Alapon

হাররার ঘটনা: মুসলিম ইতিহাসের অন্যতম ট্র্যাজেডি



মুসলিম ইতিহাসে সর্বপ্রথম যে ক্ষমতালোভী শাসক আমরা দেখতে পাই, সেটা ছিলো ইয়াযিদ ইবনে মুআবিয়া। ক্ষমতা ঠিকিয়ে রাখার জন্য, ক্ষমতার মসনদ পাকাপোক্ত করার জন্য যা যা করা দরকার ছিলো, তার সবকিছু করতে সে প্রস্তুত ছিলো।
হুসাইন ইবনে আলীর (রাদিয়াল্লাহু আনহু) সাথে ইয়াযিদের সংঘাত দেখানো হয় কারবালার ঘটনায়। অথচ কারবালার ঘটনা ছিলো ইয়াযিদ-হুসাইন (রাsmile –এর সংঘাতের ‘পরিণতি’। ৬০ হিজরীতে ইয়াযিদ ‘খলিফা’র আসনে বসার পর দেখলো মদীনার বিখ্যাত সাহাবীরা তার নিকট বাইয়াত গ্রহণ করছেন না। তখন সে মদীনার তৎকালীন গভর্নর ওয়ালিদ বিন উতবাকে চিঠি লিখলো:
“বাইয়াতের ব্যাপারে হুসাইন ইবনে আলী, আব্দুল্লাহ ইবনে উমর ও আব্দুল্লাহ ইবনে যুবাইরকে (রাদিয়াল্লাহু আনহুম) কঠোর চাপ প্রয়োগ করো। বাইয়াত না করা পর্যন্ত তাদেরকে কোনো অবকাশ দিও না।” [১]

যালিমকে টিকিয়ে রাখার জন্য অসংখ্য যালিমের প্রয়োজন হয়। মদীনার গভর্নর পরামর্শ করার জন্য ডাকলেন আরেক যালিমকে। সে ছিলো মারওয়ান ইবনুল হাকাম। সে সরাসরি বললো, তাঁদেরকে বাইয়াতের জন্য আহ্বান করো, যদি তারা প্রত্যাখ্যান করে, তাহলে তাঁদেরকে হত্যা করো। তাঁদের গর্দান উড়িয়ে দাও। [২]
রাসূলুল্লাহ (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) তাঁর যে নাতিকে বলেছেন ‘জান্নাতের যুবকদের সর্দার’, যে নাতিকে তিনি খুতবা থামিয়ে কোলে নিয়েছেন, যে আব্দুল্লাহ ইবনে যুবাইরের (রাsmile জন্মের পর মদীনাবাসী ‘আল্লাহু আকবার’ বলেছিলো, নবিজীর (সাsmile মুখের থুথু যার মুখে গিয়েছিলো, যে আব্দুল্লাহ ইবনে উমরকে (রাsmile নবিজী (সাsmile ‘পুণ্যবান’ বলেছেন; তাঁদেরকে মারওয়ান হত্যা করতে চাচ্ছে শুধুমাত্র শাসকের বাইয়াত না করার কারণে!
আল-হুসাইনকে (রাsmile গভর্নর ডেকে পাঠালে তিনি বাইয়াত দিতে অস্বীকার করেন। এটা শুনে এবার সামনাসামনি মারওয়ান গভর্নরকে বললো- “তাঁর গর্দান উড়িয়ে দাও”। হুসাইন (রাsmile দাঁড়িয়ে গেলেন। দৃঢ় প্রত্যয়ে জিজ্ঞেস করলেন- “হে নীলনয়নার ছেলে! তুমি কি আমাকে হত্যা করবে?”
মদীনার গভর্নরও হুসাইনকে (রাsmile হত্যা প্রস্তাবে একমত ছিলেন না। তিনি বললেন,
“হে মারওয়ান! সমগ্র দুনিয়া ও তার সবকিছু পেলেও আমি হুসাইনকে (রাsmile হত্যা করতে চাইবো না। সুবহানাল্লাহ! ‘আমি বাইয়াত করবো না’ একথা বলার কারণেই কি আমি হুসাইনকে (রাsmile হত্যা করতে চাইবো?” [৩]

ইয়াযিদী শাসনের জন্য হুসাইন (রাsmile ছিলেন গলার কাঁটা। বিষয়টি ইয়াযিদ শুরু থেকেই টের পেয়েছিলো। এজন্য সে যেকোনো মূল্যে হুসাইনের (রাsmile বাইয়াত চাচ্ছিলো। অথচ ওয়ালিদ বিন উতবার আহ্বানে হুসাইন (রাsmile সাড়া দেননি, মারওয়ান হুসাইনকে (রাsmile হত্যা করতে চাইলেও সে সমর্থন করেনি। ইয়াযিদ বুঝলো যে, সোজা আঙ্গুলে ঘি উঠে না।
কারবালা পূর্ববর্তী ও কারবালা পরবর্তী ইয়াযিদের প্রতিক্রিয়া দেখলে এটা স্পষ্ট যে, সে যেকোনো মূল্যে আল-হুসাইনের (রাsmile বাইয়াত আদায় করতে চাচ্ছিলো। তার এই চাওয়া পূরণ ব্যর্থ হলে কী করতে হবে সেটা সে বলে দিক বা না দিক, সে যাদের নিয়োগ দিয়েছিলো, তারা তাদের ‘বিচার-বিশ্লেষণের’ অনুযায়ী তা করবে। মদীনায় একটু সফট-মানসিকতার ওয়ালিদ বিন উতবা হুসাইনকে (রাsmile হত্যা করতে না চাইলেও মারওয়ান তাঁকে হত্যা করতে চায়। মারওয়ান যদি তখন মদীনার গভর্নর হতো, তাহলে হয়তো কারবালার আগেই মদীনায় ‘কারবালা’ হতো।

দুই বিপরীত মানসিকতার দুজন ইয়াযিদী মদীনায় যে কাজটি করতে পারেননি, সেই কাজটি ঐবছর কারবালায় করে আরেক ইয়াযিদী সেনাপতি উবাইদুল্লাহ ইবনে যিয়াদ। মদীনায় থাকাবস্থায় যেসব সাহাবীদেরকে বাইয়াত নেবার জন্য ইয়াযিদ ‘কঠোর চাপ’ শব্দের ব্যবহার করেছিলো, তারা মদীনার বাইরে বের হলে তাদের বাইয়াত নেবার জন্য ইয়াযিদ তার সেনাপতিকে কেমন নির্দেশ দিতে পারে?
কারবালার ঘটনার প্রায় দুই বছর পরের ঘটনা। তখন ৬৩ হিজরী। মদীনাবাসী ইয়াযিদের যুলুমের কারণে ছিলো অতিষ্ঠ। তারা যালিম শাসক ইয়াযিদের বাইয়াত প্রত্যাহার করলো। মদীনার লোকেরা নবিজীর (সাsmile সাহাবী আব্দুল্লাহ ইবনে হানজালাকে (রাদিয়াল্লাহু আনহু) তাঁদের নেতা হিশেবে মেনে নিলো।

একজন লোক তার পাগড়ি খুলে ছুঁড়ে ফেললো। সে বললো, “আমি যেমন এই পাগড়ি কেটে ফেললাম, তেমনি ইয়াযিদের আনুগত্যও কেটে ফেললাম।” আরেকজন লোক তার জুতো ছুঁড়ে মারলো। সে বললো, “আমি যেমন আমার জুতো ছুঁড়ে মারলাম, তেমনি ইয়াযিদের বাইয়াত প্রত্যাহার করলাম।” এভাবে দেখা গেলো মদীনায় জুতো আর পাগড়ির স্তুপ জমা হলো। মদীনাবাসী ইয়াযিদের বিরুদ্ধে বিক্ষোভ ঘোষণা করলো। তারা সিদ্ধান্ত নিলো, মদীনায় থাকা ইয়াযিদের গভর্নরকে মদীনা থেকে বহিষ্কার করবে; আধুনিককালে যেমন রাষ্ট্রদূতের অফিস ঘেরাও করা হয়। [৪]

উমাইয়্যা বংশের লোকেরা মারওয়ান ইবনে হাকামের ঘরে একত্রিত হলো। মদীনাবাসী চারিদিক থেকে তাদেরকে ঘিরে রাখলো। বিক্ষুব্ধ জনতার মুখে যালিমের সহচররা। তারা তখন ডাকযোগে ইয়াযিদের কাছে বার্তা প্রেরণ করা হলো, যাতে ইয়াযিদ তাদেরকে উদ্ধার করার জন্য বাহিনী প্রেরণ করে।

ইয়াযিদ যখন শুনলো তার দলের লোকদেরকে মদীনাবাসী আটক করেছে, তখন সে ক্ষুব্ধ হলো। সে জিজ্ঞেস করলো, “তাদের মধ্যে কি ১০০০ লোক নাই, যারা মদীনাবাসীর বিরুদ্ধে লড়াই করবে?”

ইয়াযিদ তার বাহিনী প্রস্তুত করলো। দামেস্ক, হিমস, জর্ডান, ফিলিস্তিনের প্রায় ১২,০০০ অশ্বারোহী সৈন্য ও ১৫,০০০ পদাতিক সৈন্যের এক বিশাল বাহিনী প্রস্তুত করলো মদীনা আক্রমণে [৫]। নবিজীর (সাsmile জীবদ্দশায় কাফিররা যখন মদীনা আক্রমণ করে, তখনো কিন্তু ২৭,০০০ সৈন্য একত্রিত হয়নি!

ইয়াযিদ তার বাহিনীর সেনাপতি নিযুক্ত করলো এমন একজনকে, যে ছিলো ইতিহাসের অন্যতম নৃশংস সেনাপতি। যে সেনাপতি যুদ্ধে গেলে কারো বাছ-বিছার করতো না, এরকম একজনকে ইয়াযিদ সেনাপতি বানালো, যাতে মদীনায় আক্রমণ করতে গিয়ে তার মন গলে না যায়। তার নাম ছিলো মুসলিম ইবনে উকবা।

আন-নুমান ইবনে বশীর ইয়াযিদকে বললেন তাকে সেনাপতি বানাতে। কিন্তু, ইয়াযিদ দেখলো এমন সফট-হার্টেড মানুষ দিয়ে মদীনা আক্রমণ করা যাবে না। ইয়াযিদ বললো, “না, তাদেরকে (মদীনাবাসী) শায়েস্তা করার জন্য ঐ যালিমের (মুসলিম ইবনে উকবা) প্রয়োজন। আল্লাহর কসম! তাদের প্রতি ইহসান প্রদর্শন করার পর ও বারবার তাদেরকে ক্ষমা করার পর এবার অবাধ্যদের অবশ্যই হত্যা করবো।” [৬]

আব্দুল্লাহ ইবনে জাফর (রাদিয়াল্লাহু আনহু) ইয়াযিদকে সতর্ক করে দেন। তিনি জিজ্ঞেস করেন, “তুমি কি নিজেকে ‘হালাল’ বানাতে চাও? তুমি কিভাবে মদীনা (হারাম) আক্রমণ করবে?” ইয়াযিদ সেই সাহাবীর কথায় কর্ণপাত করলো না। সে জানালো যে, বাইয়াত আদায় করার জন্য সে যেকোনো কিছু করতে প্রস্তুত। [৭]

ইয়াযিদ তার সেনাপতিকে নির্দেশ দিলো:
“মদীনার লোকদেরকে তুমি তিনবার আহ্বান জানাবে। তারা যদি বাইয়াত প্রদান করে, তাহলে তাদের বাইয়াত গ্রহণ করবে। নতুবা তুমি আল্লাহর সাহায্য প্রার্থনা করবে এবং তাদের সাথে যুদ্ধ করবে। যদি তুমি তাদের উপর বিজয়ী হও, তাহলে মদীনা তিনদিন ‘হালাল’ ঘোষণা করবে।” [৮]

বিজয়ী হলে ৩ দিনের জন্য মদীনা হালাল ঘোষণার মানে হলো ঐ ৩ দিন যা ইচ্ছে করতে পারবে। ইয়াযিদের এই নির্দেশের ফলে কী হয়েছে আমরা সেটা একটু পর দেখতে পাবো। উল্লেখ্য, সেই সময় মদীনায় হাজারের উপর সাহাবী বসবাস করতেন, সাহাবীদের সন্তানরা বসবাস করতেন। তখন যদি হুসাইন (রাsmile মদীনায় থাকতেন, তাহলে ইয়াযিদের নির্দেশানুযায়ী তাঁকেও হত্যা করা হতো?

মজার ব্যাপার হলো, মদীনায় আক্রমণের পাশাপাশি ইয়াযিদ একইসময় মক্কায়ও আক্রমণ করতে চেয়েছিলো। মক্কায় আক্রমণ করার জন্য সেনাপতি বানাতে চেয়েছিলো কারবালার ভিলেন, সেনাপতি উবাইদুল্লাহ ইবনে যিয়াদ। হুসাইন (রাsmile হত্যার সেনাপতি, ইয়াযিদের নিজস্ব ‘ম্যান’ উবাইদুল্লাহ জবাব দিলো, “আল্লাহর কসম! আমি ইয়াযিদের মতো ফাসিকের জন্য দুটো মারাত্মক কাজ একসাথে করতে পারি না। একটি হলো রাসূলের (সাsmile নাতিকে হত্যা, আরেকটি হলো বাইতুল্লায় আক্রমণ।” [৯]

কারবালার ঘটনায় যে ছিলো খলনায়ক, সেই ইয়াযিদের ডান-হাত উবাইদুল্লাহ এবার ইয়াযিদের এমন সাম্রাজ্যবাদী আগ্রাসনের বিরুদ্ধে! কারবালায় ইয়াযিদের জন্য যে এতো কিছু করলো, সে পর্যন্ত এবার আর ইয়াযিদের আর কোনো দুষ্কর্মে অংশীদার হতে চাচ্ছে না।
ইয়াযিদের বাহিনী মদীনা আক্রমণ করতে এলো। আব্দুল মালিক ইবনে মারওয়ান, যিনি পরবর্তী উমাইয়া খলিফা (পঞ্চম উমাইয়া খলিফা) হয়েছিলেন, তিনি মুসলিম ইবনে উকবাকে পরামর্শ দিলেন মদীনার পূর্বদিকে হাররায় সেনাবাহিনী নিয়ে যেতে। মদীনার লোকেরা যখন তাদেরকে আক্রমণ করতে যাবে, তখন তাঁদের চোখে-মুখে সূর্যের আলো পড়বে। আব্দুল মালিক ইবনে মারওয়ান জানান, যদি মদীনাবাসী বাইয়াত প্রদান করে, তাহলে তো ভালো। আর যদি বাইয়াত প্রদান না করে, তাদেরকে হত্যা করবেন; কেননা তারা শাসকের আনুগত্য অস্বীকার করেছে। [১০]

আজকের যুগেও যালিমের সহচররা যালিমের আনুগত্য করার জন্য আব্দুল মালিক ইবনে মারওয়ানের মতো যালিমকে পরামর্শ দেয়। হাররায় ইয়াযিদের বাহিনী সমবেত হলো। তারা মদীনাবাসীকে ইয়াযিদের হাতে বাইয়াত নিতে বললো। যে মদীনাবাসী কয়েক যুগ আগে নিজেদের বিপদের কথা ভেবেও রাসূলকে (সাsmile আশ্রয় দিয়েছিলো, যে মদীনার বুকে শতো শতো শহীদ ঘুমিয়ে আছেন, সে মদীনাবাসী কিভাবে একজন যালিমের আনুগত্য মেনে নেবে? তারা দেখেছে ইয়াযিদের বাহিনী কিভাবে হুসাইনকে (রাsmile নির্মমভাবে হত্যা করেছে, তারা ইয়াযিদের অত্যাচার দেখা সত্ত্বেও কি এমন যালিমকে বাইয়াত প্রদান করতে পারে?
মুসলিম ইবনে উকবার আহ্বান, চোখের সামনে ২৭,০০০ সৈন্যের বাহিনী দেখা সত্ত্বেও মদীনাবাসী আনুগত্য করলো না। তিনদিন তাঁদেরকে আনুগত্যের আহ্বান জানানো হয়েছিলো। প্রতিদিন তারা একই উত্তর দিলো। তারা যালিমের আনুগত্য করবে না।
আব্দুল্লাহ ইবনে হানযালা, ফদল ইবনে আব্বাস, মাকিল ইবনে সিনানা (রাদিয়াল্লাহু আনহুম) –এর মতো মহান সাহাবীরা একমত যে, তারা জীবন বাজি রেখে লড়াই করবেন, তবুও যালিম শাসকের আনুগত্য করবেন না।

৬৩ হিজরীর ২৮ যুলহিজ্জা, ৬৮৩ সালের ২৭ শে আগস্ট রোজ বুধবার। ইয়াযিদের বাহিনী মদীনাবাসীর উপর আক্রমণ করে। ২৭,০০০ সৈন্যের আক্রমণের বিপরীতে দাঁড়িয়ে ছিলেন মাত্র ২,০০০ সাহাবী-তাবে’ঈ।

মদীনাবাসী সাহসিকতার সাথে লড়াই করে। নবিজীর (সাsmile চাচাতো ভাই ফদল ইবনে আব্বাস (রাsmile ইয়াযিদের বাহিনীর একজনকে হত্যা করেন। তিনি চিৎকার দিয়ে বলেন, “আমি আব্দুল মুত্তালিবের পুত্র (নাতি), আমি যালিমকে হত্যা করেছি।” তিনি ভেবেছিলেন যে, তিনি সেনাপতি মুসলিম ইবনে উকবাকে হত্যা করেছেন। কিন্তু, পাশ থেকে মুসলিম ইবনে উকবা বলে সে জীবিত আছে। [১১]

মদীনাবাসীর প্রতিরোধ একপর্যায়ে ভেঙ্গে পড়লো। ২৭,০০০ সৈন্যের বিরুদ্ধে কতোক্ষণই বা থাকা যায়? আর তারা এমনসব সৈন্য যারা কাফিরদের অপেক্ষা নির্দয়। মুজাদ্দিদে আলফে সানী (রাহিমাহুল্লাহ) বলেন, হাররার যুদ্ধে ইয়াযিদের বাহিনী যা করেছে, কোনো ফিরিঙ্গী বাহিনীও মুসলিমদের সাথে এমনটা করতো না।
বিজয়ী হবার পর তারা মদীনায় কী করবে? ইয়াযিদের সেই নির্দেশের কথা মনে আছে? ইয়াযিদ তার বাহিনীকে ঘোষণা দিয়েছিলো ৩ দিনের জন্য মদীনা তাদের জন্য হালাল। তারা যা ইচ্ছা তাই করতে পারে।

শুরু হলো ইয়াযিদ বাহিনীর লুটপাত। তারা সাহাবীদের ঘরে গিয়ে লুটপাত চালালো, নবিজীর (সাsmile পরিত্যাক্ত জিনিস সাহাবীদের কাছ থেকে কেড়ে নিলো, সাহাবীদের সন্তানদের ঘরে আক্রমণ চালালো। যেখানে যাকে পাচ্ছিলো, যে তাদের সাথে বিরোধিতা করছিলো, তাকেই হত্যা করতে থাকে।

রাসূলের (সাsmile প্রখ্যাত সাহাবী ছিলেন আবু সাঈদ খুদরী (রাsmile। ইয়াযিদের বাহিনী তাঁর বাড়িতে হামলা করলো। তাঁর পানির পাত্র কেড়ে নিলো, তাঁর একজোড়া পোষা কবুতর ছিলো, সেগুলোও কেড়ে নিলো। যারা সাহাবীদের সাথে এমন আচরণ করে, তাদের প্রতি, তাদেরকে এমন কাজ করার নির্দেশদাতার প্রতি আমাদের এতো সহমর্মিতা!?
আবু সাঈদ খুদরী (রাsmile বয়স্ক ছিলেন। তবুও তিনি তলোয়ার নিয়ে দাঁড়িয়ে যান। লুটপাতকারীকে অভিশাপ দিলেন, “আমি চাই তুমি আমার ও তোমার পাপের বোঝা বহন করে জাহান্নামবাসী হও।” সে তাঁর নাম জিজ্ঞেস করলো- “তুমি কে?”
তিনি বললেন, “আমি আবু সাঈদ খুদরী।”
“রাসূলের (সাsmile সাহাবী?”
“হ্যাঁ।”

কী মনে করে লোকটি তাঁকে ছেড়ে দিলো। তাঁকে হত্যা করার হয়তো সাহস পায়নি। [১২]
মদীনার সাত ফুকাহার একজন ছিলেন সাঈদ ইবনুল মুসায়্যাব (রাহিমাহুল্লাহ)। মুসলিম ইবনে উকবা তাঁকে ইয়াযিদের প্রতি বাইয়াতের আহ্বান জানালে তিনি বললেন, “আমি আবু বকর, উমরের (রাদিয়াল্লাহু আনহুমা) ন্যায় চরিত্রে বাইয়াত করবো (ইয়াযিদের মতো চরিত্রহীনের হাতে নয়)।” তখন তাঁকে হত্যার নির্দেশ দেয়া হলো। তাঁকে বাঁচানোর জন্য পাশ থেকে একজন বললো, “ও একটা পাগল, তাঁকে হত্যা করো না।” এটা শুনে মুসলিম ইবনে উকবা তাঁকে ছেড়ে দিলো। [১৩]

মদীনার গ্র্যান্ড মুফতি ‘পাগল’ অজুহাতে ইয়াযিদের বাহিনীর হাত থেকে রক্ষা পেয়েছিলেন। তারা কতোটা নৃশংস, নির্মম ছিলো!
ইয়াযিদ বিজয়ের পর তার বাহিনীকে ৩ দিনের জন্য মদীনাকে ‘হালাল’ ঘোষণা করেছিলো। প্রখ্যাত তাবে’ঈ ইবনে শিহাব আয-যুহরীকে জিজ্ঞেস করা হয়েছিলো, হাররার ঘটনায় ইয়াযিদের বাহিনী মদীনার কতোজন সাহাবী-তাবে’ঈকে হত্যা করেছিলো? তিনি বলেন, “মদীনার সম্ভ্রান্ত মুহাজির ও আনসারদের মধ্যে ৭০০ জনকে হত্যা করা হয়, তাদের দাস-দাসী ও অন্যান্য সাধারণ মানুষ মিলিয়ে মোট ১০,০০০ মানুষ হত্যা করা হয়।” [১৪]
কাফিরদের যুদ্ধে লুটতারাজের পাশাপাশি ধর্ষণ দেখা যায়। অথচ ইসলামে ধর্ষণ দূরে থাক, যুদ্ধে নারীদেরকে হত্যা করতে নিষেধ করা হয়েছে। একবার নবিজী (সাsmile যুদ্ধে শত্রুপক্ষের একজন নারীর মৃতদেহ দেখে রাগ করেন।

অথচ ইয়াযিদের বাহিনী মদীনায় ঢুকে শুধু হত্যাযজ্ঞ চালায়নি। ইয়াযিদ তার সৈন্যদের জন্য সবকিছু ‘হালাল’ করেছিলো। ফলে ঐ তিনদিন ইয়াযিদের সৈন্যরা মদীনায়, যে শহরে ৬০ বছর আগে নবিজী (সাsmile বসবাস করেন, সেই শহরের মেয়েদেরকে ধর্ষণ করে।
প্রখ্যাত ইতিহাসবিদ, মুহাদ্দিস আল্লামা ইবনুল জাওযী (রাহিsmile, আল্লামা জালালুদ্দীন সুয়ূতী (রাহিsmile ও আল্লামা ইবনে কাসির (রাহিsmile উল্লেখ করেন, হাররার ঘটনায় ইয়াযিদের বাহিনী মদীনার ১০০০ মেয়েকে ধর্ষণ করে; এক বছর পর মদীনায় পিতৃপরিয়হীন ১০০০ সন্তান জন্মগ্রহণ করে! [১৫]

ইয়াযিদের বাহিনী যাদেরকে ধর্ষণ করে, তারা কারা ছিলেন? বেশিরভাগই ছিলেন সাহাবীদের কন্যা, আত্মীয়, স্ত্রী। মদীনাকে ৩ দিনের জন্য ইয়াযিদ ‘হালাল’ ঘোষণা করেছিলো, মদীনায় তার সৈন্যরা হত্যা, লুটপাত, ধর্ষণ করে। এগুলো ছিলো সরাসরি তার নির্দেশে। এমনকি মদীনার এই করুণ অবস্থার কথা যখন সে জানতে পারে, সে খুশিতে উল্লাস করে, আনন্দে আত্মহারা হয়। কারণ, সে এটাকে ধরে নেয়- শাসকের আনুগত্য না করলে এমনই হবে! [১৬] এমন যালিমের ব্যাপারে যারা ‘নিরব থাকা, চুপ থাকা’র নসীহত করেন, তারাও কি যালিমের সহযোগী না; যেমনটা ইমাম আহমদ ইবনে হাম্বল (রাহিsmile কারারক্ষীকে বলেছিলেন?


ইয়াযিদের নাজাতের জন্য অনেকেই কন্সটান্টিনোপলের একটি হাদীস দেখান, যা বেশিরভাগ মুহাদ্দিস ইয়াযিদের পক্ষের হাদীস নয় বলে উল্লেখ করেছেন (কমেন্টে উল্লেখ করছি)। এবার আসুন, আরো কয়েকটি হাদীস দিয়ে লেখাটি শেষ করি। বুখারী-মুসলিমের হাদীসগুলো ‘সহীহ’ কিনা সেটা একটু সহীয়তের লেন্স দিয়ে যাচাই করে নিবেন।

রাসূলুল্লাহ (সাsmile বলেন:
“মদীনা এখান হতে ওখান পর্যন্ত হারাম রূপে গণ্য। সুতরাং, তার গাছ কাটা যাবে না এবং এখানে কোনো ধরণের অঘটন ঘটানো যাবে না। যে ব্যক্তি মদীনাবাসীকে ভীত-সন্ত্রস্ত করবে, তাহলে তার প্রতি আল্লাহ, ফেরেশতা ও সকল মানুষের লানত বর্ষিত হবে। কিয়ামতের দিন আল্লাহ তার ফরয বা নফল কোনো আমল কবুল করবেন না।” [সহীহ বুখারী: ১৮৬৭, ১৮৭০, সহীহ মুসলিম: ৩২১৪, মুসনাদে আহমাদ: ৬৪৫৮]
তথ্যসূত্র:
১। আল্লামা ইবনে কাসির, আল-বিদায়া ওয়ান নিহায়া: ৮/২৭৮।
২। আল্লামা ইবনে কাসির, আল-বিদায়া ওয়ান নিহায়া: ৮/২৭৮।
৩। আল্লামা ইবনে কাসির, আল-বিদায়া ওয়ান নিহায়া: ৮/২৭৯।
৪। আল্লামা ইবনে কাসির, আল-বিদায়া ওয়ান নিহায়া: ৮/ ৪০২।
৫। আল্লামা ইবনে কাসির, আল-বিদায়া ওয়ান নিহায়া: ৮/ ৪০৩।
৬। আল্লামা ইবনে কাসির, আল-বিদায়া ওয়ান নিহায়া: ৮/ ৪০৩।
৭। ইমাম আয-যাহাবী, তারীখুল ইসলাম: ৫/২২৪।
৮। তারীখ আত-তাবারী: ১৯/২০৮, আল্লামা ইবনে কাসির, আল-বিদায়া ওয়ান নিহায়া: ৮/ ৪০৪।
৯। তারীখ আত-তাবারী: ১৯/২০৪।
১০। আল্লামা ইবনে কাসির, আল-বিদায়া ওয়ান নিহায়া: ৮/ ৪০৫।
১১। তারীখ আত-তাবারী: ১৯/২১০।
১২। তারীখ আত-তাবারী: ১৯/২১৪।
১৩। আল্লামা ইবনে কাসির, আল-বিদায়া ওয়ান নিহায়া: ৮/ ৪০৭-৪০৮।
১৪। আল্লামা ইবনে কাসির, আল-বিদায়া ওয়ান নিহায়া: ৮/ ৪০৮।
১৫। আল্লামা ইবনে কাসির, আল-বিদায়া ওয়ান নিহায়া: ৮/ ৪০৭, আল্লামা ইবনুল জাওযী, আর রাদ্দু আলাল মুতাআসসিবিল আনিদ আল মানি মিন যাম্মি ইয়াযিদ: ৭৫, আল্লামা জালালুদ্দীন আস-সুয়ীতী, তারীখুল খুলাফা: ২০৭।
১৬। আল্লামা ইবনে কাসির, আল-বিদায়া ওয়ান নিহায়া: ৮/ ৪১১।

হাররার ঘটনা: মুসলিম ইতিহাসের অন্যতম ট্র্যাজেডি
- আরিফুল ইসলাম
২২ আগস্ট ২০২১

পঠিত : ৬৪২ বার

মন্তব্য: ০