Alapon

হিজরি সন গণনার ইতিহাস



সাইয়্যেদেনা উমার রা.-এর শাসনামল। ইসলামী হুকুমাত তখন অনেক বড়। এর মধ্যে একটি সংকটে পড়লো রাষ্ট্র। আরবে তৎকালীন সমাজ মাসের হিসেব ও তারিখের হিসেব করতো কিন্তু নির্দিষ্টভাবে সনের হিসাব করতো না। রাষ্ট্র বিশাল হওয়ায় অনেক ডকুমেন্টস মেইনটেইন করতে হচ্ছে। যেমন, রাষ্ট্রীয় আদেশ, সার্কুলার, ঘোষণাপত্র, চুক্তিপত্র, কূটনৈতিক চিঠি ইত্যাদি। এগুলোতে মাসের নাম থাকলেও সন লিখা থাকতো না।

১৬ হিজরির শাবান মাসের ঘটনা। তখন অবশ্য ১৬ হিজরি বলে কিছু ছিল না। একটি অফিসিয়াল সার্কুলার হাজির হলো উমার বিন খাত্তাব রা.-এর সামনে। সেখানে মাসের নাম লেখা ছিল কিন্তু সনের নাম ছিল না। উপস্থিত কর্মকর্তাদের মধ্যে মতবিরোধ তৈরি হলো এটি কোন সনের সার্কুলার! উমার রা. বললেন এটি এখনই সমস্যা তৈরি করছে। ভবিষ্যতে তো এটি বড় সমস্যা হিসেবে দাঁড়াবে। এর সমাধান কী? এর কোন সদুত্তর পাওয়া যায় নি সেসময়।

তৎকালীন আরবে সুনির্দিষ্ট কোন সন প্রথা প্রচলিত ছিল না। বিশেষ ঘটনার নামে বছরগুলোর নামকরণ করা হতো। যেমন- বিদায়ের বছর, অনুমতির বছর, ভূমিকম্পের বছর, হস্তীর বছর ইত্যাদি। মহানবী সা. যখন পৃথিবীতে এসেছেন আরববাসী তখন ‘হস্তীর বছর’ থেকে কাল গণনা করছিল। এরপর ফিজার যুদ্ধ দিয়েও সাল গণনা হতো। যেমন তারা বলতো হস্তীর বছরের তিন বছর পরে আমার মেয়ের জন্ম। ফিজার যুদ্ধের আগের বছর আমাদের বিয়ে হয়েছে ইত্যাদি।

ইসলামের দ্বিতীয় খলিফা হজরত উমার ফারুক রা. যখন খেলাফতের দায়িত্বভার গ্রহণ করেন, তখন বহু দূর-দূরান্ত পর্যন্ত নতুন নতুন রাষ্ট্র ও ভূখন্ড ইসলামী খেলাফতের অন্তর্ভুক্ত হয়। রাষ্ট্রের জরুরি দলিল, কাগজপত্র ইত্যাদিতে কোন সন উল্লেখ না থাকায় অসুবিধার সৃষ্টি হতো। আবার বসরার (ইরাক) গভর্নর মুসা আল আশয়ারি রা. রাষ্ট্রনায়ক উমার ফারুক রা.-কে লিখে পাঠালেন, আপনি পাঠানো চিঠিতে সন না থাকায় সমস্যা হচ্ছে। তিনি এক্ষেত্রে গ্রিসকে অনুসরণ করার পরামর্শ দেন।

উদ্ভূত পরিস্থিতিতে আমীরুল মুমেনিন একটি বিশেষজ্ঞ মিটিং আহ্বান করলেন এই সমস্যা সমাধানে। এখানে বিজ্ঞ সাহাবা ও পন্ডিত ব্যক্তিদের আহ্বান জানান হয়েছে। সোলার ক্যালেন্ডার নাকি লুনার ক্যালেন্ডার ব্যবহার করা হবে? কোন ঘটনাকে সাক্ষী রেখে বছর গণনা শুরু হবে? কোন মাসকে প্রথম মাস হিসেবে ধরা হবে? ইত্যাদি সব জটিল সমস্যা নিয়ে আলোচনা হবে সেই মিটিং-এ।

হিজরতের ১৬ বছর পর ১০ জমাদিউল আউয়ালে আসলো সেই ঐতিহাসিক দিন। যেহেতু আরবের মানুষ ও সাহাবীরা চন্দ্রবর্ষ অনুসরণ করতো এবং আমাদের ইবাদতের অনেক গুরুত্বপূর্ণ তারিখ চাঁদের সাথে সম্পর্কিত তাই সৌর ক্যালেন্ডার বাদ পড়ে যায় শুরুতেই। মহানবী সা.-এর জন্ম, নব্যুয়ত, হিজরত ও মৃত্য—এ চারটি ঐতিহাসিক ও গুরুত্বপূর্ণ ঘটনার যেকোন একটি হতে হিজরি সন গণনা করার প্রস্তাব উত্থাপিত হলো।

কিন্তু সমস্যা হলো জন্ম ও নবুয়তের তারিখ নিয়ে মতপার্থক্য আছে। আর মৃত্যু শোকের সিম্বল। অতএব হিজরতের মাধ্যমেই সন গণনা শুরু করার পক্ষে সাহাবার একমত হলেন। হিজরতের বছর থেকে সন গণনার পরামর্শ দেন বিজ্ঞ সাহাবী সাইয়্যেদেনা আলী রা.। কারণ ঐদিন থেকে আমাদের নবী হজরত মুহাম্মদ সা. শাসনক্ষমতা গ্রহণ করতে শুরু করেন এবং মুসলিমরা রাষ্ট্রীয় শক্তি অর্জন করে। সেজন্যই দিনটি মুসলিমদের কাছে চিরস্মরণীয়। আর পবিত্র মাস মহররমকে ১ম মাস হিসেবে নির্ধারণ করতে একমত হন সাহাবারা।

সিদ্ধান্ত হলো যে বছর মুহাম্মদ সা. হিজরত করে মদিনায় এসেছেন সে বছরের মহররমের ১ তারিখ থেকে হিজরি বর্ষ গণনা করা হবে। হিসেব করে দেখা গেল ১ হিজরির ১ মহররম অর্থাৎ প্রথম দিনটি ছিল জুমাবার, জুলিয়ান দিনপঞ্জি অনুসারে ১৬ জুলাই ৬২২ খ্রিস্টাব্দ। আর এই সিদ্ধান্তটি নেয়া হয় ঘটনার ১৬ বছর পর ৯ জুন ৬৩৭ সালে। সেদিনই বিশেষজ্ঞরা হিসেব করে দেখলো সেদিন ছিল ১০ জমাদিউল আউয়াল, ১৬ হিজরি।

উমার ফারুক রা. শাসন ক্ষমতা গ্রহণ করার তিন বছরের মাথায় এমন গুরুত্বপূর্ণ সমস্যার সমাধানে কার্যকরি সিদ্ধান্ত গ্রহণ করলেন। সেই ধারাবাহিকতায় আজ ১ মহররম ১৪৪৩ সাল। আজ হিজরি নববর্ষ। সবাইকে হিজরি নতুন বছরের শুভেচ্ছা। নতুন বছরে মহান রাব্বুল আলামীন আরো বেশি তার অনুগত হওয়ার তাওফিক দান করুন। আমিন।

পঠিত : ২৮৮ বার

মন্তব্য: ০