Alapon

দ্যা ব্যাটল অব আঙ্কারা...



পনেরশ শতাব্দীর অন্যতম ভয়ানক যুদ্ধ সংগঠিত হয়েছিল আঙ্কারায় (তুরস্কের রাজধানী)। যেটি ব্যাটল অব আঙ্কারা নামে ইতিহাসে পরিচিত। এ যুদ্ধটি হয়েছিল তৎকালীন পৃথিবীর সেরা দুই কমান্ডার এবং সেরা দুই সালতানাতের মাঝে। একজনের কাছে ছিল তৎকালীন দুনিয়ার সেরা ক্যাভালরি, অন্যজনের কাছে সেরা ইনফ্যান্ট্রি। একজন ডিফেন্সিভ ওয়ারফেয়ারে চ্যাম্পিয়ন, আর অন্যজন এট্যাকিং ওয়ারফেয়ারে কিংবদন্তি। এই দুই বীরের একজন ছিলেন গ্রেট অটোমান শাসক সুলতান বায়েজীদ ইয়িলদ্রিম দ্য থান্ডারবোল্ট, অপরজন ছিলেন চেঙ্গিসের রেখে বিস্তীর্ণ ভূখণ্ডের একছত্র অধিপতি আমির তৈমুর গুরিগান (King of Timurid Empire).

সুলতান প্রথম বায়েজিদ – অটোমান সাম্রাজ্যের চতুর্থ সুলতান প্রথম মুরাদের বড় ছেলে বায়েজিদ। ইতিহাস তাকে চেনে বায়েজিদ ইয়িলদ্রিম নামে। বায়েজিদ এই নামটা এমনি এমনি অর্জন করেননি। তিনি বজ্রপাতের মতোই তার সেনাবাহিনী নিয়ে এশিয়া থেকে ইউরোপ আবার ইউরোপ থেকে এশিয়ায় ঘুরে বেড়াতেন। তিনি এমন এক জেনারেল যার সেনাবাহিনী কোথাও থামতে জানতো না। তিনি এতটাই দ্রুতগতির ছিলেন যে শত্রুপক্ষ যুদ্ধে তৈরি হবার আগেই বায়েজিদের বজ্রপাত নেমে আসতো। নিকোপলিসের প্রান্তরে ক্রুসেডের সময় চার সপ্তাহের পথ তিনি ১২ দিনে পাড়ি দিয়ে ক্রুসেডারদের উপর আক্রমণ করেছিলেন, সে যুদ্ধে পুরো ইউরোপের মেরুদন্ড তিনি এমনভাবেই ভেঙে দিয়েছিলেন পরবর্তী তিনশ বছর তারা কোনো ক্রুসেড ঘোষণা করতে পারেনি।

আমির তৈমুর গুরিগান – হালাকু-বারকি যুদ্ধের পরে ভেঙে যাওয়া মঙ্গল সালতানাতকে তৈমুর পুনরায় একত্রিত করেন। চেঙ্গিসের পুরো সাম্রাজ্যের দুই-তৃতীয়াংশ-ই তিনি তার পদতলে নিয়ে এসেছিলেন। আর বারকি খানের সুবাদে পুরো মঙ্গল সাম্রাজ্যে তখন ইসলামের অনুপ্রবেশ চলে এসেছিল। নিজের প্রিয়তমা স্ত্রী আলজাইয়ের মৃত্যুর পর তৈমুর হয়ে ওঠেন এই এশিয়ার এক অপ্রতিদ্বন্দ্বী দিগ্বিজয়ী।

প্রায় সতেরো মিলিয়ন মানুষকে হত্যা করা এই আমির তখন ভাবছিলেন আর কী করা যায়। আর তখনই এক চিঠি আমীরে তৈমুরের সামনে এই দুনিয়ার বুকে হেঁটে চলা তার একমাত্র যোগ্য প্রতিদ্বন্দ্বীকে সামনে হাজির করে।

স্ত্রীর সম্মান রক্ষায় রক্তক্ষয়ী যুদ্ধ:

মূলত তৈমুর বায়েজিদের সাথে কখনোই যুদ্ধে জড়াতে চাননি। তার কাছে বিশাল সংখ্যক তাতার বাহিনী থাকার পরেও তিনি বায়েজিদের সাথে যুদ্ধ এড়িয়ে যেতে চেয়েছেন কারণ তিনি অটোমানদের শক্তি সম্পর্কে জানতেন। কিন্তু বায়েজিদের এক অপমানকর চিঠি তৈমুরকে আনাতোলিয়ায় ডেকে আনে। মূলত এর ফলেই “ব্যাটল অব আঙ্কারা” সংঘটিত হয়। বৃদ্ধ দিগ্বিজয়ী তার শত্রুদের ফেরত চান বায়েজিদের কাছে, কারণ তারা তখন বায়েজিদের আশ্রয়ে ছিলেন। বায়েজিদ উত্তর দিয়েছিলেন- ‘আমি যদি তোমাকে যুদ্ধে হারাই, তবে তোমার স্ত্রীদের নগ্ন করে আমি তাদের হাতে শরাব পান করব।’

পুরুষ মানুষ তখনই সবচেয়ে হিংস্র হয়ে যুদ্ধ করে যখন তার স্ত্রীর সম্মানে আঘাত হানা হয়। বায়েজিদের এই অপমানজনক চিঠি অটোমান সাম্রাজ্যে ঝড়ের ঘনঘটা বইয়ে আনে। এই দিগ্বিজয়ী যেন তেন কেউ ছিলেন না, গোল্ডেন হর্ডকে পিষে ফেলা, ককেশাসের পর্বতকে অবনত করা, হিন্দুস্তান থেকে সিরিয়া, খোরাসান থেকে সাইবেরিয়া ভূমির একচ্ছত্র অধিপতি তিনি- তৈমুর লং।

অটোমানদের শেষ দেখবার উদ্দেশ্যে তৈমুর বেরিয়ে পড়েন তার নাতি মুহাম্মদ সুলতান, পীর মুহাম্মদ, খলিল সুলতান, ছেলে মিরন শাহ এবং শাহরুখ মির্জাকে নিয়ে। এরা প্রত্যেকেই ছিল তৎকালীন এশিয়ার সেরা যোদ্ধা, প্রত্যেকের সাথেই ছিল বিশাল ক্যাভালরি বাহিনী। তৈমুর যখন তার জীবনের সেরা যুদ্ধতি লড়তে সর্বোচ্চ প্রস্তুতি সারতে ব্যস্ত, তখন অটোমানদের অভ্যন্তরে শুরু হলো বিশৃঙ্খলা।

গাজিদের উপর নিয়ন্ত্রণ নিতে গিয়ে বায়েজিদ নিজেই কোণঠাসা হয়ে আছেন ইতিমধ্যেই, তার উপর মুসলিম সাম্রাজ্যের উপর আক্রমণ তারা কোনোভাবেই সমর্থন করছেন না। প্রস্তুতির প্রথম চালেই ভুল করছেন বায়েজিদ, কারণ এই গাজিদের শক্তিতেই অটোমানদের জন্ম হয়েছিল। অবশেষে গাজিদের না পেয়ে নিজের অনুগত বাহিনী নিয়েই যুদ্ধের প্রস্তুতি নিলেন বায়েজিদ।

তবুও তার এ বাহিনী ছিল ভয়ংকর। তৎকালীন দুনিয়ার সেরা ইনফ্যান্ট্রি রেজিমেন্ট জানিসারী ছিল অটোমানদের। তার উপর ছিল কাপিকুলু ডিভিশন, যাদের মরনপণ লড়াইয়ে ক্রুসেডের মোড় ঘুরে গিয়েছিল। বাহিনী আরও বড় করতে বেশ কিছু তাতারদের তিনি ডেকে পাঠালেন। সবমিলিয়ে তার বাহিনী তৈমুরের বাহিনীর অর্ধেক হলেও কোয়ালিটিতে তারা ছিল যোজন যোজন এগিয়ে।

বায়েজিদের দ্রুতগতি যেমন তার জন্য মঙ্গলজনক ছিল, তেমনি কিছু দুর্দশাও ডেকে এনেছিল। বায়েজিদ ভাবলেন, তৈমুরের জন্য অপেক্ষা না করে তিনি যদি তৈমুরকে আগেভাগেই পাহাড়ি অঞ্চলে আক্রমণ করতে পারেন তবে খেলা ঘুরে যাবে। তবে সবাই মত দিলেন, জুলাইয়ের এই তপ্ত গরমে ১০ দিন সফর করে তৈমুরকে আক্রমণ করা মোটেও বুদ্ধিমানের কাজ হবে না। কিন্তু বায়েজিদের জোরাজুরিতে তারা বাধ্য হলেন বেরিয়ে পরতে।
আর সেদিকে পাকা ঘুঘুর ন্যায় দিগ্বিজয়ী এগিয়ে চলছেন আঙ্কারার দিকে। সোজা পথে আনাতোলিয়া না গিয়ে দুর্গম টরাস পর্বতমালা অতিক্রম করে তিনি আঙ্কারার দিকে অগ্রসর হোন। সেখানে গিয়ে তিনি পেয়ে গেলেন বায়েজিদের বিল্ট ইন ক্যাম্প, পানির মজুদ যা ছেড়েই বায়েজিদ আরারাত পর্বতের দিকে এগিয়ে গেছেন তৈমুরকে আক্রমণ করতে। আর যুদ্ধের চাল এখানেই ঘুরে গেল। আসার পথে জুবুক খালে বাঁধ দিয়ে পানির স্রোত তিনি উল্টোদিকে ঘুরিয়ে দিলেন যেন তুর্কিরা কোনো পানির সন্ধান না পায়।

তৈমুরের আঙ্কারায় অবস্থানের খবর পেয়ে বায়েজিদ দ্রুত মার্চ করে আটদিনে আঙ্কারায় পৌঁছান, কিন্তু ততক্ষণে অনেক দেরী হয়ে গেছে। তখন আঙ্কারায় বায়েজিদের তৈরি করা ক্যাম্পে আরাম-আয়েশ করছেন তৈমুর। আসার পথে কোনো পানি না অবশেষে এক ঝর্ণার পানির সন্ধানে গেলেন তুর্কি ভলান্টিয়াররা। সেই পানিতে বিষ মিশিয়ে রেখেছিলেন তৈমুর। রাতে সেই পানি খেয়ে অনেক সৈনিকের পেট খারাপ হয়ে গেল।

রোদেপোড়া, পিপাসার্ত এক আধমরা বাহিনী নিয়ে তৈমুর গুরিগানের সামনে দাঁড়িয়ে আছেন বায়েজিদ ইয়িলদ্রিম। তৈমুরের চালে বায়েজিদ এমনভাবে আটকা পড়েছেন যে তাকে এখানেই যুদ্ধ করতে হবে। আর ওদিকে পানির অভাবে তার বাহিনীও আধমরা হয়ে আছে।

জগতের সবচেয়ে একরোখা দুটি জাতির মাঝে যুদ্ধ শুরু হলো। কিন্তু যুদ্ধের প্রথমেই ঘটে গেল বিপত্তি। তুর্কিদের চারভাগের এক ভাগই ছিল তাতার। তারা মুহুর্তের মাঝেই দলবদল করে ফেললো। এ ধরনের আক্রমণের জন্য মোটেও প্রস্তুত ছিল না তুর্কিরা। তাতারদের তুলনায় সৈন্যসংখ্যা ছয়ভাগের এক ভাগ হয়ে যাওয়াতে কোণঠাসা হয়ে পড়েছিল বায়েজিদ।
জানিসারী প্রধান হাসান আগা, শাহজাদা মোস্তফা, ঈসা আর মুসা মিলে কাতারে কাতারে তাতারদের লাশ ফেলছিলেন। তাদের জন্য সুবিধা করে উঠতে পারছিল না তৈমুরের বাহিনী। কিন্তু একপর্যায়ে তাদের শক্তিও শেষ হয়ে যেতে লাগলো।

বায়েজিদ যখন বুঝতে পারলেন এই তাজাদম বাহিনীর সাথে তাদের আধমরা পেরে উঠবে না তখন তার মাঝে এক হিংস্র পিতার ছাপ ফুটে উঠল। তিনি তার ছেলেদের কৌশলে পালিয়ে যেতে সাহায্য করলেন। এরপরই বায়েজিদ তার সেই চিরচেনা ক্ষুধার্ত বাঘের ন্যায় বিদ্যুৎগতিতে তাতারদের উপর ঝাঁপিয়ে পড়লেন।

বায়েজিদ, হাসান আগা, হামজা পাশা, গাজি বে এভ্রেনোস অমানুষিক বীরত্ব দেখিয়ে লাশের দেয়াল বানিয়ে ফেললেন তাতারদের অগ্রভাগে। তাদের বজ্রপাতের মতো এই আক্রমণের ফলে সকল প্রকার সুবিধা থাকা সত্ত্বেও পেরে উঠছিল না তৈমুরের বাহিনী।

কিন্তু এরপর এক চালে খেলা ঘুরিয়ে দিলেন তৈমুর। তার রিজার্ভ এক লাখ বাহিনী আর পির মুহাম্মদ তার হাতিগুলোকে চালিয়ে দিলেন জানিসারীদের উপর। এবার যারা এতক্ষণ তলোয়ারের ঘায়ে মরেনি তারা পানির অভাবে মরতে লাগলো। আর এদিকে হস্তিবাহিনী পিষ্ট করে ফেললো জানিসারীদের। জানিসারীদের কয়েকটি দুঃসাহসী ইউনিট মাটিতে বর্শা গেঁথে লাফিয়ে হাতির উপর উঠে হাতি মারতে লাগলো।

আর এদিকে বায়েজিদের কুঠারের আঘাতে এক এক করে উড়ে গেল তৈমুরের সেনাপতি আবু বকর, মালিক শাহ আর সুলাইমান শাহের মাথা। সন্ধ্যা পর্যন্ত বায়েজিদের আক্রমণে নিহত হলো একশোর বেশি তাতার। আঙ্কারার ময়দানে নব্বই হাজার অটোমানদের বিপরীতে পরে রইলো এক লক্ষ তাতারের লাশ।

তৈমুর যুদ্ধে জিতলেন ঠিকই কিন্তু হারালেন তার একমাত্র যোগ্য উত্তরসূরী মুহাম্মদ সুলতানকে। আর যুদ্ধে হেরে গিয়েও নিজের উত্তরসূরী বাঁচিয়ে দিলেন বায়েজিদ যার ফলশ্রুতিতে অটোমান সাম্রাজ্য টিকে রইলো আরও পাঁচশ বছর।

যুদ্ধে আমির তৈমুর গুরিগান জিতে গিয়েও হেরে গেলেন, আর সুলতান বায়েজিদ ইয়িলদ্রিম হেরেও জিতে গেলেন।

(বায়েজিদকে বন্দীর পর তার সামনেই নগ্ন করে উপস্থাপন করা হলো তার স্ত্রীদের, যা কিনা তৈমুরকে হুমকি দিয়েছিলেন বায়েজিদ। এ দৃশ্য দেখে স্ট্রোকে মারা গেলেন বায়েজিদ। এভাবেই অটোমানদের এক দুর্ধর্ষ যোদ্ধার জীবনের ইতি ঘটলো। এরপর তৈমুরও আর বেশিদিন বাঁচেননি। উত্তরাধিকার হারানোর শোকে তিনিও ভেঙে পড়েছিলেন। বায়েজিদের মৃত্যুর দু বছরের মাথায় তিনিও মৃত্যুর কোলে ঢলে পড়লেন।)

যুদ্ধ কাউকেই ছাড়ে না...

- রিফাত

পঠিত : ৩৪৬ বার

মন্তব্য: ০