Alapon

তিউনেশিয়ায় ক্যু: পতনটা আসলে কার?




তিউনেশিয়ার প্রধানমন্ত্রীকে বরখাস্ত এবং সংসদকে স্থগিত রাখার মাধ্যমে যে সিভিল ক্যু সম্পন্ন হল তা নিয়ে আলোচনা-পর্যালোচনার শেষ নেই। অনেকেই এটাকে স্রেফ আন-নাহদার পতন হিসেবে উল্লেখ করছেন এবং ঘানুসীর উদারনীতির সমালোচনা করছেন। যেহেতু আমার থিসিসের একটি পার্ট ছিল ঘানুসীর রাষ্ট্রচিন্তা সেহেতু এ বিষয়ে গত তিন-চার বছর বেশকিছু কাজ করার সুযোগ হয়েছে, তিউনেশিয়ার অনেকের সাথে বসার এবং দীর্ঘ আলোচনার সুযোগ হয়েছে। সেই অভিজ্ঞতা থেকে বেশকিছু অবজারভেশন এখানে শেয়ার করতে চাই:

১. তিউনেশিয়ার স্বাধীনতা লাভের পর থেকে দীর্ঘ ৫৫ বছর দুজন স্বৈরশাসক শাসন করেছিল। স্বভাবতই একনায়নতন্ত্রের অধীনে দীর্ঘ সময় থাকা একটি রাষ্ট্রের চরিত্র দ্রুতই বদল করা কঠিন এমনকি মানুষের মনও। আরব বসন্ত পরবর্তী সময়ে কোন দলই এখনো স্টাবলিশ হতে পারেনি। ২০১৯ সালের নির্বাচনের ফলাফল দেখলে এটা স্পষ্ট যে, পুরাতন দলগুলোর আসন সংখ্যা ১-৫ এর মধ্যে নেমে এসেছে। সেই তুলনায় আন-নাহদাই বরং সবচেয়ে ভালো পজিশনে ছিল। যদিও সেটা একক সংখ্যাগরিষ্টতার তুলনায় অনেক কম।

২. ২০১৯ এর নির্বাচনের ফলাফল একটি ঝুলন্ত পার্লামেন্ট তৈরী করেছিল যা ছিল খুবই নড়বড়ে। এতটাই যে, কোন সরকারই কয়েকমাসের বেশী টিকেনী। স্বভাবতই টিকার কথা নয় কারন, ৮-১০ টি দল যখন সরকার চালায় তখন ছোট্র এই দেশটির পরিণতি কি হতে পারে তা সহজেই অনুমেয়। এখানে একটি বিষয় উল্লেখ না করলেই নয় যে, আন-নাহদার প্রস্তাবিত কোন সরকার বাকী রাজনৈতিক দলগুলো মানেনী এবং সরকার গঠন প্রশ্নে প্রথম ভোটেই আন-নাহদা হেরে যায়। রশিদ ঘানুসীকে প্রধানমন্ত্রী না করা সত্ত্বেও! এ পদে একজন নিরপেক্ষ সাবেক উপমন্ত্রী/ প্রতিমন্ত্রীকে তারা নিয়োগ দিয়েছিল কিন্তু তাকেও মানেনী দলগুলো। পরবর্তী সরকারগুলোতে আন-নাহদার অংশগ্রহন ছিল খুবই কম। দুয়েকজন করে মন্ত্রী ছিল মাত্র! এরপর যদি সামগ্রিক ব্যর্থতার জন্য তাদেরকে দায়ী করা হয় তাহলে সম্ভবত এটা ইনসাফ হবেনা।

৩. একটি দেশের উন্নয়ন কোন ম্যাজিক নয় বরং এর কিছু উপাদান রয়েছে যেগুলোর সমন্বিত কার্যক্রম হলেই কেবল উন্নয়ন সম্ভব। বিশেষত অস্থির রাজনীতি। আরব বসন্ত পরবর্তীতে এখনো সেখানে একটি স্থিতিশীল রাজনীতি প্রতিষ্ঠা সম্ভব হয়নি। পাশাপাশি তিউনেশিয়ার মতো একটি দেশের যেখানে ফ্রান্সের কঠোর হস্তক্ষেপ রয়েছে সেখানে আপনি রাতারাতি সবকিছু পরিবর্তন করে ফেলবেন সেটা সম্ভব নয়। এই পয়েন্টটা পৃথিবীর সকল দেশের ইসলামিস্টদের খুব ভাল করে বুঝা দরকার। বর্তমান গ্লোবালাইজেশনের যুগে আপনি বাধ্য অনেক দেশের সাথে সমন্বয় করতে বিশেষত উন্নয়নশীল দেশগুলোর ক্ষেত্রে। আপনার মডেল যতই সুন্দর হোক না কেন কিছু পয়েন্টে আপনি আটকে যাবেন যদি সামগ্রিক অর্থনীতিকে আপনি সেভাবে সমন্বয় করতে না পারেন। তবে এখানে যে কোন রাজনৈতিক দলের দেশের সামগ্রিত অর্থনীতি নিয়ে স্পেসিফিক পরিকল্পনা কিংবা বিকল্প সমাধানগুলোর প্রস্তাবনা থাকা দরকার, গবেষণা প্রতিষ্ঠানগুলোকে সক্রিয় রাখা দরকার। প্রচুর কাজ হওয়া দরকার।

৪. রশিদ ঘানুসী রাজনৈতিকভাবে জনপ্রিয় নেতা ছিলেন না বরং উনার পরিচয় একজন ইন্টেলেকচ্যুয়াল এবং সাংগঠনিক নেতা। সুতরাং উনার কাছ থেকে এরদোয়ানের মতো ভূমিকা আশা করা নিছক বোকামী। আমারতো মনে হয় উনি উনার জায়গায় সর্বোচ্চ চেষ্টা করেছেন। যার ফলে দীর্ঘ ১০ বছর বিপ্লবকে টিকিয়ে রেখেছিলেন। ঘানুসীর লেখাগুলো যদি পড়ার সুযোগ হয় তবে দেখবেন তার একটা মূল কনসার্নের জায়গা হল, একনায়কতন্ত্র কিংবা স্বৈরাচার বিরোধী। তিনি আবারো যাতে স্বৈরাচার না আসে সেহেতু সম্ভাব্য সব চেষ্টাই করেছেন। এজন্যই বারবারই পিছু হটেছেন, সমঝোতা করেছেন। ঘানুসীর পজিশন থেকে কিংবা আন-নাহদার যতটুকু ভূমিকা রাখার সুযোগ ছিল তিনি সবটুকুই করার চেষ্টা করেছেন।

৫. মধ্যপ্রাচ্যে তিউনেশিয়াসহ যেখানেই ইসলামপন্থীরা (সেটা যে চিন্তারই হোক না কেন) ক্ষমতায় কিংবা কাছাকাছি আছে সেখানে তাদের সবদিক থেকে থামিয়ে দেওয়া কিংবা দমিয়ে রাখার জন্য আমিরাত-ইসরাইল ব্লক বিশাল পরিকল্পনা নিয়ে কাজ করে বিশেষত আরব বসন্ত পরবর্তী সময়ে এ কাজগুলো নানাভাবেই বাড়ছে। গত কয়েকমাসে আগে আমিরাতের প্ররোচনায় বেশকিছু এমপি ঘানুসীর বিরুদ্ধে অনাস্থা প্রস্তাব এনেছিল। তখন মাত্র ১০-১৫ ভোটে ঘানুসী টিকে যায় স্পীকার হিসেবে। এরকম নানা ষড়যন্ত্র গত ১০ বছর ধরেই চলছে।

৬. বিশ্ব রাজনীতির প্রেক্ষাপটকে সামনে রাখলে এটা বুঝা জরুরী যে, বাইডেন প্রশাসনের নতুন মধ্যপ্রাচ্য পলিসির নতুন খেলা শুরু হচ্ছে। আমার মনে হয় এটা প্রথম প্রেজেক্ট। এর মাধ্যমে মধ্যপ্রাচ্যে নতুন এক যুগের শুরু হল। এটার ফিউচার কোন দিকে যাবে তা সময়ই বলে দিবে।

সবমিলে আরও অনেক দিকের পর্যালোচনার সুযোগ আছে। তবে তিউনেশিয়ায় এই ক্যু নিঃসন্দেহে ঘানুসী কিংবা আন-নাহদার রাজনীতির জন্য বড় ধরনের ধাক্কা হলেও আমার মনে হয় মূল পতনটা তিউনেশিয়ার মানুষের, তিউনেশিয়ার গণতন্ত্রের এবং রাজনীতির।

(চলবে..........)
~ Hafijur Rahman

পঠিত : ২৮৪ বার

মন্তব্য: ০