Alapon

তিউনিসিয়ায় গণতন্ত্রের বুকে গুলি নির্বাচনের ওপর ইসলামপন্থীদের আস্থার সমাপ্তি (!)


তিউনিসিয়ায় গণতন্ত্রের বুকে গুলি
নির্বাচনের ওপর ইসলামপন্থীদের আস্থার সমাপ্তি (!)

25 জুলাই 2021। তিউনিসিয়ার অরাজনীতিক প্রেসিডেন্ট কায়স সাইয়েদ এক ডিক্রিবলে সেদেশের প্রধানরমন্ত্রীকে বরখাস্ত করেছেন, পার্লামেন্ট এক মাসের জন্য ফ্রিজ করেছেন এবং সংসদ সদস্যদের অনাক্রম্যতাও স্থগিত করেছেন। তিনি নিজে প্রশাসনিক ক্ষমতা গ্রহণ করেছেন। এবং পার্লামেন্টের পরিবর্তে নিজের নিয়োগ করা প্রধানমন্ত্রী দিয়ে দেশ চালানোর ঘোষণা দিয়েছেন।

পৃথিবীর কত দেশেই তো সরকার পরিবর্তন হয়, প্রেসিডেন্ট নিহত হয়, বাংলাদেশে ততটা শোরগোল হয় না; কিন্তু তিউনিসিয়ার সরকার বরখাস্তে দেখা গেল ফেসবুক সরগরম। কেবল তিউনিসিয়া মুসলিম দেশ বলে নয়, মানুষ মনে করছে ওই দেশে মিশরের ব্রাদারহুডের মত একটি ইসলামপন্থী দলের বিরুদ্ধে অভ্যুত্থান হয়েছে। তাই ইসলামী রাজনীতির পক্ষ-বিপক্ষ গোষ্ঠীর আগ্রহের কেন্দ্রে রয়েছে বিষয়টি।

আমরা একটু পেছনে যেতে চাই। কারণ প্রেক্ষাপট বিবেচনায় না নিয়ে মানুষ বিভিন্ন দেশের ঘটনাবলীকে সরলীকরণের মাধ্যমে সিদ্ধান্তে উপনীত হতে চায়।

স্বাধীন তিউনিসিয়ার বয়স বেশি নয়। 1956 সালে দেশটি সালে ফরাসী-অধীনতা হতে মুক্তিলাভ করে। স্বাধীনতার অব্যবহিত পর কট্টর সেক্যুলাররা তিউনিসিয়ার ক্ষমতা কুক্ষিগত করে। তাদের মাঝে সবচেয়ে আলোচিত ছিল হাবিব বারগুইয়া, যিনি ত্রিশ বছর ধরে ক্ষমতায় ছিলেন। আল্ট্রা সেক্যুলারিজম প্রমোট করার কারণে তাকে আরবের কামাল পাশা বলা হত। তিনি তিনটি ভয়াবহ ইসলাম-বিদ্বেষী পদক্ষেপ নিয়েছিলেন: সহস্রাব্দপ্রাচীন যাইতুনা মাদ্রাসা বন্ধ করে দেয়া, হিজাব নিষিদ্ধ করা, ও রমাদানে রোযা পালন নিষিদ্ধ করা। তার আমলে রামাদানে রোযা রাখার কারণে বহু মানুষকে চাকুরিচ্যুত করা হয়।

ত্রিশ বছর শাসন করার পর তাকে ক্ষমতাচ্যুত করেন তারই প্রধানমন্ত্রী যায়নুল আবেদীন বেন আলি। বলাবাহুল্য তিনিও ছিলেন বারগুইয়ার মত আল্ট্রা সেক্যুলার। প্রায় অর্ধশতাব্দীর উগ্র ধর্মনিরপেক্ষ শাসনে ইসলামের চিহ্নগুলো মুছে দেয়া সম্ভব না হলেও তিউনিসিয়ার জনগণের একটি বড় অংশকে আল্ট্রা সেক্যুলার হিসেবে গড়ে তোলা সম্ভব হয়েছে, যার প্রভাব এখনো তিউনিসিয়ান সমাজে রয়েছে।

এখন বর্তমান প্রসঙ্গে আসি।

2019 সালে তিউনিসিয়ায় সর্বশেষ পার্লামেন্ট নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয়। 217 আসনবিশিষ্ট পার্লামেন্টে কোন দল একক সংখ্যাগুরষ্ঠতা পায়নি। পার্লামেন্টে সবচেয়ে বড় দল হিসেবে আবির্ভুত ইসলামপন্থী আল-নাহদা আন্দোলন, যার আসন ছিল মাত্র 52, পূর্বের নির্বাচনের চেয়ে আল-নাহদা 17টি আসন কম পায়।

যে পার্লামেন্টে সংখ্যাগরিষ্ঠতার জন্য 109টি আসন দরকার, সেখানে যদি সবচেয়ে বড় দল মাত্র 52 আসন পায়, সেই পার্লামেন্টের কী অবস্থা হবে তা সহজেই অনুমেয়।

আল-নাহদাপ্রধান রাশিদ ঘান্নুশি পার্লামেন্টের স্পীকার নির্বাচিত হন। যদিও আল্ট্রা সেক্যুলার দলগুলো তা কোনভাবেই মানতে চায়নি। তার বিরুদ্ধে পার্লামেন্টে অনাস্থা প্রস্তাবও আনা হয়, যদিও তা পাশ হয়নি।

তিউনিসিয়ার সংবিধানে ক্ষমতা তিনটি সাংবিধানিক পদের মাঝে বণ্টিত। সেদেশের রাষ্ট্রপতি সাংবিধানিকভাবে পররাষ্ট্রনীতি ও প্রতিরক্ষা বিভাগ নিয়ন্ত্রণ করেন। তিনি প্রধানমন্ত্রী নিয়োগ দেন, তবে তা অনুমোদন করে পার্লামেন্ট। সরকার পরিচালিত হয় প্রধানমন্ত্রীর নেতৃত্বে, সরকারের দৈনন্দিন কাজে প্রেসিডেন্টের ভূমিকা নেই।

2019 সালে তিউনিসিয়ায় প্রেসিডেন্ট নির্বাচন হয়। আল-নাহদা পার্লামেন্টে বড় দল হিসেবে আবির্ভুত হলেও প্রেসিডেন্ট নির্বাচনে তার প্রার্থী মুরো প্রথম দফায় আউট হয়ে যায়। প্রেসিডেন্ট হিসেবে নির্বাচিত হন নির্দলীয় প্রার্থী বিশ্ববিদ্যালয়ের আইনের শিক্ষক কায়স সাইয়েদ।

খুব সম্ভবত পার্লামেন্টে সংখ্যাগরিষ্ঠতা না থাকায় এবং আল্ট্রা সেক্যুলারদের শত্রুতার শিকারে পরিণত হওয়ার ভয়ে আল-নাহদা প্রধানমন্ত্রীর পদ গ্রহণে আগ্রহী হয়নি। নতুন নির্বাচনের পর প্রথম প্রধানমন্ত্রী হন এফডিটিএল দলের ইলয়াস আল-ফাখফাখ। পরে দূর্নীতির অভিযোগ ওঠলে তিনি পদত্যাগ করেন। পরে হাবিব জিমলিকে প্রধানমন্ত্রী করতে চাইলে প্রেসিডেন্টের আপত্তির কারণে তাকে প্রধানমন্ত্রী করা যায়নি। তারপর নির্দলীয় হিশাম মাশিশিকে প্রধানমন্ত্রী হিসেবে নিয়োগ দেয়া হয়। তাকে প্রেসিডেন্টের ঘনিষ্ঠ বলে মনে করা হলেও পার্লামেন্ট অনুমোদন দেয়।

2021 এর জানুয়ারি হতেই সঙ্কট চলে আসছিল। দূরত্ব সৃষ্টি হয়েছিল প্রেসিডেন্ট ও প্রধানমন্ত্রীর মাঝে। মাশিশি চারজন মন্ত্রী নিয়োগ দেন, পার্লামেন্ট তাঁদের নিয়োগ অনুমোদন করে, কিন্তু প্রেসিডেন্ট তাদেরকে শপথবাক্য পাঠ করাননি। এটি নিয়ে দূরত্ব তৈরী হয় প্রধানমন্ত্রী ও প্রেসিডেন্টের মাঝে, পার্লামেন্ট-স্পীকারও প্রেসিডেন্টের মাঝে।

নতুন সংবিধানে রাষ্ট্রের তিনটি গুরুত্বপূর্ণ পদের মাঝে ক্ষমতার ভাগাভাগির পর হতেই এই তিন পদধারীর মাঝে টানাপোড়েন চলে আসছে। পূর্ববর্তী প্রেসিডেন্ট আল-বাজি কায়েদ আস-সাবসি’র আমলেও অনুরূপ টানাপোড়েন দেখা গিয়েছিল।


প্রেসিডেন্টের কায়স নিজের ক্ষমতাবৃদ্ধির চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছিলেন। অপরদিকে পার্লামেন্ট-স্পীকারও সংসদের ক্ষমতা রক্ষায় বদ্ধপরিকর ছিলেন। মাঝখানে দুর্বলতা প্রকাশ প্রধানমন্ত্রীর। এই টানাপোড়েনে প্রেসিডেন্ট আপন ক্ষমতাবৃদ্ধির সুযোগ অনুসন্ধান করছিলেন।

রাজনৈতিক অস্থিরতা ও করোনাক্রান্ত অর্থনৈতিক ও স্বাস্থগত দুরবস্থা প্রেসিডেন্টের সামনে সে সুযোগ এনে দিল। মাত্র একদিন দেশব্যাপী বিক্ষোভ হয় সরকারের ব্যর্থতার বিরুদ্ধে। আল-নাহদা ক্ষমতাসীন না হলেও দলটির কার্যালয়সমূহে হামলা করা, আগুন দেয়া হয়। অথবা সুযোগ কুক্ষিগত করার জন্য পরিকল্পিতভাবে নৈরাজ্য সৃষ্টি করা হয়। তারপর একদিনের বেশি সহ্য/অপেক্ষা করলেন না প্রেসিডেন্ট। সংবিধানের 80 ধারাবলে সকল ক্ষমতা কুক্ষিগত করলেন, যদিও পাঠ করতে সক্ষম এমন এক শিশুও বুঝতে পারবে যে, এই ডিক্রি জারির মাধ্যমে সংবিধান সংঘন করেছেন আইনের সাবেক অধ্যাপক প্রেসিডেন্ট কায়স সাইয়েদ। সংবিধানের 80 ধারায় ব্যতিক্রমী ব্যবস্থা গ্রহণ করতে হলে স্পীকার ও প্রধানমন্ত্রীর সাথে পরামর্শকে বাধ্যতামূলক করা হয়েছে।

অতএব এটি পরিস্কার যে, প্রেসিডেন্টের ক্ষমতাবৃদ্ধির জন্য একটি সুযোগের অপেক্ষায় ছিলেন কায়স, এবং সেই সুযোগ সৃষ্টি হওয়ামাত্র তা কাজে লাগালেন।

প্রেসিডেন্ট কায়সের ক্ষমতাবৃদ্ধিতে তিউনিসিয়াবাসীর আপাতআনন্দ অচিরেই বিষাদে পরিণত হবে। প্রধানমন্ত্রীর পরিবর্তন তিউনিসিয়াকে সঙ্কটমুক্ত করতে পারবে না। তিনি যদি সেনাবাহিনীর ওপর নির্ভরশীল হন, তবে অচিরেই সেনাবাহিনী সেই নির্ভরশীলতাকে ছুটি দেবে। গণতন্ত্রের বুকে যে গুলি তিনি চালালেন, সেটি হয়ত সেনারা তার বুকে চালিয়ে দেবে।

নতুন গণতান্ত্রিক দেশ হিসেবে তিউনিসিয়ার সংবিধান ছিল আদর্শ। উন্নত গণতন্ত্রের দেশগুলোর মত ক্ষমতার বিভাজন ছিল। কিন্তু বয়স্কের খাবার শিশুর উদরে হজম হল না।
এটি ইসলামপন্থীদের জন্য নতুন অভিজ্ঞতা নয়, পুরনো অভিজ্ঞতার পুনরাবৃত্তি হল। আলজেরিয়া ও মিশরের পর তিউনিসিয়ায় যে অভিজ্ঞতা অর্জন করল ইসলামপন্থীরা তারপর নিশ্চয় তারা কর্মপন্থা পুনর্বিবেচনা করবে। নির্বাচনের ওপর ইসলামপন্থীদের আস্থার মৃত্যুর জন্য আরো চ্যুতির অপেক্ষা করতে হবে?

যারা আল-নাহদার ভূমিকা পর্যালোচনা করতে চান তারা তিনটি বিষয় বিবেচনা রাখবেন: ক) 217 আসনবিশিষ্ট পার্লামেন্টে আল-নাহদার আসন ছিল 52টি। খ) আল-নাহদা দলীয়ভাবে সরকারে যোগ দেয়নি। (গ) তিউনিসিয়াল আল্ট্রা ধর্মনিরপেক্ষ ঐতিহ্য।

লেখা দীর্ঘ হওয়ার আশঙ্কায় আল-নাহদার আপোষকামীতা আলোচনা করা গেল না। তবে বিষয়টি এমন নয় যে, তাদের বৈপ্লবিক হওয়ার সুযোগ ছিল, কিংবা বৈপ্লবিক হলে ফলাফল ভিন্ন হত।

[আগ্রহীরা তিউনিসিয়ার রাজনৈতিক অবস্থার সাথে ইসরাইলের পরিস্থিতির তুলনা করতে পারেন। সেদেশে ক্ষমতায় আসার মত সংখ্যাগরিষ্ঠতা অর্জন না হওয়ায় দুই বছরের মাঝে চারবার নির্বাচন হয়। তবুও অসাংবিধানিক কোন পন্থা অনুসৃত হয়নি। ইসরাইলে বর্তমানে যে জোট ক্ষমতায় রয়েছে, আদর্শের বিচারে সেটি বহুবৈচিত্রময়। ভিন্নমতের প্রতি সহনশীলতা, গণতন্ত্রচর্চা, সংবিধানের সুরক্ষা – এগুলো কি এতটাই হারাম বস্তু যে মুসলমানদের তা অনবরত লংঘন করতে হয়? আরেকটি বিষয়ে বিশ্বসম্প্রদায়ের নগ্ন দ্বৈততা স্পষ্ট, সেক্যুলারিজমকে যেখানে গণতন্ত্রের জন্য অপরিহার্য মনে করা হয়, সেখানে মুসলিম দেশগুলোতে গণতন্ত্র ধ্বংসের জন্য সর্বদা আল্ট্রা সেক্যুালারিজমকে ব্যবহার করা হয়। তিউনিসিয়ার পার্লামেন্টে সেক্যুলার এমপি আবির মুসির আচরণ মনে রাখবেন।]

~ Jubayer Ehsanul Haqe Sir

পঠিত : ৩২৮ বার

মন্তব্য: ০