের সাথে বিতর্ক করুন পছন্দ যুক্ত পন্থায়। নিশ্চয় আপনার পালনকর্তাই ঐ ব্যক্তি সম্পর্কে বিশেষ ভাবে জ্ঞাত রয়েছেন, যে তাঁর পথ থেকে বিচ্যুত হয়ে পড়েছে এবং তিনিই ভাল জানেন তাদেরকে, যারা সঠিক পথে আছে।’ (সুরা নাহল : আয়াত ১২৫)

হজরত আবু উমামা রাদিয়াল্লাহ আনহু বর্ণনা করেন, রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেছেন, ‘যে ব্যক্তি অন্যায়ের পক্ষে তর্ক করে না, তার জন্য জান্নাতের এক পার্শ্বে একটি ঘর তৈরি করা হয়। আর যে ব্যক্তি ন্যয়ের পক্ষে থেকেও তর্ক পরিহার করে তার জন্য জান্নাতের মধ্যস্থলে একটি ঘর তৈরি করা হয়। আর যে ব্যক্তি তার চরিত্রকে সুন্দর করে তার জন্য জান্নাতের উপরের অংশে একটি ঘর নির্মাণ করা হয়।’ (আবু দাউদ, ইবনে মাজাহ, বয়হাকি)।

???? মানসিক প্রবণতার প্রতি সম্মান প্রদর্শন :
মানুষের বদ্ধমূল ধারণা এবং বিশ্বাসের সঙ্গে তার একটা গভীর সম্পর্ক এবং আন্তরিক ভালোবাসা মিশ্রিত থাকে। মানুষ কোন বিশ্বাসের ব্যাপারে এটা খুব কমই চিন্তা করে যে, যুক্তি-প্রমাণের কষ্টি-পাথরে আমার বিশ্বাসটা কি সুষ্ঠু এবং নির্ভুল?
মুসলমানদের জন্য এটি ফরজ যে, অবাঞ্ছিত কিছু হতে দেখলে সময়-কালের প্রতি লক্ষ্য রেখে, সম্ভব হলে একে হাত দ্বারা যথাশক্তি বলে প্রতিরোধ করা। আর না হয় বলে সে ভুল বা অপকর্ম সংশোধনের চেষ্টা করা। কিন্তু তার মানে এই নয় যে, কোন কিছু অন্যায় বা ভুল হতে দেখা মাত্রই ঝট করে বলে দিতে হবে যে- এটা সম্পূর্ণ ভুল বা আপনি যা করছেন ভুল করছেন

???? যে সব ব্যাপারে মতের মিল রয়েছে : কোনো আলোচনার শুরুতেই যদি কোন ব্যক্তি কোন বিষয়ে অসম্মতি গোপন করে, 'না' বলে ফেলে; তারপর এ অসম্মতির ভাবটিই শেষ পর্যন্ত তার মধ্যে প্রভাব বিস্তার করে।

???? পর্যায়ক্রমে অগ্রসর হোন :
অকাট্য যুক্তি-প্রমাণ দ্বারা আপনি কাউকে নির্বাক করতে পারেন, কিন্তু আপনার শ্রোতাকে অন্তর দিয়ে কোন কিছু গ্রহণ করার জন্য প্রস্তুত করা। মন থেকে পুরনো ভাবধারাকে বের করে নতুনভাবে সত্যকে গ্রহণ করার অনুভূতি সৃষ্টি করা নিছক বাকচাতুর্য বা যুক্তি তর্কের দ্বারা সম্ভব নয়। বরং এজন্য সুকৌশলে সাধারণ পন্থায় তার মধ্যে অনুপ্রেরণা এবং কর্মোন্মাদনা সৃষ্টি করতে হবে।

পঠিত : ৯৮১০ বার

মন্তব্য: ০