Alapon

বড়ো বেলার জীবনে হয়তো স্বস্তি আছে, কিন্তু আনন্দটা হয়ে গেছে সংকুচিত...



ছোটবেলায় আমাদের বাড়ির পাশেই ছিলো আইসক্রিম ফ্যাক্টরি। সে কারণে স্কুলে যাওয়ার সময় একটা আইসক্রিম খেতাম আবার ফেরার সময় একটা খেতাম। তারপর বিকালবেলা আবার আইসক্রিম খাওয়ার জন্য আম্মার কাছে প্যানপ্যান করতাম। আর স্বাভাবিকভাবেই আম্মাও দিতো ঝাড়ি! তাই অধিকাংশ বিকালটা আইসক্রিমশূণ্যই কাটতো।

সেসময় আম্মার একটা মাটির ব্যাংক ছিলো। আম্মা সেই ব্যাংকটাতে পয়সা রাখতেন। একদিন খেয়াল করলাম, পয়সা নেওয়ার জন্য আম্মার পিছন পিছন ছোটাছুটি করে যতোটা পরিশ্রম হয়, তার চেয়ে কম পরিশ্রম করে ব্যাংক থেকে পয়সা বের করা সম্ভব। যেই ভাবা সেই কাজ। এভাবে সম্ভবত সপ্তাহখানেক চলেছিলো। কথায় আছে, চোরের দশদিন গেরোস্তের একদিন। আম্মাও আমাকে ধরে ফেললেন। তারপর আমার পিঠে প্রচন্ড উত্তম মধ্যম দিলেন।

সেদিন মাইর খাওয়ার পর মনে মনে পন করেছিলাম, বড়ো হয়ে একটা আইসক্রিম ফ্যাক্টরি দিবো। তারপর সারাদিন শুধু আইসক্রিমই খাবো।

কিন্তু বড়ো বেলায় এসে আইসক্রিম ফ্যাক্টরি দেওয়া তো দূর কি বাত, আইসক্রিম খাওয়ারই খুব একটা ইচ্ছে করে না।

ছোটবেলায় প্রতিদিন সন্ধ্যাবেলায় মোগলাই খেতে চাইতাম। তখন প্রতিপিচ মোগলাইয়ের দাম ছিলো ১০ টাকা। হাফ মোগলাই পাওয়া যেতো ৫ টাকায়। তো সন্ধ্যা হলেই চিন্তা করতাম, কীভাবে ৫ টাকা সংগ্রহ করা যায়! ৫ টাকা হলেই সেতু হোটেলের পানে দৌড় দিবো। কিন্তু প্রতিদিন তো আর দোকানে গিয়ে টাকা চাইতে পারি না। যেদিন সন্ধ্যায় মোগলাই খেতে পারতাম না, সেদিন মন খারাপ করে বাড়ির পথে হাটতাম আর ভাবতাম, ‘বড়ো হয়ে একটা হোটেল দিবো। আর সেই হোটেলে শুধু মোগলাই পাওয়া যাবে। তখন ইচ্ছেমতো মোগলাই খাবো!’

আর এখন পেটে গ্যাসের ভয়ে মোগলাই খাওয়াই হয় না!

ছোটবেলায় আমাদের বাড়িতে টেলিভিশন ছিলো না। তাই শুক্রবার হলেই সিনেমা দেখার জন্য আশেপাশের পরিচিতজন বা বন্ধুদের বাড়িতে ছুটতে হতো। অন্যদিকে শুক্রবার আম্মাজানের প্রধান কাজ হতো, দুপুরের পর আমাকে বাড়ির বাইরে যেতে না দেয়া! সে কারণে দুপুরে খাওয়ার পর আম্মা শর্ত দিতো, ‘হয় এখন ঘুমাও, না হয় পড়তে বসো!’
আম্মা জানতোই যে, আমি কখনো পড়তে চাইবো না, ঘুমটাই বেছে নিবো। তাই আম্মা বিছানার এক কোনায় বসে সেলাইয়ের কাজ করতেন। আর আমি ঘুমের ভান করে বিছানায় পড়ে থাকতাম। সেলাইয়ের কাজ করতে করতে আম্মা একপর্যায়ে ঘুমের দেশে হারিয়ে যেতেন। সেই সুযোগে আমি দিতাম ভোঁ- দৌড়!

একদিন সিনেমা দেখা শেষ করে বাড়ি ফিরতে ফিরতে সন্ধ্যা হয়ে গেল। বাড়ির অঘোষিত নিয়ম ছিলো, যে যেখানেই থাকুক মাগরিবের নামাজ পড়ে বাড়ি ফিরতে হবে। সেদিন আমি বেশ খানিকটা দেরি করেই বাড়ি ফিরেছিলাম। আর খুব স্বাভাবিকভাবে বাড়ি ফেরা মাত্রই আম্মা আমার পিঠে উত্তম মধ্যম লাগিয়ে দিলেন। সেদিন ভীষণ কষ্ট পেয়েছিলাম। আর মনে মনে বলেছিলাম, ‘বড়ো হওয়ার পর আমি সারাদিন শুধু টেলিভিশনই দেখবো। তখন তো আর কেউ নিষেধ করবে না!’

আজ বড়ো বেলায় এসে এমনও মাস চলে যায় যে, টেলিভিশন দেখাই হয় না। আর বাংলা সিনেমা দেখার জন্য আকুপাকু করা সেই চঞ্চল মনটা কোথায় যে হারিয়ে গেছে- তা বলা মুশকিল!

ছোটবেলার সেই দিনগুলোতে হয়তো কষ্ট ছিলো, কিন্তু আনন্দের কোনো সীমা ছিলো না। আজ বড়ো বেলার জীবনে হয়তো স্বস্তি আছে, কিন্তু আনন্দটা হয়ে গেছে সংকুচিত...

পঠিত : ২৬৪ বার

মন্তব্য: ০