Alapon

❝আল্লাহর জন্য ভালোবাসা❞



ভালোবাসা কে না চায়? নশ্বর এ পৃথিবীর মানুষের মাঝে ভালোবাসার অস্তিত্ব আছে বলে ই পৃথিবী এতো সুন্দর, এতো কাম্য মনে হয়। ভালোবাসার স্বরূপ বস্তুগত কোন কিছু দ্বারা পরিমাপ করা সম্ভব নয়। কখনো ক্ষুদ্র কিছু প্রাপ্তি আমাদের মনে ভালোলাগার অনুভূতি সৃষ্টি করে। আবার অনেক জমকালো আয়োজন ও মনে আবেদন সৃষ্টি করতে ব্যর্থ হয়।

একজন মা তার শিশুকে এতোটা ই ভালোবাসেন যে তার জন্য নিজের জীবন, সমস্ত সুখ হাসিমুখে বিলিয়ে দিতে পারেন। তাই মায়ের শান্তির জন্য, তাকে ভালো রাখার জন্য আমরা ও তার জন্য স্যাক্রিফাইস করতে প্রস্তুত থাকি। এ ভালোবাসা আল্লাহ প্রদত্ত। আল্লাহ সুবহানাহু ওয়াতাআ'লা আমাদের সৃষ্টি করেছেন। অতঃপর মনোহর নানা নিয়ামতরাজি দ্বারা এ ধরা সুশোভিত করেছেন, কেবলমাত্র বান্দার সুযোগ সুবিধার কথা চিন্তা করে। বিনিময়ে কি চেয়েছেন? আমরা যেনো জীবনের সকল কাজ তার সন্তুষ্টির জন্য ই করি, তার প্রেরিত বিধান অনুযায়ী করি। আল্লাহ বলেন,

“জ্বিন ও মানবজাতিকে আমি আমার ইবাদাতের জন্য সৃষ্টি করেছি।”
(সূরা আয যারিয়াত, আয়াতঃ৫৬)

যান্ত্রিক জীবনের মাঝে আটকা পড়ে মুসলিমদের মাঝে ঈমানের আবশ্যকীয় অংশ হিসেবে যে সুদৃঢ় বন্ধন থাকার কথা ছিলো, তা নড়বড়ে হয়ে পড়েছে। রাস্তায় কেউ বিপদে পড়লে ফোন হাতে লাইভে আসা মানুষ অনেক দেখা যায়, কিন্তু সাথে সাথে সাহায্যে এগিয়ে আসা মানুষের আজ বড়োই অভাব। শহুরে আত্মকেন্দ্রিক জীবনের ভয়াবহ প্রভাব সমাজে নানাবিধ সমস্যার জন্ম দেয়।

√আবু হুরাইরা (রাঃ) থেকে বর্ণিত রয়েছে। রাসূল(সাঃ) বলেছেন,
“ কিয়ামতের দিন আল্লাহ ডেকে ডেকে বলবেন, তারা আজ কোথায় যারা দুনিয়াতে একে অপরকে আমার সন্তুষ্টির জন্য ভালোবাসতো? আজকের এ দিনে, যখন আমার আরশের ছায়া ব্যতীত আর কোন ছায়া থাকবে না; আমি তাদের আমার আরশের ছায়ায় আশ্রয় দেবো।”
( সহীহ মুসলিমঃ২৫৬৬)

“যে ব্যক্তি আল্লাহর জন্য কাউকে ভালোবাসলো, আল্লাহর জন্য কাউকে ঘৃণা করল, আল্লাহর জন্য কাউকে দান করল এবং আল্লাহর জন্য কাউকে দান করা থেকে বিরত থাকল, সে ব্যক্তি নিজ ঈমানকে পূর্ণতা দান করল।”
( আবু দাউদঃ৪৬৮৩ )

√ উবাদাহ ইবনে আস সামিত(রাঃ) থেকে বর্ণিত। রাসূল(সাঃ) বলেছেনঃ
“তাদেরকে ভালোবাসা আমার জন্য আবশ্যক হয়ে পড়ে যারা আমার জন্য ই একে অপরকে ভালোবাসে, একে অপরের সাথে সাক্ষাৎ করে, একত্রে এক মজলিসে বসে এবং কেবল আমার সন্তুষ্টির জন্য ই পারস্পরিক সম্পর্ক রক্ষা করে।”
(মুসনাদে আহমাদঃ২১৫৭৫)

আল্লাহর ভালোবাসা পেতে চায় না এমন কেউ নেই। আর আল্লাহ চান আমরা যেনো একে অপরকে ভালোবাসি। এমন কিছু ছোট ছোট কাজ, যা করতে মোটেও কষ্ট হবে না;অথচ ভালোবাসার এক মধুর, মজবুত বন্ধন তৈরি হবে, যা কাম্য- তেমন কিছু কাজের কথা উল্লেখ করা যেতে পারে।

*◾সালামের ব্যাপক প্রচলনঃ*

আবু হুরাইরা রাঃ থেকে বর্ণিত। রাসূল(সাঃ) বলেছেন,
“ আমি কি তোমাদের এমন একটি কাজের কথা বলবো না যা তোমাদের মাঝে পারস্পরিক ভালোবাসা সৃষ্টি করবে? সেটি হলে, ব্যাপক সালামের প্রচলন করা।”
(মুসলিমঃ৮১, রিয়াদুস সালেহীনঃ৮৪৭)

রাসূল(সাঃ) আরো বলেছেন,
“ যখন কোন ব্যক্তির তার মুসলিম ভাইয়ের সাক্ষাৎ হয় সে যেনো তাকে সালাম দেয়। অত:পর তাদের উভয়ের মাঝে কোন বৃক্ষ, প্রাচীর অথবা পাথর ও যদি আড়াল সৃষ্টি করে এবং তাদের আবারও দেখা হয়, তবে যেনো সে তাঁকে পুনরায় সালাম জানায়।”
(সুনানে আবু দাউদ, হাদীস নংঃ৫২০০)

এমনকি আমরা হাদীস থেকে জানতে পারি যে, সাহাবীরা প্রয়োজন ব্যতীত বাজারে গমন করতেন যেনো বেশি সংখ্যক মানুষকে সালাম দিতে পারেন। (রিয়াদুস সালেহীনঃ৮৪৯) দু'আ বিলানো ও সংগ্রহের এ মহা সুযোগ থেকে বঞ্চিত হবার মতো বোকা নিশ্চয়ই আমরা নই।

*◾যেকোন প্রয়োজনে এগিয়ে আসাঃ*

√ আবদুল্লাহ ইবনে উমর(রাঃ) থেকে বর্ণিত রয়েছে। রাসূল(সাঃ) এক প্রশ্নের জবাবে বললেনঃ

“কোন মুসলিম ভাইয়ের প্রয়োজন পূরণের জন্য হেঁটে অগ্রসর হওয়া টা আমার কাছে আমার মসজিদে দু'মাস ইতেক্বাফ করার চাইতেও অধিক পছন্দনীয়। সেই ব্যক্তি, যে তার ভাইয়ের সাহায্য করার জন্য কদম ফেলে; তার পদদ্বয় আল্লাহ সে দিন দৃঢ়, স্থির, অটল রাখবেন যেদিন সকলের পা টলমল করবে।”
( আল মু'জামুস সগীর, হাদীস নংঃ ৮৬১)

রাসূলের(সাঃ) মসজিদ, অর্থাৎ মসজিদে নববীতে শুধু সালাত আদায়ের ই বিশাল ফজীলত রয়েছে। তাহলে সেখানে ইতেক্বাফ সম্পাদন করার সাওয়াব ভেবে দেখা প্রয়োজন। অথচ রাসূলের(সাঃ) কাছে তার চাইতেও অধিক প্রিয় ছিলো যে কাজ, সে কাজে আমরা কতো পিছিয়ে।

*◾অসুস্থ ব্যক্তিকে দেখতে যাওয়াঃ*

যখন আমরা অসুস্থ হয়ে পড়ি, নিজেকে বড্ড অসহায় মনে হয়। ইচ্ছে করে, কেউ পাশে বসে গল্প করুক, সঙ্গ দেক। কাউকে যখন আমরা দেখতে যাই, সে ব্যক্তি অনেক খুশি হন। আল্লাহ তা'আলা ও তার বান্দাকে সুখী রাখতে চান। তাই এ কাজের জন্য তিনি আমাদের আশাতীত পুরস্কার দিবেন।

‘যে ব্যক্তি আল্লাহ তা‘আলার সন্তুষ্টির আশায় কোন অসুস্থ লোককে দেখতে যায় অথবা কোন ভাইয়ের সাথে সাক্ষাৎ করতে যায়, একজন ঘোষক (ফেরেশতা) তাকে ডেকে বলতে থাকেন, কল্যাণময় তোমার জীবন, কল্যাণময় তোমার এই পথ চলাও। তুমি তো জান্নাতের মধ্যে একটি বাসস্থান নির্দিষ্ট করে নিলে’।

(মিশকাত শরীফ, হাদীস নংঃ৫০১৫)

যখন অসুস্থ ব্যক্তির সাথে দেখা করবো, তার সাথে কুশল বিনিময় করবো এবং তাকে আমাদের জন্য দু'আ করতে বলবো। কেননা, আল্লাহ তা'আলা রুগ্ন ব্যক্তির দু'আ কবুল করেন।

√ ইবনে আব্বাস(রাঃ) থেকে জানা যায় যে, রাসূল(সাঃ) বলেছেন, ৫ শ্রেণির ব্যক্তির দু'আ কবুল হয়ে থাকে। তন্মধ্যে, সুস্থ হবার পূর্ব পর্যন্ত রুগ্ন ব্যক্তির দু'আ অন্যতম।”
(মিশকাত শরীফ, পৃষ্ঠা ১৯৬)

*◾উপহার আদান প্রদানঃ*

“তোমরা একে অপরকে উপহার প্রদান করো। তাহলে পরস্পরকে ভালোবাসবে।”
( আল আদাবুল মুফরাদঃ৫৯৪)

বাসায় ফিরে হঠাৎ দেখলেন কোন বোন বই হাদিয়া পাঠিয়েছে। নিশ্চয়ই খুব খুশি হয়ে যাবেন। ঠিক তেমনি করে ই গিফট দেয়া নেয়া হলে ভালোবাসা বৃদ্ধি পায়। বা এমন হলো, কারো সাথে কোন বিষয় নিয়ে মনোমালিন্য হয়েছে। “মন্দ দূর করো ভালো দিয়ে” নীতির বাস্তব প্রয়োগ করতে চাইলে কিন্তু আপনি উপহার প্রদান করতে ই পারেন। সেক্ষেত্রে সে ব্যক্তি বুঝবেন যে, আপনি তাকে শত্রু ভাবছেন না। সে ও হাসিমুখে আপনার সাথে কথা বলবে।

“ উপহার প্রদান করো, যেনো ভালোবাসা বৃদ্ধি পায় ও ঘৃণা, দ্বেষ দূর হয়।”
( আল মুয়াত্তাঃ১৪১৩ )

এক্ষেত্রে একটি বিষয় লক্ষণীয়। তা হলো, উপহারের মূল্যমান কে বিবেচনায় না এনে অন্তর্হিত প্রগাঢ় টান এর দিকে মনোযোগ দেয়া উচিত। গ্রহীতা এবং যিনি উপহার দিচ্ছেন, উভয়কে ই এ বিষয়ে খেয়াল করতে হবে।

*◾নিয়মিত খোঁজ খবর রাখাঃ*

মুঠোফোনের ব্যাপক বিস্তারের কারণে এখন কারো হাল হাকীকত জানতে আমাদের আর কষ্ট করে বাড়ি বয়ে যেতে হয় না। প্রিয়জনকে এক নজর দেখতে মাইলের পর মাইল পথ অতিক্রম করার দিন ও শেষ হয়েছে। তবু কি সমাধান মিলেছে? দৈর্ঘ্যের দূরত্ব কিংবা নেটওয়ার্কের দূরত্ব কমে আসলেও মনের দূরত্ব বেড়েছে অনেকটা। হাজারো ব্যস্ততার ঘেরাটোপে নিজেকে আবদ্ধ করে নিজের আপনজনের খোঁজ নিতে ও ভুলে যাই। ভেবে দেখুন তো, স্কুল লাইফের সবচেয়ে অন্তরঙ্গ ফ্রেন্ডের সাথে শেষ কবে কথা হয়েছিলো? সোশ্যাল মিডিয়ায় যুক্ত থাকার পরেও দিনের পর দিন নক দিয়ে তাকে জিজ্ঞেস করা হয় না কেমন আছে সে। কিংবা দ্বীনে ফেরার পথের হাতছানি দেয়া সেই আপুটা, যিনি না থাকলে হয়তো আরো অনেকটা পথ অন্ধকারেই হাতড়ে বেড়াতে হতো, তার সাথে কুশল বিনিময় করা হয়?

ব্যস্ততার অজুহাত দেবার আগে চলুন একটি হাদীস জেনে নিই।

√ আবু হুরাইরা রাঃ থেকে বর্ণিত। একজন কৃষ্ণকায় মহিলা মসজিদে ঝাড়ু দিতো। রাসূল(সাঃ) তাঁর কথা জিজ্ঞেস করলে তাকে জানানো হলো, সে মারা গিয়েছে। তখন তিনি বললেন,
“ তোমরা আমাকে জানাওনি কেন? আমাকে তার কবর দেখিয়ে দাও। অত:পর তিনি তার কবরে গেলেন এবং জানাজার সালাত আদায় করলেন।”

(সহীহ বুখারীঃ৪৫৮)

আমরা কি শেষ নবী মুহাম্মদ সল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এর চাইতেও বেশি ব্যস্ততার মধ্যে থাকি? এজন্য ই তিনি ছিলেন রহমাতুল্লিল আলামীন। আমাদের আদর্শ তো তিনি ই। তবে কেনো আজ আমাদের এ দশা?

ভালোবাসার অমোঘ অস্ত্র প্রয়োগ করে জিতে নেয়া সম্ভব একজন মানুষের মন। হৃদয়ের সাথে হৃদয়ের এক শক্ত বাঁধন সৃষ্টি করা সম্ভব। সমাজে শান্তি, প্রীতি আর শৃঙ্খলা ফেরাতে ভালোবাসা ছড়িয়ে দেবার বিকল্প নেই। একে অপরের প্রতি ভালোবাসা থাকলে ই সীসাঢালা প্রাচীরের ন্যায় শত বাঁধার সামনেও অবিচল এক উম্মাহ গড়ে তোলা সম্ভব। সর্বপ্রথম স্বীয় জীবনে এ পরিবর্তন আনা প্রয়োজন। ইসলামের স্বর্ণযুগের সেই সাহাবীদের জীবনীর আদলে নিজ জীবন গড়বো ইনশা আল্লাহ। আল্লাহ আমাদের তাওফিক দান করুন। আমীন।

। আল্লাহর জন্য ভালবাসা ।
~ ‌সাবিহা সাবা

পঠিত : ৬৬৪ বার

মন্তব্য: ০