Alapon

❝অবমাননার জবাবে রাসূল(সাঃ)❞



যখন আমরা রাসূল(সাঃ) কিভাবে ভালোবাসার মাধ্যমে অপমান বা গঞ্জনার প্রতিউত্তর করতেন সে বিষয়ে কিছু পোস্ট করি- একদল লোক এসে হাদীস দিয়ে তার বিরোধীতা করা শুরু করে। তখন আমরা ঠিক বুঝে উঠতে পারি না যে কিভাবে এর জওয়াব দেয়া যায়।

অ্যালেন ওয়েস্ট, একজন আমেরিকান রাজনীতিবিদ- যে একজন উগ্রপন্থী ইসলামোফোব, তার ভাষ্যমতে, মুহাম্মদ মদীনার কর্তৃত্ব লাভের পর তার মাঝে কিছু একটা পরিবর্তন ঘটেছিলো। সহনশীলতা, ভালো ব্যবহারের মাধ্যমে রাসূল(সাঃ) উপহাসের জবাব দিতেন বলে কোরআনে যে আয়াতসমূহ উল্লিখিত রয়েছে তার সব ই মক্কায় নাজিলকৃত বলে তারা দাবী করে৷ আপনারা হয়তো জানেন যে পোপ বেনেডিক্ট যখন ক্রুসেড হিস্ট্রিওগ্রাফি রচনা করেন, সেখানে তিনি এ দাবী করেছেন। তারা রাসূল(সাঃ) কে কোরআন রচয়িতা বলে ই বিশ্বাস করছে।

“দ্বীনের ব্যাপারে কোন জোর-জবরদস্তি নেই।” এ আয়াতটি মদীনায় অবতীর্ণ হয়েছিলো। কিন্তু তারা দাবী করে এটি মক্বায় নাজিলকৃত, যেসময়ে রাসূলের কাছে কোন রাষ্ট্রীয় ক্ষমতা ছিলো না। আর যখন ই তার হাতে ক্ষমতা চলে আসলো, জিহাদ, কাফেরদের প্রতি চড়াও হওয়ার আহবান, মুশরিকদের যেখানেই পাও হত্যা করো-আয়াতসমূহ সামনে আসতে শুরু করলো। তাদের এ দাবির সামনে হয়তো আমরা নতি স্বীকার করে নিতে বাধ্য হই। কিন্তু আমাদের মাঝে কয়জন আছেন যিনি বুদ্ধিবৃত্তিকভাবে, একাডেমিক পদ্ধতিতে এর জবাব দিতে পারবেন?

আলোচনা শুরু করবার পূর্বে কিছু বিষয় মাথায় রাখতে হবে।

১. সীরাহ বা রাসূল(সাঃ) এর জীবনচরিত কে কোরআনের আলোকে যাচাই করে নেয়া এই ডিসকাশনের জন্য আবশ্যক। কেননা, ইসলামোফোবদের কাছে কোরআন একটি গ্রন্থ, যার রচয়িতা স্বয়ং মুহাম্মদ(সাঃ)। তাদের ধারণা, যেহেতু এ আপাত ঐশীবাণী সম্বলিত গ্রন্থটি মুহাম্মদ লিখেছে, তো সে অবশ্যই তা নিজস্ব রাজনৈতিক, অর্থনৈতিক সহ পারিপার্শ্বিক খেয়াল সুবিধা অনুযায়ী ই লিখেছে। আর আমাদের কাছে তিনি কেমন? যেমনটা আয়িশাহ(রাঃ) রাসূল(সাঃ) এর চরিত্রের প্রকৃতি বর্ণনা করতে গিয়ে বলেছেন,

“ জেনে রাখো! পুরো কোরআনই হলো রাসুল (সা.)-এর চরিত্র।’ অর্থাৎ তিনি ছিলেন আল-কোরআনের বাস্তব নমুনা। (মুসনাদ আহমাদ)

অর্থাৎ কোরআনে আমরা যা ই পড়ছি, রাসূল(সাঃ) ছিলেন তার জীবন্ত প্রতিমূর্তি। তাই সীরাহ পাঠের সময় আমরা একে কোরআনের লেন্স দ্বারা পর্যবেক্ষণ করবো।

২. ব্যতিক্রমী ঘটনা হাইলাইট করা এবং সাধারণত যা হয় তাকে অগ্রাহ্য করা- আমাদের নীতিবিরুদ্ধ এবং তা নিষিদ্ধ। না উসূলুল ফিক্বহ, না উসূল আদ দ্বীন- কোথাও এরূপ বিবেচনার আলোকে সিদ্ধান্ত প্রদান করার নিয়ম নেই। প্রেক্ষাপট অবশ্য ই মাথায় রাখতে হবে। ধরুন, কেউ একজন বিচ্ছিন্নভাবে কেবল ক্বাব ইবনু আশরাফের ঘটনা উল্লেখ করলো। এভাবে যে, সে নিছক ই একজন কবি ছিলো এবং রাসূল(সাঃ) মুহাম্মদ ইবনু মাসলামা(রাঃ) সহ আরো কয়েকজন সাহাবীকে প্রেরণ করলেন তাকে হত্যা করে ফেলার জন্য। কেউ যদি সমসাময়িক প্রেক্ষাপট উল্লেখ না করে কেবল এ কথা বলে, তবে তা হবে সত্য গোপন। কেননা, একজন মুসলিম হিসেবে আপনার এটি জানা উচিত যে ক্বাব ইবনু আশরাফ ছিলো এমন একজন, যে লোকেদের যুদ্ধের জন্য প্ররোচিত করতো, মুসলিম মহিলাদের উপর হামলা করবার জন্য মানুষকে উদ্বুদ্ধ করতো। ইবনু রাযী এবং আরো কিছু সীরাহ লেখক উল্লেখ করেছেন যে, সে এমনকি নিজেও নিরীহ মুসলমানদের উপর আক্রমণ করতো। তাই এক্ষেত্রে সম্পূর্ণ কনটেক্সট কে আলোচনায় না এনে শুধুমাত্র ঘটনা দ্বারা গোটা একটি নীতিকে বিচার করা অযৌক্তিক।

৩. মক্বায় রাসূল(সাঃ) ছিলেন ক্ষমতাহীন, মাজলুম গোষ্ঠীর অন্তর্ভুক্ত। যেমনটা সবাই জানি যে, যখন কোন একটি গ্রুপের লোকেরা অত্যাচারিত হয় তখন নিজেদের বশে শাসকগোষ্ঠীকে আনার জন্য তারা এমনকি নীতিবিবর্জিত কৌশলও ব্যবহার করে থাকে এবং এটি কার্যকর ও হয়। জঙ্গি হামলা এ কারণেই হয়ে থাকে। তারা কোন একটি জনপদে হামলা চালায় এবং সরকারের মাঝে ভীতি সৃষ্টি করে নিজেদের কথা শুনিয়ে ক্ষমতা বাগিয়ে নেয়। কারণ শাসকগোষ্ঠীর নিজস্ব ভাষায় লড়াই করার ক্ষমতা তার নেই। এখন ভেবে দেখুন, রাসূল(সাঃ) কি এরূপ কখনো করেছিলেন? তিনি কি নীতিবিবর্জিত কোন উপায়ে ক্ষমতা হাতিয়ে নেবার প্রচেষ্টা করেছেন? উলটো তার উপর ই নানা সময়ে জুলুম উৎপীড়ন চালানো হয়েছিলো, অর্থনৈতিক মন্দার সম্মুখীন হতে বাধ্য করা হয়েছিলো, পরিবার হারানোর শোকে মুহ্যমান হন তিনি, এমন পরিস্থিতি তৈরি করা হয় যখন নিজের সাথীদের অসহায়ত্ব, কষ্ট দুর্দশা চেয়ে চেয়ে দেখা ছাড়া উপায় ছিলো না।

তা কি সামান্য কয়েক মাস স্থায়ী ছিলো? তাদের বয়কট করা হয়, পাথরের আঘাতে জর্জরিত করা হয়, রক্তে রঞ্জিত করে মেরে ফেলা হয়। এমন অবস্থার মধ্য দিয়ে তারা যখন যাচ্ছিলেন; তাদের জানা ছিলো না, এ দিনগুলোর শেষ কোথায়। কবে তারা আবারও স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেলতে পারবেন। জানা ছিলো না, অচিরেই মদীনায় হিজরতের মাধ্যমে এ কষ্টের অবসান ঘটবে। তাদের শুধু ধৈর্য ধারণ করতে এবং এই পরীক্ষাকে ঠিক এরূপে ই গ্রহণ করতে বলা হয়েছিলো, যেরূপে আল্লাহ পাঠিয়েছেন। যদি আপনি অন্যায় পন্থা অবলম্বন করেন, তাহলে আপনার রাসূল(সাঃ) এর সুন্নাহর অনুসারী নন। বরং মুহাম্মদ (সাঃ) যা করেছিলেন, আপনি ঠিক তার বিপরীত টা ই করলেন। শত্রুর সাথে তাহলে আপনার আর কি তফাৎ রইলো? কোনদিক দিয়ে আপনি তার চাইতে উত্তম হলেন? জালিম শাসকের সাথে আপনার আর কোন ফারাক ই রইলো না৷ যদি আপনি জালিম শাসকের জুলুমের প্রতিবাদ অন্যায় আর সহিংসতা দ্বারা ই করেন, তাহলে আপনার এমনকি আল্লাহর কাছে সাহায্য চাইবার ও কোন অধিকার নেই।

মক্বায় থাকাকালীন নবী মুহাম্মদ(সাঃ) তার উপর হওয়া অত্যাচার তিনি ঠিক কিভাবে মোকাবিলা করতেন?


১. রাসূল(সাঃ) এর অনুভূতিতে আঘাত হেনে নানা সময়ে যেসব কথা বলা হতো, তাতে সাহাবীদের হৃদয় ক্ষতবিক্ষত হতো। এ তীক্ষ্ণ বাক্যবাণ রাসূল(সাঃ) কে যতোটা না ব্যাথা দিতো, তার চাইতেও এসব সহ্য করা তাদের জন্য ছিলো কষ্টকর। যখন কাফেররা রাসূল(সাঃ) কে কষ্ট দেয়ার জন্য নাম বিকৃত করে ‘মুযাম্মাম’ ডাকা শুরু করলো। আল ওয়ালীদ ইবনে মুগীরা,বীর খালিদ বিন ওয়ালীদ(রাঃ) এর পিতা), সে সর্বপ্রথম এ নাম উদ্ভাবন করে। মুহাম্মদ নামের অর্থ, যিনি সর্বদা প্রশংসার যোগ্য। তারা এ নামকে মুযাম্মাম বলে বিকৃত করলো। অর্থাৎ, যাকে অবদমিত করে রাখা যায়, যে অপমানিত ও লাঞ্চিত। রাসূল(সাঃ) এর সাথীরা, যারা স্বীয় জীবনের চাইতেও বেশি তাঁকে ভালোবাসতেন; তাদের পক্ষে এ অপমান মেনে নেয়া কষ্টসাধ্য ছিলো। তখন রাসূল(সাঃ) কি করলেন? তিনি কি সাহাবীদের কাছে এসে বলেছিলেন যে, দেখো তারা আমাকে কি নামে ডাকছে! না। কারণ তিনি এ পদক্ষেপের পরিণাম সম্বন্ধে ভালোভাবেই বুঝতে পেরেছিলেন। যদি তিনি এরূপ করতেন, তাহলে সাহাবীদের অন্তরে পুষে রাখা ক্ষোভকে আরো উসকে দেয়া হতো।

রাসূল(সাঃ) তাদের কাছে এসে স্মিতহাস্যে বললেন,
“কুরাইশদের গালাগাল থেকে আল্লাহ্ আমাকে কি চমৎকারভাবে হেফাজত করেন। ওরা মুজাম্মাম (নিন্দিত)-কে গাল দেয়, কিন্তু আমার নাম তো ‘মুহাম্মদ’ (প্রশংসিত)।” (ইবন ইসহাক)

সুবহানাল্লাহ! ঠিক একভাবে আমরা দেখি একদল লোক রাসূল(সাঃ) এর ছবি নিয়ে কার্টুন আঁকছে। তারা তো রাসূলের(সাঃ) ছবি আঁকছে না, বরং তারা এমন কাউকে অংকন করছে যার দাঁড়ি রয়েছে। এটা মোটেও তাঁর শামায়েল নয়। তারা যদি তাঁর প্রকৃত সৌন্দর্য ফুটিয়ে তুলতে চায় ও, তা কোনভাবেই পূর্ণাঙ্গ রূপ পাবে না। তাদেরকে তাদের মতো থাকতে দিন। রাসূল(সাঃ) ও বলেছিলেন, তাদেরকে তাদের মতো বলতে দাও। তারা মুজাম্মামকে অভিসম্পাত করছে, আমাকে নয়। যারা তাকে এভাবে অবমাননা করতো, রাসূল(সাঃ) তখনো তাদের হেদায়েতের জন্য আল্লাহর কাছে দু'আ জারি রাখতেন। আল্লাহ তো তার এ জমীনে লোকেদের অভিশাপ দেবার জন্য আমাদের প্রেরণ করেন নি। যেখানে রাসূল(সাঃ) তাঁর উম্মাহর ‘ফেরাউন’ এর জন্য ও দু'আ করেছেন। সে কে ছিলো? আবু জাহেল।

মুহাম্মদ(সাঃ) দু'আ করতেনঃ

اللَّهُمَّ أَعِزَّ الْإِسْلَامَ بِأَحَبِّ هَذَيْنِ الرَّجُلَيْنِ إِلَيْكَ بِأَبِي جَهْلٍ أَوْ بِعُمَرَ بْنِ الْخَطَّابِ

অর্থঃ হে আল্লাহ! ইসলামকে শক্তিশালী করো, এ দুই ব্যক্তির মাঝে যাকে তুমি অধিক ভালোবাসো তাঁর দ্বারাঃ আবু জাহল অথবা উমর ইবনুল খাত্তাব।
(সুনানে তিরমিজিঃ৩৬৮১)

সেসময় তারা দু'জনেই মুসলমানদের উপর জুলুম করতেন। তবু, আল্লাহর নবী(সাঃ) তাদের মাঝে উত্তম গুণাবলির আভাস দেখতে পান। যদি রাসূল তাদের ধ্বংস কামনা করে দুয়া করবার জন্য আরশের দিকে চেয়ে দু হাত উত্তোলন করতেন তবে হয়তো তাদের বিপর্যয় অনিবার্য হয়ে যেতো। কিন্তু উত্তম গুণাবলির সমন্বয়ক প্রিয় নবী মুহাম্মদ(সাঃ) এতোটাই মহৎ হৃদয়ের অধিকারী ছিলেন যে, যেসব ব্যক্তি তার অন্তর বিদীর্ণ করে দেয়া অবমাননাকর কথাবার্তা বলে তাকে কষ্ট দেয়, যারা তার বাণীর প্রসার ব্যাহত করার জন্য সর্বশক্তি প্রয়োগ করেছে, তার পরিবারের সদস্যদের হত্যা করেছে- তিনি তাদের কে ই নিজের বুকে টেনে নিতে চাইছেন। তাদের মাঝে এখনো ভালো কিছু অবশিষ্ট রয়েছে বলে মনে করছেন। তায়েফের সেইসব লোকেদের জন্য তিনি হেদায়েতের দু'আ, কল্যাণের দু'আ করছেন যারা তাকে প্রস্তরাঘাতে জর্জরিত করেছে, জীবনের সবচাইতে কঠিন দিনগুলো পার করিয়েছে। তাদের উপর থেকে আশা হারান নি। এবং এটা আমাদের শিক্ষা দেয় যে, রাসূল(সাঃ) বুঝতেন প্রকৃত সাহায্য কোথা থেকে আসে। আমাকে তাদের মতো হওয়া সাজে না।

এ প্রসঙ্গে আল্লাহ সুবহানাহু ওয়াতাআ'লা আয়াত নাজিল করেনঃ

اِدْفَعْ بِالَّتِیْ هِیَ اَحْسَنُ فَاِذَا الَّذِیْ بَیْنَكَ وَ بَیْنَهٗ عَدَاوَةٌ كَاَنَّهٗ وَلِیٌّ حَمِیْمٌ
অর্থঃ “তুমি অসৎ কাজকে সেই নেকী দ্বারা নিবৃত্ত করো যা সবচেয়ে ভাল। তাহলে দেখবে যার সাথে তোমার শত্রুতা ছিল সে অন্তরঙ্গ বন্ধু হয়ে গিয়েছে।”
(সূরা হামীম আস সাজদা, আয়াতঃ৩৪)

শুধু যে তারা সঙ্গ প্রদানকারী বন্ধু হবে তেমন না, বরং তারা হবে সুখে দুঃখে সার্বক্ষণিক পাশে থাকা মিত্র। আপনি কি জানেন এ আয়াত আল্লাহ কখন নাজিল করেছিলেন? সেসময় যখন সবেমাত্র হামযা(রাঃ) ইসলামের সুশীতল ছায়ায় আশ্রয় নিয়েছিলেন এবং উমর(রাঃ) তখনো অমুসলিম ছিলেন। হামযা ইসলাম গ্রহণ করার পর মুসলমানদের মাঝে আনন্দের হিল্লোল বয়ে যায় এবং তারা নিজেদেরকে আগের চাইতে বেশি শক্তিশালী অনুভব করে। কেননা তাঁর ইসলামে দাখিল হওয়া ছিলো ইসলামের ইতিহাসে প্রথম প্রভাবশালী কারো ইসলাম গ্রহণ। আশার আলো প্রজ্বলিত হয়েছিলো বিশ্বাসীদের অন্তরে। এমন সময় আল্লাহ অভয়বাণী দিলেন, এটিই শেষ নয়। যদি মন্দকে দূর করার জন্য সর্বোত্তম ব্যবহার করো, আরো বেশি সহনশীল হও- তাহলে এরকম আরো হামযা'রা তোমার পাশে সহযোদ্ধা হবে। এবং আলহামদুলিল্লাহ এরপরই উমর ইবনুল খাত্তাব(রাঃ) ইসলাম গ্রহণ করলেন। যিনি এমনকি হামযা(রাঃ) অপেক্ষাও অত্যধিক সম্মান মর্যাদার অধিকারী ছিলেন।

এবার মদীনার প্রেক্ষাপট নিয়ে কথা বলা যাক। রাসূল(সাঃ) এর হাতে এখন সমাজের সর্বময় কর্তৃত্ব। এখন তিনি আর পলাতক নন। মৃত্যুর শংকা তাকে তাড়া করে বেড়াচ্ছে না। সেই কর্তৃত্বের বলে তিনি কি করেছিলেন?

১. لَاۤ اِكْرَاهَ فِی الدِّیْنِ. “দ্বীনের ব্যাপারে কোন জোর জবরদস্তি নেই।” (সূরা বাক্বারাহঃ২৫৬)
এ আয়াত মদীনায় শাসনভার গ্রহণ করবার পরেই নাজিল হয়েছিলো।

২. মদীনায় তিনি এতোটা দয়া, অনুগ্রহের সহিত প্রবেশ করেছিলেন যে তার শত্রুরা পুনঃপুন চেষ্টা করা সত্ত্বেও তাঁকে বিপর্যস্ত করতে পারে নি৷ রাসূল(সাঃ)কে তাদের দ্বারা নানা পরীক্ষার সম্মুখীন হতে হয়েছে, যারা তার নবুওয়াত কে মিথ্যে প্রমাণ করার জন্য সর্বোচ্চ চেষ্টা করে যাচ্ছিলো। তাদের মাঝে অন্যতম ছিলো, যা'ইদ ইবনু সা'অনা; ইহূদীদের প্রধান দু'জন পাদ্রীদের একজন ছিলো সে। রাসূল(সাঃ) ঘোষণা দিয়েছিলেন, ইহূদীদের দশ জন পাদ্রী যদি ইসলাম গ্রহণ করে তাহলে মদীনার সমস্ত ইহূদীরা ইসলামের সুশীতল ছায়ায় আশ্রয় নিবে। তাদের মাঝে তিন জন মুসলমান হয়ে গিয়েছিলেন। যা'ইদ ইবনু সা'অনা অন্যতম। তো, তিনি রাসূল(সাঃ) কে পরীক্ষা করতে চাইলেন। এ উদ্দেশ্যে তিনি ছদ্মবেশে তার মজলিসে আগত হলেন।

রাসূল(সাঃ) এর সাথে তার ব্যবসায়িক সম্পর্ক ছিলো। একে অপরকে টাকা ধার দিতেন তারা। সেবার রাসূল(সাঃ) এর কাছে যা'ইদ টাকা পেতেন এবং টাকা ফেরত দেয়ার তারিখটি আরো এক সপ্তাহ পরে ছিলো। তিনি উপস্থিত হয়ে সাহাবীদের সম্মুখে রাসূলকে শাসাতে লাগলেন, তাঁকে অপমানিত করা শুরু করলেন। রাসূল(সাঃ) এর হাতে এখন ক্ষমতা রয়েছে। তিনি চাইলে ই বলতে পারতেন, ‘হে লোকেরা! তোমরা কি আমাকে চেয়ে চেয়ে অপমানিত হতে দেখবে?’ কিন্তু তিনি তা বলেন নি। উপরন্তু যখন উমর(রাঃ) উঠে দাঁড়িয়ে বললেন, ‘ইয়া রাসূলুল্লাহ! এর বিষয়টি আমি দেখছি’; রাসূল(সাঃ) তা অপছন্দ করলেন এবং বললেন যে, ‘তোমার থেকে এমনটা আমি প্রত্যাশা করি নি। এখন যাও, তুমি তাকে তার প্রাপ্য ২০ পাউন্ড খেজুর বুঝিয়ে দাও এবং সাথে অতিরিক্ত হিসেবে আরো ২০ পাউন্ড খেজুর দিবে তোমার অপ্রীতিকর আচরণের জন্য।’

সুবহানাল্লাহ! কতোই না উত্তম আচরণ। ফেরার পথে উমর(রাঃ)কে, যাইদ ইবনে সা'অনা জিজ্ঞেস করলেন ‘তুমি কি জানো আমি কে?’ উমর(রাঃ) নিতান্ত অবহেলায় উত্তর দিলেন, ‘না। এবং জানার ইচ্ছে ও নেই।’ এবার যাইদ নিজের পরিচয় দিতে ই উমর(রাঃ) বিস্ময়ে হতবাক হয়ে বললেন, “আপনি তো একজন বিদ্বান, সম্মানিত মানুষ। তাহলে আপনি কেন এরূপ আচরণ করলেন? রাসূল(সাঃ) আপনার কতো প্রশংসা করে থাকেন!” এবার যাইদ ইবনু সা'অনা তদ্রুপ আচরণ করার নেপথ্যের কারণ গোমর বলতে গিয়ে জানালেন, “আমি রাসূল(সাঃ) এর মাঝে নবুওয়াতের সমস্ত নিদর্শন দেখতে পেয়েছিলাম। কিন্তু একটি নিদর্শন জানা বাকি ছিলো, যা পরীক্ষা করতে হতো। আমাদের গ্রন্থে উল্লেখ আছে যে, যেই নবী আসবেন; তাঁর সহিষ্ণুতা লললল রোষের চাইতেও মহান। তাঁকে যতোই রাগান্বিত করার চেষ্টা করা হবে, তিনি ততো বেশি ধৈর্যের পরাকাষ্ঠা দেখাবেন। আলহামদুলিল্লাহ এখন আমি এর বাস্তব সাক্ষী হয়ে গেলাম।” অতঃপর তিনি কালেমা শাহাদাত পাঠ করে মুসলমান হয়ে গেলেন। এবং ঘোষণা দিলেন, “আজ থেকে আমার সমস্ত সম্পদের অর্ধেক ইসলামের জন্য বিলিয়ে দিলাম।” উল্লেখ্য যে তিনি মদীনার সবচেয়ে বেশি ধনী ব্যক্তিদের অন্যতম ছিলেন।

রাসূল(সাঃ) চাইলেই তাকে সেখান থেকে বের করে দেয়ার ব্যবস্থা করতে পারতেন। কিন্তু তিনি তা করেন নি। কতো সময়ে তিনি শারীরিক নির্যাতনের সম্মুখীন হয়েছিলেন। গাওরাছ ইবনু হারিস, রাসূলকে(সাঃ) গাছের নীচে শুয়ে থাকতে দেখলো। মদীনায় থাকাকালীন সে, রাসূলের(সাঃ) গাছে ঝোলানো তরবারি নিয়ে নিতে উদ্যত হলো। তিনি তখন কাইলুলা করছিলেন। সে তরবারী তার গ্রীবায় ধরে বলে উঠলো, ‘হে মুহাম্মদ! আমার হাত থেকে তোমাকে এখন কে বাঁচাবে?’ রাসূল(সাঃ) এবার নির্ভয়ে উত্তর দিলেন, ‘আল্লাহ!’ তার কন্ঠের দৃঢ়তায় চমকে গিয়ে সে বেদুইন তরবারি হাত থেকে ফেলে দিলো। এবার তরবারি তুলে নিয়ে তার গ্রীবায় রেখে বললেন, ‘এবার আমার হাত থেকে তোমাকে কে বাঁচাবে!’ উত্তরে বেদুইন বললোঃ ‘তোমার মহত্ত্ব প্রদর্শন করো, মুহাম্মদ। প্রতিশোধ গ্রহণ কোরো না।’ দয়ার নবী মুহাম্মদ (সাঃ) তাকে ছেড়ে দিলেন এবং চলে যেতে দিলেন। বললেন, ‘যাও, তোমার কোন চিন্তা নেই।’

আবদুল্লাহ ইবনে উবাই'র কথা ভেবে দেখুন! তিন তিন বার সে চরম মুনাফেক্বি করেছিলো। সে রাসূল(সাঃ) কে কর্তৃত্বের আসন থেকে সরিয়ে দেয়ার জন্য বদ্ধপরিকর ছিলো। সে যে শুধু তাকে হত্যার চেষ্টা করেছে এমন ই না, বরং সে রাসূলের ক্ষমতার বিশ্বাসযোগ্যতা নষ্ট করার চিন্তায় সর্বদা বিভোর থাকতো। এই আবদুল্লাহ ইবনে উবাইকে যখন লোকেরা মেরে ফেলতে চাইলো, রাসূল(সাঃ) কি বলেছিলেন? এ উত্তর টি খুবই গুরুত্বপূর্ণ।
তিনি বললেনঃ “ আমি চাই না মানুষ বলুক, এ ব্যক্তি নিজের সাথীদের হত্যা করে।” কি সুদূরপ্রসারী ভাবনা! অর্থাৎ তিনি চাইছিলেন না যে ভবিষ্যতের ইসলামোফোব'রা যেনো কোন সমালোচনার রসদ খুঁজে না পায়। এ উদ্দেশ্যে তিনি আবদুল্লাহ ইবনে উবাইকে হত্যার সম্মতি দেন নি। যদিও সে প্রকৃতপক্ষেই এ শাস্তির যোগ্য ছিলো।

وَ لَا تُطِعِ الْكٰفِرِیْنَ وَ الْمُنٰفِقِیْنَ وَ دَعْ اَذٰىهُمْ وَ تَوَكَّلْ عَلَى اللّٰهِؕ

অর্থঃ ❝আর কখনো দমিত হয়ো না কাফের ও মুনাফিকদের কাছে, পরোয়া করো না তাদের নির্যাতনের এবং ভরসা করো আল্লাহর প্রতি।❞
(সূরা আহযাবঃ৪৮)

আল্লাহ এ আয়াত কোন বিষয়ে নাজিল করেছিলেন? যখন লোকজন রাসূল(সাঃ) এর স্ত্রীদের নিয়ে উপহাস করতে শুরু করেছিলো। তারা রাসূল(সাঃ) এর সাথে যয়নব বিনতে জাহাশ(রাঃ) এর বিবাহ নিয়ে বিদ্রুপাত্মক কথাবার্তা বলছিলো। মদীনায় হিজরতের ৫ বছর পরের ঘটনা এটি। তখন আল্লাহ বলেছিলেন, এসব রটনা, নিন্দা কে পাত্তা দিও না। আল্লাহর উপর ভরসা করো। নিশ্চয়ই তোমার রব্ব ই তোমার জন্য যথেষ্ট। সুবহানাল্লাহ। আল্লাহ কোরআনে কতো চমৎকার ভাবে ধৈর্যের পাঠ শিক্ষা দিয়েছেন।

এবার রাসূল(সাঃ) বিজয়ীবেশে মক্কায় ফিরে এলেন। আজ তিনি সেই ব্যক্তি, যাকে নির্যাতন নিপীড়নের মাধ্যমে তার জন্মভূমি থেকে বিতাড়িত করা হয়েছিলো। মক্বাবাসীর প্রতি সেদিন তিনি চাইলেই এক কথায় প্রতিশোধ গ্রহণ করতে পারতেন। এরা তো তারা ই, যারা তাঁর এবং তাঁর পরিবারের প্রাণনাশ করতে চেয়েছিলো। আল আব্বাস রাদ্বি'আল্লাহু আনহু যখন রাসূলের কাছে এসে আরজ করলেন, “ইয়া রাসূলুল্লাহ! আপনি কি আবু সুফিয়ানকে একটু অনুগ্রহ করতে পারেন? আপনি অবগত আছেন যে সে তার গোত্রের গণ্যমান্য ব্যক্তি। তাই আপনি যখন মক্বায় প্রবেশ করবেন, তখন আবু সুফিয়ানের ঘর কে ও সকলের জন্য নিরাপদ ঘোষণা করে দিয়েন।” রাসূল(সাঃ) অনুরোধ রক্ষা করলেন। ঘোড়ার পৃষ্ঠদেশে নিজের নাক স্পর্শ করা অবস্থায়,
একজন বিনয়ী বিজেতার বেশে; তিনি প্রবেশ করলেন মক্বায় এবং বললেন, “যে ব্যক্তি আবু সুফিয়ানের ঘরে আশ্রয় নিবে, সে নিরাপদ।” পুরো পরিস্থিতি আনুকুল্যে থাকা সত্ত্বেও সেদিন তিনি অন্যের আবেগ, অনুভূতি, মর্যাদার গুরুত্ব দিয়েছিলেন। এ সেই আবু সুফিয়ান, যে বছরের পর বছর রাসূলের বিরুদ্ধে লোকেদের সংগঠিত হয়ে যুদ্ধ করতে প্ররোচিত করেছে, তাকে হত্যার চেষ্টা করেছে! আপনি কি পারবেন এমন কারো জন্য সহানুভূতি দেখাতে, যে আপনার পরিবারের হত্যার জন্য দায়ী?

মক্বা বিজয়ের পরের কথা বলি। ফুদ্বালাহ আল লাইসী, যে পবিত্র ক্বাবাঘরে রাসূল(সাঃ) কে হত্যার উদ্দেশ্য নিয়ে ইহরামের আড়ালে ছুরি বহন করছিলো। এটা এমন সময়ের কথা, যখন রাসূল(সাঃ) কেবল মদীনা নয়, একটি গোটা অঞ্চল এর কর্তৃত্ব করছিলেন। রাসূল(সাঃ) তার মনের গোপন অভিসার ও জানতেন। তিনি জিজ্ঞেস করলেন, ‘হে ফুদ্বালাহ! তুমি বিড়বিড় করে কি বলছো?’ সে উত্তর দিলো, আমি তো কেবল আল্লাহর জিকির করছিলাম। তিনি বারবার জিজ্ঞেস করতে লাগলেন এবং প্রতিবার সে আরো উচ্চস্বরে জবাব দিচ্ছিলো। রাসূল(সাঃ) তা শুনে তার বুকে হাত রেখে কল্যাণ কামনার দু'আ করে দিচ্ছিলেন। ফুদ্বালাহ বলেন, “এর পূর্বে তিনি ছিলেন আমার কাছে সবচেয়ে ঘৃণিত একজন ব্যক্তি। অথচ এরপর তার প্রতি ভালোবাসায় আমার অন্তর পরিপূর্ণ হয়ে উঠলো।” সুবহানাল্লাহ। মুহাম্মদ (সাঃ) চাইলেই তার ছোরা ছিনিয়ে নিয়ে তাকে মেরে ফেলতে পারতেন। কিন্তু তিনি চেয়েছিলেন তার মাঝে ভালোত্ব জাগিয়ে তুলতে। তার দয়া, মহত্ত্ব এতো বিশাল ছিলো যে তিনি তার প্রতি শত্রুতা পোষণকারী ব্যক্তিদের সাথে ও সহনশীল, সহমর্মি স্বভাবের ছিলেন।

এবার জানা যাক, রাসূলুল্লাহ সল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম রাগান্বিত হতেন কোন বিষয়ে। আয়েশা রাদ্বি'আল্লাহু আনহা বলেনঃ
“ আমি কখনোই রাসূলকে(সাঃ) তাঁর নিজের জন্য রাগতে দেখিনি। তিনি তখন ক্রুদ্ধ হতেন, যখন আল্লাহর সীমা অতিক্রম করা হতো।” কেমন ছিলো তাঁর রাগ? জাবির (রাঃ) বর্ণনা করেছেন, “যখন রাসূল(সাঃ) রেগে যেতেন, তার মুখ রক্তিম বর্ণ ধারণ করতো।” ইবনে আব্বাস(রাঃ) বলেন, “তিনি যখন রাগান্বিত হতেন, তার মুখমন্ডলে আলাদা একটা হাসি ফুটে উঠতো।” সুবহানাল্লাহ! রাগ অবস্থায় ও হাসি মুখে থাকতেন তিনি, যা দেখে বোঝা যেতো তিনি এখন রাগে দিশেহারা বোধ করছেন।

এবং আরো কোন বিষয় তাকে রাগিয়ে তুলেছিলো? যখন কিছু যুবক বললো, ‘আমরা সারারাত্রি আল্লাহর ইবাদাতে কাটিয়ে দিব, সারাদিন রোজা রাখবো, গোটা সময় কোরআন পাঠ করতে থাকবো! তিনি তা শুনে রেগে গেলেন এবং বললেন, “আমি তোমাদের মাঝে আল্লাহকে সবচেয়ে বেশি জানি এবং সর্বাধিক ভয় করি।” সীমালঙ্ঘন তাকে রাগান্বিত করতো। জুলুম তাকে রাগান্বিত করতো! একজন অমুসলিম এর প্রতি হওয়া অন্যায় তাঁকে রাগান্বিত করে তুলতো। যুদ্ধ চলাকালীন সৈন্যদল থামিয়েছিলেন একজন নারীর হত্যার বিচার করার জন্য।

যখন রাসূল(সাঃ) কে অপমানের কবাব দিতে গিয়ে কেউ ভাঙচুর করছেন, গোলযোগ সৃষ্টি করছেন, তা কি সত্যি ই রাসূলের(সাঃ) জন্য করছেন? নাকি তা এজন্য যে, কেউ প্রকৃতপক্ষে আমায় অপমানিত করলো, আমার অনুভূতিতে আঘাত হেনেছে। আমি যাকে রাসূল(সাঃ) মানি, তাকে নিয়ে কেউ কথা বলেছে, এ চিন্তা থেকে তারা বিক্ষুব্ধ হই। এটা কি তাঁর জন্য? নাকি আমাদের জন্য? সত্য বলতে, যদি এটি আসলেই আল্লাহ এবং তাঁর রাসূলের(সাঃ) কথা ভেবে করা হতো, তবে এমন আচরণ কখনোই করা হতো না, যা রাসূল(সাঃ) এর শিখিয়ে যাওয়া পদ্ধতির সম্পূর্ণ বিপরীত।

আল্লাহ আমাদের রাসূলের(সাঃ) দেখিয়ে যাওয়া পথনির্দেশ অনুসরণ করে জীবন পরিচালনার তাওফিক দান করুন। আমীন।

অবমাননার জবাবে রাসূল(সাঃ)

মূলঃ ওমর সুলাইমান
অনুবাদঃ সাবিহা সাবা

পঠিত : ৮৩৯ বার

মন্তব্য: ০